বহুরূপে ঈশ্বর কলমে #পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়
তিব্বতের প্রত্যন্ত অঞ্চল ছেড়ে মধ্য রাত্রির অন্ধকার ভেদ করে ছুটে চলেছেন সন্ন্যাসী। স্বয়ং মা তারা দর্শন দিয়ে ভর্ৎসনা করে তাঁকে অবিলম্বে চলে যেতে বলেছেন তিব্বত, যা সেই সময় মহাচীন বলে খ্যাত ছিল,…
কলমে #পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়
@কপিরাইট সংরক্ষিত
সময়টা পঞ্চাশের দশকের। সদ্য ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। চোদ্দ বছরের ছেলে কমলের ম্যাট্রিক পরীক্ষা খুব একটা ভালো হয়নি, ওর ধারণা ও অঙ্কে পাশ করবে না। পিতৃহারা কমল মানুষ হয়েছে তার মামারবাড়িতে, মা আর দাদামশাইয়ের তত্ত্বাবধানে। মা অতিশয় ভক্তিমতী মহিলা। কমল মা অন্তপ্রাণ। মায়ের ইচ্ছে কমল এমন এক মানুষ তৈরী হোক যে থাকবে রাতের অন্ধকার আকাশে তারার মতো দেদীপ্যমান। তাই পরীক্ষা ভালো না হওয়াতে কমল খুব মুষড়ে পড়েছে মনে মনে। থাকে সে হাওড়ায়, দোলাচলে সে ঠিক করতে পারছে না কি করবে।
ঠিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগে আগে একদিন কমল অনেকক্ষন গঙ্গার ঘাটে পা ঝুলিয়ে বসে রইল। তারপরে সন্ধ্যা সমাগত দেখে গিয়ে ঢুকল হাওড়া স্টেশনে আর চড়ে বসল বেনারসগামী একটি ট্রেনে। যথাসময়ে ট্রেন ছাড়ল এবং ছুটে চলল রাতের অন্ধকারের বুক চিরে। কমলের পরনে হাফপ্যান্ট আর জামা, পকেটে আছে পনেরটি টাকা। আর কিছু নেই তার সঙ্গে, একেবারে একবস্ত্রে সে বাড়ি ছেড়েছে। সময় মতন ট্রেনে টিকিট চেকার উঠলেন, সকলের টিকিটও দেখলেন, কিন্তু কমলকে যেন দেখতেই পেলেন না, চলে গেলেন অন্য দিকে। কমল খুব অবাক হল বটে আবার নিশ্চিন্তও হল, স্বস্তিতে সেও ঘুমিয়ে পড়ল। বেশ কিছুক্ষন বাদে যখন তার ঘুম ভাঙল তখন এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। ট্রেন তখন বেনারসে ঢুকছে, সে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল।হেঁটে হেঁটে একে ওকে জিজ্ঞাসা করে গঙ্গার পাড়ে এসে দাঁড়াল, পতিতপাবনী পুণ্যতোয়া গঙ্গার পবিত্র শীতল ধারা নিয়ে মাথায় দিল সে, তারপরে নামল ঠান্ডা জলে স্নান করতে। শীতল জলধারায় স্নান কমলের যাত্রার ক্লান্তি অপনোদন করে দিল।স্নান করতে করতে তার কানে এল ঘাটের কিছু লোকজন আলোচনা করছে এক আশ্রমের ভান্ডারার। সেখানে নাকি আশ্রয় চাইলে আশ্রয়ও পাওয়া যাবে। কমল খুঁজে খুঁজে গিয়ে হাজির হল সেই আশ্রমে, দেখল লোকে লাইন দিয়ে খাবার নিচ্ছে, সেও নিল। সেই সময় সে লক্ষ্য করল একজন বেশ মাতব্বর গোছের লোক অনেকের সঙ্গেই কথা বলে তাদের থাকার জায়গা নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে আর একজন পালোয়ানের মত চেহারার লোক খেতে দিচ্ছে। পালোয়ানের মত লোকটির কাছে গিয়ে কমল খাবার নিয়ে খেয়ে উঠে গিয়ে সেই মাতব্বর গোছের লোকটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো আশ্রয় প্রার্থী হয়ে, আশ্রয় মিলে গেল। দু' তিন দিন নির্ভাবনায় কেটেও গেল, তারপর একদিন রাত্রে খেয়ে দেয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছে, হঠাৎ একটা দম আটকানো অনুভূতি হতে তার ঘুম ভেঙে যেতে সে দেখল যে পালোয়ানের মত লোকটি তার বুকের ওপরে উঠে বসেছে তার গলাটা টিপে ধরে আর সেই মাতব্বর লোকটি তাকে পুলিশের চর মনে করে শাসাচ্ছে যে সে নাকি ওদের আশ্রমের খবর পুলিশকে দেবে বলে এখানে ঘাঁটি গেঁড়েছে, সে যেন পরেরদিন ভোর হবার সাথে সাথে বেনারস ছাড়ে, না হলে আর বেঁচে ফিরবে না সে। প্যান্টের ভিতরের পকেটে তার বারোটা টাকা ছিল, সেটাও ওরা বের করে নিয়েছে। এতো সত্যি সত্যি "শিবঠাকুরের আপন দেশে নিয়ম কানুন সব্বোনেশে হয়ে গেল ব্যাপার"।
কমল খুবই হতোদ্যম হয়ে সেই আশ্রম ছাড়ল, আবার সে উঠে বসল হরিদ্বারগামী একটি ট্রেনে আর পরেরদিন যখন হরিদ্বারের কাছে ট্রেন, তখন কমল ট্রেনে বসে দেখল দূরে আবছা হিমালয়ের পর্বতশ্রেণীর আভাস দেখতে পাচ্ছে সে। সে আশে পাশের লোকজনের কথা শুনে বুঝল ট্রেন হরিদ্বারে ঢুকছে। ট্রেন হরিদ্বারে থামল, সে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল ক্রমে অপসৃয়মান ট্রেনটার দিকে, তারপরে সে বাইরে এলো।
বাইরে এসে সে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে উপস্থিত হল গঙ্গার ধারে। গঙ্গাতটে দাঁড়িয়ে আশে পাশের প্রাকৃতিক শোভায় তার মন ভরে গেল, মনসা পাহাড়ের মাথায় মনসা মন্দির, চণ্ডী পাহাড়ের চণ্ডী মন্দির, অদূরে হিমালয়ের শৈল শিখর আর মহাদেবের জটা থেকে নিঃসৃত পতিতোদ্ধারিনী গঙ্গার স্বতঃ প্রবাহিত শীতল পবিত্রধারা মিলে হরিদ্বার সত্যই দেবতাত্মার প্রবেশদ্বার। তারপরে হাঁটতে হাঁটতে "হর কি প্যারি"র ঘাটের সিঁড়িতে গিয়ে বসল। সারাটা দিন অভুক্ত অবস্থায় তার কেটে গেল ওই ঘাটে, সে খেয়াল করল উল্টোদিকের তটে গঙ্গার অপর পাড়ে রক্তাম্বর পরিহিত এক সন্ন্যাসী বসে আছেন সকাল থেকে, তাঁর চিমটে, ত্রিশূল আর ঝোলাটা পাশেই নামানো রয়েছে আর তিনি নিমীলিত নেত্রে ধ্যান মগ্ন। দুপুরের দিকে সে আস্তে আস্তে উঠে গঙ্গার অন্য তীরে গিয়ে দাঁড়াল পায়ে পায়ে, মন তার খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে কাল রাত্রের ঘটনায়। তারপরে সে চলতে আরম্ভ করল উদ্দেশ্যহীন ভাবে। সেই রক্তাম্বর পরিহিত সন্ন্যাসীর পাশ দিয়ে একটু এগিয়ে যাবার পরে সে শুনল কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। সে কিছুটা বিস্মিত হলেও এগোতে যাবে এমন সময় সে শুনল কেউ বলছে, "এ বাঙালি ভূত,তেরা নানা বহুত ভারি খোঁজ লাগায়া রে তেরে লিয়ে। কাল রাত কয়সা সাধুসঙ্গ হুয়া রে তেরা"? কমল খুবই অবাক হয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে দেখে সেই রক্তাম্বর পরিহিত সন্ন্যাসী উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে মৃদু মৃদু হাসছেন আর হাত নেড়ে তাকে কাছে ডাকছেন। সে কাছে যেতে তিনি আবার তাকে ওই একই কথাগুলো বললেন, বলে বললেন, "মুঝে আজহি তুরন্ত ইঁহা আনা পড়া তেরে লিয়ে, তু চল মেরে সাথ"। এই বলে এগিয়ে এসে ছোট্ট কমলের হাতটা ধরলেন, কমল অবাক হয়ে দেখল সন্ন্যাসী প্রায় সাত ফুট লম্বা, কৃষ্ণবর্ণ, শ্বশ্রুগুম্ফ সম্বলিত প্রশান্ত মুখমন্ডল। কমলের মনে তখন তোলপাড় চলছে তার দাদামশাই তার খোঁজ করছেন এবং তার মা চিন্তিত হয়েছেন সেই সংবাদটি জেনে, আর এই সন্ন্যাসী তার নাম, তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া গতকাল রাত্রের ঘটনা কিভাবে জানলেন এইসব চিন্তায় সে স্তম্ভিত। সে তো কাউকে কিছুই বলেনি এই বিষয়ে। সন্ন্যাসী তার করতলটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করেছেন গঙ্গার তটরেখা ধরে ততক্ষনে। হাঁটতে হাঁটতে দিনের আলোর শেষ রেশটুকু যখন মুছে যাচ্ছে সন্ন্যাসী ঋষিকেশের কাছে এক জায়গায় থামলেন, থেমে তাঁর ঝোলা থেকে তাঁকে গরম পুরি তরকারি খেতে দিলেন। সে ক্ষুধার্ত আর ক্লান্ত ছিল, তায় পরপর তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার অভিঘাতে বিমূঢ় ছিল,খেয়ে নেবার পরে সে গঙ্গার ঘাটেই ঘুমিয়ে পড়ল সন্ন্যাসীর আসনের পাশে। পরেরদিন দিন ঘুম ভাঙার পরে আবার চলতে শুরু করল তারা, তৃতীয় দিনে তারা গিয়ে পৌঁছল বদ্রীনারায়ানের নিকটবর্তী ব্যাসপীঠে, যেখানে এই সন্ন্যাসীর ডেরা। সন্ন্যাসীর ডেরাতে পৌঁছে কমল দেখল আরো কয়েকজন রয়েছে সেখানে আর জানতে পারল সন্ন্যাসী হলেন জীবন্মুক্ত নিত্যসিদ্ধ হঠযোগে ও লয়যোগে সিদ্ধযোগী ব্রহ্মানন্দ পরমহংস, যাঁকে সবাই যোগীবাবা বলে সম্বোধন করে।
ব্যাসপীঠে আসার কিছুদিনের মধ্যে যোগীবাবা কমলকে দীক্ষা দিলেন এবং সাধনার বিভিন্ন পদ্ধতি রপ্ত করাতে শুরু করলেন। আশ্রমের রোজের কাজকর্মের দায়িত্ব যেমন রান্না, দূরের পাহাড়ে গিয়ে কাঠ সংগ্রহ করা, জল আনা ইত্যাদি কাজ অন্যসব গুরুভাইদের সঙ্গে সঙ্গে কমলের ওপরেও ন্যস্ত ছিল। কমল খুব দ্রুত তার সাধনার স্তর গুলি অতিক্রম করতে লাগল। হিমালয়ের ব্যাসপীঠের ধ্যানগম্ভীর পরিবেশ, নীলকণ্ঠ পর্বতের তুষারধবল শৃঙ্গ, পারিপার্শ্বিকের অটল নৈঃশব্দ আর সর্বোপরি সদ্গুরু যোগীবাবার নিয়ত সান্নিধ্য ও পথপ্রদর্শন কমলকে অচিরেই এক মহাজীবন আস্বাদনের যাত্রী করে তুলল। দেখতে দেখতে চোদ্দ বছর অতিক্রান্ত হল তার ব্যাসপীঠে, এই চোদ্দ বছরে কমল অনুভব করল যে যোগীবাবা যেন তার একাধারে মাতা, পিতা, সখা, গুরু এবং তার ইহকাল পরকালের একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছেন। টানা চোদ্দ বছর সাধনা করে কমল সিদ্ধিলাভ করল, এখন তার নাম হল শ্রীকেবলানন্দ পরমহংস। যোগীবাবা তার সাধনা কালীন সময়ে বিভিন্ন রকম ভাবে পরীক্ষা নিয়ে দেখে নিয়েছিলেন তার আধারটি সাধনার জন্য কতখানি উপযুক্ত এবং সে কতটা গুরুগতপ্রাণ।
এবার যোগীবাবা কমলকে পাঠালেন পরিব্রাজনায়, তার আগে অবশ্য কমলকে যোগীবাবা পাঠিয়েছিলেন তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। মা ভীষণ অসুস্থ ছিলেন তখন, ছেলেকে ফিরে পেয়ে তিনি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলেন। যে অঙ্ক পরীক্ষা খারাপ হয়েছে মনে করে কমল গৃহত্যাগ করেছিল, দেখা গেল সেই অঙ্কতে কমল লেটার নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করেছে। কিন্তু আশুতোষ কলেজে ভর্তি হয়ে কিছুদিন ক্লাস করার পরে কমল যোগীবাবার নির্দেশে বেরিয়ে পড়ে পরিব্রাজনে এবং সমগ্র ভারতবর্ষ সে এইভাবে তিনবার ভ্রমণ করে। কয়েকবছর পরে কমলের ক্রিয়াযোগে দীক্ষা হয়, সে আত্মদর্শন করে নিজের সৎচিদানন্দময় আত্মার দর্শন লাভ করে, নিজের স্বরূপ জেনে আরো কিছুবছর সাধন করে সিদ্ধি লাভ করে আপ্তকাম হয়। এরপরে সে তান্ত্রিক দীক্ষা নিয়ে তন্ত্র সাধনা করে কালের নিয়ন্রণকারী মা কালীর দর্শন ও বরদানে ধন্য হয়। এইভাবে এক সাধারণ ঘরের সাধারণ ছেলে কমলের জীবন থেকে মহাজীবনের পথে ঘটে উত্তরণ। সে আমৃত্যু লোকহিতের ব্রত নিয়ে লোককল্যাণের নিমিত্ত নিজের জীবন উৎসর্গ করে। সাধারণ গৃহস্থ ঘরের ছেলে কমল হয়ে ওঠে মহাত্মা কেবলানন্দ পরমহংস যে হয়ে ওঠে বহু অনাথ, আতুর, জিজ্ঞাসু ও মুমুক্ষুর আশ্রয়স্থল।