শক্তিরূপেণ29/10/20
তখন সদ্য গ্রাজুয়েট হয়েছি। কর্মক্ষেত্র, এমপ্লয়মেন্ট নিউজ, খবরের কাগজ দেখে বিভিন্ন ব্যাংক, এসএসসি, পিএসসি, রেলে চাকরির পরীক্ষার জন্য দরখাস্ত করছি, মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছি পরীক্ষা দিতে বাপির সঙ্গে। বেশিরভ…
শক্তিরূপেণ
29/10/20
তখন সদ্য গ্রাজুয়েট হয়েছি। কর্মক্ষেত্র, এমপ্লয়মেন্ট নিউজ, খবরের কাগজ দেখে বিভিন্ন ব্যাংক, এসএসসি, পিএসসি, রেলে চাকরির পরীক্ষার জন্য দরখাস্ত করছি, মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছি পরীক্ষা দিতে বাপির সঙ্গে। বেশিরভাগ পরীক্ষার সিট পড়ে কলকাতায়, দুর্গাপুর থেকে এসে পরীক্ষা দিয়ে আবার সেদিনই ফিরতে হবে, কারণ পরেরদিন বাবার অফিস আছে আর আমার ছাত্র পড়ানো আছে। এরকমই একটা ব্যাংকের পরীক্ষার সিট পড়ল বেহালাতে।
সকাল দশটা থেকে পরীক্ষা, এদিকে বাড়িতে বোনের জ্বর আর মায়ের খুব শরীর খারাপ, অথচ পরীক্ষাটা দেওয়াও জরুরি, তাই ঠিক হল আমি আর বাপি বিধান এক্সপ্রেসে আসব, এসে পরীক্ষা দিয়ে ময়ূরাক্ষী প্যাসেঞ্জার ধরে ফিরব। পরীক্ষার দিনটা রোববার, সাধারণতঃ তাই হয়। আমরা ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঠিক সময়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে গেলাম, ট্রেনে টোস্ট ওমলেট দিয়ে বাপি, আমি দুজনেই ব্রেকফাস্ট করেছি। বাপির সেদিন বুকে একটা ব্যথা হচ্ছে, আমি পরীক্ষা দিতে ঢোকার আগে বাপিকে বলে ঢুকলাম কোনো একটা জায়গায় চুপচাপ বসে বিশ্রাম নিতে। তিন ঘন্টার পরীক্ষার পরে বাইরে বেরিয়ে দুজনেই কিছু খেলাম। তারপরে সাড়ে তিনটে চারটে নাগাদ বাস ধরে পৌঁছলাম হাওড়া। তখন বর্ষাকাল, স্টেশনের বাইরে রজনীগন্ধার গুচ্ছ বিক্রি হচ্ছিল, চার ডজন কিনে ফেললাম। অন্যসময় হলে কিনতাম না, কারণ হাতে লাগেজ থাকত, এবারে যেহেতু কোনো লাগেজ নেই, তাই কিনলাম। বাপিকে জিজ্ঞেস করলাম যে শরীর কেমন, বললেন বুকের পেনটা রয়েছে।
এবারে ট্রেনে উঠব, ট্রেন প্লাটফর্মে দেবার পরে দেখি সব জেনারেল কম্পার্টমেন্টের সিট এমাথা থেকে ওমাথা দুদিকের জানলায় সুতো দিয়ে বাঁধা, কোনো জায়গায় প্রতিটা সিটে একটা করে দেশলাই কাঠি ফেলে রাখা, লোকজন তেমন তখনো নেই। আমি এইরকম দুটো দেশলাই কাঠি সরিয়ে আগে একটায় বাপিকে বসালাম প্যাসেজের পাশে, আর একটায় নিজে বসলাম, সেটাও প্যাসেজের পাশের সিট। আমাদের পরের কামরাটা ছিল লেডিস কম্পার্টমেন্ট।
ট্রেন ছাড়ার আধঘন্টা আগে সেসব লোকজন হাজির হল যারা দেশলাই কাঠি ফেলে হাওয়া খেতে গেছিল, এসেই সিটের দাবি নিয়ে হুজ্জুতি শুরু করল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে একজনকে জায়গা ছেড়ে দিলাম, কিন্তু ওরা বাপীকে বসতে দেবে না, বরং আমি বসলে ওরা জায়গা ছাড়বে, অল্পবয়সি তরুণী তো!! আমি মোলায়েম ভাবে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে বাপির শরীর খারাপ, কিন্তু তারা শুনলে তো!!! একজন চট করে গিয়ে ট্রেনের গার্ডসাহেবকে ডেকে আনল, সেই গার্ড ভদ্রলোক আবার ভীতু মানুষ, আমাকে বললেন, "দেখুন দিদিভাই, ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি, ডেলি প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে লাগলে কি থেকে কি হবে কে জানে!!!!😲😲😲 আপনি ওদের সাথে মিটিয়ে নিন"। বলে তিনি প্রস্থানোদ্যত হলেন। আমিও নিরুপায়, বাপিকে না বসালে আরো যদি বাপির শরীরের অবস্থা খারাপ হয়? আমি গার্ডের কোটের কলার পেছন থেকে ধরে আটকালাম, এবারে ভদ্রলোক কেঁদেই ফেললেন। হাতজোড় করে বারবার তাঁর অপারগতা বলতে লাগলেন আমাকে, আমি ছেড়ে দিলাম ভদ্রলোককে। এদিকে ডেলি প্যাসেঞ্জাররা মজা পেয়েছে, নানা কুরুচিকর মন্তব্য করতে লাগল।আমি শেষে ওদেরকে বললাম, "আপনারা তো আমাকে বসতে দিচ্ছিলেন, আমি লেডিস কামরায় যাচ্ছি, আমার জায়গাতে বাপিকে বসতে দিন "। এবারে ওরা বাপিকে বসতে দিল কিন্তু আমাকে নামতে দেবে না।
দরজা থেকে প্যাসেজটা পুরো আটকে রেখে নানারকম উল্টো পাল্টা কথা বলে যাচ্ছে, একজন হঠাৎ বলল, "নামতে দেব না আপনাকে, যা করার আছে করে নিন ”। বহুক্ষণ ধরে ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছিলাম, আর হল না। হাতে রাজনীগন্ধার গোছাটা ছিল, সেটাই ধরে এলোপাথাড়ি চালাতে চালাতে এগোলাম দরজার দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে ওরা হকচকিয়ে গেল, তারপরে কার গায়ে ওই রজনীগন্ধার গোছার বাড়ি পড়ে ভেবে মুহূর্তে প্যাসেজটা খালি হয়ে গেল। এদিকে ট্রেন ছাড়বার সময় হয়ে গেছে, আমি বাপিকে বসে থাকতে বলে ধীরে সুস্থে নেমে পাশের লেডিসে উঠে পড়লাম, জায়গাও পেয়ে গেলাম।
বর্ধমানে যখন ট্রেন দাঁড়ালো দেখি সেই ডেলি প্যাসেঞ্জারের দল আমাকে প্লাটফর্মে নেমে হাতজোড় করে বলছে, "বাব্বাঃ মেয়ে তো নয়, একেবারে শক্তিরূপেণ "!!! দূর্গাপুরে ট্রেন থেকে নেমে বাপি বলল, " জানিস ওরা আমাকে কি বলেছে? বলেছে বাবা কি মেয়েই মানুষ করেছেন, একেবারেই সিংহের পিঠে সওয়ার সিংহবাহিনী, তার আবার সিংহটাও লাগে না।" আর সেই গার্ডসাহেব দুর্গাপুর স্টেশনে নেমে এসে নিজের অকর্মণ্যতা স্বীকার করে আমাকে আন্তরিক অভিনন্দন আর শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছিলেন, "মা, আমি অন্যায় জেনেও প্রতিবাদ করতে পারিনি ওদের আচরণের, আমার ব্যক্তি স্বার্থ বাঁচাতে। কিন্তু আমারও ঘরে মেয়ে আছে, আমি তাকে আপনার মতো করে গড়ে তুলব"। বাসে ফিরতে ফিরতে মনে পড়ল রবি ঠাকুরের দুটো লাইন,
"ক্ষমা যেথা হীন দুর্বলতা,
হে রূদ্র নিষ্ঠুর যেন হতে পারি সেথা "।
এই ঘটনা আমি একটুও লিখতে ইচ্ছুক ছিলাম না, কারণ তাতে নিজের ঢাক নিজে পেটানো হবে, আমার সহোদরা এবং আত্মজার জোরাজুরিতে লিখলাম। কারুর খারাপ লাগলে বা অজ্ঞাতে কারুর অনুভূতিকে আঘাত দিয়ে থাকলে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করে রাখছি তাই।
পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে
**********************-**