Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

পুজোর অন্য কথা - জগজ্জননীর চোখেও বিষাদের ছায়া

জগজ্জননীর চোখেও বিষাদের ছায়া!মোশারফ হোসেন বুধবার সন্ধ্যায় স্বাভাবিক ছন্দে হেঁটে যাচ্ছিলাম। গন্তব্য পাড়ার দুর্গাপুজার মণ্ডপ। স্ট্রিট লাইটগুলো জ্বলছে। রোজের মতোই। কিন্তু আমার কাছে ঠিক স্বাভাবিক লাগছে না। কারণ, আমি ভুলে যাইনি পাঁজি-প…

 


জগজ্জননীর চোখেও বিষাদের ছায়া!

মোশারফ হোসেন

বুধবার সন্ধ্যায় স্বাভাবিক ছন্দে হেঁটে যাচ্ছিলাম। গন্তব্য পাড়ার দুর্গাপুজার মণ্ডপ। স্ট্রিট লাইটগুলো জ্বলছে। রোজের মতোই। কিন্তু আমার কাছে ঠিক স্বাভাবিক লাগছে না। কারণ, আমি ভুলে যাইনি পাঁজি-পুঁথির বিচারে আজকের সন্ধ্যাটা সারা বছরের বাকি সন্ধ্যাগুলো থেকে আলাদা। সেই আলাদা পরিচিতির কারণেই আজ সন্ধ্যার রূপটা অনেকটাই আলাদা হওয়ার কথা। কারণ, আজ মহাপঞ্চমী। বছরের বারোটা বাংলা মাসেই দু’টো করে পঞ্চমী আসে। একটা শুক্লপক্ষে, অন্যটা কৃষ্ণপক্ষে। কিন্তু গোটা বছরে মহাপঞ্চমী একটাই। দেবীপক্ষের পঞ্চমী। অন্যান্য বছরগুলিতে সন্ধ্যার এই সময়টা আমার পাড়া তো বটেই, গোটা কলকাতা মহানগরীকে আলোর বন্যায় ভেসে যেতে দেখতে অভ্যস্ত। তৃতীয় চতুর্থীর সন্ধ্যা থেকেই আলোর ছটায় যেন আত্মহারা হয়ে ওঠে তিলোত্তমা। তার দৈনন্দিন আটপৌরে রূপ আড়ালে চলে যায়। কোথা থেকে যেন আবির্ভূত হয় চোখ ধাঁধানো, মন ভোলানো এক রূপসী কলকাতা। সর্বাঙ্গ থেকে রূপের জৌলুস বিকিরিত হতে থাকে। চোখ ফেরানো দায় হয়। 

সেই রূপসীর টানেই শহর ছাড়িয়ে শহরতলি, আরও আরও দূর থেকে হাজারে হাজারে, লাখে লাখে আনন্দপিপাসু নারী পুরুষ, কিশোর কিশোরী, বালক বালিকা, এমনকী প্রবীণ প্রবীণারাও হাজির হয়ে যান কলকাতায়। রাজ্য-রাজধানীর রাজপথ ধরে হাঁটতে থাকেন। এক এলাকা থেকে আর এলাকা। শরতের দুপুরের সূর্য বিকেলের দিকে ঢলে পড়তে না পড়তেই গণ্ডা গণ্ডা, ডজন ডজন, এমনকী বলা যায় দিস্তা দিস্তা ট্রেন হাওড়া আর শিয়ালদহ স্টেশনে উগরে দিতে থাকে হাজারে হাজারে দর্শনার্থীকে। খানিক আগেও যারা ছিলেন ট্রেনের যাত্রী, খানিক বাদেই তাঁরা হয়ে যান জীবন্ত জনস্রোতের এক একটি অংশ। সেই চলমান জনস্রোতের গতি বিভিন্নমুখি। নতুন পোশাকের গন্ধ মাখানো, হাজার হাজার পাখির কিচির মিচিরকে মানানো হাজার কণ্ঠের কলতানভরা সেই জনস্রোতের কোনও অংশ ছুটে চলে উত্তরে, কেউবা দক্ষিণে। মধ্যটা প্রায় সবারই কমন। হেঁটে হেঁটে পায়ে ফোস্কা পড়লেও ক্লান্তি নেই। হাতে এই তো মাত্র কয়েকটা সন্ধ্যা থেকে ভোর। এই মধ্যেই পুজোর কলকাতার যতটা বেশি সম্ভব এলাকা ছুঁয়ে ফেলা চাই-ই চাই। যত নামী মণ্ডপের নাম টিভির পর্দায় ভেসে ওঠে, ফুটে ওঠে খবরের কাগজের পাতায়- পারলে সব ক’টিই দেখা চাই। এত সুন্দর মণ্ডপ, এই বিপুল আলোকসজ্জা, এমন চোখ টানা, মনকে আপ্লুত করে তোলা নানা আঙ্গিকের দশভূজা ত্রিনয়নী দর্শনের সুযোগ বছরে আর তো আসে না! সেকারণেই এমন আকাশছোঁয়া আগ্রহ, বাঁধন না মানা উৎসাহ। এই আগ্রহ আর উৎসাহই পথশ্রমের দৈহিক ক্লান্তিকে মনে আঁচড় কাটতে দেয় না। 

গত অনেকগুলো বছর ধরেই এমনই কলকাতাকে দেখে আসতে অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু এবারের মহাপঞ্চমীর কলকাতা যেন আর এক শহরের রূপ নিয়েছে। একবার মনে হয় চিনি, আবার যেন চিনি না। আনন্দ থাকলেও উচ্ছ্বাস নেই। আলো থাকলেও ছটা নেই। কারণ, বাড়তি এবং বিশেষ আলোকসজ্জার ব্যবস্থা এবার হয়নি বললেই চলে। কেবল মরুভূমির মাঝে মাঝে চেনা মরুদ্যানের মতোই শহরের নির্দিষ্ট জায়গাগুলিতে এবারও পুজো প্যাণ্ডেল মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দেখে মনে হয়, তা যেন নিয়মরক্ষার কারণেই। আকারে, আয়তনে, সজ্জায় গত বছরের সঙ্গে তুলনা করা কঠিন। সেখানে প্রাণের উল্লাস কোথায়! শে বিচারে বলি, এ আমার চেনা মহাপঞ্চমীর চেনা কলকাতা নয়।

পাড়ার মণ্ডপে যাচ্ছি। এবার আমরাও নিয়মরক্ষার পুজোই করব। এটা আমাদের ২৩ তম দুর্গোৎসব। শুরু করেছিলাম ১৯৯৮ সালে। তখন ছিলাম হাতে গোণা মাত্র ক’জন। পায়ে পায়ে তার বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কলেবরও বেড়েছে। প্রতিবছরই মহাপঞ্চমীর সন্ধ্যায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। এবারও হবে। খানিক বাদেই। তবে এবার একটু অন্যরকমের। এলাকার বাসিন্দা করোনাযোদ্ধা চিকিৎসক, নার্স, সাফাইকর্মী, করোনায় আক্রান্ত হয়েও সুস্থ হয়েছেন এমন করোনাজয়ীদের সংবর্ধনার মাধ্যমেই হবে এবারের পুজো ও শারদোৎসবের উদ্বোধন।  সেই অনুষ্ঠানে হাজির থাকতেই চলেছি। 

অন্যান্য বছর এই সময়টায় পাড়ার প্রতিটি কোণ আলোর বন্যায় ভেসে যায়। মাইক্রোফোনে অধিকাংশ সময় বাজতে থাকে আনন্দসঙ্গীত। দুর্গাপুজো ও শারদোৎসবের উদ্বোধন উপলক্ষে মহাপঞ্চমীর সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। মূলত পাড়ার ছোট্ট ছেলেমেয়েরাই এতে অংশ নেয়। কেউ কচি গলায় গান গায়, আবার সুন্দর নাচের অনুষ্ঠান উপহার দেয়। দিবাকরের ছোট্ট মেয়েটা বসিরের শিশুকন্যার হাত ধরে নাচতে থাকে, রঞ্জিত বিশ্বাসের ছোট মেয়ের বয়স কতই বা হবে! কিন্তু নৃত্যপটীয়সী। গতবার ওরা নৃত্যের মাধ্যমে মহিষাসুরমর্দিনী পরিবেশন করে তাক লাগিয়ে দিল। মুর্শেদ আলির সদ্য কিশোরী কন্যাটি, তারকবাবুর কলেজছাত্রী মেয়ে, বা ওদের মতো আরও অনেকেই তাদের প্রতিভার পরিচয় দেয় বিভিন্ন বছরের এই দিনের অনুষ্ঠানে। সংখ্যায় তুলনায় কম হলেও ছোট ছোট ছেলেরাও থাকে। দর্শকের আসনে বসে আমরা মুগ্ধ হই। ওরা আমাদেরই সন্তান বলে হয়ত খানিক আত্মশ্লাঘাও অনুভব করি। 

ভাবতে ভাবতে কখন যেন পুজো প্যান্ডেলে পৌঁছে গেলাম। এবার মণ্ডপের অবয়ব অনেকটাই সংক্ষিপ্ত। পরিচিত ঝলমলে সুউচ্চ প্রতিমার জায়গায় তুলনায় এবার ছোট আকারের। ডাকের সাজ। মৃণ্ময়ীর মুখের দিকে তাকালাম। মনে হল আনন্দময়ীও যেন খানিক বিষন্ন। মণ্ডপের অন্য প্রান্তে চোখ চলে গেল। দীর্ঘ একটি লাইন। মহিলারা লাইন দিয়েছেন। তরুণী থেকে প্রবীণা। নানা বয়সের। তাঁদের বেশিরভাগেরই পোশাক মলিন, শীর্ণ দেহ। চোখে-মুখে অনিশ্চয়তা আর বিষন্নতা মাখামাখি হয়ে রয়েছে। বেশ কিছু মুখ চেনা চেনা। অনেকেই এপাড়ারই কোনও না কোনও বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন। ক’মাস আগে কাজ চলে গেছে। করোনার আতঙ্কে বহু পরিবারই বাইরের কাউকে বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দিচ্ছেন না। নিজেদের কাজ নিজেরাই করে নিচ্ছেন। একটু কষ্ট হলেও। তাতে যদি রোগের হানার আশঙ্কা খানিক কম রাখা যায়। লাইনে দাঁড়ানো কিছু মহিলার স্বামী হয়ত লকডাউনের কারণে কাজ হারিয়েছেন, কারও রোজগার কমে গেছে। সাত-আটমাস আগেও তাঁরা ভাবেননি, কোনওদিন পুজো প্যান্ডেলের সামনে লাইনে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। যদি দান হিসেবে একটা শাড়ি পাওয়া যায়!

 ঘাড় ঘুরিয়ে ফের একবার দেবীপ্রতিমার দিকে তাকালাম। মনে হল, সামান্য দানের প্রত্যাশায় অপেক্ষমান জীবন্ত জননীদের অব্যক্ত বিষাদ প্রতিফলিত হয়েছে জগজ্জননীর মুখমণ্ডলে। তাই ত্রিনয়নীকে এমন বিষন্ন লাগছে আমার চোখে।