দেশমানুষ-এর জন্যে একটি নিবন্ধপুজোর একাল সেকালচেন্নাই, ২৬/১০/২০২০
সুস্মিতা নাথ করোনাসুরের দাপটে এবারের পুজো মাটি। মহিষাসুর দমন হলেও মা দুগ্গা এই নতুন অসুরটিকে কতটা কব্জা করতে পারলেন, এ নিয়ে সন্দেহ আছে। কিছুটা হয়ত কাবু হয়েছে সে দুর্…
দেশমানুষ-এর জন্যে একটি নিবন্ধ
পুজোর একাল সেকাল
চেন্নাই, ২৬/১০/২০২০
সুস্মিতা নাথ
করোনাসুরের দাপটে এবারের পুজো মাটি। মহিষাসুর দমন হলেও মা দুগ্গা এই নতুন অসুরটিকে কতটা কব্জা করতে পারলেন, এ নিয়ে সন্দেহ আছে। কিছুটা হয়ত কাবু হয়েছে সে দুর্বৃত্ত, কেননা আজকে এই লেখাটা শুরুর আগে কাগজে দেখলাম, সংক্রমণের হার কমেছে, এবং এই প্রথম দেশে সুস্থতার হার বেড়ে নব্বই শতাংশে পৌঁছেছে। আশার কথা, সন্দেহ নেই। কিন্তু পাশাপাশি আরেক খবর, পুজোর ক’দিনে ‘পশ্চিমবঙ্গে লাফিয়ে বেড়েছে সংক্রমণের হার, এবং প্রতিমা নিরঞ্জন ঘিরে বাড়ছে উদ্বেগ’। সৌজন্যে দুগ্গা মায়ের কিছু অবোধ, অত্যুৎসাহী, হুজুগপ্রিয় সন্তান। কুসন্তানকে কোন মা সামলাতে পারে? মা দুগ্গাও হার মেনেছেন। ফলে পুরোপুরি স্বস্তি পেতে আরও কতদিন, কেউ জানি না। তবে এ কথা নিশ্চিন্তে বলা যায় যে, মায়ের ট্র্যাডিশনাল অস্ত্রগুলো কলির এই অসুর দমনে তেমন কাজে আসেনি। নতুন অস্ত্র চাই। মেডিসিন, ভ্যাক্সিন, থেরাপি, বা তেমনই কিছু অস্ত্র। কিংবা হয়ত কোনও দধীচির আত্মাহুতিতে কাল নেমে আসবে করোনার। কে জানে? কে বলতে পারে?তাই এবারের পুজোর কথা থাক। অন্যপুজোর কথা হোক। হয়ত অতীতচারণ হবে, তবু প্রবাসের এই বিষ/বিশময় উৎসবহীন শরতে ছেলেবেলার পুজোগুলো বড় টানছে। তখন পুজো শুরু হত বহু আগে। পুজোর মণ্ডপ তৈরির বাঁশ এসে পৌঁছানো মাত্র আমার পুজো শুরু। উৎসবের ঢাকে অদৃশ্য কাঠি পড়ে যেত তখনই। এরও অনেক পরে আসত মহালয়। আর মহালয়ার ঠিক পরপরই যেন দুরন্ত গতিতে সপরিবারে ছুটে আসতেন মা দুগ্গা। তখন তিনি এক বৃহৎ উৎসবের অংশমাত্র ছিলেন। মূল অংশ অনস্বীকার্য, কিন্তু এক পুজোকে ঘিরে আনুসঙ্গিক যে কত আনন্দ ছিল, হিসেব করা কঠিন এখন।
পুজো মানেই নতুন জামা। সেই সময় আমাদের নতুন জামার জন্যে এক একটা উৎসবের অপেক্ষা করতে হত, ---পুজো, পয়লা বোশেখ, ষষ্ঠী, অথবা জন্মদিন। এই অপেক্ষাই প্রাপ্তিযোগের আনন্দকে কয়েকগুন বেশি বাড়িয়ে দিত। একমাত্র পুজোতেই হত একাধিক জামা। বাবা হয়ত একটি বা বড়জোর দু’টি দিয়েছেন, কিন্তু আত্মীয় পরিজন থেকে প্রাপ্তিযোগগুলো বচ্ছরকার এই দিনগুলিকে রামধনু রঙে রাঙিয়ে দিত। কে, কী, কেমন জামা দিলেন, এ কখনই বিচার্য ছিল না, উপহারের মূল্য কখনই আনন্দের পরিমাপ নির্ধারন করত না। দূরের কোনও প্রিয়জন থেকে আসা জামা হয়ত আকারে বেজায় বড় হয়েছে, বেঢপ আকার, কিংবা নেহাতই খুব ছোট, তবুও পরোয়া নেই। নতুনের গন্ধটাই সব ভুলিয়ে দিত। ঢলঢলে বা বেজায় টাইট, অনেক বড় বা খুবই ছোট, সে জামাই মহানন্দে পরে বেরিয়েছি ঠাকুর দেখতে। বলা ভালো, দেখতে নয় দেখাতে। আপাময় মানব সমাজকে নিজের নতুন জামাটি দেখাতে। এবং অবশ্যই আনন্দ ভাগ করে নিতে। সে যে কী সুখের দিন ছিল! আহা! আর কি কখনও ফিরে আসবে সেগুলো?
প্রাচুর্য হয়ত তুলনায় কম ছিল, কিন্তু এখনের থেকে অনেক বেশি সরল সহজ ছিল জীবনটা। তুচ্ছাতি তুচ্ছ জিনিসে অমূল্য সুখের সন্ধান পেতাম। শরতের সোনালি রোদ, শিশির ভেজা ঘাস, গাঢ় নীল আকাশে তুলোর মতো সাদা মেঘ, উঠোন জুড়ে শিউলি ফুল, হিমেল বাতাস, সবেতেই লেগে থাকত উৎসবের গন্ধ। পাঁচ ইন্দ্রিয় দিয়ে চেটেপুটে অনুভব করতাম সেই উৎসব সুখ। ভাগ্যিস তখন ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, ও মুঠোফোন ছিল না।
হয়ত সেই অভ্যাসেই আজও শরৎ সকালের রোদ দেখলেই মনের ভেতরে উৎসবের আমেজ এসে যায়। কিন্তু ওই আমেজটুকুই সার। উৎসব তার সব রং নিয়ে আর যেন ধরা দিতে চায় না আজকাল।
তখন পুজো মানেই আলাদা কর্মকাণ্ড। প্রায় মাসখানেক আগেই শুরু হয়ে যেত পাড়ার দাদাদের ব্যস্ততা। হয়ত এরও আগের থেকেই। চাঁদা তোলা, বা মূর্তির বায়না, ইত্যাদির মতো নেপথ্য কাহিনিগুলো, যা শুরু হয়েছে মাস দু’-তিনেক আগেই, সেসব নিয়ে মাথা ঘামাবার বয়স তখন নয়। তখনও আমাদের ছোট, নিতান্তই গ্রাম্য শহরটায় থিম পুজো বা ভাড়া করা পেশাদারদের দিয়ে মণ্ডপ সাজানোর তেমন প্রচলন ছিল না। মাত্র দু’-চারটে জায়গায় শোনা যেত বাইরের থেকে অমুক বা তমুক ডেকরেটরস এসে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির কিংবা তাজমহল বানিয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ শুনতাম কুমোরটুলি থেকেও মূর্তি আনাতেন। সেসব ভিড় করে দেখতে যেতাম ঠিকই, কিন্তু ওই পুজোগুলোয় একটু বেশি আনন্দ আছে বলে একটুও মনে হত না। মঞ্চ যেমনই হোক, মূর্তি একচালা বা আলাদা আলাদা, এসবের সঙ্গে আনন্দ উপভোগের কোনও সম্পর্ক ছিল না।
আমাদের পাড়ার পুজোয় সমস্ত ব্যবস্থাপনায় থাকতেন পাড়ার দাদা, দিদি, কাকু, জেঠুরাই। দাদারাই মূল দায়িত্বে। তুমুল আগ্রহ নিয়ে দেখতাম তাদের প্রতিটা কাজ, …বাঁশ দিয়ে মণ্ডপের মাচা গড়া, নানা আকারের ফ্রেম বানিয়ে ওতে রংবেরঙের কাপড়ে সামান্য ভাঁজ ফেলে পেরেক ঠুকে ঠুকে আটকে ওটার দেওয়াল তৈরি, এবং পরে সমস্ত ফ্রেমগুলো এক এক করে মূল কাঠামোয় আটকে দিয়ে একটা পরিপূর্ণ মণ্ডপের রূপ দেওয়া, তারপর সব শেষে শোলার মধ্যে বিবিধ নকশা কেটে (ঘরে ঘরে কত যে শখের শিল্পীরা ছিলেন!) সেই মণ্ডপ সাজিয়ে তোলা। এখানেই শেষ নয়, ফুলের টব, আলপনা, ঝাড়বাতি আদির অলঙ্কারও জূড়ে যেত তাতে। এভাবেই একটু একটু করে পূর্ণতা পেত শারদোৎসবের প্রস্তুতি।
দিনের সিংহভাগই পড়ে থাকতাম নিজেদের পাড়ার মণ্ডপে। ওখানেই দৌড়ঝাঁপ ছুটোছুটি খেলা, ঠাকুর দেখা, মানুষ দেখা, সব। মায়ের মৃণ্ময়ী রূপটি এতটাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম যে, সিংহের ক’টা দাঁত দেখা যাচ্ছে, লেজটা ঠিক কেমন ভাবে বাঁকানো, অসুর মহাশয় ঠিক কী ভঙ্গিমায় রয়েছে, গণেশের ইঁদুর কোথায় লুকিয়ে, মায়ের নথে ক’টা পুঁতি, মহিষের কাটা মুণ্ডুটি কোথায়, ইত্যাদি থেকে শুরু করে চাঁদমালার নকশা, প্রায় মুখস্ত হয়ে যেত। পরে ঠাকুর না দেখেই আনাড়ি হাতে সমস্ত ডিটেলিং সহ ছবি এঁকে ফেলতে পারতাম।
পুজোর দিনগুলোয় ব্যস্ততা আমারও তুঙ্গে। ভোরে উঠেই মায়ের তুলে রাখা বাগানের ফুল পৌঁছে দিয়ে মণ্ডপে আসা শুরু। এরপর তো আছেই অঞ্জলি দেওয়া, ভোগের প্রসাদ আনা, ও আরও নানা বাহানায় অথবা বাহানা ছাড়াই একটু পরপরই সেখানে ছুটে যাওয়া। চারটে দিন যে কীভাবে হুশ করে কেটে যেত, বোঝাই যেত না। ক’টা দিন একেবারে একাত্ম হয়ে থাকতাম ঠাকুরের সঙ্গে, পাড়ার মণ্ডপের সঙ্গে, ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে, আর ভোগের খিচুরির সঙ্গে।
তখন পুজো আক্ষরিক অর্থেই ছিল সর্বজনীন। পুরো পাড়াটাই একটা বড় পরিবার হয়ে উঠত। দিদিরা দল বেঁধে পুজোর আয়োজন করছে, ফুল, দুর্বা ও বেলপাতা রেডি করছে, ফল কাটছে, প্রসাদ সাজাচ্ছে, আরও কত কী। বেড়াতেও যেত দল বেঁধেই। আমাদের পাড়ার বভিন্ন বয়সি মেয়েদের মস্ত বড় একটি দল ছিল। তারা যেখানেই যেত সবসময় একত্রে। শুনেছি, এই দলটাকে ছোট্ট জনপদটির প্রায় সব্বাই চিনত। ক্লাবের এক অবাঙালি বোরোভাষী দাদা ছিলেন, যার দায়িত্ব ছিল মেয়েদের এই দলকে প্যান্ডাল হপিং-এর সময় সঙ্গ দেওয়া। অনেকটা অভিভাবকের মতো। কিন্তু অভিভাবকের মতো সবসময় খড়গহস্ত নয়। সাদাসিধে, সহনশীল এবং অবশ্যই প্রচণ্ড দায়িত্ববান। এর পেছনে নিঃসন্দেহে মেয়েদের ‘অবলা’ ভাবার মানসিকতা রয়েছে। একইসঙ্গে অবলা বলে উপেক্ষা নয়, বরং তাদের প্রতি আরও বেশি যত্নবান হওয়ার ইঙ্গিতও আছে বইকি। কিন্তু সত্যি কোনও বিপদ এলে একা সেই দাদা এতজনকে কীকরে রক্ষা করতেন সে প্রশ্ন এখন অবান্তর। আসলে সুখের কথাটি হল, সবাই জানত কোনও বিপদই হবে না। বিপদের কথা মাথায়ই আসত না কারও। কেননা ওই পরিপূর্ণ শান্তির শহরটায় তখনও কোনও নরাধমের উপস্থিতি ছিল না। থাকলেও চারদিকে শুভশক্তির দাপটে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। এতটাই ভয়হীন, বিপদহীন, শান্তি ও স্বস্তির পরিবেশ ছিল সর্বত্র। তথাপী সেই দাদা সঙ্গে যেতেন। মূল কথা হল, তিনি যাচ্ছেন জেনে তবেই সব বাড়ির অভিভাবকদের থেকে শহর ঘুরে ঠাকুর দেখার অনুমতি পেত মেয়েরা।
দাদার সঙ্গে একটা সাইকেল থাকত। সেটা হাঁটিয়ে নিয়ে তিনি প্রমীলা বাহিনীর পেছন পেছন চলতেন। সেই দলে আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ। ফলে বাড়ির থেকে আমার যাওয়ার অনুমতি সহজে মিলত না। অনেক অনুনয় বিনয়, বলা ভালো কান্নাকাটি করে বড়জোর একদিন যেতে পারতাম। কিন্তু বেড়াতে তো বেরিয়ে পড়লাম, কিছুক্ষণ পরেই শুরু হত আসল গল্প। একে আকারে ছোট, উপরন্তু নতুন জুতো পরে পায়ে ফোস্কা বাঁধিয়ে ফেলেছি। হেঁটে হেঁটে পুজো ঘোরা অসম্ভব হয়ে উঠত। তবু উৎসাহে ভাটা নেই। ফোস্কা পায়ে যতই ব্যথা করুক, যতই খুড়িয়ে চলি, তবু সব না দেখে বাড়ি ফিরতে নারাজ। তখন বিপদতাড়ন হয়ে উঠতেন সেই দাদা। তাঁর সাইকেলে উঠে বাকিটুকু ঘোরা। হয়ত আমার মতো আরও এক/দু’জনকে একই সাইকেলে বইতে হত তাঁকে। সে এক দিন ছিল সত্যি।
কোথায় যে হারিয়ে গেল সেসব সম্পর্কগুলো, সেইসব নির্ভরযোগ্য মানুষগুলো, সেই নিঃস্বার্থ নির্মল মুহূর্তগুলো!
সবশেষে আসত বিজয়াদশমী। দুগগা মাকে বিদায় দেওয়ার পরে যে কষ্টটা অনুভব হত, সেটা কেটে যেত পরবর্তী কয়েকদিন নিয়মিত চব্যচোষ্য খাওয়ার সম্ভাবনায়। আমাদের ছোটদের ছেলে মেয়ে মিলিয়ে আট-দশজনের একটি দল ছিল, যারা এক এক করে লাইন ধরে সব বাড়িতে ঢুকে পড়তাম। ও বাড়ির জেঠিমণি, কাকিমণি বা কাকু জেঠুর পায়ে টুপ করে প্রণাম ঠুকে বৈঠকখানায় দাপিয়ে বসতাম। ইঙ্গিত স্পষ্ট, -মিষ্টিমুখ না করে উঠছি না। বাড়ির লোকেদের প্রশ্রয়ের হাসিও বলে দিত, আমরা যাওয়ায় তারাও খুশি। এরপর প্লেট ভরে আসত মিষ্টি নিমকি বোঁদে নারকেলের নাড়ু ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কত আর খাব? যথারীতি আগের দু’-তিনটে বাড়িতে খেয়ে তো গলা পর্যন্ত ভরে আছে। কিন্তু তাইবলে কি সব ফিরিয়ে দেব? সে বান্দাও আমরা নই। কাজেই সেই বাড়ির কাকিমণি বা জেঠিমণির দিকে নির্লজ্জ কুণ্ঠাহীন ভাবে একটা পলিব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বলতাম, “আমরা আর খেতে পারছি না গো। এতে সব খাবার ভরে দাও।”
এভাবে লক্ষ্মীপুজোর আগেই পাড়ার সব বাড়িতে বিজয়া সারা হয়ে যেত। একই সঙ্গে জমানো খাবারের পুটুলিও ক্রমশ পেটমোটা হয়ে উঠত। এর ঠিক পরেই তো আবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে লক্ষ্মীপুজোর প্রসাদ খেতে হবে। সেসব অবশ্য বেশির ভাগ ভিজে খাবার, মুরি মুড়কি নাড়ু ছাড়া ফলমূল ও খিচুরি লাবড়া পায়েস। সেগুলো সংরক্ষণযোগ্য নয়। তবে মুড়কি, নাড়ু, মোয়া, সন্দেশ, প্যারার দৌলতে লক্ষ্মীপুজোর রেশও বেশ ক’দিন চলত। অবশেষে যখন বাইরের সাপ্লাই শেষ হয়েছে, তখন বেরিয়ে আসত আমাদের সেই পুটুলিগুলো। একে শরতের হিম, তারোপরি বেশিরভাগই শুকনো খাবার বলে সেসব নষ্ট হত না। আর একটু আধটু হলেও কেই বা তোয়াক্কা করত? বাড়ির লোকেদের লুকিয়ে মাঠের মধ্যে গোল হয়ে বসে সেসব বাসি পুরোনো খাবারগুলো খাওয়া ছিল আরও এক উৎসবের মতো। পরম তৃপ্তিতে খেতাম। সে যে কী আনন্দের বিষয় ছিল, বলে বোঝানো কঠিন।
বিজয়া ও লক্ষ্মীপুজোর মাঝের সময়টায় প্রতি দুপুর ব্যয় করতে হত চিঠি লেখায়। কত যে চিঠি লিখতে হত! জনে জনে চিঠি। বড়দের বিজয়ার প্রণাম না জানানো তখন রীতিমতো অপরাধ বিবেচিত হত। পুজোর আগেই একগুচ্ছ ইনল্যান্ড, খাম ও পোস্টকার্ড এনে রাখা হত। তারপর বাড়ির সবাই মিলে দূরের স্বজনদের উদ্দেশ্যে লেখা হত চিঠি। তেমনই চিঠিও পেতাম প্রচুর। যারা খুব কম লিখতেন তারাও বছরের দুটো দিনে, নববর্ষ এবং বিজয়ায় শুভেচ্ছা বার্তা জানিয়ে একখানা করে পোস্টকার্ড অন্তত পাঠাতেন। পিওনকাকু রোজই কোনও না কোনও চিঠি পৌঁছে দিতেন। বিজয়ার পরে পিয়নকাকুদেরও কত আপ্যায়ন করা হত! ঘরে বসতে বলে জল ও প্লেটভরে মিষ্টি দেওয়ার উপরিও বকশিস হিসেবে খামে ভরে টাকা দেওয়া হত। আর এতে যেন গ্রহীতার চাইতেও গৃহকর্তাই খুশি হতেন বেশি। এমনই দুধওয়ালা কাকু, পেপারের কাকু, মালি কাকু, এবং বছরভর আমাদের জীবনের সঙ্গে নানা ভাবে যুক্ত মানুষদের প্রভূত আন্তরিকতার সঙ্গে আদর আপ্যায়ন করা হত এই সময়েই।
চিঠির কথায় যখন এলাম তখন বলি, সকলের সঙ্গে একত্রে নয়, স্পেশালই আমাকে সম্পূর্ণ আলাদা খাম বা ইনল্যান্ডে চিঠি পাঠাতেন একমাত্র আমার বড়ছেলে, আমার জেঠু। দীর্ঘ সে চিঠি পড়লে মনে হত যেন পাশে বসেই তিনি কথাগুলো বলছেন। মা-ছেলের কত যে অন্তরঙ্গ আলাপন! ওতে আমি আগের চিঠিতে কী কী বানান ভুল করেছি, সেসবেরও উল্লেখ থাকত। থাকত খুঁটিনাটি নানা কথা। থাকত এক প্রজন্মের মনন ও চিন্তন আরেক প্রজন্মে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস। সেসব অনেক চিঠি আজও স্বযত্নে রেখে দিয়েছি।
বহুদিন আর কোনও চিঠি আসে না। আমিও লিখিনি কাউকে। জেঠু চলে গিয়েছেন, চলে গিয়েছেন আরও অনেক স্বজন, গুরুজন। ফোন কেড়ে নিয়েছে চিঠির জায়গা। প্রিয়জনের স্পর্শধন্য সেই চিঠিগুলো তাই প্রতি মুহূর্তে নস্টালজিক করে তোলে।
বছর ঘুরে এখনও শরত আসে, সোনালি সূর্য, নীলাকাশ ও সাদা মেঘের দল ঢুঁ দিয়ে যায়, এখনও প্রবাসের যাযাবর জীবনে পুজো আসে, নতুন পরিচিত মানুষজনের মাঝে ষষ্ঠী থেকে দশমী কেটে যায়, অঞ্জলি, আড্ডা, ভুরিভোজ, সবই হয়, তবু কোথায় যেন কী না-থাকার শূন্যতা বারবারই মনের ভেতরে উঁকি দিয়ে যায়। হয় আমি বদলে গিয়েছি, নয় পৃথিবী বদলে গিয়েছে। কিংবা হয়ত দুজনেই।