বিভাগ--গল্প তপুসীমা রাহা
অনু সকাল থেকে আজ ভারী ব্যস্ত। সন্ধ্যেবেলা রূপুর এক অফিস কলিগ বন্ধু আসবে তাদের বাড়ি, তাই সান্ধ্যকালীন আড্ডার অন্যতম উপকরণ কিছু স্ন্যাকস এর আইটেম রেডী করে রাখল সে। পনির পকোড়া রূপুর খুব পছন্দের। এই আইটেমটা ক…
বিভাগ--গল্প
তপু
সীমা রাহা
অনু সকাল থেকে আজ ভারী ব্যস্ত। সন্ধ্যেবেলা রূপুর এক অফিস কলিগ বন্ধু আসবে তাদের বাড়ি, তাই সান্ধ্যকালীন আড্ডার অন্যতম উপকরণ কিছু স্ন্যাকস এর আইটেম রেডী করে রাখল সে। পনির পকোড়া রূপুর খুব পছন্দের। এই আইটেমটা করলেই রূপু একেবারে আনন্দে গদগদ হয়ে যাবে,সে জানে। রূপু বলে, " জানিস অনু,তোর মতো পনির পকোড়া ভূভারতে কেউ বানাতে পারে না।" কথাটা মনে পরতেই মনে মনে হেসে উঠল অনু। মনে মনে বলল," রাম পেটুক রূপুটা, ভালো মন্দ খাবার জন্য ইচ্ছেমতন তৈলমর্দন করে। ভাবে আমি কিছু বুঝিনা।" এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই সে হাতে হাতে ঘর গোছাতে থাকে। একবার রান্না ঘরে উঁকি মেরে দেখে নেয়, ফিসফ্রাইটা ফ্রিজে তুলল কিনা। সঙ্গে একটু ড্রাই চিলি চিকেনও করে রেখেছে। অনু রূপুকে হাড়ে হাড়ে চেনে। বন্ধু নিয়ে আসছে মানেই "বিপিনবাবুর কারণসুধা" ঠিক মজুত থাকবে।
লো ভলিউমে একটা নব্বইয়ের দশকের কিশোর কুমারের গানের ক্যাসেট চালিয়ে সে কাজ করতে থাকে।
"হামে অর জিনেকি চাহত না হোতি,
আগর তুম না হোতে,আগর তুম না হোতে।"
গানটা শুনে অনু একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। এটা তপুর প্রিয় গান ছিল। সবসময় গুনগুন করে এই গানটা গাইত। তপুর কথা মনে পরতেই অনুর মনে বিষাদ ছেয়ে যায়।
অনু,তপু আর রুপু একসাথে কলেজে পড়তো। একই ডিপার্টমেন্ট। সেকেন্ড ইয়ারে তপুর সাথে অনুর প্রেমটা গড়ে উঠল। স্নাতক হবার পর পরই তপু চলে গেল এয়ার ফোর্সের চাকরি নিয়ে। তার এক বছর পরেই তপুর বাড়ির লোকের জোরাজোরিতেই তাদের বিয়েটা তাড়াহুড়ো করে হয়ে যায়।কারণ তাদের ছেলের বিদেশ বিভূঁইয়ে একা হাত পুড়িয়ে খেতে হচ্ছিল,তাই এর বিহিত করতে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা তারা সেরে ফেলতে চাইছিল। তারপরেই সে তপুর সাথে চলে যায় আসাম, সেইখানেই তার পোস্টিং ছিল। বিয়ের তিন বছর হয়ে গেলেও অনু কনসিভ না করায় তারা ডাক্তার কনসাল্ট
করলে তিনি সব পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানান যে সমস্যা তপুর।তারা সন্তান ধারণ করতে অপারগ। কারণ তপুর এই সমস্যা মেটার নয়। এর কোনও সমাধানও নেই। এই বিষয়টি জানার পর থেকেই তপু কেমন যেন বদলে যেতে থাকে। হঠাৎ করে ভীষণ ভায়োলেন্ট হয়ে যেতো। আবার কখনও কখনও খুব ডিপ্রেশনে চলে যেতো। সবসময় বলতো একটা বাচ্ছা না থাকলে সংসারটাই খেলো হয়ে যায়। শেষে বিবাহের পাঁচ বছরের মাথায় তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। অনু জানে তপু অনুর মা হওয়ার বাসনার চরিতার্থতার জন্য এই পদক্ষেপ নেয়,যা তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রেখে পাওয়া সম্ভব ছিল না।
ডিভোর্সের পর অনু কলকাতায় এসে চাকরি খুঁজতে শুরু করে। হঠাৎ একদিন গড়িয়াহাটে রূপুর সাথে দেখা। সে চাকরি খুঁজছে শুনে সে বলে আমাদের অফিসে একজন রিসেপশনিস্ট নেবে। তুই চাইলে এপ্লাই করতে পারিস। আমার রেকমেন্ডেশন থাকলে চাকরিটা তোর হয়ে যাবে আশা করি। এই ভাবেই ধীরে ধীরে রূপুর সাথে তার বন্ধুত্বটা ভালোবাসার রূপ নেয়। যদিও অনু বিবাহ করতে রাজী ছিল না, কারণ আগের তিক্ত অঅভিজ্ঞতা থেকে তার মনে সংসার সম্পর্কে স্থায়ী ভয় বাসা বেঁধেছিল। কিন্তু রূপুর অদম্য জেদ আর চেষ্টার কাছে হার মেনে সে আবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়। এখন সে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মনে মনে মা হতে পারার সুখানুভূতি নিত্য চারিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে, বাচ্ছার গর্ভে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে।
এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই অনু স্নানে ঢোকে।
রূপু বলেছে বাথরুমে গেলে কখনও দরজা লাগাতে না। তাই সে দরজা ভেজিয়েই স্নান করছিল। মুখে সাবান দিয়ে সাবানটা রাখতে গিয়েই নীচে পরে গেল। সে তাড়াহুড়ো করে মুখটা ধুতে গেল,তারপর সাবানটা তুলে রাখবে ভেবে। কিন্তু কলের পাশেই পরে থাকা সাবানটায় পা পরাতে, সে পা পিছলে পরল বাথরুমের মেঝের উপর। ভয়ে, প্রবল মানসিক টেনশনের জেরে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে সে বুঝল সে জ্ঞান হারাচ্ছে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
বেশ কিছুক্ষণ পর মনে হল চোখের সামনে একটা আলোর আভাস। কে যেন অনু অনু বলে ডাকছে। অনেক চেষ্টার পর চোখ টেনে খুলে সে দেখল তপু বসে তার শিয়রে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। প্রথমে সে ভাবল সে স্বপ্ন দেখছে। পরে বুঝল স্বপ্ন নয়,তপু সত্যি তার শিয়র প্রান্তে বসে আছে। সে উঠে বসতে গেলে তপু বাঁধা দিল।বলল " তুমি একটু ঘুমাও অনু, আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। তুমি মা হতে চলেছ, একটু বেশী সাবধানতা অবলম্বন করে চলা তোমার অবশ্যই উচিত।জানতো একটা সন্তান কতো কাঙ্ক্ষিত জীবনে। নিজেদের জীবন দিয়ে বুঝলে না?" অনু জিজ্ঞেস করে "কিন্তু তুমি হঠাৎ কি করে চলে এলে আমার বাড়ি?" তপু বলে " পরে সব বলব, এখন তুমি একটু রেস্ট নাও দেখি। কতো বড় বিপদ যে আজ তোমার হতে যাচ্ছিল, তুমি আন্দাজও করতে পারবে না।" সত্যি খুব ক্লান্ত লাগছে অনুর। তপুর হঠাৎ আগমনের আকস্মিকতায় সে অবাক হলেও বেশী চিন্তা করতে সে আর পারছিল না।সকাল থেকে আজ কেন জানি বার বার বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তপুকে তার মনে পরে যাচ্ছিল, আর আজই তপু এসে হাজির,এ কি মিরাকেল, ভাবতে ভাবতে সে চোখ বন্ধ করে। ধীরে ধীরে দুই চোখের পাতা ভারী হয়ে ঘুমে ঢলে পরল সে। ঘুম ভাঙল রূপুর ডাক আর নাড়া খেয়ে। ঘুম থেকে উঠে ভ্যাবলার মতো সে এদিক ওদিক দেখতে লাগল। রূপু বলল "সন্ধ্যা অবধি ঘুমাচ্ছ যে অনু, শরীর ঠিক আছে তো?" অনু তখনও তার বিষ্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মাথা নেড়ে হ্যাঁ করল। তারপর বলল "তোমার বন্ধু এলো না?" শুনে রূপু বলল " না, আমিই ওকে আজ আনলাম না। আজ অফিসে তোমার দিদি ফোন করেছিলেন। জানালেন কাল আসামের গভীর জঙ্গলে আলফা জঙ্গিদের সাথে গুলী বিনিময়ের সময় তপু গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। " শুনে অনুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল, মুখে কথা জোগাল না। রূপু বলে চলেছে " আমরা তিনজন এতো ভালো বন্ধু ছিলাম,তার উপর তোমার তো ওর সাথে অনেক বেশী গাঢ় ছিল সম্পর্কের বাঁধন, তাই মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ইচ্ছে করেই জয়কে বলে দিলাম অন্যদিন যাস আমার বাড়ি। আজ একটু অসুবিধা আছে।"
অনু বোবার মতো বসে রইল খাটের উপর। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল পাশের বাড়ির ছাদে চোদ্দো বাতি দিয়েছে। মনে পরে গেল..... ও আজ তো ভূত চতুর্দশী।মনটা বাইরের ঘন অন্ধকারের মতো তমসাচ্ছন্ন হয়ে গেল এই ভেবে যে বাবা হওয়ার তুমুল বাসনা বুকের মধ্যে নিয়েই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে যেতেও তপু অসীম মমতার বশবর্তী