Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

দৈনিক।
একটি _ অসমবয়সী _ প্রেম।
ভালোবাসার চিরন্তন গল্প।অনিতা দাশগুপ্ত।
মাধবী মিত্রের পরিবারে একটা দুশ্চিন্তার ছায়া নেমে এসেছে কয়েক দিন ধরে। বেশ কয়েক দিন হয়ে গেল পাওয়া যাচ্ছে না প্রফেসর অনিকেত মিত্র কে। অথচ কোনো কারন খুঁজে পাচ্ছ…


দৈনিক।


একটি _ অসমবয়সী _ প্রেম।


ভালোবাসার চিরন্তন গল্প।

 

অনিতা দাশগুপ্ত।


মাধবী মিত্রের পরিবারে একটা দুশ্চিন্তার ছায়া নেমে এসেছে কয়েক দিন ধরে। বেশ কয়েক দিন হয়ে গেল পাওয়া যাচ্ছে না প্রফেসর অনিকেত মিত্র কে। অথচ কোনো কারন খুঁজে পাচ্ছেন না ওনারা। ঝঞ্ঝাট হীন পরিবার ওদের মতো আর একটা ও এই কমপ্লেক্সে নেই। ওনারা দুজনে ই কলকাতার নামজাদা কলেজে পড়ান। ওনাদের একমাত্র ছেলে অভিরূপ ভালো চাকরি করে আই টি সেক্টরে। সকলে নিজেদের জীবনে খুব প্রতিষ্ঠিত ও খুশী। এইরকম অবস্থায় এই ধরনের একটা ঘটনা বেশ অভাবনীয়। প্রথম দুদিন ওরা ভেবেছিল গ্রামের বাড়িতে গেছেন, চলে আসবেন। যদিও এই রকম না বলে যাওয়া টা বড়ই অস্বাভাবিক মাধবীর কাছে। তবুও ধৈর্য ধরে ছিলেন ফিরে আসবেন ভেবে। আরও আশ্চর্যের বিষয় মোবাইল টা ও সুইচ অফ দেখাচ্ছে। তাছাড়া মাধবী এবং অভিরূপ আত্মীয় স্বজন সবার বাড়িতে খোঁজ নিয়ে দেখেছেন কারোর বাড়িতে উনি যান নি। এই দিকে ওনার কাছে যেসব ছাত্রছাত্রীরা বাড়িতে পড়তে আসে তারাও প্রায় সবাই বারবার খোঁজ করছে, কেউ কেউ বাড়িতে এসে ও খবর নিয়েছে তাদের প্রিয় স্যারের ব্যাপারে। এদের কারো কাছ থেকে মাধবী অনিকেতের হঠাৎ নিরুদ্দেশ হওয়ার কোনো সুত্র পান নি মাধবী। চার  

পাঁচ দিন এই রকম দুশ্চিন্তা র পর অভিরূপ তার মা কে বলে, " এবার তাহলে পুলিশে একটা মিসিং ডায়েরী করে দি মা।''

মাধবী অত্যন্ত শক্ত স্বভাবের মহিলা। অল্প তে ভেঙে পড়েন না। কিন্তু আজ ছেলের কথা শুনে তিনি আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না। ছেলের হাত দুটো ধরে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, " যদি খারাপ কিছু খবর পাই বাবু? সে যে আমি সহ্য

করতে পারবো না। ''

" কিন্তু মা একটা তো ব্যাবস্থা করতে হবে। এইরকম ভাবে হাত গুটিয়ে আর ক'দিন বসে থাকবো?''

" সেটা ও ঠিক। বাবু দাঁড়া, আমাকে আর একটু সময় দে। ওর স্টাডি রুম টা আর একবার দেখি। ''

" ঠিক আছে মা। তুমি আজ দেখো। কিন্তু কাল সকালে আমি থানায় যাব ডায়েরী করতে।''

     মাধবী স্টাডি রুমে ঢুকে সব বই গুলো ভালো করে আবার দেখতে থাকেন, যদি তার অজানা কিছু বেরিয়ে আসে। বেশ কিছুক্ষণ দেখার পর হঠাৎ ওনার আলমারির ভেতরের ড্রয়ার গুলো র কথা মনে হয় যা দেখা হয় নি। কয়েক টা কাগজ পত্র দেখতে দেখতে একটা খাম ওনার নজরে পড়ে। সেটা খুলতে মেয়েলী হাতে লেখা  বেশ কয়েকটি চিঠি বেরিয়ে আসে যেগুলো পড়ে মাধবী 

হতবাক হয়ে যান। সব চিঠি গুলো অনিকেত কে লেখা । একটা নারী হৃদয়ের সমর্পণ । প্রতিটি চিঠি র ভাষা ও খুব সুন্দর। তাতে মনের তীব্র আকুলতা ও প্রেমের হাহাকার আছে কিন্তু অনিকেত কে ঘর ছাড়া করার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। সব চিঠি গুলো লিখেছে রূপাঞ্জনা অনিকেতের এক প্রিয় ছাত্রী যে ওর মেয়ের বয়সী। চিঠি গুলো পড়ে মাধবী বুঝতে পারে ওদের এই সম্পর্ক বেশ কয়েক বছরের। চিঠি গুলো হাতে নিয়ে সোফায় বসে পড়ে মাধবী। ওর মন ডুকরে কেঁদে ওঠে। ভাবে এক ই ছাদের তলায় থেকে অনিকেতের শয্যা সঙ্গিনী হয়ে ও ওর মন টা বুঝতে পারলো না। অনিকেত কবে যে ওর কাছ থেকে নিজেকে এতো টা সরিয়ে নিল সেটা মাধবী টের ও পেল না। শ্রান্ত মন নিয়ে সারা টা রাত ওর কেটে গেল স্টাডি রুমে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে ঠিক করলো ছেলে কে সব জানিয়ে ওকে থানায় যেতে বারণ করতে হবে। বারবার মনে হচ্ছিল একটা কথাই অনিকেত যদি এই ভাবে লোক না হাসিয়ে ওকে সোজা সুজি বলতো যে ওর

ভালবাসার পাত্রী আর মাধবী নয়, তাহলে নিজে থেকেই মুক্তি দিত মাধবী। সকালে অভিরূপ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মাধবী সব কথা ওকে জানিয়ে বললো,

" বাবু, যে স্বেচ্ছায় অন্য কারোর সাথে ভালো থাকবে বলে চলে গেছে, তাকে নিয়ে আর টেনা হ্যাচড়া করিস না। ওকে ওর মতো শান্তি তে থাকতে দে। তবে এটা ভেবে খারাপ লাগছে মেয়ে টা বড্ড ছোট। "

" সবাইকে কী বলবে ? বাবার কলেজে কী বলবে? 

কত বদনাম হবে ভাবতে পারছো। আর কয়েক মাস বাদে তো বাবা রিটায়ার করবে।'

" সেটা তোমার বাবাকে বুঝে নিতে দাও।''

" আমার শুধু তোমাকে একটা ই অনুরোধ। এটা নিয়ে আমরা কাউকে কিছু বলবোনা।সময় হলে সবাই নিজে থেকেই জানতে পারবে।''

___________________________________________

 ‌ রুপাঞ্জনাদের কলকাতার এই ফ্ল্যাট টা ফাঁকাই পড়ে থাকে সবসময়। কথা টা অনিকেতের জানা

ছিল। তাই প্রস্তাব টা ওর তরফ থেকেই এসেছিল।

ওদের সম্পর্ক টা গভীর হতে বেশি সময় লাগে নি।

প্রথম যেদিন কলেজে ওকে দেখে ছিল সেদিন থেকেই ওর কালো দীঘল চোখ দুটো অনিকেত কে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। লাবণ্য ভরা শরীরের যে এক অদ্ভুত আকর্ষণীয় ক্ষমতা ছিল তাকে এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না অনিকেতের। ওর ত্রিশ বছরের সংসারের কোনো বন্ধন ই এই প্রবল আকর্ষণ কে বাঁধা দিতে পারে নি। স্ত্রী মাধবী কে যদিও কোনো আভাস পেতে দেয় নি অনিকেত। রূপে গুণে মাধবী এই বয়সে যদি ও কারোর থেকে 

কম নয় , কিন্তু ওর প্রতি দিন দিন অনিকেতের আকর্ষণ কেমন যেন কমে আসছিল। এর সঠিক কারণ অনিকেত নিজেও জানে না। অতিরিক্ত পরিশীলিত মন, শিক্ষা দীক্ষা সব কিছু মিলিয়ে মাধবী একটু একটু করে দুরে সরে গেছে অনিকেতের। যদিও এটা ওর দোষ নয়। কিন্তু ওর অবাক লাগত তার মনের কোনো খোঁজ মাধবী কি ভাবে রাখলো না। রুপাঞ্জনা তো ওদের বাড়িতে সপ্তাহে দুদিন করে আসত । রুপাঞ্জনা র প্রতি অনিকেতের মুগ্ধ দৃষ্টি কী চোখে পড়ে নি মাধবীর? না কি সকলের মতো ও ভেবেছিল এই বয়সে স্ত্রী ছাড়া পুরুষ দের গতি কী? অনেকক্ষণ ধরে শুয়ে শুয়ে এইসব কথা ভাবছিল অনিকেত। 

" এবার তো ওঠো। আর কতক্ষণ শুয়ে থাকবে? আমার চা কিন্তু তৈরী।''

চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে রুপাঞ্জনা। জানলা দিয়ে সকালে মিষ্টি রোদ ছড়িয়ে পড়েছে ওর মুখে সারা শরীরে। আর ও লাবণ্যময়ী লাগছে ওকে। অনিকেত যেন চোখ ফেরাতে পারছে না। একমুখ হেসে চায়ের ট্রে টা রেখে অনিকেতের চুল টা ঘেঁটে দিতে অনিকেত আবার ওকে নিজের কাছে টেনে নেয়। " না না এখন একদম নয়। কাল রাতে অনেক কিছু হয়ে গেছে। '' বলেই রুপাঞ্জনা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় ওর বাহুবন্ধন থেকে। ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলে যায় ," উঠে পড়ে চা খেয়ে নাও। আমি ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসছি। '' 

রুপাঞ্জনার কথা বার্তা ভাব ভঙ্গি দেখে অনেক দিন আগের মাধবী কে মনে পড়ে যায় অনিকেতের। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ওর। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসার পর ‌দেখে রুপাঞ্জনা ব্রেকফাস্ট রেডি করে ফেলেছে। দুজনে একসঙ্গে বসে টেবিলে। " অনিকেত তোমার মোবাইল টা আজ অন করো। ম্যাডাম নিশ্চয়ই খুব

চিন্তা করছে।'

" সে তো অনেক দিন ধরেই করছে। হঠাৎ আজ তোমার মনে হলো? আমি তোমাকে যে কথা টা বলেছিলাম সেটা কি ভেবে দেখেছো?'

" অনেক ভেবেছি। কিন্তু তুমি যেটা চাইছো সেটা আমি করতে পারি না?'

" কেন পারো না? আমি তো সব ছেড়ে দিতে রাজি আছি। ঐ জীবনে আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। তুমি আবার আমায় বাঁচার প্রেরণা জুগিয়েছো।''

" আমি তো তোমার সঙ্গে থাকতে চাই অনিকেত। কিন্তু তোমার এতো দিনের সংসার কে আমি ভেঙে দিতে পারি না।''

অনিকেত হঠাৎ রেগে গিয়ে বলে, " তাহলে এতো দিন কী করলে? আর এখানে ই বা কেন আসতে

রাজি হলে?''

" তোমাকে ভালোবাসি অনিকেত। মন প্রাণ দিয়ে তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক গড়তে গেলে ত্রিশ বছরের তোমাদের সম্পর্ক টা ভেঙে যাবে। এটা আমি কোনো দিন চাই নি। আমার সব চিঠি তে সেটা ই জানিয়েছিলাম তোমাকে। ''

" তাহলে এখানে আসা টা? ''

" আমি তো রাজী ছিলাম না। কিন্তু তোমার জোরের কাছে আমার লোভী মন টা হেরে গেছে। '' 

" এখন‌ তাহলে তুমি কী করবে? তোমার তো এটাই ফাইনাল ইয়ার। আর ক'মাস পরে আমি ও রিটায়ার করবো।''

" আমি দিল্লি চলে যাব। মা ,বাপি তো আগেই চলে গেছে। আমি তো ওখানকার ই মেয়ে। ''

" আর আমাকে ভুলে যাবে , তাই তো? অন্য কাউকে বিয়ে করে নেবে।''

" তোমাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব? এই কদিনে তোমার কাছে যা পেলাম সেটা নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবো। আর বিয়ে? জানি না সেটা আর আমি করতে পারব কি না। ''

" তুমি কি বলো, আজকেই আমাকে চলে যেতে হবে?' 

" আমি কী সে কথা বলেছি? তবে যেতে তো তোমাকে হবেই। ''

" তোমাকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো সেটা ভাবছো না?''

" অভ্যাস হয়ে যাবে। আর আমি তো তোমার মনেই থাকবো।''

বিকেলে অনিকেত বেরিয়ে যাবার আগে ওকে জড়িয়ে ধরে অঝরে কাঁদতে থাকে রূপাঞ্জনা। অনিকেতের দুচোখ ভরে যায় জলে। দুটো অসম বয়সের প্রেমিক প্রেমিকা ভারাক্রান্ত মনে একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নেয়। 

   সন্ধ্যে বেলায় ডোর বেল টা বাজার কিছুক্ষণ পর

মাধবী দরজা খুলে দেয়। অনিকেত কে দেখে আবেগে ভেসে না গিয়ে ওকে ঘরে আসতে দেয়।

বুঝতে দেয় না ও সব কিছু জানতে পেরে গেছে। শুধু বলে, " এবার থেকে কোথাও গেলে মোবাইলে র সুইচ টা অন রেখো। তোমার কাছে আমি আর কিছু চাই না। ''

  অনিকেতের জন্য চা নিয়ে সোফা তে  ওর পাশে একটু তফাতে বসে মাধবী। ওরা মনে মনে দুজনে বোঝে ওদের মধ্যে এখন বহু যোজনের দূরত্ব আর যেটা পার করা আর সম্ভব নয় ওদের কারো পক্ষেই। 


   (সমাপ্ত)