#শিরোনাম : #ঋণশোধ
কলমে #পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়
আজ কয়েকবছর হল এপাড়ায় ভাড়া এসেছেন প্রণতি দেবী। দুই মেয়ে শ্রী আর পরা দুজনেই লেখাপড়া করে, স্বামী বাইরে চাকরি করেন। বড়ো মেয়ে শ্রী কলেজে পড়ে, ছোট মেয়ে পরা পড়ে স্কুলের নিচু ক্লাসে। প্রণতি দেবী…
#শিরোনাম : #ঋণশোধ
কলমে #পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়
আজ কয়েকবছর হল এপাড়ায় ভাড়া এসেছেন প্রণতি দেবী। দুই মেয়ে শ্রী আর পরা দুজনেই লেখাপড়া করে, স্বামী বাইরে চাকরি করেন। বড়ো মেয়ে শ্রী কলেজে পড়ে, ছোট মেয়ে পরা পড়ে স্কুলের নিচু ক্লাসে। প্রণতি দেবীর বাপের বাড়ি এই পাড়াতেই। মাঝে মাঝে ভাই, জ্যাঠতুতো দাদা, বৌদি, ভাইপো এঁরা আসেন দেখা করতে, প্রণতিদেবীও যান। প্রণতি দেবী মানুষটা ভীষণ প্রাণবন্ত, উচ্ছল, কর্মঠ, আত্মীয় বৎসল, সহানুভূতিশীল এবং স্পষ্টবাদী। একদম রেখে ঢেকে কথা বলেন না আর একটা বিষয়ে প্রণতিদেবীকে সকলেই একটু সমঝে চলে, সেটা তাঁর কথার ধারের জন্য। সামনাসামনি অনেকেরই এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। স্বামী, মেয়ে কাউকেই এই ব্যাপারে রেয়াত করেন না তিনি। তারই কিছু এখানে তুলে ধরব।
ছোট মেয়ে পরার চোখে হাই পাওয়ারের চশমা, ফলে পড়ায় সে ভীষণ অমনোযোগী। স্কুলের ক্লাসে বোর্ড দেখতে পায় না বলে অর্ধেক ক্লাসের কাজ তার হয় না. তাই বাড়িতে তাকে চেপে ধরে পড়ান প্রণতিদেবী। সে পড়তে পড়তে নিজের অন্যমনস্কতা ঢাকতে হাঁ করে মায়েরই মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকে। প্রণতিদেবী তাকে বলেন, "এখন পড়ে নে, তোর পরীক্ষার পরে আমি সেজে গুজে বসবো, তখন সারাদিন ধরে দেখিস, কেউ বারণ করবে না"। শুনে বড়ো মেয়ে শ্রী খুব হাসতে থাকে, আর ছোটমেয়ে রেগে যায়।
মাসতুতো বোনের ছেলে সোমু দিদি শ্রীর খুব নেওটা। আসলে সারাক্ষন দিদির গা ঘেঁষে গল্প, রাত্রে শুয়ে শুয়েও দিদির সঙ্গে তার গল্প চলে, মাসি প্রণতিদেবীর সঙ্গে কথা বলে, কিন্তু দিদির সঙ্গেই বেশী ভাব। একদিন সোমু এসে ঐরকম শ্রীর সঙ্গে গল্প করছে, প্রণতিদেবী এসে সোমুর সামনে দাঁড়ালেন, শ্রী চা করতে গেল, সোমু দিদির পেছনে যেতে উদ্যোত হলে প্রণতি দেবী নিজের হাত পা শুঁকতে লাগলেন সোমুর সামনে। সোমু জিজ্ঞেস করল, "মাসি, কি হয়েছে "? প্রণতিদেবী বললেন, "না, দেখছিলাম আমার গায়ে খারাপ গন্ধ বেরোচ্ছে কিনা, আমি এসে দাঁড়াতেই তুই উঠে শ্রীর পেছন পেছন চললি, তাই মনে হল আর কি "। সোমু এমন হঠাৎ আক্রমণে রেগেমেগে বলল, "আচ্ছা মাসি, তুমি কি রোজ সকালে উঠে কুরুনি দিয়ে তোমার জিভটা কুরোও, উফফ... কি ধার গো তোমার জিভের"!!!
প্রণতীদেবীর স্বামী অলকেশ বাবুর মাথায় টাক নেই, কিন্তু চুলের একটা আলতো আবরণ যেন, ভীষণ পাতলা চুল তাঁর, প্রণতি দেবী বলেন অলকেশবাবুর মাথায় চুল "আছি আছি নেই নেই গোছের, মন খুলে আছি বলতে পারবে না, আবার নেইও বলতে পারবে না"।
অলকেশ বাবুর মা সুপ্রীতি দেবী ভীষণ দজ্জাল মহিলা, তাঁর তিন ছেলে একটু মেনিমুখো স্বভাবের আর তিন মেয়ে অবয়বে মহিলা কিন্তু স্বভাবে পুরুষ, ফলে ছয় ছেলে মেয়েদের যাঁরা জীবনসঙ্গী তাঁদের প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়। অলকেশবাবুকে প্রণতিদেবী সেই প্রসঙ্গে প্রায়ই বলেন, "তোমার মা সব ছেলেগুলোকে মেয়ে করে আর মেয়েগুলোকে ছেলে করে বড়ো করে বাজারে ছেড়ে দিয়েছে যার ফলে বৌগুলোর আর জামাইদের জীবনের সাড়ে সব্বোনাশ হয়ে গেছে "।
কেউ বেশ গাবিয়ে কিছু বললে প্রণতি দেবীর মন্তব্য, "তুমি যদি পঞ্চানন, তোমার দুঃখের কি কারণ "। অনেক ক্ষণ অপেক্ষা করতে হলে বলবেন, "উফঃ... শিবের মাথায় ফুল ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছি তো আছি, কখন ফুল পড়বে"। কোনো জিনিস না পাওয়া গেলে বলবেন, "শিয়ালের ইয়ের দরকার তো, তাই শিয়াল পর্বতে গিয়ে ইয়ে করেছে "।
শ্রীর বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে অশান্তি হলে শ্রী ফিরে আসে। একদিন শ্রীকে নিয়ে ফিরছেন প্রণতিদেবী, একটি দোকানে কেনাকাটা করার সময়ে পাড়ার ছেলে গৌরাঙ্গ জিজ্ঞেস করল, "মাসিমা, শ্রী কি এখন আপনার কাছেই আছে "? প্রণতিদেবী সঙ্গে সঙ্গে বললেন, "কেন, আর কোথায় থাকার কথা ছিল, তোমার কাছে "? গৌরাঙ্গ তুতলে টুতলে একাকার, সে এমনিতেই প্রণতীদেবীকে খুব সমঝে চলে তাঁর গাম্ভীর্যের জন্য, তবু সে বলল, "না, মানে জিজ্ঞেস করছিলাম আর কি "। প্রণতি দেবী বললেন, "এটা জিজ্ঞেস করার কি আছে, মেয়ে মায়ের কাছে থাকবে না তো আর কোথায় থাকবে, হ্যাঁ?"। গৌরাঙ্গ পালাতে পথ পায় না।
শেষে একটি ঘটনা বলি, পাড়াতে লক্ষ্মী ঘোষের ময়রার দোকান, ঘিয়ের ব্যবসা। প্রণতি দেবীর বাবা বিনয়বাবু প্রণতি দেবীর ভায়ের বিয়ের সময় লক্ষ্মী ঘোষের কাছ থেকে বিয়ের মিষ্টি, দই আর ঘি নিয়েছিলেন পঁচিশ বছর আগে। সব টাকা শোধ হয়ে গেলেও লক্ষ্মী ঘোষের খালি মনে হয় বিনয় বাবুর কাছে ওঁর ন টাকা বারো আনা আজও পাওনা, যেটা আদৌ সত্যি নয়। বিনয়বাবু মারা গেছেন কুড়ি বছর, প্রণতি দেবীর ভাই প্রণবেশের মেয়েরই তখন আঠারো বছর বয়স। প্রণবেশকে বলতে গিয়েছিলেন, সে এক ধমকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। সারাগায়ে শ্বেতী ভর্তি নিঃসন্তান লক্ষ্মী ঘোষকে পাড়ার ছেলেরা দেখলেই পেছনে লাগে তাঁর এই অকারণ অর্থগৃধ্নুতার জন্য। জীবনে তাঁর একটাই বেঁচে থাকার কারণ অর্থ একত্রিত করা, বৌ মারা গেছে বিনা চিকিৎসায়, বাড়িতে আর কেউ নেই, কিন্তু তবু তাঁর এই অর্থপিপাসার শেষ নেই। এহেন অশীতিপর লক্ষ্মী ঘোষ একদিন প্রণতিদেবী আর তাঁর মা বাজারে যাচ্ছেন, রাস্তায় ধরলেন, "অ প্রণতি, অ প্রণতি, একটু কথা ছিল মা। বিনয়বাবুর কাছে আমি ন টাকা বারো আনা পাই আজও, তুমি একটু দেখবে"? প্রণতিদেবী বললেন, "আপনি ভাইকে বলেছেন "? লক্ষ্মী ঘোষ বললেন, "হ্যাঁ, বলেছিলুম বৈকি, সে বলল পঁচিশ বছর আগের ওই টাকা এখন তামাদি হয়ে গেছে। তাছাড়া বাবা কারুর কাছে ঋণ রেখে যাবার লোকই ছিলেন না, আমি যখন বাবার কাছ থেকে শুনিনি, তখন ঐরকম কিছু বাকি নেই আপনার কাছে। এখন তুমি বল, তা বললে হয়, প্রায় দশ টাকার মত বাকি আছে "। এই লেনদেনের ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯৭২ সালে, আর বিনয়বাবু ভীষণ সৎ লোক ছিলেন, কখনো ধারে কোনো কিছু করার মানুষ ছিলেন না। তবুও প্রণতি দেবী দশটা টাকা লক্ষ্মী ঘোষের হাতে দিয়ে বাজারে চলে গেলেন।
কয়েকদিন পরে আবার লক্ষ্মী ঘোষ প্রণতি দেবীকে ধরলেন, তিনি নাকি তাঁর হিসেবের খাতা খুলে দেখেছেন ওটা তিরিশ টাকা ছিল। প্রণতি দেবী বললেন, "আমি এইসব কিছুই জানিনা, তবুও দশ টাকা আপনাকে দিয়েছি সেদিন, আর পারব না "। বলে চলে গেলেন, কিন্তু নাছোড়বান্দা লক্ষ্মী ঘোষ এতো সহজে ছাড়লে তো!!! দেখা হলেই সেই বিনয়বাবুর তাঁর কাছে ঋণ রেখে মরেছেন, টাকা শোধ না হলে ওঁর আত্মা শান্তি পাবে না, এইসব বলে কাঁদুনি গাইতে থাকেন। পাড়ার লোকজন লক্ষ্য করেছে, একদিন ভাইপো এসে বলল, "আমি একটু কড়কে দেব নাকি পিসি "? প্রণতি দেবী বললেন, "আর একটু দেখি বুঝলি "। পাড়ার ছেলেদের হাতে লক্ষ্মী ঘোষের কয়েকবার হেনস্থা হয়েছে তাঁর এই স্বভাবের জন্যে। কিন্ত তাঁর একদম "স্বভাব যায় না মলে" ।
এরপরে একদিন আবার প্রণতিদেবীর সঙ্গে রাস্তায় লক্ষ্মী ঘোষের দেখা, সেদিন ভাইপো কাছেই দাঁড়িয়ে, পাড়ার ছেলেরাও সবাই মোটামুটি কাছাকাছি রয়েছে, লক্ষ্মী ঘোষ এগিয়ে এসে প্রণতিদেবীকে বললেন, "তা প্রণতি আমার টাকা কটার ব্যাপারে কি ভাবলে? কবে দেবে ভাবছো?"প্রণতিদেবী খুব সহজ স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলেন, "ভাবছি, আপনার তো শিগগিরি বাবা সঙ্গে দেখা হবে, তখন চেয়ে নেবেন বাবার কাছ থেকে, তাতে বাবাও শান্তি পাবেন, আপনিও আপনার টাকা পেয়ে যাবেন "। লক্ষ্মী ঘোষ হতবাক হয়ে বললেন, "মানে "? প্রণতি দেবী বললেন, "মানে আপনি তো শিগগির ওপরে যাবেন, তখন ওখানেই এই লেনদেনটা করে নেবেন, আমাকে আর এর মধ্যে জড়াবেন কেন অযথা "। লক্ষ্মী ঘোষ ধপ করে রাস্তার মাঝখানে বসে পড়লেন হতাশ হয়ে আর পাড়ার ছেলেরা তাঁকে ঘিরে নাচতে রইল,
"হেই হেই লক্ষ্মী ঘোষের দই,
হেই হেই কিনতে গেলেই নেই,
লক্ষ্মী ঘোষের টাকা চাই,
আর কিছুই নেই "
এইসব ছড়া সুর করে বলে।
#কলমে : #অমিতাভ
#তারিখ : ০২/১১/২০২০
***************************
জৈষ্ঠ্যের তাপের পিঠে ঠেস দিয়ে পিপাসার্ত
আমি বসে আছি, পিপাসার জল দাও!
কে আছ চন্ডালিকা তৃষ্ণা মিটাবে?
অবাক করা রামধনু ওঠে না আর
বর্ণালী পাখিটিও কণ্ঠ ছোঁয়নি আজ
তুমি তো উড়ন্ত পাখি!
উড়ে যেতে যেতে হৃদয়ের কথা বলো যাও!
মানুষের মনের কোণে উঁকি মারা যেমন কঠিন -
তোমার ফেলে যাওয়া শব্দগুলো
জড়ো করাও তেমনি কঠিন!!
উড়বো যে -আমার তো ডানা ছাঁটা,
ভয় আর সংশয়ের মাত্রাবৃত্তে আঁটা...
জীবনের খোঁজে সারাজীবন
বালিয়াড়ির পথে হাঁটা!
চাঁদ সমুদ্রকে ছুঁয়ে আসে আমার কাছে
ঘামরেণু লেগে থাকে তোমার মুখে
একেই কি তবে জীবন বলে !
📝অমিতাভ