শুধু এক মুঠো ভাত****************************কলমে ------ গোপা ব্যানার্জি
আমি মনে করি শুধু আমরা না আমাদের আগের জেনারেশন মানে আমাদের বাবা- মা'রা, এবং আমাদের পরের জেনারেশন তো নিশ্চয়ই মানে আমাদের ছেলেমেয়েরা এই ধরনের সম্পূর্ণভাবে…
শুধু এক মুঠো ভাত
****************************
কলমে ------ গোপা ব্যানার্জি
আমি মনে করি শুধু আমরা না আমাদের আগের জেনারেশন মানে আমাদের বাবা- মা'রা, এবং আমাদের পরের জেনারেশন তো নিশ্চয়ই মানে আমাদের ছেলেমেয়েরা এই ধরনের সম্পূর্ণভাবে পৃথিবীর স্তব্ধ হয়ে যাওয়া আমরা আগে কখনোই দেখিনি।তাই এই করোনাকালের প্রভাব আমাদের প্রত্যেকের উপরে ভীষণভাবে বিস্তারিত করেছে। কিছুতেই চাইলেও মন থেকে আমরা ভুলতে পারছি না । হয়তো পৃথিবী এখন ধীরে ধীরে অনেকটাই স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করছে, তবু কোথায় যেন মনের কোণে একটা ভীতি কাজ করে। সবথেকে যেটা বেশি কষ্টের সেটা হলো হারিয়ে যাওয়ার সময়, হারিয়ে যাওয়া বেশ কিছু আপন বা দূরের মানুষগুলো। তাই আমি আবার এই করোনাকালের উদ্দেশ্যে এই লেখাটা লিখেছি।
___________________________________
শীতের প্রথমদিকে ভোর বেলায় কলের ঠান্ডা জলে স্নান করতে করতে আপামর বাঙালি হেঁড়ে গলায় নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটায়। আমারও ঠিক তেমনটি ঘটলো আজকের ভোরে স্নান করতে গিয়ে।
মনের আনন্দে হেঁড়ে গলায় গান ধরলাম
' হারে রে রে রে আমায় বাঁধবে কে রে র 'যেমন চড়তাম ট্রেনে আবার
চাপবো ট্রেনে মনের আনন্দে রে'।
একসময় গান থামিয়ে নিজের মনেই চিৎকার করে উঠলাম হুররে ইউরেকা ইউরেকা।
আরে না, নতুন কিছু সৃষ্টি করিনি সৃষ্টির একটি অতি প্রয়োজনীয় জিনিস নতুন করে পেলাম সেই আনন্দে আমার ভোরবেলায় উঠে স্নান করতে করতে এই গান বা এই আনন্দের প্রকাশ।
এবার দেখছি কথাটা খুলে বলতেই হয়, তা নইলে পাগলের প্রলাপ বলে মুঠোফোন বন্ধ করে দেবে আমার বন্ধুরা।
হয়তো মাসখানেক হল, বিগত সাত মাস পর দূরযাত্রার রেলগাড়ি ছুটতে শুরু করেদিয়েছে। দু-তিন দিন আগে খবর পেলাম লোকাল ট্রেন গুলি ও চলতে শুরু করেছে।
ব্যাস আর যায় কোথায়, খবর পাওয়া মাত্রই মন লোকাল ট্রেনের সামনে ঘোরাফেরা শুরু করল, আর ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে না তাই আজ ভোর রাত্রে স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম স্টেশনের উদ্দেশ্যে।
স্টেশনে দাঁড়িয়ে প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ আমার সেই পরিচিত স্টেশনটাকে দুচোখ ভরে দেখতে লাগলাম। আগের মতন এখনো তত জনবহুল হয়ে উঠতে পারেনি সে, তবে বেশ কিছু মানুষকে ব্যাগ হাতে ট্রেনের প্রতীক্ষা করতে দেখে মন আনন্দে ভরে গেল।
টিকিট কাটতে টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম কাউন্টার থেকে সেই পরিচিত দৃষ্টি আমার মুখের উপরে, একগাল হেসে বলে ফেললাম,এই স্টেশন থেকে লাস্ট স্টেশন টিকিট দিন, ফিরতিটাও কিন্তু একসাথেই দিয়ে দেবেন।
টিকিট হাতে পেয়ে অনেকদিন পর
নিজেকে বেশ রাজা বাদশা লাগছে।
সাত মাস পর রেল গাড়ির টিকিট হাতের মুঠোয়, এখানে লাখ টাকার লটারি কিংবা একটা গুপ্তধনের খোঁজ খুব সামান্য মাত্র।
আসলে সাত মাস পর লোকাল ট্রেনে এতটা রাস্তা যাব আবার এতটা রাস্তা ফিরব এটা ভেবেই কেমন একটা বাদশাহী মেজাজ তৈরি হয়ে গেলো মনের ভেতর।
ট্রেন প্লাটফর্ম এসে দাঁড়াতেই এক লাফে উঠে পড়ে জানলার ধারে নিজেকে বেশ করে গুছিয়ে বসলাম।
কতদিন পর দুচোখে মেলে দেখতে লাগলাম যাত্রীদের ওঠা, সিট দখল করে বসা, হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়ানো নিজের নিজের জিনিসপত্র সামলে রাখার ব্যস্ততাকে।
গাড়ি চলতে শুরু করলে আমি এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলাম আমার সেই পুরনো হকার ভাইদেরকে যারা এই সাত মাস আগেও আমাদের সবার সাথে ট্রেন যাত্রায় সঙ্গী হয়ে থাকতো হাসি মুখে।
একটু পরে দেখা পেলাম সেই সদা হাস্যজ্জল মুখের চাওয়ালা হকারটির।
এই যা, এই সাত মাসের মধ্যে আমি তো তার নামটাই ভুলে গেছি, বোঝো আমার কান্ডটা । ভিড়ের মাঝে আমাকে দেখতে পেয়ে মুখে একটা খুশির ভাব তার, আমিও হাত ইশারায় ডাকলাম তাকে।
কাছে এসে দাঁড়াতে হঠাৎ নামটা মনে পড়ে গেল ।একগাল হেসে বললাম,
শ্যামল ভাই না?
মুখে একটা হালকা হাসি এনে শ্যামল বললো,
হ্যাঁ দাদা ভালো আছেন তো, একটা চা দেবো?
মনে কেমন যেন একটা খটকা লাগলো, এতদিন পর দেখা এত হাসিখুশি ছেলেটার মুখে আরেকটু যেন হাসি দেখার ইচ্ছেটা হচ্ছিল ।
ভাবলাম এই করোনাকাল যা যাচ্ছে তাতে করে হাসি আর থাকবে কি করে, তবু ভালো লাগছে ওকে দেখে।
গরম চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম 'রাম দুলারীর চা
এক ভাঁড় খা'
এই কথাটা বললেনাতো শ্যামল ভাই?
ভিড়ের মাঝে তোমার গলায় এই কথাটা শুনে আমরা খুব উপভোগ করতাম তোমার হাতে চা খাওয়াটা।
শ্যামল শুকনো মুখে বলল,
এই সাত মাসে অনেক কিছুই ভুলে গেছে দাদা ,নতুন করে আবার সব অভ্যেস করছি ধীরে ধীরে।
আমি বললাম,
'দাদারা বৌদিরা মুখটা ছাড়িয়ে, দেবো নাকি নুন লঙ্কা ঘষে'
সেই শশাওয়ালা ভাইটি কই সে আছে তো এই ট্রেনে?
শ্যামল বললো হ্যাঁ দাদা আছে দু তিনটে কামরার পেছনে, এসে যাবে আপনার সাথে ওর দেখা হয়ে যাবে।
আমি খুব আনন্দ পেয়ে বললাম,
হ্যাঁ ওর কাছ থেকেও আজ আমি শশা খাব ,বহুদিন খাই না ওর হাতে নুন লঙ্কা মাখানো শশা।
' দেব নাকি আমতেল মাখানো একমুঠো মুড়ি মুখে ভরে'
সেই মুড়ি বিক্রেতা ভাই বীরেন,সে ও আছে নাকি এই ট্রেনে? তার মুড়ির সাথে শসার কম্বিনেশন আহা জীবে তো আমার জল চলে আসছে শ্যামল ভাই।
শ্যামলের চোখদুটো হঠাৎ ছল ছল করে উঠলো সে বলতে লাগল,
না দাদা বীরেন এই ট্রেনে কেনো এই পৃথিবীতেই নেই সে মারা গেছে কিছুদিন আগে করোনা আক্রান্ত হয়ে।
আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিল না আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।
আসলে আমার চাকরি জীবনে প্রায় বাইশ বছর আমি এই লাইনে অফিস আসা যাওয়া করছি এই একটি ট্রেনে চেপে, তাই প্রতিটি হকারের সাথে আমার কেমন যেন একটা আত্মার সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেছে।বীরেনের মৃত্যুর খবরটা শুনে আমার খুব কষ্ট হল।
শ্যামল সেটা বোঝার পরই পরিবেশটা হালকা করার জন্য বলে উঠলো,
দাদা একটা ভালো খবর আছে।
বললাম, বলে ফেলো।
সে একটু হেসে বলল আমার ছোট বোন টার এই লকডাউন এর মধ্যেই বিয়ে দিয়েছি, ছেলেটি খুব ভালো রিকশা চালায় সাথে মুটের কাজ'ও করে। ওরা ভালো আছে।
আমি আমার মানিব্যাগ খুলে 500 টাকার একটা নোট শ্যামলের হাতে ধরিয়ে বললাম ভাই আমার ছোট্ট বোনটাকে এটা আমার আশীর্বাদ স্বরূপ দিলাম। তাকে এবং তার স্বামীকে আমার ভালোবাসা ও আশীর্বাদ জানালাম।
শ্যামল সংকুচিত হয়ে বলল,
এটা কি করছেন দাদা ? আপনার আশীর্বাদ আমি ওদের পৌঁছে দেবো টাকাটা আপন