Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

কারণে বারণ 
✍️✍️ পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়✍️✍️
তখন ক্লাস নাইন, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। সকালে ঘুম ভেঙেই মনে হল বাইরে একটা পুজো পুজো রোদ্দুর আজ। আজকে স্কুল আছে, কিন্তু ফিরতে হবে নিজে, কারণ আজকে ফেরার বাস আসবেনা, তাই যাওয়া আসা দুটোই আজ সাইক…


 কারণে বারণ 


✍️✍️ পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়✍️✍️


তখন ক্লাস নাইন, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। সকালে ঘুম ভেঙেই মনে হল বাইরে একটা পুজো পুজো রোদ্দুর আজ। আজকে স্কুল আছে, কিন্তু ফিরতে হবে নিজে, কারণ আজকে ফেরার বাস আসবেনা, তাই যাওয়া আসা দুটোই আজ সাইকেলে, সন্ধ্যাবেলায় আবার টিউশন আছে। বাপি সকালে বেরিয়ে গেলেন শুধু চা খেয়ে, ডিপার্টমেন্টের পুজো আছে, সেই পুজোর পরে খাবেন। একটু পরে আমিও বেরোলাম স্কুলের জন্য সাইকেলে। যেতে যেতে রাস্তায় দেখলাম সব কটা রিক্সা স্ট্যান্ডে, সাইকেল সারানোর দোকানে ছোট ছোট বিশ্বকর্মা ঠাকুরের মূর্তি বসিয়ে ধুমধাড়াক্কা গান মাইকে বাজিয়ে সাড়ম্বরে পুজো হচ্ছে। সারাদিন স্কুলে কাটিয়ে বিকেলে বাড়ি ফিরে সঙ্গে সঙ্গে আবার বেরোলাম টিউশনে পড়তে। বিশ্বকর্মা পুজো বলে স্যার তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলেন, স্যারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখি সাইকেলের সামনের চাকায় হাওয়া নেই।


সাইকেল নিয়ে হেঁটে হেঁটে একটা সাইকেল সারানোর দোকানে এসে সামনের চাকায় হাওয়া ভরিয়ে বেরোতে যাব, দোকানের মালিকের ছোট্ট ছেলে, বছর ছয়েকের হবে, হাতে কয়েক কুচি ফল, একটা মিষ্টি, দুটো লুচি গুঁজে দিল। দেখি দোকানের মালিকও চোখে মুখে আকুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আমায় প্রসাদটা খেতে বলছেন, অগত্যা বাচ্ছাটার হাত ধরে গাল টিপে কোলে নিয়ে প্রসাদ খেলাম, ওকেও একটু দিলাম প্রসাদ, প্রণাম করলাম ঠাকুরের জায়গায়, তারপরে সাইকেল নিয়ে বাড়ি এলাম। বাড়ি এসে দেখি সবাই তৈরী হচ্ছে বেনাচিতির গীতা ভবনে নিমন্ত্রনে যাবে বলে। গীতা ভবনের অনিলদা আর সুনীলদা আমাদের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন, কর্মসূত্রে বাবার সঙ্গে আর পারিবারিক সূত্রে আমাদের সঙ্গে। ওঁদের বাড়িতে বিশ্বকর্মা পুজো হয়, যেহেতু ওঁরা কনস্ট্রাকশন বিজনেসের সঙ্গে জড়িত। প্রতিবারই আমাদের নিমন্ত্রণ থাকতো।


ওঁদের বাড়িটা ছিল বেনাচিতির জে কে পালের সাইকেলের দোকানের পাশের গলিতে।সকলে নিমন্ত্রণ খেয়ে বাড়িতে আসবার জন্য বেরোলাম, রিকশার জন্য হাঁটতে হাঁটতে জলখাবারের গলির মুখে দেখি আমাদের চেনা রিক্সাওয়ালা বিহারী কাল্লুদাস দাঁড়িয়ে আছে। এ কাল্লুদাস আবার আমার মাকে মা ডাকে, ওর নাকি আমার মাকে দেখলে ওর দেশে যে ওর জননী তার কথা মনে পড়ে। আমরা এগিয়ে ওর রিক্সায় উঠব, কাল্লুও আমাদের দিকে চেয়ে একমুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে, ঠিক তার আগের মুহূর্তে দেখি আমাদের পাড়ারই বাসিন্দা বুটি ব্যানার্জী কাকু, যিনি সেই সময়ে আইএনটিইউসির একজন কর্মকর্তা, ঈষৎ টলোমলো পায়ে এসে কাল্লুর রিক্সাতে উঠলেন এবং "চলো কনিষ্ক রোড" বলে হুঙ্কার দিলেন। কাল্লুদাস মিনমিন করে বলার চেষ্টা করল আমাদের কথা, কিন্তু বুটিকাকু তখন ঠিক নিজের মধ্যে নেই, কাল্লু অসহায় মুখে নিরুপায় হয়ে রিক্সায় উঠল চালাতে। আমরা একটু এগিয়ে রবিন সুইটসের সামনে থেকে রিক্সা পেলাম। আমাদের আগে আগে কাল্লু চলেছে বুটি কাকুকে নিয়ে।


এখানে একটু বলা দরকার, লিংক রোড দিয়ে কনিষ্ক রোডে ঢুকলে আগে পড়তো আমাদের বাড়িটা, কারণ আমরা থাকতাম সেকেন্ড ব্লকটায়, আর বুটি কাকুর বাড়ি হল ফিফ্থ বা লাস্ট ব্লকে, তাই বেনাচিতি থেকে কণিষ্কয় আসার সময়ে বুটি কাকুর বাড়ি আগে পড়ে। সেই সময়ে আমাদের ঠিক পাশের বাড়িতে থাকতেন মাইকেল কাকু, মাইকেল দাস আর একটু এগিয়ে ই রোর প্রথমের বাড়িটাতেই থাকতেন গোবিন্দ কাকু, গোবিন্দ সাহা। মাইকেলকাকু, গোবিন্দকাকু আর বুটিকাকু তিনজনেই আইএনটিইউসির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এবং একই পাড়ার বাসিন্দা বলে ঘনিষ্ঠতাও ছিল খুব। মাইকেল কাকুদের সঙ্গে আমাদের খুব হৃদ্যতা ছিল প্রতিবেশী বলে আবার আমাকে খুব স্নেহ করতেন বলে।মাইকেলকাকুর বাড়িতে আমি বহুবার দেখেছি দূর্গাপুরের কংগ্রেস লিডার লাবণ্য ঘটক, আনন্দগোপাল মুখার্জীকে।


কাল্লু বুটি কাকুকে নিয়ে ওঁর বাড়ির সামনে দাঁড়ালো যখন, তার পাশ দিয়ে আমাদের রিক্সাটা চলে এলো। পেরোতে পেরোতে শুনলাম বুটিকাকু বলছেন কাল্লুকে, "এ হামারা কোঠি নেহী হ্যায় "। তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে নটা । আমরা আমাদের বাড়ি পৌঁছে, ভাড়া মিটিয়ে ঢুকে গেলাম বাড়িতে। এবার বিছানা করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি প্রায় সোয়া দশটা, দেখি তখনো কাল্লু বুটিকাকুকে নিয়ে ঘুরছে, ওঁকে নামাতে পারেনি রিক্সা থেকে। বুটিকাকু মনের আনন্দে গান গেয়ে যাচ্ছেন "হ্যায় আপনা দিল তু আওয়ারা " আর রিক্সার সিট বাজিয়ে তাল দিচ্ছেন।আমার মা আর আমি কাল্লুর অবস্থা দেখে তখন খুব হাসলাম। এবার একটু বসে গল্প করে শুতে যাব যখন, সোয়া এগারোটা হবে, একবার বারান্দায় গেছি, দেখি তখনো কাল্লু বুটিকাকুকে নিয়ে ঘুরে যাচ্ছে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায়। বেচারার তখন পরনের গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে সপসপ করছে, সারা শরীর ঘামে ভেজা আর দুচোখে জল পড়ছে। বুটিকাকু ওকে দাঁড়াতে দিচ্ছে না, দাঁড়ালেই গালিগালাজ করছে, আর রিক্সা চললেই হেঁড়ে গলায় গান গাইছে। আর ওঁর বাড়ির লোক ওঁকে ওইরকম অপ্রকৃতিস্ত দেখে কেউ ওঁকে রিক্সা থেকে নামানোর ঝুঁকি নিচ্ছে না, নামানোর চেষ্টাই করছে না। কাল্লু বেচারার তাই ভোগান্তির শেষ নেই।


আমার মা কাল্লুর ওই অবস্থা দেখে মাইকেল কাকিমাকে ডেকে সমস্ত বললেন, কাকিমা সঙ্গে সঙ্গে মাইকেলকাকুকে বললেন। মাইকেলকাকু কাল্লুর রিক্সা ওঁর বাড়ির সামনে আসতেই বুটিকাকুর পাশে উঠে বুটিকাকুর বাড়িতে গেলেন। বুটিকাকুকে একরকম জোর করে ধরে নামিয়ে বুটিকাকুর বাড়িতে ঢুকিয়ে কাল্লুর রিক্সাতে ফেরত এলেন যখন, তখন রাত্রি বারোটা বাজে। কাল্লু সেই রাতে আমাদের বাড়িতে খেয়ে আমাদের বাইরের ঘরে শুয়ে পড়ল, বেচারা এতো ক্লান্ত ছিল যে ভালো করে খেতেও পারল না। কারণ সেবনের এহেন পরিণতি দেখে আমরা সকলেই সিদ্ধান্তে এলাম যে কারণ সেবনে চিরকালীন বারণ থাকবে আমাদের কাছে।