Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

শ্রীশ্রীচণ্ডী বৈদিক ও তান্ত্রিক অনুধ্যানে
কলমে #পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়@কপিরাইট সংরক্ষিততারিখ 21/10/20
"প্রভাতে য স্মরণীততং দূর্গা দূর্গেক্ষর দ্বয়ম,আপদ শান্তি নাশ্যন্তি তমো সূর্যোদয়ে যথা"।
প্রভাতে উঠে যে দুই অক্ষর বিশিষ্ট দূ…

 


 শ্রীশ্রীচণ্ডী বৈদিক ও তান্ত্রিক অনুধ্যানে


কলমে #পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়

@কপিরাইট সংরক্ষিত

তারিখ 21/10/20


"প্রভাতে য স্মরণীততং দূর্গা দূর্গেক্ষর দ্বয়ম,

আপদ শান্তি নাশ্যন্তি তমো সূর্যোদয়ে যথা"।


প্রভাতে উঠে যে দুই অক্ষর বিশিষ্ট দূর্গানাম স্মরণ করে, সূর্যোদয়ে যেমন অন্ধকার নাশ হয় সেইরকম তার সমস্ত আপদ কেটে যায়।


দুর্গম পরিস্থিতি থেকে যিনি ত্রাণ করেন তিনিই দূর্গা, জীবের দুর্গতি যিনি নাশ করেন তিনিই দূর্গা, দুর্গতকে যিনি আশ্রয় প্রদান করেন তিনিই দূর্গা। তাই শ্রীরামচন্দ্র জানকীকে উদ্ধারকল্পে যখন রাক্ষসরাজ রাবণের সঙ্গে যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন, তখন তিনি অকালবোধন করে দেবীকে আবাহন করেন এবং দেবীর আশীর্বাণীতে আশ্বস্ত হয়ে যুদ্ধে জয়লাভ করেন। আবার কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে একই কর্মে অর্জুন প্রবৃত্ত হন, অর্জুনকে দূর্গার স্তব করার উপদেশ দেন বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ, তাই শ্রীমদ্ভগবদগীতাতে অর্জুনের সেই স্তব আছে, যে স্তবে দেবীকে তুষ্ট করে অর্জুন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন এবং জয়যুক্ত হন। আদ্যাস্তবে বলে আদি শক্তি আদ্যা মাতা নিয়মিত তাঁর স্তব পাঠ করলে বিষ্ণুভক্তি প্রদান করেন, আর শ্রীশ্রীচণ্ডী বলে, "যা দেবী সর্বভূতেষু বিষ্ণুমায়েতি শব্দিতা" অর্থাৎ আদি পুরুষ বিষ্ণু আর আদিশক্তি আদিত্যবরণী দূর্গা একে ওপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ও ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আসলে স্মরণাতীত কাল থেকে মানুষ যখনই বিপদে পড়ে, তখনি দৈবের সহায়তা কল্পে হয় শক্তির বা সেই সবিতৃমণ্ডল মধ্যবর্তী হিরণ্যবর্ণ পুরুষ বিষ্ণুর দুয়ারে হাত পাতে তাঁদের কৃপায় সেই বিপদ থেকে তারণ পেতে।


শ্রীশ্রীচণ্ডী বলে দেবী দূর্গা ত্রিগুণাত্মিকা, সেই ত্রিগুণ সত্ত্ব, রজঃ আর তমোর আশ্চর্য সমন্বয় দেখা যায় দূর্গা মূর্তিতে, যেখানে অসুর হল তমোগুণের প্রতীক, সিংহ হল রজঃ গুণের প্রতীক আর দেবী দূর্গা হলেন সত্ত্ব গুণের প্রতীক। রজোগুণকে সঙ্গে নিয়ে সত্ত্বগুণা দেবী তমোগুণকে নাশ করছেন। অর্গলা মানে আগল, কীলক মানে খিল বা গজাল যা দিয়ে অর্গলটি আটকানো আছে। চণ্ডী রহস্য অতি দুরূহ, দুর্জ্ঞেয়, সেই রহস্য জানতে হলে আগে অর্গলাস্তোত্র আর কীলক স্তব পড়তে হবে সেই রহস্যের অর্গল ও সেই অর্গলের গজালটি সরিয়ে অর্গল মুক্ত করতে হবে সেই রহস্য।


"দুর্গতি নাশিনী দূর্গা বিশ্বমাতা মহেশ্বরী

সংনম্যতে সদা দেবী প্রসীদ জগদম্বিকে"।


দুর্গতিনাশিনী দূর্গা বিশ্বমাতা এবং মহা ঈশ্বরী মহেশানী, তাঁকে সর্বদা প্রণাম করে প্রসন্নতার প্রার্থনা জানাই।


শ্রীশ্রীচন্ডীতে শ্রোতৃগণ যে সমস্যার সম্মুখীন হয়ে জিজ্ঞাসু হয়েছেন- তা কোন আধ্যাত্মিক বা পারমার্থিক সমস্যা নয়, পারিবারিক ও ব্যবহারিক জীবনের সমস্যায় তাঁরা বিচলিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কিন্তু এর সমাধান কল্পে আচার্য যে উপদেশ দিয়েছেন তা সর্বতোভাবেই পারমার্থিক। সমস্যা সমাধানে এই দেবাসুরের তাত্ত্বিকরূপ  আচার্য, দেবী মহামায়ার তত্ত্ব উদ্ঘাটন করেছেন।চণ্ডীর মূখ্য বর্ণনীয় বিষয় হচ্ছে যুদ্ধ। চণ্ডীর যুদ্ধ মূলত: সাধকের অন্তরের। চণ্ডীর যুদ্ধ সূক্ষ্মস্তরের- দেবতায় ও অসুরে।  সকলের অন্তরে অজ্ঞান-তমঃ আছে – সেটাই অসুর। জীবনের স্বচ্ছন্দ বিকাশের পক্ষে সেটাই ছন্দোহীনতা বা সুরবিরোধী অসুরভাব, আর উজ্জ্বল জ্ঞানদীপই মহাবিদ্যারূপিণী মহাদেবী। সকল আসুরিক শক্তির ইনি বিনাশকারী। অজ্ঞানতমোরূপ আসুরিকতা বিধ্বংস করতে মহাশক্তি দুর্গা প্রকটিতা। চণ্ডীর মহাদেবী নিখিল ভাস্বর জ্ঞানদীপের সমষ্টিভূতা মূর্তি। সুতরাং গীতার “নাশয়াম্যাত্মভাবস্থো জ্ঞানদীপেন ভাস্বতা” মন্ত্রের মধ্যে চণ্ডীর অসুরধ্বংসকারী মহাযুদ্ধের রহস্যটি সূত্রাকারে বিরাজিত।


চণ্ডীর যুদ্ধ মনোময় ও বিজ্ঞানভূমিতে স্থিত। অসুরগুলো মনোময় ভূমির বস্তু, মহাদেবী বিজ্ঞানময় ভূমির প্রজ্ঞাঘন শক্তি। এই দু’য়ে যুদ্ধ। চণ্ডীর যুদ্ধ সাধন-সমর।  চণ্ডীর কথা যুদ্ধের মধ্যে। চণ্ডীর প্রথম চরিতের প্রথমাংশ ভূমিকা বা ঘটনার ক্ষেত্র প্রস্তুতি। চণ্ডীতে সুরথ রাজা হলেও এখন রাজ্যভ্রষ্ট। রাজ্যচ্যুত রাজা বনে এসেছেন কিন্তু বাণপ্রস্থী হন নি। বনে আশ্রয় নিয়েও বিষন্নচিত্ত। আত্মীয়, স্বজন, রাজপ্রাসাদ, অশ্ব, গজ, পাত্র, অমাত্য সকলের অমঙ্গল আশঙ্কায় চিন্তান্বিত। আর বৈশ্য সমাধি, ধনলোভী নিজ স্ত্রী-পুত্রগণ কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে তিনিও বনে এসেছেন।  রাজা ও বৈশ্যের বনেই দেখা, তাদের একই অবস্থা। আত্মীয়-স্বজন কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েও তাদের প্রতি মমতাকৃষ্ট। তাদের প্রতি অতীব দুঃখার্ত (দ্বাবপ্যত্যন্তদুঃখিতৌ, চণ্ডী- ১/৪৩ )।


চণ্ডীতে সুরথ-সমাধির মোহগ্রস্ত ও উদ্ভ্রান্ত মনকে ঋষি প্রশান্ত করেছেন; চণ্ডীর মাহাত্ম্য কীর্তন করে এবং তাঁদের দ্বারা দেবী মহামায়ার পূজা করিয়ে।  সুরথ-সমাধির বাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে মাতৃদর্শনে, আর চণ্ডীর উপদেশের পরিবেশ ঋষির তপোবন। তপোবনের প্রাকৃতিক শোভা  ও সৌন্দর্য- প্রশান্ত শ্রীসম্পন্ন, রমণীয় শান্তরসপ্রধান। চণ্ডীর আলোচ্য বিষয় দেবাসুর-সংগ্রাম- রজোময় ও তমোময়। চণ্ডীর প্রশান্ত ভূমিতে যুদ্ধের অশান্ত বার্তা। চণ্ডীর মধ্যম চরিতে দেবী মহালক্ষ্মীর আবির্ভাব তত্ত্বতঃ একটি অনুভূতি বিজ্ঞানময় ভূমির- সামগ্রিক দৃষ্টি। বহুত্বে একত্ব, একত্বে বহুত্ব। সমগ্র সত্ত্বাকে একেবারে একত্র একত্বে দর্শন।

 “ইহৈকস্থং জগৎ কৃৎস্নম্” একস্থ সমগ্র বিশ্ব। বিশ্বচরাচরের সকলই একদেহে স্থিত, সেটাই অপরোক্ষ দর্শন, বিশ্বরূপ দর্শনের মর্মকথা।চণ্ডীতে মায়ের মহীয়সী স্ত্রীমূর্তির মধ্যে নিখিল দেবগণের শক্তিসমূহ প্রকটিত। ভিন্ন ভিন্ন দেব শক্তি একই বিশ্বজননীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। তাঁর বাহুই বিষ্ণু, চরণই ব্রহ্মা, শ্রীবদনই শিব। কেশে যম, নাসিকায় পবন, নয়নে অগ্নি। বিভিন্ন দেবতার বিভিন্ন আয়ুধগুলো মায়ের শ্রীহস্তে শোভমান। তাই মায়ের দর্শনেই নিখিল দেবতা ও দৈবশক্তির দর্শন পাওয়া যায়। এক স্বরূপে বিশ্বদেবতার দর্শন, এক নিরূপম দর্শন।

 চণ্ডীতে মাতৃরূপ দর্শনে দেবগণের প্রীতিযুক্ত বিস্ময়। দেবগণ ‘পুলকোদ্গমচারুদেহাঃ’ আনন্দে। দেবগণ জানেন, মা আমাদের সকল অমঙ্গল নাশ করবেন- তাই উল্লসিত। চণ্ডীতে দেবগণের স্তুতিতে প্রসন্না দেবীর সান্ত্বনা বাক্য-

“ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি।

তদা তদাবতীর্য্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম্”।। ( ১১/৫৫ )


-‘যখনই যখনই দানবের অভ্যূদয়ে জীবগণ এই প্রকারে উৎপীড়িত হবে তখনই তখনই আবির্ভূতা হয়ে শত্রু নাশ করে শান্তি আনয়ন করবো।’ দুর্গার দুঃখদুর্দশাগ্রস্ত উৎপীড়িত জীবের জন্য দয়া আছে। আমাদের দুঃখ তাঁদের প্রাণে লাগে। ডাকলে শোনেন। প্রয়োজন বোধ করলে মর্ত্যভূমিতে অবতরণ করেন। অনুগ্রহ করে দুঃখ দূর করেন।চণ্ডীতে মেধা ঋষি মহাদেবীর তত্ত্ব বলেছেন, “যা দেবী সর্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে” (৫/১৭)

-আত্মার স্বরূপ হলো চেতনা বা চৈতন্যস্বরূপতা। ঋষি বললেন, মহাদেবী আছেন সর্বভূতে চেতনারূপে।চণ্ডীতে দেবতাগণ মায়ের স্তবে বলেছেন, 

“সর্বাশ্রয়াখিলমিদং জগদংশভূতম্” (৪/৭)।


তুমি সকলের আশ্রয়। এই সমস্ত জগৎ তোমার অংশভূত। দেবীমাহাত্ম্যে মহাদেবী আদ্যা পরমাপ্রকৃতি  ( পরমা প্রকৃতিরাদ্যা - ৪/৭ )। কিন্তু এই পরমা প্রকৃতির মধ্যে পুরুষ এবং প্রকৃতি  উভয় সম্মিলিতা, কারণ মহাদেবী কেবল নিখিল বিকার ও গুণের মূল নন- তিনি চৈতন্যময়ী এবং মাহেশ্বরীও। মহাদেবী প্রকৃতি বলে ত্রিগুণময়ী, আবার পুরুষ বলে ত্রিগুণের দোষের দ্বারা লিপ্ত নন। এরূপ আশ্চর্যজনক তত্ত্ব বলে মহাদেবী হরিহরাদিরও অজ্ঞেয়া।


“হেতুঃ সমস্তজগতাং ত্রিগুণাপি দোষৈ-

র্ন জ্ঞায়সে হরিহরাদিভিরপ্যপারা।” ( ৪/৫ )


তুমি সমস্ত জগতের কারণ। তুমি ত্রিগুণা হয়েও দোষে লিপ্ত নও। হরিহর প্রভৃতিরও তুমি অজ্ঞেয়া।

চণ্ডীতে ভগবতী অসুরকে বললেন, “পশ্যৈতা দুষ্ট ময্যেব বিশন্ত্যো মদ্বিভূতয়ঃ”।। ( ১০/৫ ) – রে দুষ্ট! দেখ্ আমার বিভূতিসকল আমাতেই প্রবেশ করছে। এ বলে আকর্ষণ করলেন। অসুর দেখলো অগণিত মাতৃকামূর্তি দেবীর দেহে প্রবেশ করছে, আর প্রবেশ করে এক হয়ে যাচ্ছে। মা বললেন,


“অহং বিভূত্যা বহুভিরিহ রুপৈর্যদাস্থিতা।

তৎ সংহৃতং ময়ৈকৈব তিষ্ঠাম্যাজৌ স্থিরো ভব।।” (১০/৮)


-‘আমি ঐশ্বর্য দ্বারা এ যুদ্ধে বহুরূপে যে অবস্থান করছিলাম, তা উপসংহার করলাম। আমি এখন একাই আছি, একাই যুদ্ধ করবো, তুই স্থির হ।’ নিখিল বিভূতি যে এক বস্তুরই বহু প্রকাশ – গীতায় তা সুব্যক্ত, চণ্ডীতে বাস্তবায়িত।


বৈশেষিক দর্শনের ঋষি কণাদ ধর্মের লক্ষণ বলেছেন, “যতো বাহভ্যুদয় নিঃশ্রেয়সসিদ্ধিঃ স ধর্মঃ”। যা হতে অভ্যুদয় ও নিঃশ্রেয়স লাভ হয় তা-ই ধর্ম। অভ্যুদয় মানে সাংসারিক উন্নতি, যেমন- ধন, মান, যশ, প্রতিপত্তি ইত্যাদি। নিঃশ্রেয়স মানে নিশ্চিত মঙ্গল।  প্রবৃত্তি-লক্ষণ ধর্মের ফল অভ্যুদয়। নিবৃত্তি-লক্ষণ ধর্মের ফল নিঃশ্রেয়স। পূর্ণাঙ্গ বৈদিক ধর্মের চণ্ডীর লক্ষ্য নিবদ্ধ।


সুরথ ও সমাধির অর্চনায় মা পরিতুষ্টা হয়ে বললেন, বর চাও। রাজা চাইলেন অবিভ্রংশ রাজ্য। সমাধি চাইলেন তত্ত্বজ্ঞান। যে জ্ঞানের উদয় হলে, মিথ্যা আমি ও আমার নাশ প্রাপ্ত হয়, তা-ই চাইলেন সমাধি। রাজা চাইলেন অভ্যুদয়, বৈশ্য চাইলেন নিঃশ্রেয়স। শ্রীচণ্ডীতে তা প্রকট করে দেখানো  হল। সুরথ রাজা ভজনা করেছেন রাজ্যসুখের জন্য, সমাধি বৈশ্য ভজনা করেছেন মুক্তিসুখের জন্য। ভগবতী উভয়কেই বাঞ্ছানুরূপ ফলদান করেছেন।


 চণ্ডী গ্রন্থেই প্রবৃত্তি-ধর্ম বা ভোগের কথা এবং নিবৃত্তি-ধর্ম বা ত্যাগের কথা -যোগের কথা দৃষ্ট হয়। চন্ডীতে ভোগ যোগ দু’টি পৃথক বস্তু। ভোগের জন্য ভোগ, ত্যাগের জন্য যোগ। ভোগ চাও ত এক পথ, ত্যাগ চাও ত আলাদা পথ। চণ্ডী দু’ হাত বাড়িয়ে এক হাতে ভোগ আরেক হাতে যোগ দিচ্ছেন।


চণ্ডী পাঠের পূর্বে অর্গলা স্তোত্র পাঠ করা আবশ্যিক। এ স্তোত্রের “রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি” মন্ত্রের পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি  হেতু অনেকে মনে করেন- চণ্ডীতে কেবল দেহি দেহি রব, কেবল ভোগ আর ভোগের জন্যই প্রার্থনা। এ প্রার্থনায় দ্বিবিধ তাৎপর্য নিহিত আছে। যিনি ভোগাকাঙ্ক্ষী, তাঁর কাছে এক প্রকার অর্থ, যিনি মোক্ষাকাঙ্ক্ষী, তাঁর কাছে অন্য প্রকার অর্থ। যিনি ভোগী তিনি দেহের রূপ কামনা করেন, যিনি ত্যাগী তিনি আত্মার স্বরূপ জ্ঞান জাগিয়ে তুলবার প্রার্থনা করেন। ভোগী লৌকিক যুদ্ধে, মামলা মোকদ্দমায় জয় কামনা করেন, ত্যাগী সাধন-সমরে জয় আকাঙ্ক্ষা করেন। ভোগী চান লৌকিক নাম যশ খ্যাতি, তাই বলেন যশো দেহি। সাধক চান ভগবদ্ভক্ত বলে জগতে কীর্তিত হতে। ভোগার্থী বাঞ্ছা করেন লৌকিক শত্রুর ধ্বংস; তাই বলেন, “দ্বিষো জহি”। ত্যাগী – যোগী চান, সাধন-পথে যে সকল বাধক রয়েছে; সেই কামাদি শত্রুর অবলুপ্তি। ভোগী যেখানে পাঠ করেন-


“ভার্যাং মনোরমাং দেহি মনোবৃত্ত্যনুসারিণীম্”। ‘( হে দেবি, ) আমার মনোবৃত্তির অনুসারিণী ( অনুকূল আচরণকারিণী ) মনোরমা ভার্যা ( ভরণীয়া বা স্ত্রী বা ভক্তি ) দাও।’ এক্ষেত্রে ভোগী ভার্যা অর্থে ভরণীয়া বা স্ত্রী গ্রহণ করে প্রার্থনা করেন ,কিন্তু সাধকগণ চিরদিন সেখানে ভার্যা অর্থে ভক্তি ধরেই পাঠ করে থাকেন।


এ ছাড়া মায়ের কাছে কেউ অবনত হয়ে কিছু কামনা করলেই মা তা দেন না। যে বস্তু দিলে একজনের উপকার কিন্তু অন্যের ক্ষতি তা দেন না। যাতে জগতের সকলের উপকার তা-ই মা দেন। তাই তো দেবগণের স্তবে সন্তুষ্টা হয়ে জগজ্জননী বললেন-

“বরদাহং সুরগণা বরং যং মনসেচ্ছথ।

তং বৃণুধ্বং প্রযচ্ছামি জগতামুপকারকম্”।। ( ১১/৩৭ )

ঞঞ্জ

‘হে দেবগণ, আমি বরদাত্রী, তোমরা মনে মনে জগতের হিতকর যে ইচ্ছা করছো তা প্রার্থনা করো, এখনই দিচ্ছি।’ সুতরাং মা যে জগতের মঙ্গলময় বর দিবেন, তা নিষ্কাম ভক্তেরও কাম্য। দেবতাগণও বলেছেন-

“ত্রৈলোক্যবাসিনামীড্যে লোকানাং বরদা ভব। ( ১১/৩৫)

‘হে স্তবনীয়ে দেবি। ত্রিভুবনবাসী জনগণের জন্য বরদাত্রী হও।’


কেউ কেউ মনে করেন,  চণ্ডীতে ভক্তির গন্ধও নেই। এরূপ মনে করা ঠিক নয়।  চণ্ডী গ্রন্থও ভক্তিশূন্য নয়। যে অর্গলা-স্তবে “রূপং দেহি জয়ং দেহি” প্রার্থনা পুনঃ পুনঃ উচ্চারিত হয়েছে সেই স্তবেই আছে-


“দেবি ভক্তজনোদ্দাম-দত্তানন্দোদয়েহম্বিকে” (২৪)


হে দেবি অম্বিকে, তুমি ভক্তদেরকে অনর্গল আনন্দ দান করে থাকো। ভক্তদেরকে যে কত আনন্দ দান করেন তার প্রমাণ চতুর্থ অধ্যায়ে দেবগণের স্তুতিকালে দৃষ্ট হয়। স্তবপরায়ণ দেবগণের বর্ণনায় ঋষি বলেছেন- “প্রণতি-নম্রশিরোধরাংসাঃ” “প্রহর্ষপুলকোদ্গম-চারুদেহাঃ” ( ৪/২ ) তাঁরা গ্রীবা ও স্কন্ধ নত করে প্রণাম করে আনন্দে রোমাঞ্চ উদ্গত হওয়ায় সুন্দর দেহশালী হয়ে মহাদেবীকে স্তব করে ছিলেন। আনন্দ গভীর না হলে পুলক হয় না।


চণ্ডীর পঞ্চম অধ্যায়ের স্তবের শেষে বলেছেন-

“যা চ স্মৃতা তৎক্ষণমেব হন্তি নঃ

 সর্বাপদো ভক্তিবিনম্রমূর্তিভিঃ”।। ( ৫/৮২ )


‘আমরা ভক্তিনম্র হয়ে স্মরণ করলে জগন্মাতা তৎক্ষণাৎ আমাদের সকল বিপদ নষ্ট করে থাকেন।’ সবশেষে চণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ের স্তবে দেবগণ বলেছেন- হে দেবি, মা যেমন পুত্রদের রক্ষা করেন, সেরূপ আমাদেরকে পাপ থেকে রক্ষা করো।

“পাপেভ্যো নঃ সুতানিব” ( ১১/২৭ )

এ প্রার্থনার মধ্যে প্রীতিপূর্ণ আর্তি বিদ্যমান। পরেই বলেছেন, তোমার যারা আশ্রিত, তাদের আর বিপদ নেই।

“ত্বামাশ্রিতানাং ন বিপন্নাণাং” ( ১১/২৯ )

হৃদয়ে ভক্তি না থাকলে- আশ্রিত, শরণাগত, মুখের কথায় হয় না।

তারপর একটি আশ্চর্য সংবাদ বলেছেন-

“ত্বামাশ্রিতা হ্যাশ্রয়তাং প্রয়ান্তি” ( ১১/২৯ )

তোমাকে যারা আশ্রয় করে, তারা সকলের আশ্রয় হয়ে থাকে। সকলের বলতে নিখিল বিশ্বের. সকলের। আর এক মন্ত্রে তা স্পষ্টতর করেছেন-

“বিশ্বাশ্রয়া যে ত্বয়ি ভক্তিনম্রাঃ” ( ১১/৩৩)


যারা তোমার কাছে ভক্তিভরে বিনম্র, তারা বিশ্বের আশ্রয় হয়ে থাকে। কতখানি ভক্তিপূর্ণ চিত্তে মাতৃচরণ আশ্রয় করলে সে নিখিল বিশ্বের আশ্রয়স্থল হতে পারে তা বিশেষভাবে অনুধাবনীয়। চণ্ডীর পঞ্চম অধ্যায়ের স্তবটিতে পুনঃ পুনঃ “নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ”।

শত শতবার নমস্কার।


চণ্ডী গ্রন্থে মহিষাসুরের যুদ্ধের প্রসঙ্গে, স্তবে দেবগণ বলেছেন, মহিষাসুর বধকালে তোমার বাইরে নিষ্ঠুরতা থাকলেও “চিত্তে-কৃপা” ছিল। তোমার ভয়ঙ্কর শস্ত্রপ্রভাসমূহের ঝকমকানিতে অসুরদের দৃষ্টি যে নষ্ট হয় নি, তার কারণ তোমার অর্ধ-চন্দ্রযুক্ত বদনখানি তারা দেখতে পেয়েছিল

( ৪/২০ )। তোমার শস্ত্রদ্বারা পবিত্র হয়ে তারা উৎকৃষ্ট লোকে গমন করুক, এরূপ মতি নিয়েই তুমি তাদেরকে অস্ত্রাঘাত করেছো। না হলে তো শুধু দৃষ্টি দ্বারাই তাদেরকে ভষ্মীভূত করতে পারতে।


“দৃষ্ট্বৈব কিং ন ভবতী প্রকরোতি ভস্ম

সর্বাসুরানরিষু যৎ প্রহিণোষি শস্ত্রম্।


লোকান্ প্রয়ান্তু রিপবোহপি হি শস্ত্রপূতাঃ

ইত্থং মতির্ভবতি তেষ্বপি তেহতিসাধ্বী”।। ( ৪/১৯ )


করুণাময়ী মহাদেবীও যে হতারিগতিদায়িকা তা এই মন্ত্রে সুব্যক্ত হয়েছে।

দেবী মাহাত্ম্যেও  মহাদেবী বলেছেন-


“শ্রোষ্যন্তি চৈব যে ভক্ত্যা মম মাহাত্ম্যমুত্তমম্। ( ৪/১২ )

ন তেষাং দুষ্কৃতৎ কিঞ্চিদ্ দুষ্কৃতোত্থা ন চাপদঃ”। ( ৫/১২)


যে আমার উৎকৃষ্ট মাহাত্ম্য ভক্তিসহকারে পাঠ করবে, তার কোন পাপ, বা পাপজনিত বিপদ হবে না। আরও বলেছেন-


“তস্মান্মমৈতন্মাহাত্মং পঠিতব্যং সমাহিতৈঃ।

শ্রোতব্যঞ্চ সদা ভক্ত্যা পরং স্বস্ত্যয়নং হি তৎ”।। ( ১২/৭ )


সে জন্য, আমার এই মাহাত্ম্য একাগ্রচিত্ত হয়ে ভক্তিসহকারে সকলের পাঠ ও শ্রবণ করা উচিত। তা-ই উৎকৃষ্ট স্বস্ত্যয়ন। আরও অনেক ফলের কথা আছে। সবচেয়ে বড় কথা-


‘সর্বং মমৈতন্মাহাত্ম্যং মম সন্নিধিকারকম্’। ( ১২/২০ )

আমার মাহাত্ম্য আমার সন্নিধিকারক।দেবী মাহাত্ম্য চণ্ডীতে ঋষিবর চণ্ডীগ্রন্থ শুনিয়ে শ্রোতা সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্যকে দেবীর চরণে শরণাগতি গ্রহণ করতে বললেন।


“তামুপৈহি মহারাজ শরণং পরমেশ্বরীম্।

আরাধিতা সৈব নৃণাং ভোগস্বর্গাপবর্গদা” ।। ( ১৩/৫ )


‘সেই পরমেশ্বরীর শরণাগত হও। তাঁকে আরাধনা করলে তিনি মানুষকে ভোগ, স্বর্গ ও অপবর্গ ( মোক্ষ বা মুক্তি ) প্রদান করে থাকেন।’ ঋষি তাঁদেরকে আরাধনায় নিযুক্ত করেছিলেন। আরাধনার ফলে তাঁরা দেবীর সাক্ষাৎকার ও বাঞ্ছানুরূপ ফল লাভ করলেন।


এ আলোচনায় দেখা গেল মূলত: একই  মহাসত্য সর্বত্র ঘোষিত এবং এ আলোচনা থেকে বলা যায় যে, তন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে বৈদিক সত্যের দর্শনই চণ্ডী।

[10/21, 1:55 AM] শৈলেন মন্ডল ডিমারী: যোগশাস্ত্র প্রণেতা


কলমে #পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়


কথায় বলে, "গুরু ঘাঁটিয়ে বিদ্যে পায়, আর রাখাল ঘাঁটিয়ে টাকর(গালাগালি) পায়"। পরমাত্মার সঙ্গে আত্মার সংযোগ এই দেহভান্ডটির মাধ্যমে যে উপায়ে সম্ভব, তার অন্যতম পন্থা যোগশাস্ত্র।ঈশ্বরকৃপা, আত্মকৃপার পরে গুরুকৃপায় মানুষ লৌকিক জীবন থেকে মহাজীবনে উন্নীত হতে পারে সেই গুরুকৃপার সঙ্গে যৌগিক শাস্ত্র করায়ত্ত করতে পারলে।ভারতীয় যোগশাস্ত্রের ইতিহাসে অমলিন অবদান রেখে যাওয়ার জন্য আমরা ঋণী যাঁর কাছে তিনি মহর্ষি পতঞ্জলি, যাঁর সম্পর্কে আমাদের ভারতবাসী হিসেবে জানা আবশ্যক।


খৃষ্টপূর্ব ৭ম শতকে শিক্ষাক্ষেত্রে তক্ষশীলা খুব প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। খৃষ্টপূর্ব ৭০০ শতক থেকে ৫০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত তক্ষশীলার ছিল এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ব্রহ্মদত্ত, কৌটিল্য, পাণিনি, যিবেক ও পতঞ্জলি’র মত মহান পণ্ডিতগণ তক্ষশীলায় অধ্যয়ন করতেন। এদের মধ্যে পতঞ্জলি ছিলেন ভারতীয় যোগ দর্শনের প্রবর্তক, মহান দার্শনিক, ব্যাকরণবিদ ও বিজ্ঞানী। তিনি ছিলেন ‘যোগশাস্ত্রে’র স্রষ্টা। হিন্দু যোগ দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণিক শাস্ত্রগ্রন্থ ‘যোগসূত্র’র সংকলক ছিলেন পতঞ্জলি। মহাভাষ্য (পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী-এর উপর রচিত কাত্যায়নের বৃত্তিকার টীকা) গ্রন্থেরও রচয়িতাও তিনি। দ্বাদশ শতাব্দীতে  বিজয় নগরের রাজা বীরবাক্কুর প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন এই পতঞ্জলি। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ‘মাধব নিদান’। রোগ নির্ণয়ের জন্য এই গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে।


বহু দিন আগে, এক সময় সমস্ত মুনি ও ঋষিরা ভগবান বিষ্ণুর কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন এই কথা বলার জন্য যে, যদিও তিনি (ধন্বন্তরী অবতার) আয়ুর্বেদের মাধ্যমে অসুখ নিরাময়ের উপায় দিয়েছেন, তবুও মানুষ অসুস্থ হয়। তাঁরা এও জানতে চেয়েছিলেন যে যখন মানুষ অসুস্থ হয় তখন কি করা উচিত।


শুধু শারীরিক অসুস্থতাই নয়, কখনও কখনও ক্রোধ, লালসা, লোভ, ঈর্ষা ইত্যাদি থেকে উৎপন্ন মানসিক আবেগজনিত অসুস্থতাও নিরাময়ের প্রয়োজন হয়। এই সব অশুদ্ধি থেকে একজন কিভাবে মুক্তি পেতে পারে? এর উপায় কি?


ঋষিরা যখন তাঁর কাছে নিজেদের বক্তব্য পেশ করলেন, তিনি আদিশেষ/শেষনাগ/অনঙ্গদেবকে (সচেতনতার প্রতীক),  তাঁদের কাছে পাঠালেন, যিনি পৃথিবীতে মহর্ষি পতঞ্জলি হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। এযুগে মহাত্মা রামঠাকুরের গুরু ছিলেন অনঙ্গদেব এবং রামঠাকুর স্বয়ং ছিলেন সেই গুরুর আরেকটি সত্তা।


যোগ দর্শনের প্রবর্তক পতঞ্জলির প্রদর্শিত মার্গ ‘পাতঞ্জল দর্শন’ নামে পরিচিত। পতঞ্জলির যোগশাস্ত্রের চারটি পাদ। প্রথম পাদে আলোচিত হয়েছে যোগের লক্ষণ ও সমাধি। দ্বিতীয় পাদে সমাধি লাভের পূর্বে অনুসরণীয় ব্যবহারিক যোগ এবং যম, নিয়ম, আসন ইত্যাদি যোগাঙ্গের কথা বা অষ্টাঙ্গ যোগের কথা আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় পাদে ধারণা, ধ্যান, সমাধি ও এসবের ফল এবং বিভূতি বা ঐশ্বর্য আলোচিত হয়েছে। চতুর্থ পাদে পাঁচ প্রকার সিদ্ধি ও পরা প্রয়োজন কৈবল্যের আলোচনা করা হয়েছে।  এইভাবে পতঞ্জলি পৃথিবীতে আসেন যোগের জ্ঞান দান করার জন্য। এই জ্ঞানই ‘যোগসূত্র’ নামে পরিচিত।


জানা যায়, পতঞ্জলি বলেন ১০০০ মানুষ একত্রিত না হলে তিনি ‘যোগসূত্র’ আলোচনা করবেন না। সুতরাং সহস্র মানুষ তাঁর জ্ঞান শোনার জন্য বিন্ধ্য পর্বতমালার দক্ষিণ দিকে একত্রিত হলেন। পতঞ্জলির আরেকটি শর্ত ছিল, তাঁর ছাত্রদের ও তাঁর মধ্যে একটি পর্দা রাখতে হবে। ছাত্রদের কেউ সেই পর্দা তুলতে পারবে না। তিনি যতক্ষণ না জ্ঞান দান শেষ করছেন, সবাইকে কক্ষে উপস্থিত থাকতে হবে।


পতঞ্জলি পর্দার আড়ালে থেকে ১০০০ মানুষকে জ্ঞান দান করছেন, প্রত্যেকের মধ্যে সেই জ্ঞান সঞ্চারিত হচ্ছে!


এ এক বিস্ময়কর তত্ত্ব, এমন কি ছাত্ররাও বিশ্বাস করতে পারছিল না কি করে তাদের এই জ্ঞান লাভ হচ্ছে। কি করে গুরু পর্দার আড়ালে থেকে একটি শব্দ উচ্চারণ না করে প্রত্যেকের মাঝে এই জ্ঞানের উপলব্ধি ঘটাচ্ছেন তা তাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না।


প্রত্যেকে বিস্ময়ে বিহ্বল অবস্থায় এক অদ্ভুত অনুভব প্রাপ্ত হল। প্রত্যেকে এমন এক অদম্য শক্তি, এমন এক অভাবনীয় উৎসাহ অনুভব করছিল যে তারা স্থিরভাবে তা ধারণ করতে পারছিল  না। কিন্তু তাদেরকে নিয়ম বজায় রাখতে হবে।  


 একটি ছোট ছেলেকে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হয়েছিল। তাই সে স্থান ছেড়ে চলে যায়। সে মনে মনে ভাবল যে, সে যাবে এবং নিঃশব্দে ফিরে আসবে। আরেক জন কৌতুহলী হয়ে উঠল - “পর্দার আড়ালে গুরুদেব কি করছেন? আমি দেখতে চাই।”


এখানে গুরু যে চোখের সামনে না থেকেও তাঁর জ্ঞান শিষ্যদের মধ্যে সঞ্চার করেছিলেন, তা তিনি প্রত্যেকের আত্মার সঙ্গে নিজ আত্মার আত্মিক সংযোগ ঘটিয়েছিলেন। আর মাঝখানের পর্দাটি হল অজ্ঞতার পর্দা। ঘরের মধ্যে উপস্থিতি মানে আত্মার সঙ্গে আত্মার সংযোগ রক্ষা করা।


একটি ছাত্র আর ধৈর্য রাখতে না পেরে পর্দাটি তুলে দেয়, সঙ্গে সঙ্গে সেই ছাত্রটিসহ বাকি ৯৯৮ জন ছাত্র ভস্ম হয়ে যায়, মহর্ষি পতঞ্জলি খুবই দুঃখিত হন, যেখানে তিনি সারা বিশ্বকে জ্ঞান দানে রাজি ছিলেন, সেখানে তাঁর সমস্ত ছাত্র ভস্মীভূত হয়ে গেল। আধার উপযুক্ত হবার আগে যদি জ্ঞান ও সাধনা বেশী হয়ে যায়, তবে আধারের দেহ নাশ হয়।


এমন সময় সেই ছোট ছেলেটা ফিরে এল, মহর্ষি তাকে জিজ্ঞেস করলেন সে কোথায় গেছিল। ছোট ছেলেটি তাঁকে বলল যে সে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে গেছিল এবং তার এই না অনুমতি নিয়ে বেরোনোর জন্য মহর্ষি যেন তাকে ক্ষমা করে দেন। মহর্ষি স্বস্তির সঙ্গে ভাবলেন যে একজন অন্তত রয়েছে যাকে তিনি যোগের সূত্রগুলোর বিষয়ে তাঁর জ্ঞান দান করতে পারবেন, তিনি সেই ছেলেটিকে সমস্ত জ্ঞান দান করলেন। কিন্তু জ্ঞানলাভের শেষে ছেলেটিকে বললেন যে যেহেতু সে আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সংযোগের পদ্ধতির জ্ঞান লাভ করার সময়ে গুরুর অনবধানে বারণ সত্বেও কক্ষ ত্যাগ করেছে, তাই সে নিয়ম ভেঙেছে, ফলে সে ব্রহ্মরাক্ষস হয়ে গাছে ঝুলে থাকবে আর এই অভিশাপ থেকে সে তখনি মুক্তি পাবে যখন সে এই জ্ঞান একজন শিষ্যের মধ্যে সম্যক ভাবে প্রদানে সমর্থ হবে। এই বলে পতঞ্জলি দেব অদৃশ্য হলেন।


ব্ৰহ্মরাক্ষস গাছে ঝুলে রইল, যে গাছের তলা দিয়ে যায়, তাকে সে একটা করে প্রশ্ন করে, তারা উত্তর দিতে অপারগ হয় আর সে তাদের খেয়ে ফেলে, এছাড়া তার আর কোনো রাস্তা নেই, এইভাবে তার কয়েক হাজার বছর কেটে গেল। সে এই সময়ের মধ্যে একজনকেও পেল না যাকে সে যোগসূত্রের জ্ঞান দান করতে পারে।  একজন জ্ঞানী ব্যক্তি যখন বিপথগামী হন, তখন সে একজন সাধারণ দুষ্কৃতীর চেয়ে অনেক বেশী ভয়ঙ্কর হন। এইভাবে ব্রহ্মরাক্ষস গাছে ঝুলে থেকে মুক্তির প্রতীক্ষা করতে রইল।


দয়াপরবশ হয়ে শেষে মহর্ষি পতঞ্জলি আবার নিজেই জন্ম নিয়ে এলেন তার কাছে শিষ্য হয়ে এবং ব্ৰহ্মরাক্ষস তাঁকে যোগসূত্রের পূর্ণজ্ঞান দান করলেন। শিষ্যরূপী পতঞ্জলি তা কয়েকটি তালপাতায় লিখে রাখলেন। শিষ্যকে মুক্তি দিতে গুরু তাঁর শিষ্যের শিষ্য হলেন।পতঞ্জলি সূত্রগুলি গাছের মগডালে বসে লেখেন যেহেতু ব্রহ্ম রাক্ষস ওখানেই থাকে এবং ওখানে বসেই সূত্রগুলি বিবৃত করে।ব্রহ্ম রাক্ষস রাত্রে তাঁকে বলেন আর পতঞ্জলি তা পাতায় লেখেন। প্রতিদিন তিনি কিছু পাতা তুলে আনেন, দেহের কোন জায়গায় কেটে রক্ত বের করে তাই দিয়ে লিখে রাখেন।এইভাবে সাতদিন ধরে লিখে সমস্ত জ্ঞান আহরণ করে তিনি ক্লান্ত হয়ে গেলেন। সব লেখা শেষ হলে তিনি সব পাতাগুলোকে একটুকরো কাপড়ে বেঁধে গাছের তলায় রেখে নদীতে গেলেন স্নান করতে।যখন তিনি ফিরে এলেন, দেখলেন যে একটা ছাগল ওই পাতাগুলোর বেশিরভাগটাই খেয়ে ফেলেছে।ছাগলটি এখানে মায়ার প্রতীক যার বশে আমাদের জ্ঞানের দীপ্তি অনেকটাই ঢেকে যায়।উপযুক্ত স্থান, কাল ও পাত্র বিবেচনা না করে জ্ঞান অরক্ষিত রাখা অনুচিত।পতঞ্জলি কাপড়ের ঝোলটির মধ্যে বেঁচে যাওয়া পাতাগুলি নিলেন এবং ওখান থেকে চলে গেলেন। এখানে এই পাতাগুলি জ্ঞানের প্রতীক যে জ্ঞান একসঙ্গে পুরোটা ধারণ করা কারুর পক্ষে সম্ভব নয়।গল্পটি পুরাণের, গল্পটির অন্তর্নিহিত গভীরতা আছে যা পুরাণ ব্যাখ্যা করে না, পাঠকের চিন্তা শক্তির ওপরে ছেড়ে দেয় তার রহস্য উদ্ধার করতে।


পতঞ্জলির সংঞ্জানুসারে ‘যোগ’ মানে হল মনের পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করা। বিভিন্ন ধরণের যোগ থাকলেও, প্রত্যেক ধরণের যোগের উদ্দেশ্যই হল মনকে নিয়ন্ত্রণ বা বশ করা। ‘যোগ’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘ইউয্‌’ থেকে। যার মানে হল একত্রিত করা- আত্মার সাথে পরমাত্মার সংযোগ। পতঞ্জলি যোগ দর্শনকে বাংলায়  ব্যাখ্যা করেছেন অনেকেই, কিন্তু প্রাঞ্জল সাবলীলভাবে যৌগিক ব্যাখ্যা  করেছেন ব্রহ্মর্ষি সত্যদেব এবং শ্রীমৎ হরিহরানন্দ গিরি। এঁদের দুজনেরই ব্যাখ্যা সাধারণের পক্ষে বোঝা সম্ভব যদিও মূল বিষয়টি গুরুকৃপাতেই বোধের স্তরে আসে। কারণে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ও মনকে সংযত করে অতীন্দ্রিয় স্তরে উন্নীত হতে হয় আর সেই অতীন্দ্রিয় অনুভব গুরুকৃপা ভিন্ন অধরাই থেকে যায়, কারণ সদ্গুরু আসেন সাধারণকে উদ্ধার কল্পে সাধনা করিয়ে নিয়ে মোক্ষ প্রদান কার্যে, যাঁকে ঈশ্বর স্বয়ং চাপরাশ দিয়ে প্রেরণ করেন। তাই সর্ব স্তরেই "গুরু কৃপাহি কেবলম”।

"গুরু পরম ধন অমূল্য রতন

রাখরে হৃদয়ে ধরি করি সযতন।”-শ্ৰীশ্ৰী মা সর্বাণী