Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

পুজোর অন‍্য কথা

উজ্জ্বল আদক সাতের দশক -- পুজো তখনও মাস খানেক বাকি। সবে মাঠে বিকেলের খেলা শেষ হয়েছে।গোপালদা হঠাৎই আমাদের তিনজনকে ডেকে বললো, "এ'বছর পুজোয় কলকাতার ঠাকুর দেখতে যাবি ?"
আমরা প্রত‍্যেকেই বিস্মিত। মনে হলো, গোপালদা বোধহয় আমাদ…

 



উজ্জ্বল আদক

সাতের দশক -- 

পুজো তখনও মাস খানেক বাকি। 

সবে মাঠে বিকেলের খেলা শেষ হয়েছে।গোপালদা হঠাৎই আমাদের তিনজনকে ডেকে বললো, "এ'বছর পুজোয় কলকাতার ঠাকুর দেখতে যাবি ?"


আমরা প্রত‍্যেকেই বিস্মিত। মনে হলো, গোপালদা বোধহয় আমাদের চাঁদে নিয়ে যাবে বলছে। 


আমরা তখন ক্লাস এইট -- গোপালদা, ক্লাস ইলেভেন। গোপালদা আমার দাদার বন্ধু, আমাদের গডফাদার।


বাড়িতে ছাড়বে কি, পয়সা পাবো কোথায় .. হাজার প্রশ্ন মাথায় .... তিনজনের কারো মুখে কোনো কথা নেই। আবার গোপালদা বলতে শুরু করলো, "কাউকে বলা যাবে না, কলকাতায় যাচ্ছি ঠাকুর দেখতে। সকাল ন'টা নাগাদ বেরুবো, বিকেল চারটে নাগাদ ফিরবো। বাড়িতে বলবি, হাওড়ার ঠাকুর দেখতে যাবি আমার সাথে। রাস্তায় যা বলবো, আমার সব কথা শুনতে হবে।"


সঙ্ঘশ্রী, সঙ্ঘমিত্র, মুক্তদল ... এইসব স্বপ্নের পুজো দেখবো ভেবেই, আমরা সবাই রাজি হয়ে গেলাম সমস্ত রকম মিথ‍্যে বলার।


সপ্তমীর সকাল। পল্লীর মাঠে সবাই জড়ো হলাম, এ্যডভেঞ্চারের অপেক্ষায় .. বড়রা জিজ্ঞেস করলে, মিথ‍্যে বলার অঙ্গীকার নিয়ে। প্রথমেই বিপদ, পাড়ার এক কাকা জিজ্ঞেস করলেন, "কোথায় যাচ্ছিস তোরা?" গোপালদাই উত্তর দিলো, "আমার সাথে।" বুঝলাম, গোপালদা কোনো রিস্ক নিচ্ছে না। মিথ‍্যে বলার দায়িত্ব প্রথম থেকেই নিজের কাঁধে, যদি আমরা বেফাঁস কিছু বলে ফেলি।


হেঁটে হাওড়া স্টেশন, সেখান থেকে বাসে ভবানীপুর ... গোপালদাই সবার টিকিট কাটলো। আমাদের তিনজনের কার কাছে কত টাকা আছে জানিনা, তবে আমার পকেটে দু'টো আধুলি। তাতে কি হয় জানিনা, যাওয়ার বাসভাড়া কত, ফেরারটাই বা কত, কোনো ধারণাই নেই।


চোখের সামনে মুক্তদলের ঠাকুর, তারপর সঙ্ঘশ্রী, সঙ্ঘমিত্র ...আরো আরো ...পায়ে পায়ে হেঁটে ... বিশ্বাস‌ই হচ্ছে না নিজের চোখকে। 


গোপালদা হঠাৎই বলে উঠলো, "তোদের কার কাছে কত পয়সা আছে দে আমাকে। কি খাবি বল।" বাধ‍্য ছেলের মতো সবাই গোপালদার হাতে, পকেটের সব পয়সা দিয়ে দিলাম। 


ঘুগনী-পাঁউরুটি খাওয়া হলো সবাই মিলে। ভাবতেই পারছি না, কলকাতার ঠাকুর দেখা হলো, তার ওপর ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পেট ভরে খাওয়া। হঠাৎই নিজেকে বেশ হ‍্যায়-ম‍্যায় মনে হতে লাগলো।  


দোকানে পয়সা মেটাবার সময় দেখলাম, গোপালদার মুখটা কেমন যেন গম্ভীর। জিজ্ঞেস করলাম, "গোপালদা, কিছু হয়েছে ?" গম্ভীর উত্তর, "পাকামি করিস না। চুপচাপ থাক।"


মনে পড়ে গেলো গোপালদার দেওয়া শর্ত -- "রাস্তায় যা বলবো, আমার সব কথা শুনতে হবে"।


বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। একটার পর একটা বাস এসে দাঁড়াচ্ছে বাসস্টপে, আবার চলেও যাচ্ছে। কোনো বাসেই উঠতে বলছে না গোপালদা। পাঁচ-ছ'টা বাস চলে যাবার পর বললাম, সব বাসগুলোই তো হাওড়া যাচ্ছে গো, আমরা উঠছি না কেন ?


আবার গম্ভীর ডায়লগ, "চুপচাপ দাঁড়া, আমি যখন বলবো, তখন উঠবি"।


হঠাৎই শুনলাম, গোপালদা এক পথ চলতি ভদ্রলোককে বলছে, "দাদা, দু'টো টাকা দেবেন ? হাওড়া যাব, পয়সা কম পড়ে গেছে।"


এ' বাবা, এ'রকমভাবে অপরিচিত কারো কাছ থেকে পয়সা চাওয়া যায় নাকি ! মনে মনে ভাবলাম। মুখে বলার সাহস নেই, বললেই পাকামি বলে গণ‍্য হবে তো।


ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, "ক'জন আছো ?" চারজন আছি শুনে, বললেন, "দাঁড়াও। বাস আসতে দাও।"


পয়সা দেওয়ার সাথে, বাস আসার কি সম্পর্ক, বুঝতে পারলাম না। 


মিনিট দুয়েকের মধ‍্যে হাওড়ার বাস এসে দাঁড়ালো আমাদের সামনে। উনি আমাদের বললেন, "উঠে পড়ো বাসে"। আমরা তিনজন উঠে পড়ে দেখছি, গোপালদা দাঁড়িয়ে ওনার পাশে। কন্ডাক্টরের দিকে এগিয়ে, পকেট থেকে পয়সা বার করে বললেন,"ভাই, চারটে হাওড়ার টীকিট কেটে পয়সা ফেরত দাও"। আর গোপালদাকে দেখিয়ে বললেন, "টিকিটগুলো এই ছেলেটির হাতে দাও"। ওনার কথা মতো কাজ হলো, কন্ডাক্টর টিকিট গোপালদার হাতে দিয়ে বললো, "উঠে পড়ো"।


তখনকার যুগে, ছোটদের হাতে পয়সা দেওয়াটা অনুচিত মনে করতো সবাই। 


ঠিক না ভুল জানিনা, 

প্রায় পঞ্চাশ বছর পরেও, আজ‌ও, এই ভাবনাটাই বহন করে চলেছি আমি।