Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

#সন্তানরূপেন 
     "ও মা দাও না গো যেতে, প্লিজ প্লিজ প্লিজ, যেতে দাও না। তুলি, মিনি, সুমি ওরা সবাই তো যাচ্ছে। চাটুজ্জে কাকু আমাকেও যেতে বলেছে। কাকিমাও বলছিলো, জানো কত্ত কিছু পাবো, আর আমাকে শাড়ি পরে সুন্দর করে সেজে যেতে হবে। …


 #সন্তানরূপেন 


     "ও মা দাও না গো যেতে, প্লিজ প্লিজ প্লিজ, যেতে দাও না। তুলি, মিনি, সুমি ওরা সবাই তো যাচ্ছে। চাটুজ্জে কাকু আমাকেও যেতে বলেছে। কাকিমাও বলছিলো, জানো কত্ত কিছু পাবো, আর আমাকে শাড়ি পরে সুন্দর করে সেজে যেতে হবে। দাও না গো আমায় যেতে। ওরা আবার আমায় পুজোও করবে। জানো, চাটুজ্জে কাকিমা বলছিলো এমন ভাগ্য নাকি খুব কম মেয়েরই হয়, ব্রাহ্মণদের মেয়ে ছাড়া নাকি কুমারী পুজোয় বসা যায় না। তাই আমি বসতে পারবো, দাও না গো মা, প্লিজ যেতে দাও।" 


     - তুষু অনেক্ষন ধরে মাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো। দেবিকা মেয়ের কোনো কথা কানে না তুলে ঘরের কাজে অতিরিক্ত ব্যস্ততা দেখাতে থাকে। তুষু আবার বলে - "দাও না মা আমায় যেতে"। দেবিকা ধমকের সুরে বলে - "তুষু বিরক্ত ক'রো না, একবার তো বলেছি তোমার ওখানে যাওয়া হবে না, এখন যাও নিজের ঘরে যাও, বিকেলে খেলতে যেও ক্ষণ ওদের সাথে। আর সন্ধ্যে বেলা আমরা সবাই একসাথে ঠাকুর দেখতে যাবো"। "আমি কোত্থাও যাবো না, তুমি যদি কুমারী পুজোয় না যেতে দাও আমি আর কোত্থাও যাবো না তোমাদের সাথে।" - এই বলে তুষু কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে চলে যায়।


     দরজার পাশে মা-মেয়ের এই কথোপকথন দাঁড়িয়ে দেখছিলেন দেবিকার শাশুড়ি মা প্রমীলা মুখার্জী। তিনি এবার ঘরে এসে দেবীকাকে বললেন - "আর কতদিন এভাবে আটকে রাখবে বৌমা, দিয়ে দাও, যাদের সম্পত্তি এবার তাদের হাতেই দিয়ে দাও ওকে। ওর পরিচয়েই ও বাঁচুক। এর আগেও তোমায় অনেকবার বলেছি, বাড়িতে আর অশান্তি ডেকে এনো না। ভালোয় ভালোয় বাড়ির বড়োদের কথা শোনো। তোমার এখনো একটা ছেলে আছে, তাকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে তো নাকি।" - কথাগুলো শুনিয়ে প্রমীলা দেবী বেরিয়ে যান। 


     দেবিকা ঘরের কাজ সেরে সন্ধ্যে বেলায় মেয়ের ঘরে যায়। 

-- "ওঠ মা, রেডি হয়ে নে, ঠাকুর দেখতে যাবো তো। আজ নবমী, তুই বলেছিলি না তোর পছন্দের লাল জামাটা আজ পরবি।"

-- "আমি কোত্থাও যাবো না তোমার সাথে, কোত্থাও না। ওরা আজ কত্ত মজা করলো, আর তুমি আমায় যেতেই দিলে না।" - বলে তুষু বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। দেবিকা জানে মেয়ের জেদ কত, তাই আর বৃথা চেষ্টা না করে নিজের ঘরে চলে যায়। 


     আজ দেবিকার বড্ডো কষ্ট হচ্ছে, বাস্তবটা সত্যিই বড়ো কঠিন। আজ এই নিয়ে রবিনের সাথেও অনেক মনোমালিন্য হয়ে গেল। রবিনও যেন আজ কাল কেমন একটা হয়ে যাচ্ছে, যদিও সে জানিয়েই দিয়েছিল এ বিষয়ে কোনো রূপ সাহায্য সে দেবীকে করতে পারবে না। এ লড়াই দেবীর একার। 


     লড়াই, সত্যিই এ এক লড়াই বটে। আজ সাত বছর ধরে সে একাই লড়ছে। প্রায় আট বছর আগে যেদিন প্রথম সুখবরটা শুনেছিল, খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলো বাড়ির সবাই। বাড়িতে এক নতুন অতিথি আসছে বলে কথা। রবিন আনন্দে তাদের পাঁচ বছরের ছোট্ট ছেলে তুবাইকে জিজ্ঞেস করে তার কি চাই বুনু নাকি ভাই। তুবাই আদো আদো গলায় বলে বুনুই চাই। সবাই আনন্দে খুব হাসে। দেখতে দেখতে এভাবেই হাসি মজায় কেটে যায় নয় মাস। মায়ের কোল আলো করে ওদের জীবনে আসে তুষু। সবাই ভীষণ খুশি। রবিন তো মেয়ে হওয়াতে আরো দ্বিগুন খুশি হয়ে পাড়ায় মিষ্টি বিতরণ করে। নার্সিংহোম থেকে ছাড়ার দিন ডাক্তার বাবু আলাদা করে ডেকে পাঠান রবিন ও দেবিকাকে। তারপর যা বলেন তাতে মাথায় বাজ পড়ে তাদের। দেবিকা হাতের মুঠো শক্ত করে বসে থাকে চেয়ারে। রবিন মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে। ডাক্তার বাবু জানান এখন তুষু যেহেতু দুধের শিশু কিছু কাল তাদের কাছে রাখাই ভালো, এরপর ডিসিশন তাদেরই নিতে হবে যে তারা কি করতে চায়। তেমন হলে ডাক্তারবাবু নিজেই যোগাযোগ করে দেবেন, তুষুকে তুলে দিতে হবে কিন্নর সম্প্রদায়ের হাতে। ভগবান যে তুষুকে দেবীর সন্তান রূপে পাঠিয়েছেন, না কন্যা রূপে, না পুত্র রূপে। 


     রবিন কিছুতেই ভেবে পায়না কি করবে সে। মন চায় না সন্তানকে দূরে ঠেলে দিতে, কিন্তু সমাজ কি মেনে নেবে তুষুকে? এক গভীর টানা পোড়েনে ভোগে রবিন। এদিকে দেবিকার মনে কোনো প্রশ্ন চিহ্ন নেই, সে তার সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করবে - এই তার দৃঢ় সংকল্প। দেবিকা মেয়েবেলায় এক বছর পুজোর অষ্টমীতে অঞ্জলি দেওয়ার সময় বলেছিলো -"ধনং দেহি সন্তানান্ দেহি সর্ব কামাংশ্চ দেহি মে"। তা নিয়ে তোলপাড় হয়ে যায় পুজোর প্রাঙ্গন। সে জানায় সে সন্তানকে সন্তান রূপেই কামনা করে, কেবল পুত্র বা কেবল কন্যা নয়। ভগবান তো তাকে সন্তানই দিয়েছেন। এই সন্তানকেও সে তার ছেলে তুবাই এর মতোই মানুষ করবে।


     তুষু ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকে সবার আদর যত্নে। রবিন এবার বাড়ির সবাইকে জানাতে বাধ্য হয় তুষুর সত্যতা। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সবার মত অনুযায়ী নেওয়া হবে। প্রথমেই সবাই একটা বড়ো ধাক্কা খায় এই খবর শুনে। পরে শ্বশুর শাশুড়ি জানান সমাজে বাস করতে হলে এ নির্মম সত্যকে তাদের মেনে নিতেই হবে, তুষুকে ছোটো থাকতেই ওর সম্প্রদায়দের কাছে দিয়ে দেওয়া ভালো, যত বড়ো হবে ওর পক্ষে আর তাদের পক্ষেও বেশি কষ্টকর হবে সেটা মেনে নেওয়া। ক্রমশ তুষুর প্রতি তাদের আদরের পারদ নিচে নামতে থাকে। বাড়ির বড়োদের নানান ব্যবহারে ছোট্ট ছেলেটাও বুঝতে থাকে তুষু তার বোন নয়, তুষুর প্রতি টান কমতে থাকে তারও। শুরু হয় দেবিকার লড়াই, মাতৃত্বের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। 


     আজ বাড়ির প্রত্যেকে মিলে দেবীকাকে বোঝাতে থাকে। রবিনও বাধ্য হয় মেনে নিতে, সমাজে যে থাকতে হবে। দেবীকাকে বলে - "দেবী একটু বোঝার চেষ্টা করো। কষ্ট কি আমারও হচ্ছে না, কিন্তু উপায় তো নেই। এ সিদ্ধান্তই সঠিক তুষুর পক্ষেও। ভেবে দেখেছো ও যত বড়ো হবে কি কি পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে ওকে। তাই এখনই সঠিক সময়।" দেবিকা কেবল অনুরোধ জানায় - "তুমি সাথে থাকলে আমি ঠিক সব সামলে নেবো দেখো।" রবিন এবার একটু বিরক্তির সাথেই জানায় - " তুমি তোমার জেদ নিয়েই বসে থাকো, আর কোনো দিন আমি এ বিষয়ে কোনো কথা তোমায় বলবো না, এ বিষয়ে তুমি আমার থেকে কোনো রূপ কিছু আশা রাখবে না। আমি নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে এ বিষয় থেকে সরিয়ে নিলাম আজ।"


     আজ দশমী। মায়ের বিসর্জনের পালা। মণ্ডপে মণ্ডপে চলছে ঢাকের সুর, গান-বাজনা। দেবিকা তৈরী হচ্ছিল মায়ের বরণ করতে মণ্ডপে যাবে বলে। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দেবিকা দরজা খোলে। দেখে চাটুজ্জে বাড়ির গিন্নি, পাশের বাড়ির রমা বৌদি, বিলুর মা, রতন মাস্টার, বিবেক দা আরো কতো সবাই এসে হাজির। ঠিক তাদের পিছনেই একদল কিন্নর হাতে তালি দিতে দিতে বাড়িতে প্রবেশ করলো। দেবী হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। 

-- "কই রে মা, নিয়ে আয় দেখি তোর বাচ্চাকে।" - তাদের মধ্যেই বয়ষ্ক একজন বলে উঠলো।

রবিন, তার মা, বাবা সকলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। রবিন হতভম্ব হয়ে বলে - " কি ব্যাপার বলুন তো, আপনারা এখানে সবাই মিলে? কি চাই আপনাদের?"

সেই বয়স্ক মাসিটি এগিয়ে এসে বলে - "কতদিন আর এভাবে লুকিয়ে রাখবি, যা নিয়ে আয় তোর বাচ্চাকে, তোদের সমাজ ওকে বাঁচতে দেবে না।" 

রবিন রেগে যায় -" কি সব বলছেন আপনি, কে এসব খবর দিয়েছে আপনাদের?"

চাটুজ্জে বাড়ির গিন্নি ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে বলে - "তা রবিন ঠাকুরপো, এত দিন ধরে এতো বড়ো সত্যিটা লুকিয়ে গেলে, আজ তুবাই তুলিকে মুখ ফসকে বলে দিলো বলে আমরা সব জানতে পারলুম। কি ভেবেছো এসব কথা কি আর লুকিয়ে থাকে, ওকে এদের হাতে সপে দাও, তাতে তুষুরই মঙ্গল।" 


     একটা শোরগোল পড়ে যায় বাড়ির মধ্যে। সবাই এতেই সম্মতি জানায়। সবাই মিলে রবিন ও তার মা-বাবাকে বোঝাতে থাকে। বাইরে মণ্ডপে ঢাকের আওয়াজ, গান-বাজনা এদিকে বাড়িতে এই শোরগোল রবিনের মাথা ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রনায়। অবশেষে রবিনের মা ছেলেকে এসে বলে -" আর কিছু করার নেই রবি, লোক জানাজানিও হয়ে গেছে, একদিন তো এই ডিসিশন নিতেই হতো, আজই না হয় ..." ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে প্রমীলা ঘরে ঢুকতে যান তুষুকে আনার জন্য। হঠাৎ দেখেন দরজার সামনে দেবিকা দাঁড়িয়ে, হাতে একটা ছুরি নিয়ে। দেবিকা আজ রণ মূর্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজের সামনে। এক পাও যদি কেউ তুষুর দিকে বাড়ায়, আজই সে শেষ করে দেবে নিজেকে, এলো পাথারি ছুরি চালাতে থাকে, কাউকে সে সামনে আসতে দেবে না। দেবিকার এই মূর্তি দেখে সবাই ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। দেবিকা মেয়ের ঘরে গিয়ে দরজায় খিল দিয়ে ঘুমন্ত মেয়ের পাশে শুয়ে পড়ে।


     রাত তখন একটা, বিছানা থেকে উঠে পড়ে দেবিকা, সিদ্ধান্ত সে নিয়ে নিয়েছে। গুছিয়ে নেয় তার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র। টেবিলে লিখে রাখে এক চিঠি রবিনের নাম। তাতে লেখা - 


     " পারলে আমার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিও, তোমরা তোমাদের মতো সুখী থেকো এই সমাজে। বাধ্য হয়েই এত বড়ো একটা ডিসিশন নিতে চলেছি। চিন্তা কোরো না, আমি ঠিক সব সামলে নেবো। যদি খবর রাখতে চাও, খবরও দেবো। আর যদি তুবাই এর কথা বলো তো বলি ওর জন্য তো তোমরা সবাই আছো ওর পাশে, তুষুর পাশে তো আমি ছাড়া কেউ নেই। তুবাই না হয় শুধু মায়ের আঁচল থেকে একটু দূরে থাকবে, আমি জানি তুমি ঠিক ওকে মানুষ করে তুলবে। তুষুর জীবনে আমিই ওর গোটা পরিবার হয়ে ওকে মানুষ করবো। ভালো থেকো।" 


                    ইতি,

                         তোমার অবাধ্য স্ত্রী দেবী


     চিঠিটা ঘরের টেবিলে রেখে দেবিকা ঘুমন্ত তুষুকে কোলে তুলে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। তখনও মণ্ডপে গান বাজছে। এতো রাতে রাস্তায় তখনও কত ভিড়, মায়ের বিসর্জন আজ। ঘুমন্ত তুষুকে কোলে নিয়ে দেবিকা হেঁটে যায় স্টেশনের উদ্দেশ্যে। মণ্ডপ পেরিয়ে বড়ো রাস্তায় ওঠে। তখনও দূরে মণ্ডপে গান বাজছে - 


"ইয়া দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।"


                                     সুপর্ণা দাস💕