Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

।। #ঘোর_সুড়ঙ্গ ।।
কর্মকৌশলী মানুষেরা কোনোদিনই বসে থাকে না।তাই সেদিন বিকাশ সহকর্মীর কাজের উৎসাহ, সত্তা উদ্দীপনা দেখে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে নি। এগিয়ে গেছে কাজে হাত লাগিয়ে তাকে একটু সাহায্য করে তোলার জন্য। কিন্তু তখন যে মধ্যরাত।…

 


।। #ঘোর_সুড়ঙ্গ ।।


কর্মকৌশলী মানুষেরা কোনোদিনই বসে থাকে না।

তাই সেদিন বিকাশ সহকর্মীর কাজের উৎসাহ, সত্তা উদ্দীপনা দেখে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে নি। এগিয়ে গেছে কাজে হাত লাগিয়ে তাকে একটু সাহায্য করে তোলার জন্য। কিন্তু তখন যে মধ্যরাত।

কাজ বন্ধ, সেই লোকটি বা এতো রাতে কাজ কেন করছে। তাঁকে বাঁধা দেওয়ার চেস্টা করেন বিকাশ।কিন্তু অনুরোধে কাজ হলো না, আর...... সেখানেই বাঁধে বিপত্তি।

আসলে খুলে বলি।

বিকাশ রায়, ইনি হলেন একজন নগণ্য নিতান্ত্যই এক সাধারণ মানুষ। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বাবা মারা যায়। আর মা মারা যান তার যখন বয়স ১৮। খুব অল্প বয়সে মাথার উপর দুটো বটগাছ হারিয়ে ফেলাতে সে ভীষণ ভাবে মানসিক ও আর্থিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পরেন। সুখের জীবন নরকে পরিণত হয়ে যায় তার। আর সে নিজেও আস্তে আস্তে মৃত্যু কোলে ঢোলে পড়তে থাকে। ক্রমে নিস্তেজ হতে থাকে তার ছাত্রযৌবনের উদ্দাম উদ্দিপনা। তার মনের ইচ্ছাশক্তি আর নতুন করে জীবন পেতে চাইছে না। এবার সে প্রতি পদে পদে চাইছে পৃথিবী ত্যাগ করতে। চলে যেতে চাইছে তার মা বাবার কাছে। বন্ধুদের বোঝানো ক্ষনিকের জন্য মাথায় ঢুকলেও তা কিছুক্ষন পরেই পারদের মতো উবে যায়। সে বড় মেধাবী ছাত্র ছিল বটে। কিন্তু বটগাছ চলে যাওয়ায় সেই মেধা এখন ভবসাগরে তলিয়েছে। তার কাছে দূরে আসে পাশে বলতে তেমন কেউ নেই। আছে এক কাকা। সেও অনাথ বিকাশকে মাস খানেক কিছু সাহায্যের পর কাকিমার বাঁধায় সেটাও বন্ধ হয়ে যায়।

তারপর থেকে বিকাশ কখনও ঠোঙা বানিয়ে কখনও বা গার্ডার বিক্রি করে দু এক টাকায় নিজের ক্ষুদার্ত পেট ভরে। কিন্তু তাতে কি আর জীবন চলে। যেখানে সারা শহর জুড়ে আধার নামলে লোকের ঘরে আলো জলে সেখানে বিকাশের ঘরে তখন ঘোর অন্ধকার। বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন অনেকদিন আগেই এসে লাইন কেটে দিয়ে গেছে। এখন শুধু তার ঘর নয় গোটা জীবনটাই ঘোর অন্ধকার। এদিকে বাবার রেখে যাওয়া দোকানের কিছু দেনা সে ওই দু একটা থেকে মেটাতে শুরু করে। সে ভেবেই নিয়েছে মরে তো যাবই কিন্তু বাবার দেনা মিটিয়ে যাবো যাতে বাবাকে কেউ গালাগালি না দিতে পারে। আর ঠিক ততদিনই বেঁচে থাকা।

একদিন তার অন্ধকার কষ্টের জীবনে হঠাৎ খুশির আলো ভুল করেই হোক প্রবেশ করল। অসময়ে এলো সুসময়ের অভয়বানী। আসলে মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ থেকে লোক এলো তার বাড়িতে। বাবার কিছু পাওনাগন্ডা মেটাতে। হিসেবে নিকেশ করে পাওয়া গেলো ২ লক্ষ ১৩ হাজার ৪২৮ টাকা। এতো ভারী অঙ্কের টাকা পাবে শুনে বিকাশের মন অঝোরে খুশির কান্নায় ঝরতে থাকে। তারা বিকাশকে সেই অঙ্কের চেক হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। কিন্তু বিকাশের যে ব্যাঙ্কে খাতা নেই। সেই টাকা সে রাখবে কোথায়? সেই চিন্তায় রাতের ঘুম উড়ে যায় তার। কি করবে কিছু ভেবে উঠতে পারছে না সে। অনেক কষ্টে যোগাযোগ করে সেই কাকার সাথে। কাকাকে সব কথা খুলে বলে বিকাশ। কাকা সব শুনে তাঁকে বলেন:-.....

--------------------------------------------

  কাকা:- বিকাশ তোর কষ্টটা আমি আর সইতে পারছি না রে বাবু। এখন তোর সময় এসেছে সুদিন। আমি চাই তুই এই টাকাটা তোর ভাল কাজে লাগা। তোর বয়স অল্প। তোকে সহজেই যে কেউ ঠকিয়ে টাকা নয় ছয় করে দেবে। তুই সময় মত যোগাযোগ করেছিস এতেই আমি খুশি। তুই আমার সাথে চল তোকে একটা ব্যাঙ্কে খাতা খুলে দিই।

  বিকাশ:- হ্যাঁ কাকা চল। তাহলে তো খুব ভালই হয়।

  কাকা:- এই টাকা তুই ব্যাঙ্কে রাখলে সুদ পাবি সেটা দিয়ে নিজের প্রয়োজন মেটাবি। কিন্তু ভুলেও টাকাটা নষ্ট করবি না। কেমন। আমি কিছু টাকা দিয়ে ২ লক্ষ ২০ হাজার মোট করে জমা করিয়ে দিচ্ছি।

  বিকাশ:- ওমা! আমার এত্ত টাকা হয়ে যাবে??

  কাকা:- হ্যাঁ রে আমার পাগল সোনা। অনেক কষ্ট করেছিস। আমার পোড়া কপাল তোর কাকিমা যদি মানুষ হত তাহলে তোকে আজ আর এই দিন দেখতে হত না রে। জাগ্ গে! চল ব্যাঙ্কে।

  বিকাশ:- আচ্ছা কাকা।

----------------------------------------------

সে খুললেন ব্যাঙ্কের খাতা, সাথে ঘুরতে শুরু করল সেই থেকে বিকাশের জীবনের চাকা। এখন আর তাঁর স্বপ্নে প্রাণ হারানোর চিন্তারা হাতছানি দিতে আসেনা।আসে শুধু বাবা মার ফোটো আগলে খালি দু ফোঁটা চোখের জল। বাবা মার আশীর্বাদ সে সব সময় প্রতক্ষ্য করল। বিকাশের বাবা ছিল প্রবল পরিশ্রমী লোক। কন্ট্রাক্টরের অধীনে মেট্রো প্রকল্পে কাজ করতেন তিনি। যথেষ্ট গুণী মানুষ সে। টাকার অভাবে বেশি দূর শিক্ষার আলো লাভ করতে পারেনি। কিন্তু বিকাশকে সে শিক্ষার আলো দিতে কোনও খামতি রাখেন নি। সে চেয়েছিল বিকাশ বড় হয়ে মেট্রো রেলের ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু সেটা অসম্পূর্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো। দুজনেই মারা গেলেন কান্সারে। সেই দিন থেকে শুরু বিকাশের জীবনে একটার পর একটা বিপত্তি।

একদিন দুপুরে আবারও মেট্রো থেকে লোক এল বাড়িতে। তার বাবার জায়গায় একটি লোক লাগবে। বিকাশের বাবার কিছু সুহৃদয় সহকর্মীদের অনুরোধে মেট্রোরেলের কন্ট্রাক্টর তাঁকে প্রস্তাব পাঠান আগামি সপ্তাহের সোমবার থেকে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য। খুশিতে পাগল হয়ে যায় বিকাশ। তখন সে বছর ২১শের। মনে নানান স্বপ্ন উড়ান দিতে থাকে। সে বাবার ফোটোর কাছে গিয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে।

হঠাৎ সে লক্ষ্য করে সেই সময় সে ছাড়াও ঘরে কেউ আছে। যে তার সাথে কথা বলার চেস্টা করছে, কিন্তু পারছে না। কিছুটা আন্দাজ করলেও সে না বুঝতে পেরে তৈরি করে ফেলেন কাজে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি। কাজে যোগ দেওয়ার আজ তার প্রথমদিন। মা বাবার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে বছর ২২শের বিকাশ চলছে বাবার ছেড়ে যাওয়া অসম্পূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করতে। মনোযোগ সহকারে কাজ করতে শুরু করল সে। মাটি খনন থেকে শুরু করে রেলের সুদীর্ঘ লাইন পাতা সবটাই সে শিখে ফেলছে নিমেষে অন্যান্য সহকারিদের সাথে। মাস খানেক কেটে গেলো। ভাল টাকা উপায় করল সে। ক্লান্তি জুড়িয়ে বসার উপায় নেই তার। সারাদিন পরিশ্রমের পর কর্মীদের বিস্রামাগার একটু বিশ্রাম সবাই নেয়। সেও নিল। প্রতিদিন সারারাত ধরে কাজ হয়। সেদিন শুক্রবার অর্ডার এলো ৩দিন কাজ বন্ধ থাকবে। কিছু শ্রমিক ছুটি গেলো। কিছু শ্রমিক রয়ে গেলো কাজের জায়গায়। বিকাশ মেট্রো সুড়ঙ্গের কাজে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছে। মেধাবী ছেলে সবটা বুঝে নিতে সমস্যা হয়নি তার।

সোমবার ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা যা সে কল্পনাও করেনি কোনওদিন। সোমবার রাত তখন বারোটা। ৩দিন টানা ছুটির পর  সুড়ঙ্গের কাজ জোড় কদমে শেষ করতে করতে রাত প্রায় ১০:৩০ টা। ক্লান্ত শরীর জিরিয়ে নিল সবাই সাথে বিকাশও। সুড়ঙ্গ তখন ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন। ছুঁচো ইঁদুরের আনাগোনা স্পষ্ট।

বিকাশের চোখে যখন সবে তন্দ্রা নেমেছে ঠিক সেই সময় ঘোর সুড়ঙ্গ থেকে ক্ষীণ ও স্থুলতার সাথে ভেসে আসছে রড কাঁটার আওয়াজ আর মাঝে মাঝে মাটি ক্ষণের আওয়াজও। বিকাশ ভাবলো সবাই তো ফিরে এসেছে রাতে তো কাজ বন্ধ তাহলে কে এত রাতে নিচে নেমে কাজ করছে?? কিছুক্ষণ পর শব্দ বন্ধ। সে ভাবলো মনের ভুল। সারাদিন এসব আওয়াজে সে অভ্যস্ত তাই রাতেও তার কানে সেই আওয়াজ বাজতে থাকছে। কিন্তু মিনিট কুড়ি পর আবার নেমে এলো সেই শব্দ। কেঁপে উঠল বিকাশের হাত পা আর হৃদযন্ত্র।

নাহ। এবার না নেমে গিয়ে দেখা ছাড়া উপায় নেই। কে এতো সাহস নিয়ে নিচে মধ্যরাতে কাজ করছে একাই। তাও আবার কারোর অনুমতি ছাড়াই। বিকাশ লোহার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলেন। এগোতে থাকলেন ঘোর অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভিতরে। মাঝে মাঝে দেওয়ালে লাগানো আলোতে নিজের ছায়া দেখে বিকাশ নিজেই আঁতকে উঠছে।

হঠাৎ সে দেখল এক ব্যাক্তি পিছন ফিরে রীতিমতো কাজ করে চলেছে। তার কাজের উৎসাহ উদ্দিপনা দক্ষতা আর সত্তা দেখে বিকাশ খুশি হলো। তারও ইচ্ছা হলো হাতে হাতে সাহায্য করার, সেই মতে এগিয়েও গেলেন কিন্তু তখন মধ্যরাত কাজ বন্ধ। তাই কিছু করার নেই তাঁকে বাধা দেওয়া বিকাশের কর্তব্য। তাই বিকাশ তার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন:-....

--------------------------------      

       বিকাশ:- এই যে আপনি এতো রাতে এখানে কি করছেন?? জানেন না রাতে কাজ বন্ধ আছে। যান উপরে যান। কালকে করবেন এসে বাকি কাজ। যান বিশ্রাম নিন।

(কোন সারা নেই সে কাজ করে চলেছে নিজের মতো। বিকাশ আবারও বললেন.....)

       বিকাশ:- কি ব্যাপার কথা কানে যাচ্ছে না?? কার অনুমতি নিয়ে এখানে এতো রাতে কাজ করছেন??

(তাও সারা নেই। এবার বিকাশ ক্ষিপ্ত হলেন। আর তাঁর কাছে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলেন।)

       বিকাশ:- কি হলো টা কি??

----------------------------------

লোকটি পিছন ফিরতেই আঁতকে উঠলেন বিকাশ।

দেখলেন এক পচা গলা বিকৃতাকৃতি মৃতদেহ যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। অদ্ভুত তার কংকালসার শরীর থেকে বিশ্রী বজ্র গন্ধ। অন্ধকার সুড়ঙ্গের দেওয়ালের লাল আলোয় সেই অদ্ভুতুরে অশরীরিটাকে আরো জঘন্য দেখতে লাগছিল। রক্ত পিপাশু হয়ে ধেয়ে আসছে বিকাশের দিকে। বিকাশ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসা চেস্টা করল কিন্তু সে দেখলো এক মহিলা সেই সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে কোনক্রমে বিকাশ সুড়ঙ্গের কোথাও লুকানোর চেষ্টা করতে থাকে। আচমকা অলৌকিক অদ্ভুতুড়ে জোরালো চিতকার শুরু হয়। যা কাচের ঘনত্বকেও ভাঙার ক্ষমতা রাখে। হঠাৎ বিকাশের কানে ভেসে এলো এক সুর। যা বিকাশকে ছেলে বেলার ঘুম পাড়ানি গানের কথা মনে করালো।বিকাশ বেরিয়ে এলো দেখল সেই মহিলা অন্ধকারে হেঁটে বেড়াচ্ছে আর গান গাইছে। হঠাৎ সে বিকাশের সামনে আসতেই বিকাশ হতবাক রয়ে গেলো। উনি তার মা। আর সেই অবয়ব ব্যক্তি যিনি কাজ করছিলেন তিনি বিকাশের বাবা। ছেলের পরিশ্রম আর কষ্ট দেখে থাকতে না পেরে হয়তো অবয়ব নিজেও মর্মাহত। যতই হোক মৃত্যুর পরেও মা বাবার ভালবাসা থেকেই যায়। 


এখন মা বাবা আর ছেলে ৩জনেই এক সাথে কাজ করে চলেছেন কারোর কোন সমস্যা না তৈরি করেই। হয়তো অবয়ব রূপে তারা তাঁকে সাহায্য করছেন কাজে। বাবার কর্ম দক্ষতা মায়ের ভালবাসা আর ছেলের মেধা বিকাশের অবয়ব অলৌকিক কর্মকাণ্ড আজ উভয়ই সাথে। ঘোর সুড়ঙ্গ আজ অলৌকিক কর্মকাণ্ডের শুভ কাজে নিযুক্ত।

আর বিকাশ হয়েছে ইঞ্জিনিয়ার। অনেক কষ্ট করে করেছে বাবার স্বপ্ন পূরণ।


।।।সমাপ্ত।।।

ধন্যবাদ 🙏🏼🙏🏼

স্ব-রচিত কলমে:- রঞ্জিত চক্রবর্তী

তারিখ:- ০৩-১০-২০২০।