Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

অমৃতস্য পুত্রী
অমৃতা মুখার্জী
ছোটবেলা নিজের নাম টা ভীষণ অপছন্দ ছিল। বাসে যেতে যেতে শবনম বেকারী দেখে প্রাণ টা হু হু করে উঠত। আহা কি সুন্দর নাম! ভোরের শিশির শবনম। মা যে কোথা থেকে এই বিদ্ঘুটে পাঞ্জাবী নাম রাখলেন আমার। 
আর একটু বড় হয়ে দ…

 


অমৃতস্য পুত্রী


অমৃতা মুখার্জী


ছোটবেলা নিজের নাম টা ভীষণ অপছন্দ ছিল। বাসে যেতে যেতে শবনম বেকারী দেখে প্রাণ টা হু হু করে উঠত। আহা কি সুন্দর নাম! ভোরের শিশির শবনম। মা যে কোথা থেকে এই বিদ্ঘুটে পাঞ্জাবী নাম রাখলেন আমার। 


আর একটু বড় হয়ে দুঃখ টা আরো চতুর্গুণ হল যখন মর্দ সিনেমা রিলিজ করল আর পাড়ার মোড় ক্রস করতে গেলেই আওয়াজ আসতে লাগল “আরে ওই যাচ্ছে অমৃতা সিং, মর্দ নাম্বার টু ইন মর্দ”। তাদের সাথে হাতাহাতি করে যথার্থ মর্দানী টাঙ্গেওয়ালী হয়ে নাক মুখ ফাটিয়েও রাগ কমেনি। মাকে প্রচুর অভিযোগ করেছি নাম নিয়ে। 


কলেজে গিয়ে আরো বিপদ, প্রায়ই ডিপার্টমেন্টে ফোন আ্সতে লাগল, “অমৃতা কে ডেকে দেবেন ? আমার নাম মির্চা ইউক্লীড”। এবার মৈত্রেয়ী দেবীর ন হন্যতে। আরে কি মুশকিল ? এতো ভারি বিপদ! সারা পৃথিবীতে এত নাম থাকতে আমার নাম নিয়ে এরকম নখরা কেন রে বাবা?


প্রায় ভেবে ফেলেছি যে নাম পালটে সুচরিতা করে নেব, এমন সময় ট্রেনে দিল্লী যাবার পথে একজন আশ্চর্য যুবকের সাথে আলাপ হল। তার বাড়ি চন্ডীগড়। আমার জলহস্তীর মত সুটকেশ সে বার্থে তুলে সারা রাত দাঁড়িয়ে গল্প করে কাটিয়ে দিল এবং নামার আগে বুমেরাং টি মেরে গেল এই বলে “ আরে ক্যা শরম কি বাত! আপকো তো পড়না চাহিয়ে , অমৃতা প্রীতম জী কি কবিতাঁয়ে, মশহুর কলমসীন ওউর আপকী নেমসেক ভী হ্যায়”। বোঝো! কেমন থাপ্পড় সবজান্তা বাঙ্গালিনীর গালে। সর্দারজী দের নিয়ে আর যদি কোনদিন জোক করেছি এরপর। 


দিল্লী তে নেমেই করোল্ বাগের বইএর দোকানে পেয়ে গেলাম তার বই। সে রাতে সেন্ট্রাল দিল্লীতে কেন জানি লোডশেডিং হয়েছিল। ভাগ্যিস হয়েছিল। চাঁদের আলোর জাফরি কাটা মেঝেতে বসে মোমবাতির আলোয় পড়ছিলাম।


রাতের বুক চিরে তীব্র হুইসিল বাজিয়ে গুমগুম করে ব্যথার পাঁজর গুঁড়িয়ে চলে যাচ্ছে দেশভাগের ট্রেন। সময়টা ১৯৪৭। পাকিস্তানের লাহোর থেকে ট্রেন চলেছে দিল্লীর দিকে। কিশোরী অমৃত কাউর বাবা কর্তার সিং হিতকারির হাত ধরে রাতের অন্ধকারে বুকে পুঁটলি চেপে পালিয়ে যাচ্ছে। পিছনে পড়ে রইল মন্ডি বাহাউদ্দিন গ্রামের সবুজ মাঠের ঘুঙ্গুর পরা ফসলের সোনালী দোলা দেওয়া খেতিবাড়ি, বাবার পাঠশালায় ছেলেদের গুন গুন পড়ার সুর, মা রাজ বিবির হাতে নিকনো আঙ্গন। 


মা মরা মেয়েকে নিয়ে প্রচারক কবি কর্তার সিং বেড়িয়ে পড়েছেন পৃথিবীর পথে, অচেনা গন্তব্যের দিকে। হিন্দু না মুসলিম ? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন ? চেয়ে দেখ ভাগ্যবিধাতা ঘর ভেঙ্গেছে শিখ মেয়েটির। কোন লেবেল দেবে তাকে ? কোন শিবিরে ঠাঁই হবে তার ? শরণার্থী শিবিরে হাহাকার। চূড়ান্ত নারকীয় পরিস্থিতি। হাজার হাজার ধর্ষিতা মেয়ের কান্নায়, আতংকের কালো রাত। অমৃতা কাঊর চুপ করে দেখেন। বুকের রক্ত মাখা পাতায় লিখে নেন তাদের স্বজন হারানোর গল্প। ফেলে আসা সন্তানের জন্য আর্তনাদ আর অজানা ভবিষ্যতের আশংকা।


প্রলয় শান্ত হলে বাপ বেটির একটেরে সংসারে ছোট মেয়েটি গিন্নী সাজে। নিজের মত রাঁধে বাড়ে, যা থালায় দেয় বাবা সোনামুখ করে খান। আহা মা মরা মেয়ে যে! রাতে ডাল তড়কায় ফোড়ন দিয়ে মেয়েটি বাবাকে এক গাল হেসে বলে “ পিতাজী আপ কো কাহানী শুনায়ে ?” কুপির আলোয় সামান্য মকখির রুটি আর আচার খেতে খেতে বাবা একমনে শোনেন আত্মজার কাব্য। অমৃত কি লেহরে, অমর ঢেউ এর সারি। কোন এক গাঁয়ের মেয়ে পুরোর গল্প, কি ভাবে মুসলমান দের হাতে সে ধরা পড়ে, তার বাড়ি ফেরার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, আর বেচারী অপহরণ কারী পুরুষটি সারা জীবন ধরে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে হিন্দু মেয়েদের বর্ডারের ওপারে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে। মানুষ তো মানুষ ই। “পিঞ্জর” ( বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরবর্তীতে উর্মিলা মার্ত্নডকর আর মনোজ বাজপায়ী) কেটে পাখি উড়ে যায় ভালোবাসার দিগন্তে। রাতভোর হয়ে যায় গল্প শুনতে।


বাবা চুপিচুপি পান্ডুলিপি নিয়ে হাজির হন চেনা সাংবাদিক প্রীতম সিং এর দরবারে। জহুরী হিরা চেনে। কবিতা আর কবি দুজনের প্রেমে পড়লেন প্রীতম। অমৃতা হয়ে গেলেন অমৃতা প্রীতম। মাত্র ষোল বছর বয়সে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ “অমৃত কি লেহরে”। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত ছটি কাব্য সংকলন। পেছন ফিরে কোনদিন তাকাতে হয়নি।

সেই মেয়েটি কাহিনী হয়ে গেছে সেই কবিতাটির জন্য।


To Waris Shah (Heer Ranjha’s Author)

Once wept a daughter of Punjab

Your pen unleashed a million cries

A million daughters weep today

To you Waris Shah turn their eyes


তার ধারালো অকপট কলম লিখে চলে


“আমার জিভ থেকে গড়িয়ে পড়ার আগে

যে শব্দ গুলো আত্মহত্যা করে

সেগুলো যদি বাঁচত আর কাগজের উপর নামতে পারত,

একটা খুন খারাবি হতে পারত”


নিজের আত্মজীবনী “রসিদী টিকিটে” র পাতায় পাতায় হাসি মজার ছলে টাইম বোমার মত নারীর অবরুদ্ধ জীবনের ব্যথা গুলো সাজিয়ে রেখেছেন। না দেখে পা দিলেই বিস্ফোরণ হয়। যত দিন সংসার করেছেন ছেলে মেয়ে মানুষ করেছেন সে এক রকম। যেদিন ভাল লাগেনি আর, একদম ভণিতা আর ন্যাকামী করেন নি। তিনি ভালবাসার হাত ধরে চলে গেছেন ইমরোজের সাথে নতুন আলেয়ার খোঁজে। তাকে খারাপ বলবেন ? সমাজচ্যুত করবেন ? তাতে তার কিচ্ছু যাবে আসবে না। তিনি দারুণ হেসে বলবেন


“তোমাকে জড়িয়ে ধরব আশরীর

তাই ভাবছি রামধণুর একটা রঙ হব আর

নিজেকে আঁকব সেই রঙ্ দিয়ে তোমার ক্যানভাসে”


একে আপনাকে ভালবাসতে হবে। অসহায় ভাবে ডুবে যাবেন এর কবিতার পঞ্চনদীতে, রাতের অন্ধকারের স্বর্ণ মন্দিরের নিটোল সোনার ডোমটির মত সে ভেসে ঊঠবে আপনার কল্পনায়। সে বলবে,


“আমার তোমাকে মনে পড়ছে

ঠিক যেন আগুন কে আবার চুমু খেলাম

তোমার প্রেম যেন সেই অমৃত বিষের কাপ

যা আমি বার বার পান করি নিঃশেষে”


সাহিত্য আকাদেমি, পদ্মশ্রী, ভারতীয় জ্ঞানপীঠ, শতাব্দী সন্মান, পদ্মবিভূষণ সব পেয়েছেন। তাঁর গল্প নিয়ে হয়েছে অজস্র সিনেমা, নাটক। 


এম এস সথ্যু বানিয়েছেন অসামান্য কাহিনী “ এক থী অমৃতা”। 


প্রগতিশীল আন্দোলনের পথে নারীকে এগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সারা দুনিয়ার ২৩ টি ভাষায় অনুবাদিত তার কবিতা। ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সন্মান পেয়েছেন। এত দাঙ্গা, এত যুদ্ধ আর রক্তপাতের পরও পাকিস্তান আর হিন্দুস্তান সমান ভাবে ভালোবেসেছে আর আপন করে নিয়েছে অমৃতা কে। ওহ জো লাহোর কি বেটি, আরে ওহ হামারী দিল্লী কি ধড়কন এ দিল, তাকে নিয়ে কোন বিবাদ হয়নি, প্রশ্নহীণ আনুগত্য পেয়েছেন পাঠকের, সরহাদ কি দোনো তরফ সে।


সারা রাত পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তার কবিতা। ঘুম ভাঙ্গলো ভোরের প্রথম আলোয়। এই প্রথম নিজের নাম টা খুব ভালো লাগল। মাকে ফোন করে বললাম “ভীষণ ভালো নাম টা রেখেছিলে বাই দি ওয়ে”।


মা তাচ্ছিল্যের গলায় বললেন “তগো হেই প্রব্লেম বুঝছস ? অমৃতা প্রীতম পইড়্যা মায়ের বুদ্ধি আন্দাজ করস ? হের কবিতা তো আমরা কুন কালে পড়সি, আর শুধু হের জইন্য না আরেক অমৃতা আসিল চিত্রকর, শের গীল, তারেও মাথায় রাখসি, তর নাম দিবার সময়, বুঝছস? তারে নিয়েও লিখস, তবে বুঝবি মায়ের কমন সেন্স, আমরা অইলাম গিয়া কুমিল্লার মাইয়া, বড়লাট কে গুলি পর্যন্ত করতে পারি, বেশি কথা কস না”।


জয় কুমিল্লা, অমৃতা জিন্দাবাদ।


♥♥♥♥♥♥♥♥♥

© Amrita Mukherjee