Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

বহুরূপে ঈশ্বর কলমে #পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়
তিব্বতের প্রত্যন্ত অঞ্চল ছেড়ে মধ্য রাত্রির অন্ধকার ভেদ করে ছুটে চলেছেন সন্ন্যাসী। স্বয়ং মা তারা দর্শন দিয়ে ভর্ৎসনা করে তাঁকে অবিলম্বে চলে যেতে বলেছেন তিব্বত, যা সেই সময় মহাচীন বলে খ্যাত ছিল,…


বহুরূপে ঈশ্বর
কলমে #পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়

তিব্বতের প্রত্যন্ত অঞ্চল ছেড়ে মধ্য রাত্রির অন্ধকার ভেদ করে ছুটে চলেছেন সন্ন্যাসী। স্বয়ং মা তারা দর্শন দিয়ে ভর্ৎসনা করে তাঁকে অবিলম্বে চলে যেতে বলেছেন তিব্বত, যা সেই সময় মহাচীন বলে খ্যাত ছিল, সেই অঞ্চল ছেড়ে পরেরদিন ঊষার উন্মেষ হবার আগে। কে এই তরুণ সন্ন্যাসী, যাঁর প্রজ্ঞা আর জ্ঞান পবিত্রতার দীপ্তিতে হিন্দু ধর্ম সতত সমুজ্জ্বল রূপ পেয়েছে , যা একদা বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারে ও প্রসারে লুপ্ত হতে বসেছিল? যাঁর হাত ধরে আর্যাবর্তের চারটি দিকে স্থাপিত হয়েছিল চারটি অদ্বৈত বৈদান্তিক মঠ এবং সন্ন্যাসীদের দশনামী সম্প্রদায়, সেই অদ্বৈত বেদান্তের প্রবক্তা আদি শঙ্করাচার্য। সেই সন্ন্যাসী আদি শঙ্করাচার্য যাঁর প্রতি মা তারার এই অদ্ভুত আদেশ, কিন্তু কেন এমন আদেশ দিলেন সর্বসিদ্ধিপ্রদায়িনী মা তারা? মা তারা তো ভক্তবৎসল, তনয়ের ইষ্টফলদাত্রী, তাহলে এমন আদেশ হল কেন? তাও আবার আদি শঙ্করাচার্যের মত শিবাবতারকে যিনি গোটা আর্যাবর্তকে তাঁর অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের মাধ্যমে হিন্দু ধর্মকে পুনরুত্থাপিত করে আসমুদ্রহিমাচল একই সূত্রে গেঁথেছিলেন?

গৌড়পাদ ছিলেন আদি শঙ্করের গুরু গোবিন্দ ভাগবতপাদের গুরু। আদি শঙ্কর নিজেই এই তথ্যটি স্বীকার করেছেন এবং গৌড়পাদ যে তার গুরুর গুরু ছিলেন, সেই ব্যাপারে নানা উদ্ধৃতির উল্লেখ করেছেন তাঁর বিবেকচূড়ামনি রচনার প্রারম্ভে। আদি শঙ্কর অষ্টম শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব হলে তাই অনুমিত হয় গৌড়পাদ খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর বাড়ি ছিল গৌড়দেশে, এই অনুমানে কোন সংশয় নাই।

গোবিন্দ ভাগবতপাদ ছিলেন অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবক্তা, অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন সনাতন হিন্দু ধর্মের বহু প্রাচীন মতবাদ যেটি মহর্ষি ব্যাসদেব(গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বলেছেন যে মহাত্মাদের বা ঋষিদের মধ্যে তিনি ব্যাস দেব) তাঁর ব্রহ্মসূত্রের মাধ্যমে একেশ্বরবাদ দর্শনটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই মতবাদটি গৌড়পাদ লাভ করেন তস্যগুরু ব্যাসপুত্র শুকদেবের কাছ থেকে এবং প্রদান করেন তদীয় শিষ্য গোবিন্দপাদকে। গোবিন্দপাদ ব্যাসদেবকে অনুরোধ করেন ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যাটি প্রদান করে লিপিবদ্ধ করতে, নাহলে সাধারণ মানুষ যাঁর যাঁর মতানুযায়ী তা ব্যাখ্যা করবে যে।যাঁর উত্তরে ব্যাসদেব জানান "কিছু সময়ের মধ্যেই একজন শিষ্য আসবে গোবিন্দপাদের কাছে যে প্রজ্ঞা ও জ্ঞানে তাঁর (ব্যাসদেবের) সমতুল্য হবে এবং সে এসে এই ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য রচনা করবে। সে সমগ্র নর্মদার জলধারা তাঁর কমণ্ডলুতে ভরে ফেলবে যে ঘটনাটি দিয়ে গোবিন্দপাদ তাঁকে চিনতে পারবেন"। গোবিন্দপাদ সেই থেকে ধ্যানমগ্ন হয়ে ওঙ্কারেশ্বরে অপেক্ষা করতে থাকেন।

"অদ্বৈত গুরু-পরম্পরা"
ভারতীয় ধর্ম ও দর্শনে, সকল জ্ঞানের উৎস ঈশ্বর এবং ঈশ্বরের থেকে বেদদ্রষ্টা ঋষিরা সেই দর্শন প্রাপ্ত হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

"গুরু-পরম্পরা"
শাস্ত্র অনুসারে, অদ্বৈত গুরু-পরম্পরার উৎস পৌরাণিক যুগের "দৈব-পরম্পরা"। তারপর এই দর্শনে বেদজ্ঞ "ঋষি-পরম্পরা" শুরু হয় এবং শেষে "মানব-পরম্পরা" বা ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের গুরু পরম্পরায় উপনীত হয়।

দৈব-পরম্পরা: নারায়ণ, পদ্মভুব (ব্রহ্মা)।
ঋষি-পরম্পরা: বশিষ্ঠ,শক্তি,পরাশর,ব্যাস,শুকদেব।
মানব-সম্প্রদায়•:ঈশ্বরকৃষ্ণ আচার্য, গৌড়পাদ, গোবিন্দ ভাগবতপাদ, আদি শঙ্কর।

যুগ (হিন্দুধর্ম)
শাস্ত্র অনুসারে, প্রত্যেক যুগের নিজস্ব গুরু আছেন:

সত্যযুগে: নারায়ণ, সদাশিব ও ব্রহ্মা
ত্রেতাযুগে: বশিষ্ঠ, শক্তি ও পরাশর
দ্বাপরযুগে: ব্যাস ও শুক
কলিযুগে: ঈশ্বরকৃষ্ণ আচার্য, গৌড়পাদ, গোবিন্দ ভাগবদপাদ ও আদি শঙ্কর ও তার শিষ্যেরা।

আদি শঙ্করাচার্যের জন্ম কেরলের কালাডি গ্রামে, দাক্ষিণাত্যের প্রখ্যাত নাম্বুদিরি সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ বংশে। তাঁর বাবার নাম ছিল শিবগুরু ও মায়ের নাম আর্যাম্বা। অবিচল শিবভক্ত পিতামাতার বেশী বয়সের সন্তান তিনি, ত্রিশূরের বৃষভচল শিবমন্দিরে পুজো দিলে তাঁদের অটল ভক্তিতে তুষ্ট মহাদেব যখন বর প্রার্থনা করতে বলেছিলেন শঙ্করের পিতামাতাকে তাঁদের জিজ্ঞেস করেছিলেন কি রকম সন্তান তাঁরা চান, বুদ্ধিমান স্বল্পায়ু না মূর্খ দীর্ঘায়ু?পিতামাতা বুদ্ধিমান স্বল্পায়ু সন্তান কামনা করেন এবং তাঁরা সন্তান রূপে লাভ করেন শঙ্করকে। মাত্র আটবছর বয়সে শঙ্করের চারটি বেদ কণ্ঠস্থ ছিল। উপনয়নের আগে তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়, তাঁর মা তাঁর উপনয়নের ব্যবস্থা করে উপনয়ন যখন দেন শঙ্কর মায়ের কাছে সন্ন্যাসের জন্য অনুমতি চান, কিন্তু মা অনুমতি দিতে নারাজ। মায়ের সঙ্গে একদিন গেছে গ্রাম সংলগ্ন পূর্ণা নদীতে স্নান করতে, হঠাৎ কুমিরে তাঁর পা টেনে নিয়ে চলল, শঙ্কর চেঁচিয়ে মাকে বলল, "হয় তুমি আমায় সন্ন্যাসের অনুমতি দাও নচেৎ কুমির আমার প্রাণ নাশ করবে "। মা বাধ্য হয়ে অনুমতি দিলেন, কুমির সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করের পা ছেড়ে দিল।শঙ্কর অঙ্গীকার করল মায়ের কাছে সে মায়ের অন্তিম সময় ঠিক উপস্থিত হবে এবং মায়ের অন্তিম সংস্কার আর পারলৌকিক কাজ করবে।

শঙ্কর কেরল ত্যাগ করে গুরুর খোঁজে উত্তর ভারতের দিকে রওনা হলেন। সুদূর কেরল থেকে শঙ্কর গিয়ে উপস্থিত হলেন নর্মদা তটে।নর্মদা নদীর তীরে ওঙ্কারেশ্বরে তিনি গৌড়পাদের শিষ্য গোবিন্দ ভগবদপাদের দেখা পান। গোবিন্দ শঙ্করের পরিচয় জানতে চাইলে, শঙ্কর মুখে মুখে "নির্বাণাষ্টাকম" শ্লোকটি রচনা করেন। এই শ্লোকটিই অদ্বৈত বেদান্ত তত্ত্ব প্রকাশ করে। গোবিন্দ তা শুনে খুব খুশি হন এবং শঙ্করকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন।

নির্বাণাষ্টাকম শ্লোকের প্রথম স্তবক

শিবোহং শিবোহং, শিবোহং শিবোহং, শিবোহং শিবোহং

মনো বুধ্য়হংকার চিত্তানি নাহং
ন চ শ্রোত্র জিহ্বা ন চ ঘ্রাণনেত্রম |
ন চ ব্যোম-ভূমির-ন তেজো ন বায়ুঃ
চিদানন্দ রূপঃ শিবোহং শিবোহম || 1 ||

অর্থ - আমি মন -বুদ্ধি-অহংকার-চিত্ত নই, আমি শ্রোত্র-জিহ্বা-ঘ্রান-নেত্র অর্থাৎ পঞ্চেন্দ্রিয় নই, আমি আকাশ-ভূমি-তেজ-বায়ু অর্থাৎ পঞ্চভূত নই, আমি সচ্চিদানন্দময় শিবস্বরূপ আত্মা।

শঙ্করকে গোবিন্দপাদ হঠযোগ, রাজযোগ ও জ্ঞানযোগের জ্ঞান প্রদান করেন। হঠযোগ ও রাজযোগ প্রাপ্ত হয়ে শঙ্করের অষ্ট সিদ্ধি যথা অনিমা, লঘিমা, দূরদর্শন, দূর শ্রবণ, ইচ্ছা মৃত্যু প্রভৃতি সিদ্ধি করায়ত্ত করেন। শঙ্করকে সব জ্ঞান দান করে গোবিন্দপাদ গভীর ধ্যানে মগ্ন হন। হঠাৎ নর্মদা তটে শুরু হয় প্রবল বর্ষণ, অতিবৃষ্টির ফলে নর্মদার জল বাড়তে থাকে এবং প্লাবন উপস্থিত হয়। শঙ্কর দেখেন জল প্রায় গুরুর গুহাতে প্রবিষ্ট হয়ে যাবে, তিনি নিজের কমণ্ডলুতে নর্মদার উত্তাল জলধারাকে সুসংহত করেন। গোবিন্দপাদ ধ্যান যোগে বিষয়টি অবগত হন এবং তাঁর ধ্যানভঙ্গ হয়। তিনি শঙ্করকে আশীর্বাদ করে পাঠান সমগ্র আর্যাবর্তে অদ্বৈত বৈদান্তিক সনাতন হিন্দু ধর্মকে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করতে।

গোবিন্দপাদ শঙ্করকে ব্রহ্মসূত্রের একটি ভাষ্য লিখতে এবং অদ্বৈত মত প্রচার করতে বলেন। শঙ্কর কাশীতে আসেন। সেখানে সনন্দন নামে এক যুবকের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। এই যুবকটি দক্ষিণ ভারতের চোল রাজ্যের বাসিন্দা ছিল। সে-ই প্রথম শঙ্করের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।কাশীতে বিশ্বনাথ মন্দির দর্শন করতে যাওয়ার সময় এক চণ্ডালের সঙ্গে শঙ্করের দেখা হয়ে যায়। সেই চণ্ডালের সঙ্গে চারটি কুকুর ছিল। শঙ্করের শিষ্যরা চণ্ডালকে পথ ছেড়ে দাঁড়াতে বললে, চণ্ডাল উত্তর দেয়, "আপনি কী চান, আমি আমার আত্মাকে সরাই না এই রক্তমাংসের শরীরটাকে সরাই?" শঙ্কর বুঝতে পারেন যে, এই চণ্ডাল স্বয়ং শিব এবং তার চারটি কুকুর আসলে চার বেদ। শঙ্কর তাঁকে প্রণাম করে পাঁচটি শ্লোকে বন্দনা করেন।

মনীষাপঞ্চকম
অন্নময়াদন্নময়মথবা চৈতন্যমেব চৈতন্যাত্ ।
য়তিবর দূরীকর্তুং বাঞ্ছসি কিং ব্রূহি গচ্ছ গচ্ছেতি ॥
এই পাঁচটি শ্লোক "মণীষা পঞ্চকম্‌" নামে পরিচিত।

 আদি শঙ্করাচার্য যখন হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানের জন্য আসমুদ্রাহিমাচল তর্কযুদ্ধে ও শাস্ত্রবিচারে অন্য ধর্মের মতাবলম্বী পন্ডিতদের হারাতে হারাতে নেপাল ছাড়িয়ে তিব্বতে(তৎকালীন মহাচীন) উপস্থিত হন এবং সেখানকার বৌদ্ধ পন্ডিতেরও পরাস্ত করেন এবং পরের দিন ধার্য্য হয় তাঁদের বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করে হিন্দু ধর্ম গ্রহনের, তখন সেখানকার সেই বজ্রযোগিনী তারার উপাসক পন্ডিতেরা বজ্রযোগিনী মা তারার কাছে আকুল আবেদন করেন যাতে তাঁদের মায়ের উপাসনা ও বৌদ্ধ ধর্ম না ত্যাগ করতে হয়, তাঁরা প্রার্থনা জানান মায়ের কাছে তাঁদের স্বধর্ম রক্ষার। যার ফলশ্রুতি মা তারা রাত্রের দ্বিপ্রহরে আবির্ভূত হয়ে আদি শঙ্করাচার্যকে ভর্ৎসনা করেন এবং সেই রাত্রের মধ্যে ঐ স্থান পরিত্যাগ করার আদেশ দিয়ে বলেন যে মায়ের যে সন্তান মাকে যে রূপে ও উপায়ে চাইবে আরাধনা করবে, আদি শঙ্করকে মা সেই অধিকার দেননি তিনি সকলকে নিজ মত গ্রহণে বাধ্য করেন। শোনা যায়, তারামায়ের কাছে ভর্ৎসিত হয়ে আদি শঙ্করাচার্য মাকে শান্ত করতে "ভবান্যাষ্টকাম" স্তোত্রটি রচনা করে মায়ের স্তব করে মাকে শান্ত করেন, আশীর্বাদ লাভ করেন এবং মায়ের আদেশপ্রাপ্ত আদি শঙ্করাচার্য মায়ের কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে সেই রাত্রে সেই স্থান ত্যাগ করে চলে আসেন আর তিব্বত ও তার পার্শ্ববর্তী চীন(যা সেই সময়ে মহাচীন নামে খ্যাত ছিল) ও অন্য উত্তর পূর্বের বেশ কিছু জায়গায় বৌদ্ধ ধর্ম বিদ্যমান থাকে। তাই ভারতের ওই অঞ্চলে ও মহাচীনে আজও মন্দ্রিত হয়, "ওঁম মণিপদ্মে হুম " নাদ আর বৌদ্ধ সাধনার তান্ত্রিক ধারায় মা বজ্রযোগিনী তারার সাধনা আজও নিয়ত বিদ্যমান রয়েছে ঐদিকে।

************************************************
 
মহাজীবনের পথে


কলমে #পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়

@কপিরাইট সংরক্ষিত


সময়টা পঞ্চাশের দশকের। সদ্য ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। চোদ্দ বছরের ছেলে কমলের ম্যাট্রিক পরীক্ষা খুব একটা ভালো হয়নি, ওর ধারণা ও অঙ্কে পাশ করবে না। পিতৃহারা কমল মানুষ হয়েছে তার মামারবাড়িতে, মা আর দাদামশাইয়ের তত্ত্বাবধানে। মা অতিশয় ভক্তিমতী মহিলা। কমল মা অন্তপ্রাণ। মায়ের ইচ্ছে কমল এমন এক মানুষ তৈরী হোক যে থাকবে রাতের অন্ধকার আকাশে তারার মতো দেদীপ্যমান। তাই পরীক্ষা ভালো না হওয়াতে কমল খুব মুষড়ে পড়েছে মনে মনে। থাকে সে হাওড়ায়,  দোলাচলে সে ঠিক করতে পারছে না কি করবে।


ঠিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগে আগে একদিন কমল অনেকক্ষন গঙ্গার ঘাটে পা ঝুলিয়ে বসে রইল। তারপরে সন্ধ্যা সমাগত দেখে গিয়ে ঢুকল হাওড়া স্টেশনে আর চড়ে বসল বেনারসগামী একটি ট্রেনে। যথাসময়ে ট্রেন ছাড়ল এবং ছুটে চলল রাতের অন্ধকারের বুক চিরে। কমলের পরনে হাফপ্যান্ট আর জামা, পকেটে আছে পনেরটি টাকা। আর কিছু নেই তার সঙ্গে, একেবারে একবস্ত্রে সে বাড়ি ছেড়েছে। সময় মতন ট্রেনে টিকিট চেকার উঠলেন, সকলের টিকিটও দেখলেন, কিন্তু কমলকে যেন দেখতেই পেলেন না, চলে গেলেন অন্য দিকে। কমল খুব অবাক হল বটে আবার নিশ্চিন্তও হল, স্বস্তিতে সেও ঘুমিয়ে পড়ল। বেশ কিছুক্ষন বাদে যখন তার ঘুম ভাঙল তখন এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। ট্রেন তখন বেনারসে ঢুকছে, সে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল।হেঁটে হেঁটে একে ওকে জিজ্ঞাসা করে গঙ্গার পাড়ে এসে দাঁড়াল, পতিতপাবনী পুণ্যতোয়া গঙ্গার পবিত্র শীতল ধারা নিয়ে মাথায় দিল সে, তারপরে নামল ঠান্ডা জলে স্নান করতে। শীতল জলধারায় স্নান কমলের যাত্রার ক্লান্তি অপনোদন করে দিল।স্নান করতে করতে তার কানে এল ঘাটের কিছু লোকজন আলোচনা করছে এক আশ্রমের ভান্ডারার। সেখানে নাকি আশ্রয় চাইলে আশ্রয়ও পাওয়া যাবে। কমল খুঁজে খুঁজে গিয়ে হাজির হল সেই আশ্রমে, দেখল লোকে লাইন দিয়ে খাবার নিচ্ছে, সেও নিল। সেই সময় সে লক্ষ্য করল একজন বেশ মাতব্বর গোছের লোক অনেকের সঙ্গেই কথা বলে তাদের থাকার জায়গা নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে আর একজন পালোয়ানের মত চেহারার লোক খেতে দিচ্ছে। পালোয়ানের মত লোকটির কাছে গিয়ে কমল খাবার নিয়ে খেয়ে উঠে গিয়ে সেই মাতব্বর গোছের লোকটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো আশ্রয় প্রার্থী হয়ে, আশ্রয় মিলে গেল। দু' তিন দিন নির্ভাবনায় কেটেও গেল, তারপর একদিন রাত্রে খেয়ে দেয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছে, হঠাৎ একটা দম আটকানো অনুভূতি হতে তার ঘুম ভেঙে যেতে সে দেখল যে পালোয়ানের মত লোকটি তার বুকের ওপরে উঠে বসেছে তার গলাটা টিপে ধরে আর সেই মাতব্বর লোকটি তাকে পুলিশের চর মনে করে শাসাচ্ছে যে সে নাকি ওদের আশ্রমের খবর পুলিশকে দেবে বলে এখানে ঘাঁটি গেঁড়েছে, সে যেন পরেরদিন ভোর হবার সাথে সাথে বেনারস ছাড়ে, না হলে আর বেঁচে ফিরবে না সে। প্যান্টের ভিতরের পকেটে তার বারোটা টাকা ছিল, সেটাও ওরা বের করে নিয়েছে। এতো সত্যি সত্যি "শিবঠাকুরের আপন দেশে নিয়ম কানুন সব্বোনেশে হয়ে গেল ব্যাপার"।


কমল খুবই হতোদ্যম হয়ে সেই আশ্রম ছাড়ল, আবার সে উঠে বসল হরিদ্বারগামী একটি ট্রেনে আর পরেরদিন যখন হরিদ্বারের কাছে ট্রেন, তখন কমল ট্রেনে বসে দেখল দূরে আবছা হিমালয়ের পর্বতশ্রেণীর আভাস দেখতে পাচ্ছে সে। সে আশে পাশের লোকজনের কথা শুনে বুঝল ট্রেন হরিদ্বারে ঢুকছে। ট্রেন হরিদ্বারে থামল, সে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল ক্রমে অপসৃয়মান ট্রেনটার দিকে, তারপরে সে বাইরে এলো।


বাইরে এসে সে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে উপস্থিত হল গঙ্গার ধারে। গঙ্গাতটে দাঁড়িয়ে আশে পাশের প্রাকৃতিক শোভায় তার মন ভরে গেল, মনসা পাহাড়ের মাথায় মনসা মন্দির, চণ্ডী পাহাড়ের চণ্ডী মন্দির, অদূরে হিমালয়ের শৈল শিখর আর মহাদেবের জটা থেকে নিঃসৃত পতিতোদ্ধারিনী গঙ্গার স্বতঃ প্রবাহিত শীতল পবিত্রধারা মিলে হরিদ্বার সত্যই দেবতাত্মার প্রবেশদ্বার। তারপরে হাঁটতে হাঁটতে "হর কি প্যারি"র ঘাটের সিঁড়িতে গিয়ে বসল। সারাটা দিন অভুক্ত অবস্থায় তার কেটে গেল ওই ঘাটে, সে খেয়াল করল উল্টোদিকের তটে গঙ্গার অপর পাড়ে রক্তাম্বর পরিহিত এক সন্ন্যাসী বসে আছেন সকাল থেকে, তাঁর চিমটে, ত্রিশূল আর ঝোলাটা পাশেই নামানো রয়েছে আর তিনি নিমীলিত নেত্রে ধ্যান মগ্ন। দুপুরের দিকে সে আস্তে আস্তে উঠে গঙ্গার অন্য তীরে গিয়ে দাঁড়াল পায়ে পায়ে, মন তার খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে কাল রাত্রের ঘটনায়। তারপরে সে চলতে আরম্ভ করল উদ্দেশ্যহীন ভাবে। সেই রক্তাম্বর পরিহিত সন্ন্যাসীর পাশ দিয়ে একটু এগিয়ে যাবার পরে সে শুনল কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। সে কিছুটা বিস্মিত হলেও এগোতে যাবে এমন সময় সে শুনল কেউ বলছে, "এ বাঙালি ভূত,তেরা নানা বহুত ভারি খোঁজ লাগায়া রে তেরে লিয়ে। কাল রাত কয়সা সাধুসঙ্গ হুয়া রে তেরা"? কমল খুবই অবাক হয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে দেখে সেই রক্তাম্বর পরিহিত সন্ন্যাসী উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে মৃদু মৃদু হাসছেন আর হাত নেড়ে তাকে কাছে ডাকছেন। সে কাছে যেতে তিনি আবার তাকে ওই একই কথাগুলো বললেন, বলে বললেন, "মুঝে আজহি তুরন্ত ইঁহা আনা পড়া তেরে লিয়ে, তু চল মেরে সাথ"। এই বলে এগিয়ে এসে ছোট্ট কমলের হাতটা ধরলেন, কমল অবাক হয়ে দেখল সন্ন্যাসী প্রায় সাত ফুট লম্বা, কৃষ্ণবর্ণ, শ্বশ্রুগুম্ফ সম্বলিত প্রশান্ত মুখমন্ডল। কমলের মনে তখন তোলপাড় চলছে তার দাদামশাই তার খোঁজ করছেন এবং তার মা চিন্তিত হয়েছেন সেই সংবাদটি জেনে, আর এই সন্ন্যাসী তার নাম, তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া গতকাল রাত্রের ঘটনা কিভাবে জানলেন এইসব চিন্তায় সে স্তম্ভিত। সে তো কাউকে কিছুই বলেনি এই বিষয়ে। সন্ন্যাসী তার করতলটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করেছেন গঙ্গার তটরেখা ধরে ততক্ষনে। হাঁটতে হাঁটতে দিনের আলোর শেষ রেশটুকু যখন মুছে যাচ্ছে সন্ন্যাসী ঋষিকেশের কাছে এক জায়গায় থামলেন, থেমে তাঁর ঝোলা থেকে তাঁকে গরম পুরি তরকারি খেতে দিলেন। সে ক্ষুধার্ত আর ক্লান্ত ছিল, তায় পরপর তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার অভিঘাতে বিমূঢ় ছিল,খেয়ে নেবার পরে সে গঙ্গার ঘাটেই ঘুমিয়ে পড়ল সন্ন্যাসীর আসনের পাশে। পরেরদিন দিন ঘুম ভাঙার পরে আবার চলতে শুরু করল তারা, তৃতীয় দিনে তারা গিয়ে পৌঁছল বদ্রীনারায়ানের নিকটবর্তী ব্যাসপীঠে, যেখানে এই সন্ন্যাসীর ডেরা। সন্ন্যাসীর ডেরাতে পৌঁছে কমল দেখল আরো কয়েকজন রয়েছে সেখানে আর জানতে পারল সন্ন্যাসী হলেন জীবন্মুক্ত নিত্যসিদ্ধ হঠযোগে ও লয়যোগে সিদ্ধযোগী ব্রহ্মানন্দ পরমহংস, যাঁকে সবাই যোগীবাবা বলে সম্বোধন করে।


ব্যাসপীঠে আসার কিছুদিনের মধ্যে যোগীবাবা কমলকে দীক্ষা দিলেন এবং সাধনার বিভিন্ন পদ্ধতি রপ্ত করাতে শুরু করলেন। আশ্রমের রোজের কাজকর্মের দায়িত্ব যেমন রান্না, দূরের পাহাড়ে গিয়ে কাঠ সংগ্রহ করা, জল আনা ইত্যাদি কাজ অন্যসব গুরুভাইদের সঙ্গে সঙ্গে কমলের ওপরেও ন্যস্ত ছিল। কমল খুব দ্রুত তার সাধনার স্তর গুলি অতিক্রম করতে লাগল। হিমালয়ের ব্যাসপীঠের ধ্যানগম্ভীর পরিবেশ, নীলকণ্ঠ পর্বতের তুষারধবল শৃঙ্গ, পারিপার্শ্বিকের অটল নৈঃশব্দ আর সর্বোপরি সদ্গুরু যোগীবাবার নিয়ত সান্নিধ্য ও পথপ্রদর্শন কমলকে অচিরেই এক মহাজীবন আস্বাদনের যাত্রী করে তুলল। দেখতে দেখতে চোদ্দ বছর অতিক্রান্ত হল তার ব্যাসপীঠে, এই চোদ্দ বছরে কমল অনুভব করল যে যোগীবাবা যেন তার একাধারে মাতা, পিতা, সখা, গুরু এবং তার ইহকাল পরকালের একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছেন। টানা চোদ্দ বছর সাধনা করে কমল সিদ্ধিলাভ করল, এখন তার নাম হল শ্রীকেবলানন্দ পরমহংস। যোগীবাবা তার সাধনা কালীন সময়ে বিভিন্ন রকম ভাবে পরীক্ষা নিয়ে দেখে নিয়েছিলেন তার আধারটি সাধনার জন্য কতখানি উপযুক্ত এবং সে কতটা গুরুগতপ্রাণ।


এবার যোগীবাবা কমলকে পাঠালেন পরিব্রাজনায়, তার আগে অবশ্য কমলকে যোগীবাবা পাঠিয়েছিলেন তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। মা ভীষণ অসুস্থ ছিলেন তখন, ছেলেকে ফিরে পেয়ে তিনি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলেন। যে অঙ্ক পরীক্ষা খারাপ হয়েছে মনে করে কমল গৃহত্যাগ করেছিল, দেখা গেল সেই অঙ্কতে কমল লেটার নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করেছে। কিন্তু আশুতোষ কলেজে ভর্তি হয়ে কিছুদিন ক্লাস করার পরে কমল যোগীবাবার নির্দেশে বেরিয়ে পড়ে পরিব্রাজনে এবং সমগ্র ভারতবর্ষ সে এইভাবে তিনবার ভ্রমণ করে। কয়েকবছর পরে কমলের ক্রিয়াযোগে দীক্ষা হয়, সে আত্মদর্শন করে নিজের সৎচিদানন্দময় আত্মার দর্শন লাভ করে, নিজের স্বরূপ জেনে আরো কিছুবছর সাধন করে সিদ্ধি লাভ করে আপ্তকাম হয়। এরপরে সে তান্ত্রিক দীক্ষা নিয়ে তন্ত্র সাধনা করে কালের নিয়ন্রণকারী মা কালীর দর্শন ও বরদানে ধন্য হয়। এইভাবে এক সাধারণ ঘরের সাধারণ ছেলে কমলের জীবন থেকে মহাজীবনের পথে ঘটে উত্তরণ। সে আমৃত্যু লোকহিতের ব্রত নিয়ে লোককল্যাণের নিমিত্ত নিজের জীবন উৎসর্গ করে। সাধারণ গৃহস্থ ঘরের ছেলে কমল হয়ে ওঠে মহাত্মা কেবলানন্দ পরমহংস যে হয়ে ওঠে বহু অনাথ, আতুর, জিজ্ঞাসু ও মুমুক্ষুর আশ্রয়স্থল।