ভালোর ভালো কথা
রিকশাওয়ালা | দমদম স্টেশনের কাছে আমি যেখানে রিহার্সাল করি, সেই পাড়াতেই রিকশা চালান মানুষটি | বাকি সবার মত মোটরগতির রিকশা নেই তাঁর | পুরোনো চেহারা তাঁর রিকশার | তবু সতীর্থদের সমৃদ্ধি কখনো মলিন করেনি মানুষটিকে | অ…
ভালোর ভালো কথা
রিকশাওয়ালা | দমদম স্টেশনের কাছে আমি যেখানে রিহার্সাল করি, সেই পাড়াতেই রিকশা চালান মানুষটি | বাকি সবার মত মোটরগতির রিকশা নেই তাঁর | পুরোনো চেহারা তাঁর রিকশার | তবু সতীর্থদের সমৃদ্ধি কখনো মলিন করেনি মানুষটিকে | অশ্বগতির রিকশার পাশে নিজের স্লো মোশনের রিকশাটি টানতে টানতে খোয়া যায়নি তাঁর রসবোধ , যা কিনা দারিদ্রের মাঝে অতি দুর্লভ |
এই রসবোধ সম্পর্কে দুটো ছোট ঘটনা বলব আজ | একবার হলো কী , রিহার্সাল রুমে পৌঁছে ভাড়া না দিয়ে সোজা ঢুকে যাচ্ছি ঘরে | ভাব হয়ে গেছে তো | তাই ঘাড় ঘুরিয়ে রোজই বাই দি তাঁকে | সেদিন বাই দিতে গিয়ে দেখলাম , উজ্জ্বল চোখ মেলে হাসছেন রিকশাকুমার | তখন মানে বুঝলাম না সে হাসির | পাল্টা হাসি ছুঁড়ে ঘরে ঢোকা মাত্তর জিভ কাটলাম | এই রে ভাড়া দিতে ভুলে গেছি যে !
ছুটছি রিকশার পিছু ----" দাঁড়ান দাঁড়ান পয়সা নিয়ে যান |" এমন কিছু তাড়া বুঝলাম না তাঁর হাবভাবে | তাড়াহুড়ো করেনও না কখনো | অনেকদিনই দেখেছি ,নিবিষ্ট মনোযোগ দিয়ে যাত্রীকে তুলছেন ---কখনো আমার মতো অগোছালো মহিলার শাড়ির কুঁচি গুছিয়ে দিচ্ছেন পাছে চাকায় ঘষে ছিঁড়ে না যায় | এইসব করতে গিয়ে যাত্রী পিছু অনেক সময় যায় তাঁর | অন্যান্যদের মত বেশি ভাড়া পাওয়ার স্বভাবজাত ত্বরা থাকে না তাঁর কখনোই | সেদিন কিন্তু ভাড়া না নিয়েই তাড়াতাড়ি চলে গেলেন |
পরের দিন হন্তদন্ত হয়ে বললাম ---" এতবার ডাকলাম,পয়সা নিলেন না যে | "প্রশান্ত হাসি দিয়ে বললেন ---"আর কখনো ভুল করবেন না বলে |" বললাম ---"কীসের ভুল ? পয়সা না দেয়ার? ও তো আমি প্রায় করে থাকি |" অদ্ভুত এক উত্তর এলো তাঁর থেকে ---ভুলটা পয়সা না দেয়ার নয় দিদি ,ভুলটা পাশের লোকটাকে গ্রাহ্য না করার | আপনার পয়সার জন্য দাঁড়াতে পারি পরের পুজো অব্দি | উপেক্ষায় এক মিনিটও নয় | বুঝলাম এই প্রগাঢ় সম্মানবোধই মানুষটিকে আগাগোড়া নির্লোভ রাখছে |
আরেকদিন | রিকশায় অলরেডি তুলেছেন এক বিত্তবান মহিলাকে | হঠাৎ সামান্য নোংরা পোশাকে ছুট্টে এলেন এক বৃদ্ধা | "বাবা ওই রাস্তাতেই পরবে আমার বাড়ি | রোদ্দুরে এত বড় ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে পারছি না | ওঁর সাথে যদি তুলে নাও অর্ধেক ভাড়ায় চললে যেতে পারি |" সাজুগুজু মহিলা কিছুতেই রাজি না ওই দুঃস্থ বৃদ্ধাকে সঙ্গে নিতে ---জগতের কোনো বিত্তবান কোনো যেমন কোনো যুগেই রাজি হননি দরিদ্রকে একযানে নিতে | ঠিক তেমন করেই নারাজি ভাবটাকে চোখেমুখে ফোটাচ্ছিলেন সেদিনের ধনীবউ | রিক্সাওয়ালার গম্ভীর কন্ঠ ---" আপনি নেমে যান | আমি বরং বুড়ো মানুষটাকেই বাড়ি দিয়ে আসি | "
হতভম্ব বড়লোকটার চোখের সামনে দিয়ে গরীব নিয়ে রিকশা ছোটালেন গরীব যানবাহক | যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেনও নেকিটাকে | ভাই পরিষ্কার দেখলাম ,এবারও চোখে ডিপোজিট যত রাজ্যের মজা আর চুকচুকে এক হাসি | সেদিন থেকে আশা করে আছি -- আগামীদিনে একটি দ্রুতগতি যান চালাবেন এই চালক | নিজের উপার্জনেই রাজপুত্র কিনবেন তাঁর ঘোড়ার বেগের যান | কিনবেনই |
অতিক্রান্ত হচ্ছে কিংবা just কেটে যাচ্ছে অতিমারির কাল | কৌতূহল হয় ---কেমন করে কাটছে এমন সৎ মানুষের দিন | রাস্তায় আজকাল কম চলে লোক | তবু বিশ্বাস ---এ চালক চাইবেন না অতিরিক্ত ভাড়া | কান্না চাপি ---করুণায় খাটো হন যদি খাঁটিমানব !
চোখ মুদি |
দীঘি ভরা ঘাম |