Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

কবি এবং সুলেখিকা দীপা ব্যানার্জীর গল্প জীবন যেরকম

#জীবন_যেরকম#দীপা_ব্যানার্জী#পর্ব_এক#মনীষার_কথা
আজ ট্রেনে ভীষণ ভীড়। পা রাখার জায়গা টুকুও নেই। কোনরকমে লেডিস কামরার এককোণে ঠেসাঠেসি করে একটু পা রাখার জায়গা করে নিয়েছে মনীষা। আজ এমনিতেই অফিসে কাজের চাপ বেশি ছিল। তার ওপর ট্রেনের অসহ্য…

 


 #জীবন_যেরকম

#দীপা_ব্যানার্জী

#পর্ব_এক

#মনীষার_কথা


আজ ট্রেনে ভীষণ ভীড়। পা রাখার জায়গা টুকুও নেই। কোনরকমে লেডিস কামরার এককোণে ঠেসাঠেসি করে একটু পা রাখার জায়গা করে নিয়েছে মনীষা। আজ এমনিতেই অফিসে কাজের চাপ বেশি ছিল। তার ওপর ট্রেনের অসহ্য ভীড়। আবার বাড়িতে ফিরে রাতের রান্নার ঝামেলা। ক্লান্তিতে মনীষার শরীর অবসন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু কিছুই করার নেই। একার রোজগারে আজকাল সংসার চালানো বড় দায়।তার ওপর বর রজত বড় বেশি টাকার অপচয় করে।

ভাবতে ভাবতে মনটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছিল। পাশে দাঁড়ানো কলিগ সীমার ডাকে সম্বিৎ ফিরল। "কিরে তখন থেকে ফোনটা বাজছে, কি ভাবছিস এত!" ব্যাগের ভিতর থেকে ফোন বার করে দেখল ছটা মিসডকল। সবকটা রজতের। কলব্যাক করল মনীষা। অপরপ্রান্তে রজত খিঁচিয়ে উঠল" কখন থেকে ফোন করছি, কোন রাজকার্য্যে ব্যস্ত ছিলে শুনি"! মনীষা এ প্রান্তে তোতলাতে থাকে,"আসলে ফোন ব্যাগের মধ্যে ছিল। আওয়াজ শুনতে পাইনি।" রজত বলে, " থাক অত এক্সকিউজ দিতে হবে না, সব লেম এক্সকিউজ! সামান্য ফোন ধরতেও পারেনা! তা মহারানীর আর কত দেরি হবে! খিদের চোটে পেট জ্বলে যাচ্ছে যে!" মনীষা টেনশনে পাগল হয়ে যায়। ভালোই বোঝে যে আজ বাড়ি ফিরে কপালে আরো অনেক দুঃখ আছে। ট্রেন থেকে নেমেই ছুটতে থাকে বাড়ির দিকে। ফ্রিজে মাছ আছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাছের ঝোল আর ভাত করতে হবে। নাহলে কপালে বিস্তর দুঃখ আছে। এভাবেই চলে মনীষার সারা সপ্তাহ। ছুটির দিন গুলো অবশ্য আরো চাপের। সেদিন পুরো বাড়ি পরিষ্কার করা, সারা সপ্তাহের বাজারের বন্দোবস্ত করা, জামাকাপড় কাচা এসব করতে করতেই কেটে যায়। বিশ্রাম নামের শব্দটা মনীষার ডিকশনারীতে একেবারেই নেই।

বাড়িতে পৌঁছনোর পরেই কোনমতে বাইরের পোশাক ছেড়ে হাত পা ধুয়ে আগে দৌঁড়ায় রান্নাঘরে। রজত বড়বেশী বদমেজাজি। পান থেকে চুন খসলেই বাক্যবাণে বিঁধতে থাকে। আগে আগে খুব অভিমান হত মনীষার। এখন ওসব বাদ দিয়ে দিয়েছে।রজত বলে, মেয়েমানুষের আবার মান অভিমান! 

যাইহোক কোনমতে ভাত চাপিয়ে ফ্রিজ থেকে মাছ বার করে ডিফ্রস্ট হওয়ার জন্য রেখে দিল। মাথাটা আজ বড় যন্ত্রণা করছে মনীষার। মনে হচ্ছে বিছানায় গিয়ে খানিকক্ষণ শুয়ে নেয়, কিন্তু সে উপায় নেই। শুতে শুতে রাত বারোটা বাজবেই।সকালে নটার মধ্যে তাকে অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যেতে হয়। তাই রান্নার কাজ খানিকটা রাতেই সেরে রাখতে হয়।

রজত চায়ের জন্য বারবার তাগাদা দিতে লাগল। দুকাপ চা করে বসার ঘরে গেল মনীষা।রজতকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতেই রজত বলে উঠল" রোজ রোজ এত দেরি হচ্ছে কেন বলতো তোমার! অফিসের পর কি আজকাল কারো মনোরঞ্জন করতে ব্যস্ত থাকছ নাকি!" মনীষা কোন জবাব দিলো না। রজত পুনরায় বলল, "কি হল গলায় কি প্যারালাইসিস হয়ে গেল নাকি! উত্তর দেওয়া যাচ্ছে না!"মনীষা যতটা সম্ভব দৃঢ় গলায় বলল,"অফিসে কাজের চাপ একটু বেশি আজকাল।রোপার কাজ চলছে,আগের ট্রেনটা তাই ধরতে পারছি না"। "আমাকে উদ্ধার করে দিচ্ছ একেবারে"।

মনীষা খোঁচাটা শুনতে শুনতে রান্নাঘরে চলে এল। চোখ থেকে ক'ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।কোনমতে সেটা সামলে নিয়ে মাছগুলো কড়াইয়ে দিয়ে দিল ভাজার জন্য।দেরী হলে আবার কথা শুনতে হবে। কাল আবার নতুন করে যুদ্ধের জন্যে মাঠে নামতে হবে। আজ বড় বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, লড়াই করার মন মানসিকতা কোনটাই নেই।

***********************

 #জীবন_যেরকম

#পর্ব_দুই

#রজতের_কথা

#দীপা_ব্যানার্জী


সকাল থেকেই মেজাজটা বিগড়ে আছে রজতের। বড় একটা অর্ডার এসেছিল গতসপ্তাহে। খুব নিশ্চিন্ত ছিল রজত,কারণ বেশ বড় অঙ্কের টাকা পাবার সম্ভাবনা আছে অর্ডারে। কিন্তু আজ ডেলিভারির সময় দেখল পাঁচশো কপি তৈরিই হয়নি। ক্লায়েন্ট ফোন করে যাচ্ছেতাই ভাষায় অপমান করল রজতকে। তখন থেকেই মেজাজ খারাপ হয়ে আছে রজতের। বাড়িতে বসেই কাজ করতে হয় রজতকে, বাইরে যাওয়ার উপায় নেই তার। তাই বড়বেশী পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছে আজকাল। এদিকে মনীষাকেও নিজের সমস্যার কথা বলতে পারেনা রজত। মনীষা ফেরেও আজকাল বড্ড বেশি দেরি করে। একা একা বাড়িতে বসে থেকে বড্ড হাঁপ ধরে যায় রজতের। মনীষাকেও বড় বেশি অপমান করে ফেলে আজকাল। ঘড়িতে দেখল রাত আটটা বাজে। এখনো এলনা মনীষা। রজত ফোন করল।মনীষা ধরল না । আবার চেষ্টা করল। পরপর ছ 'বারের চেষ্টার পর ফোন ধরল মনীষা। রজত রেগেমেগে বলল "কখন থেকে ফোন করছি, কোন রাজকার্য্যে ব্যস্ত ছিলে শুনি।" অপরপ্রান্তে মনীষা মিনমিন করে কিছু জানায়। আরো মাথা গরম হয়ে যায় রজতের।খিদে সহ্য করতে পারেনা একদম রজত। মনীষার আসতে আরো লেট হবে। ততক্ষণ কি করবে কিছু বুঝতে পারেনা। আসলে চাকরি টা চলে যাওয়ার পর থেকেই রজত আরো বেশি খিটখিটে হয়ে পড়ছে। মনীষার হাবভাবেও আজকাল আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করছে।আগে সাততাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরত। আর এখন সাড়ে আটটা নটার আগে বাড়িতেই ঢোকে না। কি জানি কি চক্কর চালাচ্ছে বাইরে। আজকাল বড্ড সন্দেহ হয়। চাকরি চলে যাওয়ার পর বাড়িতেই ব্যাবসা শুরু করেছে রজত। কিন্তু কিছুতেই লাভের মুখ দেখছে না। আজকাল তো মনীষার টাকাতেই সংসার চালাতে হচ্ছে। এদিকে আবার আজকের এতবড় ক্ষতি। মনীষা নির্ঘাত তাকে ছেড়ে দেওয়ার মতলবে আছে। তার মত অকর্মণ্য লোকের সাথে থাকবেও বা কেন!রজত ভাবে আগে তো দিব্যি গলা উচিয়ে ঝগড়া করত আমার সঙ্গে। আর এখন আমাকে পাত্তাই দেয়না! এই যে এত অপমান করি, তাতেও মুখ খোলেনা।আসলে রজত চায় মনীষা তার সঙ্গে আবার আগের মত ঝগড়া করুক,অভিমান করুক। কিন্তু মনীষা কিছুই করেনা। আজকাল তো পাশেও শোয়না। মনীষা যদি অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে যায় তাহলে রজতের কি হবে! এই সব ভেবে ভেবেই আজকাল সময় কাটে রজতের। 

কলিং বেলের আওয়াজে বাস্তবে ফেরে রজত। দরজা খুলে দেখে মনীষা। "যাক ফিরেছ তাও! আমিতো ভাবলাম আজকেই পালানোর প্লানিং করে ফেলেছ"! মনীষা এ কথাতে একেবারেই পাত্তা না দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। সেখান থেকেই একেবারে রান্নাঘরে চলে গেল।রজত ভাবে একবার কথার প্রতিবাদ তো অন্তত করতে পারত! যাক রান্নাঘরে গিয়ে মনীষার কাছে চা চাইল। মনীষা কোন জবাব না দিয়ে নিঃশব্দে চা করতে লাগল। চা নিয়ে ঘরে আসার পর রজত জিজ্ঞাসা করল"রোজ রোজ এত দেরী হচ্ছে কেন বলতো, কারো মনোরঞ্জনে ব্যস্ত থাকছ নাকি! মনীষা কোন জবাবই দিলনা। রজতের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। চিৎকার করে বলে উঠল" কি হল গলায় কি প্যারালাইসিস হয়ে গেল নাকি, উত্তর দেওয়া যাচ্ছে না!" এবার মনীষা দৃঢ়কন্ঠে জানাল যে তার অফিসে নাকি রোপার কাজ চলছে। চাকরি টা থাকলে আজ তারও ইনক্রিমেন্ট হত। মনীষাও তাকে এভাবে অবহেলা করতে পারতো না। মনটা বড় তেতো হয়ে গেল রজতের। এখন মনীষা রাত বারোটা পর্যন্ত রান্নাঘরেই কাটিয়ে দেবে। আবার কাল নটা বাজতে না বাজতেই বাইরে দৌড়াবে। রজতের মনে হয় তাকে অ্যাভয়েড করার জন্যই মনীষা এসব করে। ছুটির দিনেও খালি কাজ কাজ আর কাজ! একদিন কি রজতের সঙ্গে একটু কথা বলে কাটাতে পারেনা! চাকরি চলে গেছে বলে কি এতটাই অপদার্থ বনে গেছে রজত! কাল আবার সারাদিন বাড়িতে একা একা বসে থাক। বন্ধুরাও যে যার অফিস, সংসার কাচ্চা বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত।একটা সন্তান থাকলেও তাকে নিয়ে সময় কাটতো। কিন্তু মনীষাকে সেকথা বললেই বলে, 'এই রোজগারে বাচ্চা মানুষ করা যায় না।' সত্যিই সে অকর্মণ্য হয়ে গেছে। মন খারাপ করে নিজের ঘরে গেল রজত। আজকাল বড় সাধ্যসাধনার পর একটু ঘুম আসে। ঘুমের একটা পিল খেয়ে শুয়ে পড়ল। একেকসময় মনে হয় সবকটা পিল একসাথে খেয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। যাক কাল আবার ক্লায়েন্টের হাতে পায়ে ধরে অর্ডারটা নতুন করে নিতে হবে। আজ আর কিছু ভাবার মত মনের পরিস্থিতি নেই।

***********************

#জীবন_যেরকম

#দীপা_ব্যানার্জি

#মনীষার_কথা

#তৃতীয়_পর্ব


আজ আবার শুরু হল যুদ্ধ। অফিস টাইমের ট্রেনে পা রাখার জায়গাটুকুও থাকেনা। মনীষা কোনরকমে এককোণে দাঁড়াবার জায়গা করে নিয়েছে।হঠাৎ পরিচিত একজনের ডাকে ঘুরে তাকিয়ে দেখল ছোটবেলার বান্ধবী নিয়তি। নিয়তিকে দেখে মনটা আনন্দ ভরে উঠল। কিছুক্ষণ পর দুজনে বসার জায়গা পেয়ে গেল।নিয়তি মনীষার মুখের দিকে তাকিয়েই বলল "কিরে মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন?কিছু সমস্যা হয়েছে নাকি রে?" মনীষা এড়িয়ে গিয়ে বলল," আরে কিছু না, তোর খবর বল?কি করছিস আজকাল?" নিয়তি মুখটা একটু ব্যাজার করে উত্তর দেয়," কি আবার করব! সেই দশটা পাঁচটার দাসত্ব চালিয়ে যাচ্ছি।" শুনে মনীষা হেসে ফেলল। "তুই আর বদলালি না, সেই জগৎ সংসারের ওপর তোর যত অভিযোগ কমলো না!" নিয়তি বলল"আমি বাবা তোর মত অত দয়ার সমুদ্র নই, তুই তো বরাবর মাদার ইন্ডিয়া রয়ে গেলি!,বাই দ্য ওয়ে রজতদার কি খবর?" "কি আবার খবর হবে! আছে ওই আরকি!" নিয়তি অবাক হল" এমন নির্বিকার হয়ে উত্তর দিচ্ছিস কেন? কি হয়েছে বলতো!" "কি আবার হবে!সেই একরকমই রয়ে গেল, এত বয়স হল তবু সামান্য ম্যাচিউর হল না। কথায় কথায় বাচ্চাদের মত রাগ অভিমান"। "তুই বলেই সহ্য করিস! অন্য কেউ হলে কবে সব সম্পর্ক চুকিয়ে বেরিয়ে আসত!" নিয়তির গলায় একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ে। "অতই সোজা!যে মানুষটাকে একদিন ভালোবেসে বিয়ে করলাম, এত বছর সংসার করলাম, অত সহজে তাকে ত্যাগ করা যায়!" "তার মানে তুই রজতদাকে এখনো ভালোবাসিস"? "ওমা ভালোবাসা কখনো কমে যায় নাকি! একি আবহাওয়া যে আজ একরকম কাল অন্যরকম হবে! আর তাছাড়া রজত আমাকে ভালোবাসে বলেই না হারাবার ভয় পায়! আসলে কি জানিস তো আমাদের সম্পর্কের ওপর ধুলো পড়েছে,যা পরিষ্কার করা যাচ্ছে না।" " তাহলে অসুবিধা কিসের! পরিষ্কার করে নে না!" নিয়তি অবাক হয়ে বলে ওঠে। "ইগো, এই একটা ছোট্ট শব্দ যেটা কিছুতেই কোনকিছু ঠিক করতে দেবেনা রে। রজত একটা ইগোট্রিপের মধ্যে দিয়ে চলেছে, যেখান থেকে বেরিয়ে আসা হয়ত কখনো সম্ভব না।" মনীষার গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে। নিয়তি এবার একটু ব্যথিত গলায় বলে ওঠে,"নারে তুই একটু বেশী বেশী ভাবছিস, আসলে বাড়িতে একা থেকে থেকে রজতদার মধ্যে একটা পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার এসে গেছে। তুইই বল একে চাকরি হারানোর আপশোষ, অন্যদিকে তোর প্রতি পসেসিভনেস, এই দুইয়ের ফাঁসেই তো রজতদার আজ এই অবস্থা! আর তুইও তো একদম সময় দিসনা"! মনীষা বলে,"সময় দেব কখন বলতো? আমি তো আমার কাজ নিয়েই নাজেহাল রে, সংসারের কোন কাজেই তো কারো সাহায্য পাইনা। সব একার হাতে সামলাতে গিয়ে আর ........ তাছাড়া কথা বলব কি! যে ভাষা আজকাল আমার ওপর প্রয়োগ করে তাতে আর কথা বলার সাহস বা প্রবৃত্তি কোনটাই হয়না।" 

কথা বলতে বলতে গন্তব্য এসে যায়। নিয়তিকে বিদায় জানিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ে মনীষা। নিয়তির বলা কথাগুলোই কানে ভাসতে থাকে। কি জানি এই সম্পর্কের কি কোন পরিনতি আছে! নাকি শুধুমাত্র অভ্যাস বশে একে অপরের সাথে বসবাস করে যেতে হবে সারাজীবন! রজতকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মনীষা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা। যতই খারাপ ব্যবহার করুক না কেন, তবুও দিনের শেষে রজতের মুখটা দেখতে পাবেনা ভাবলেই শিউরে ওঠে মনীষা।

ক্রমশঃ

*********************

#জীবন_যেরকম

#দীপা_ব্যানার্জী

#চতুর্থ_পর্ব

#রজতের_কথা


সন্ধ্যে থেকে আজ শুরু হয়েছে প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। একদিকে অঝোর ধারায় বর্ষণ ও সাথে সাথে এলোমেলো বাতাসের ঝাপটা। মাঝে মাঝেই আকাশ চিরে বিদ্যুৎ এর ঝলকানি আর সাথে কানফাটানো আওয়াজ।আর দুর্যোগের সঙ্গে ফাউ হল লোডশেডিং।অন্ধকার এত ঘন যে মনে হচ্ছে যেন কেউ আলকাতরা বুলিয়ে দিয়েছে আকাশে।রজতের মনে হচ্ছে যেন জগৎ সংসার এবার পুরোপুরিই রসাতলে যেতে বসেছে।


এই দুর্যোগে বাড়িতে একা একা বসে থেকে রজত হাঁপিয়ে উঠল। সময় যেন কাটতেই চাইছে না তার। অন্ধকারে বসে থেকে থেকে নিজেকে পাগল পাগল লাগতে থাকে রজতের। অন্ধকারে সারা বাড়ি হাতরে হাতরে একটা মোমবাতিও খু্ঁজে বার করতে পারেনি সে। "কোথায় যে রাখে সবকিছু! কিছুই খুঁজে পাইনা, টর্চ টার পর্যন্ত ব্যাটারি শেষ! আসুক আজ কত ধানে কত চাল হয় টের পাইয়ে দেব!" নিজের মনেই গজগজ করতে থাকে সে। বিছানা হাতরে কোনমতে ফোনটা আবিষ্কার করে। সেটাতেও বেশি চার্জ নেই। বাড়িতে আর কোন ফোনও নেই। এটার চার্জ গেলে একেবারে কানা হয়ে যাবে সে। রজত মনীষার নম্বর ডায়াল করল। একবার দুবার তিনবার,............. বেজেই গেল বেজেই গেল, মনীষা তুলল না। রাগের মাথায় ফোনটা ছুঁড়ে মারল সজোরে। সৌভাগ্য যে সেটা খাটের ওপর গিয়ে পড়ল ও বরবাদ হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেল। রজত বারান্দায় ইজিচেয়ারে গিয়ে বসল। বৃষ্টির অল্প অল্প ছাঁট এসে রজতকে ভিজিয়ে দিতে লাগল। হয়তো বৃষ্টির জলের কারনেই তার মনটা এবার একটু শান্ত হল। মনে পড়ল এমনই এক বৃষ্টির দিনের কথা। সেদিনও এমনই অঝোরে ঝরছিল বারিধারা। দুজন একা অন্ধকারে এই বারান্দায় বসে বসে বৃষ্টি ও ঝড়ের খেলা উপভোগ করছিল। রজত কিন্তু সেদিন সমানে মনীষার সঙ্গে খুনসুটি করে যাচ্ছিল। আর মনীষা কপট রাগ দেখিয়ে বারবার রজতের সঙ্গে মিথ্যা মিথ্যা ঝগড়া করছিল। শেষ পর্যন্ত সেদিন সেই কপট ঝগড়ার পর একসময় তারা দুজনেই নিজেকে অপরের কাছে সমর্পণ করেছিল।সেদিনের সেই আদরঘন সময়ের কথা ভাবতে ভাবতে অজান্তেই রজতের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। স্মৃতির অতলে হাতরে হাতরে মণিমুক্তো আহরণ করতে করতে কখন যে সময় কেটে গেল খেয়ালই করতে পারলনা। আচমকা ফোনের আওয়াজে সম্বিৎ ফিরল। ঘরে গিয়ে দেখল পাড়ার বন্ধু প্রশান্ত। ফোন ধরতেই ও প্রান্তে প্রশান্তর উদ্বেগপূর্ণ গলা পেল," কিরে মনিবৌদি ফিরেছে? " প্রথমে প্রশ্নটা হৃদয়ঙ্গম হলনা রজতের। কিন্তু ফোনের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। রাত সাড়ে এগারোটা! সেকি! মনীষা তো এখনো ফিরল না! কোনমতে ফোন কেটে মনীষার নম্বর ডায়াল করল। কিন্তু না সুচইড অফ। বেশ ঘাবড়ে গেল রজত। কি হল মনীষার? এত রাত তো কখনও করেনা সে! তাছাড়া ঝড়বৃষ্টি থেমে গেছে বহুক্ষণ। কোথাও আটকে থাকার সম্ভাবনাও তো নেই। তবে কি কোন দুর্ঘটনা? ভাবতেই বুকের কাছটায় ভার অনুভূত হল। 


কোনমতে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। মনীষার সব অফিস কলিগের সাথে কথা বলে জানা গেল যে আজ মনীষা আকাশের অবস্থা দেখে একটু তাড়াহুড়ো করেই অফিস থেকে বের হয়ে গেছিল। কনিকা জানাল যে "মনীষা আমাকে কথায় কথায় মার্কেট যাওয়ার কথা বলেছিল।দুজন একসাথে মার্কেটে ঢুকলাম।ওখান থেকে মনীষা মোমবাতি, ব্যাটারি আর রাতে খিচুড়ি করবে বলে কিছু সামগ্রী কিনল। তারপর মার্কেট থেকে বেরিয়ে সোজা স্টেশনের দিকে চলে গিয়েছিল, তারপর আর আমি জানিনা।" 

রজত এবার শেষ চেষ্টার জন্য নিয়তিকে ফোন করল। নিয়তি সব শুনে বলল "কি বলছ! আজ তো আমার মনীষার সাথে দেখাই হয়নি!" রজত এপ্রান্তে ভেঙে পড়ে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, " নিয়তি তোর বরকে নিয়ে একবার আসবি? আমার ভীষণ টেনশন হচ্ছে রে"। নিয়তি সম্মতি জানায়। নিয়তি আর ওর বর সুপ্রতীম মিনিট কুড়ির মধ্যেই রজতের বাড়িতে চলে আসে। 

ক্রমশঃ

 ***********************

#জীবন_যেরকম

#দীপা_ব্যানার্জী

#পঞ্চম_পর্ব

#রজতের_কথা


বুকের কাছটা বড্ড বেশি ফাঁকাফাকা লাগছে রজতের। ভোররাত হতে চলল এখনো মনীষার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। সারারাত তিনজন পাগলের মত খুঁজে বেরিয়েছে মনীষাকে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি।ঠিক যেন কর্পূরের মত উবে গেছে সে। ভোরের দিকে নিয়তি বলল ," আর দেরি করে লাভ নেই, এবার পুলিশের কাছে যাওয়া উচিৎ"। সুপ্রতীম বলল, "আমার থানায় কিছুটা জানাশোনা আছে, আমি তোমার সাথে যাব চল"। তিনজনের দলটা থানার উদ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। রজতের মনের মধ্যে তোলপাড় চলছে।বিয়ের পর থেকে কোনদিন মনীষা তার থেকে এতক্ষণ দূরে থাকেনি। বাপের বাড়ি গেলেও রজত সবসময় সাথে সাথেই যেত। ফোন করে জেনেছে যে মনীষা সেখানেও যায়নি। মনীষার বাবামা হয়ত সকালের মধ্যেই এসে পড়বেন। যদি মনীষাকে পাওয়া না যায়! ভাবতেই রজতের বুকে চিনচিনে ব্যাথা শুরু হয়ে যাচ্ছে। মনীষার কিছু হলে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না। যতই তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করুক না কেন, সেতো অন্তর থেকে মনীষাকে ভালোবাসে। তাকে হারানোর ভয়ে ফ্রাসটেশনে পড়েই তো তার প্রতি বিরূপ আচরণ করে। আজ তার মনীষাকে যে একটা ভালো খবর দেওয়ার ছিল। তার নতুন চাকরির জয়েনিং লেটার আজ দুপুরে হাতে পেয়েছে সে। এটা আগের থেকেও উঁচু পোষ্ট। তার কি এই খুশি মনীষার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হবে না! ভাবতেই মাথায় টিপটিপ করে যন্ত্রণা শুরু হয়ে যাচ্ছে। 

এইসব ভাবতে ভাবতে কখন থানার গেটের সামনে পৌঁছে গেছে টের পায়নি রজত। আচমকা একটি পরিচিত আওয়াজে চমকে তাকিয়েই দেখল মনীষা,.................তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সারাশরীরে কাদা, শ্রান্ত চোখ। রজত দেখে ভাষা হারিয়ে ফেলে। মনীষা ভয় পেয়ে যায়। তোতলাতে তোতলাতে বলে ওঠে," আসলে আমি বৃষ্টির কারণে একটা ভাঙ্গা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, তখনই টের পাই দুটি ছেলে একটি মেয়ের সঙ্গে অভদ্র আচরণ করছে। দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। ছেলে দুটোকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে পাড়ার কজনের সাহায্যে থানায় নিয়ে এসেছি। সব ফর্মালিটিস পূরণ করতে দেরী হয়ে গেল"। রজত কিছু বলল না। শুধু মনীষাকে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরলো। আজ সে বুঝতে পেরেছে মনীষা তার কাছে কি। আর যেকোন মূল্যেই সে মনীষাকে হারাতে চায়না। নিজের বউয়ের দিকে গর্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ওঠে," তোমার মত মেয়ে যেন প্রতি ঘরে ঘরে জন্ম নেয়। আমার সব বাজে ব্যবহারের জন্যে আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।আমাকে ক্ষমা করবে তো!" এতদিন ধরে আটকে রাখা অশ্রু আজ বন্যা ঘটায় মনীষার চোখে। বরের দিকে তাকিয়ে বলে, "চল আজ থেকে একটা নতুন সূচনা করি। সেখানে না থাকবে রাগ, না ক্ষোভ না ঝগড়া, থাকবে শুধুমাত্র ভালোবাসা ভালোবাসা আর ভালোবাসা।" 

সমাপ্তঃ