Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

সৃষ্টি সাহিত্য যাপন।#আমার রং তোমায় দিলাম#গল্প©মণীষা রায়
__ দূরত্ব,  সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারেনি কোনদিনও। আমি আবার আসব। তুমি লিওনে এস।..., এলিসা বলে চলে....
 দোলের ছুটিতে  সিদ্ধার্থ  এসেছে হোস্টেল থেকে বাড়ি।  গেটের পাশে দাঁড়িয়ে…


 সৃষ্টি সাহিত্য যাপন।

#আমার রং তোমায় দিলাম

#গল্প

©মণীষা রায়


__ দূরত্ব,  সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারেনি কোনদিনও। আমি আবার আসব। তুমি লিওনে এস।..., এলিসা বলে চলে....


 দোলের ছুটিতে  সিদ্ধার্থ  এসেছে হোস্টেল থেকে বাড়ি।  গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়া গাছ দুটোই   ফুলে ভরে  গেছে। একটা মাছরাঙা চুপ করে বসে আছে নুয়ে পড়া কৃষ্ণচূড়ার ডালে। ভোরের  হাওয়ায় এখনও হালকা হিমেল পরশ । কোকিলের  উদাসী কুহু তান এবং দুপুর আর বিকেলের উষ্ণ হাওয়াটা বড় মন কেমন করা।  বাতাসে ভেসে বেড়ায় কি যেন  হারিয়েছির হাহাকার। মোড়ের রাস্তার ধারে পাতা ঝরা নেড়া শিমুল আর পলাশ গাছ দুটো দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য লাল ,ও কমলা  ফুল বুকে নিয়ে। সবুজ কচি পাতার আভাস তাদের শরীরে।


 এদিকে অনেক ফ্ল্যাট উঠলেও এখনও পাড়া কালচার। দোল খেলার পর দুপুরে  ঝিলের জলে স্নান করবে পাড়ার ছেলে বুড়ো সকলেই।।  রাতে পাড়ায় মাটন কষা,ডাল, ভাত , আলুভাজা আর রসগোল্লা দিয়ে  পিকনিক। ঘর ও বাইরে উৎসবের মেজাজ হলেও সিদ্ধার্থর পড়াশোনা থেকে মুখ তোলার অবসর নেই। পরীক্ষা এসে গেছে।  কয়েকদিন ছুটির পর আবার মেডিকেল কলেজ ,হোস্টেল, সাথে  তো আছেই কঠোর অধ্যাবসায়, অনুশীলন ও পরীক্ষা। 

নীচের থেকে মা হাঁক দেয় _


__ সিধু ও সিধু যা বাবা স্নান সেরে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরে ঠাকুর ঘরে আয়। রাধা মাধবের পুজো যে শুরু হলো বলে।


 ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে বৃন্দাবনের নন্দকাননে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ,রাধিকা দেবী এবং তার সখী ও অন্যান্য গোপীর সাথে রঙ খেলায় মেতেছিলেন। এই দিনকে স্মরণ করেই প্রত্যেক বছর সিদ্ধার্থদের বাড়িতে ফাগুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে, প্রচলিত পঞ্জিকা অনুসারে, ১৪তম রাতের পরবর্তী দিনে  হয়ে আসছে  দোলের পুজো। এই দিন রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ গুলালে স্নান করিয়ে দোলায় চড়িয়ে ,ভোগ নিবেদন করে ,কীর্তনগান সহকারে শেষ হয় তাদের বাড়ির পুজো।  রাধা মাধবকে ভোগ দেওয়া হয় আলুর দম, কাজু কিসমিস দিয়ে হলুদ জাফরানি পোলাও,কচুরি ,ছোলার ডাল  মালপোয়া আর রাবরি। বড়দের পায়ে আবীর দেয়। আজকাল আর কেউ রং খেলেনা। জলের অপচয়। আবীর ,গুলাল দিয়েই খেলে।


 সিদ্ধার্থ  দোতলায় তার ঘরে এসে পড়তে বসে । বাইরে লাল, হলুদ সবুজ গোলাপী আবীর হাওয়ায় উড়ছে।  জবরদস্ত খেলায় মেতেছে  পাড়ার কচি কাঁচা থেকে শুরু করে বড়রা অনেকেই।  সিদ্ধার্থ ডাক্তারী পড়া শুরু করার  আগে প্রত্যেক বছর খেলত তার সমবয়সীদের সাথে।  সে রাস্তার ধারে সোনাঝুরি গাছে ভরে থাকা হলুদ ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হারিয়ে যায় সীমান্ত পেরিয়ে অসীমের কোনো দূর শূন্যে।  বিরহেরা উড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে।  এটাই বসন্তের বিশেষত্ব। সে মেয়েদের প্রতি সহজ আকর্ষণ অনুভব করে। তার মেয়ে বন্ধু আছে কিন্তু বিশেষ আকর্ষণের কেউ নেই ।  পড়াশোনাই তার ধ্যান ,জ্ঞান ,সাধনা।

সিদ্ধার্থর বয়ঃসন্ধিকাল থেকে তার  বাবার কাছে  মাঝে মাঝেই মেল আসে সুদূর লিওন থেকে এলিসা ওয়ালকার হেরোল্ভের। সে প্রায় সিদ্ধার্থরই বয়সী। লিওন শহরটি দক্ষিণ প্যারিস থেকে তিনশ কিলোমিটার দূরে। শহরটি ঐতিহাসিক, ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ফ্রান্সের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। সে ডাচ্। তার ঠাকুর্দা নেদারল্যান্ডের আমস্টারডামে থাকে। সে, তার মা ,বাবা ও ছোট ভাই  থাকে ফ্রান্সের লিওন শহরে। তার মা ফরাসী ও একজন চিত্র শিল্পী। বাবা লিওনের একটি ইউনিভার্সিটির অংকের প্রফেসর। সে নিজে ইতিহাসের ছাত্রী। ঠাকুর্দা ও বাবার মুখে শোনে তাদের পূর্ব পুরুষদের কয়েক পুরুষ এক সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চুঁচুড়া শহরের বাসিন্দা ছিলেন।  ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তাদের বাড়িটা একজন ভারতীয় বাঙালি চক্রবর্তী পরিবারকে বিক্রি করে নেদারল্যান্ডে ফিরে যায় তারা পাকাপাকি ভাবে ।


পূর্ব পুরুষদের কাহিনী শুনে সে তৈরি করেছে কল্পনায় তার কালের নীড় যা সাক্ষী বহন করছে ইতিহাসের। তাকে চোখে দেখার বড় সখ তার। ফরাসী ও ভারতীয় দূতাবাসে যোগাযোগ করে ।, বেশ দীর্ঘ প্রচেষ্টার  পর দূতাবাসের সহযোগিতায় সে সিদ্ধার্থর বাবার নাম ঠিকানা পায়।  নিয়মিত যোগাযোগ রাখে সিদ্ধার্থর বাবার সঙ্গে। মেলগুলো সিদ্ধার্থও পড়ত। সুদূরের এই মেয়েটির প্রতি তার মনের কোণে বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়। এবার সে জানায় মার্চে আসছে ভারতে। তবে চুঁচুড়ায় কবে আসবে সঠিক তারিখ জানায় নি। 


সিদ্ধার্থর  জানলা দিয়ে দেখতে পায়  পন্ঞ্চুর  রিকশায় করে আসছে এক শ্বেতাঙ্গ তরুণী। দোল খেলা ছেড়ে সবাই তাকে দেখছে। সিদ্ধার্থ নীচে খবর দিতে  বাড়িতে হৈ চৈ পড়ে যায় । কি ভাবে আপ্যায়ন করবে এই না বলে কয়ে ,হঠাৎ চলে আসা বিদেশিনীর। সদর দরজা খুলে বাবা তাকে ভেতরে নিয়ে আসে। সিদ্ধার্থের মনে হতে লাগল

__ এরই জন্য কি এতকাল অপেক্ষায় ছিলাম? 

 বাবাকে  পাঠানো মেলগুলো পড়তে পড়তে তার মনে হত তার লেখায় প্রশংসনীয় সংযম আছে। আত্মম্ভরিতা বা বাচালতা নেই। একধরনের  মুগ্ধতাই  তৈরি হয়েছিল। 


এলিসা কুড়ি বছরের আর্য সুন্দরী ।  কথাবার্তায় প্রকাশ পায় বুদ্ধির দীপ্তি ,চিন্তার স্বচ্ছতা যা তাকে ঘিরে রহস্যের সৃষ্টি করেছে।  চেহারায় ও, কন্ঠস্বরে স্নিগ্ধ মাধুর্য। স্বল্পবাক কিন্তু সরল।   কথাবার্তাও খুব যুক্তিপূর্ণ ও গভীর। নানা বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান যা ফ্রান্সের অভিজাত সমাজে  অস্বাভাবিক বা বিরাট ব্যাপার নয়।

 

সে প্রথম কথা শুরু করে  ভাঙা বাংলায় ইংরেজী মিশিয়ে,পুরো বাক্য গঠনের জন্য একটু সময় নিয়ে। প্রত্যেককে নমস্কার জানিয়ে হঠাৎ উপস্হিত হবার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ।

___আমি তিনশ বাংলা , তিনশ হিন্দি শব্দ লার্ন বাই হার্ট করে ভারতে আসেছি। আমি সব খাব। বাট, চিলি ,স্পাইশ ,অয়েল লিটিল খাই।


রাধা মাধবের প্রসাদ দিব্যি খেল। তবে বারবার  মিনারেল ওয়াটারের বোতলে চুমুক দিচ্ছিল। সিদ্ধার্থদের তিনতলা বিশাল বাড়িটা গ্রথিক ডিজাইনের । বাড়িটা আজও সম্পূর্ণ ডাচ্ স্থাপত্যের নিদর্শন  বহন করছে ।  তিনকোনা সিঁড়ি,আর্চ ইত্যাদি বড় দৃষ্টি নন্দন। সিদ্ধার্থর ঠাকুর্দা শরিকি  বাড়িটা পুরোটাই  কিনে নেয় জ্ঞাতিদের কাছ থেকে।  সুন্দর ভাবে সংরক্ষণ করছে তারা। প্রোমোটারদের লালসার হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এলিসা বাড়িটা দেখে খুব উত্তেজিত ও আবেগ বিহ্বল হয়ে বলে


__একদিন  এই বাড়িতে আমার পূর্বসূরিদের কলকাকলিতে মুখর থাকত। এই জনপদে কত সহস্রবার তাদের পদধুলি পড়েছে।


 বাবার অনুরোধে চারদিন সে থাকে তাদের বাড়ি।  ডাচ্ সিমেট্রি, ডাচ্  ভিলা , দেখে সে  ভাবালু হয়ে পড়ে।   কবরের মধ্যে  ঘুমিয়ে আছে তারও পূর্ব পুরুষদের কেউ কেউ।  সকলের উদ্দেশ্যে সে জ্বালায় মোমবাতি। চন্দনগরের ফরাসীদের স্হাপত্য, ব্যান্ডেল চার্চ, ইমামবাড়ার স্হাপত্য দেখে সে মুগ্ধ। সিদ্ধার্থ  কলকাতায় নিয়ে গিয়ে সমস্ত দর্শনীয় জায়গাগুলো অত্যন্ত যত্ন সহকারে দেখিয়েছে। ভিক্টোরিয়ায়  বিকেলে  অস্তগামী লাল সূর্য আর চারপাশে  প্রকৃতিতে ছড়িয়ে থাকা  মুঠো মুঠো নানা রংএর দিকে চোখ রেখে , ফুচকা খেতে খেতে এলিসা বলে ওঠে _


___ সমস্ত মানুষের বস্তুত বাসস্থান এক। সেটা পৃথিবী। কাঁটা তারের সীমানাগুলো না থাকলে কি মজাই  না হতো।


এলিসা  আগামীকাল বেড়িয়ে পড়বে দিল্লির পথে। এ চার দিন  যেন এক নিটোল প্রেমের কবিতা। সারাদিন সে এলিসার সাথে সাথে থেকেছে। হাতে হাত  শরীরে শরীর কত বার স্পর্শ হয়েছে।  বন্ধুত্বের সৌজন্যে সে বার কয়েক তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়েছে কখনও গালে কখনও কপালে। তার বর্ণোজ্জ্বল দেহের সুগন্ধ সিদ্ধার্থকে করে তুলেছে আবেগ চঞ্চল।  পড়াশোনাই ছিল সিদ্ধার্থের আনন্দের উৎস। এলিসা সব ওলট পালট করে দিয়ে চলে যাচ্ছে। গভীর অবসাদে রাতে বিছানায় মুখ থুবড়ে পড়ে সে নিজেকে প্রশ্ন করে


__ কেন  মনে হচ্ছে এলিসা কাছে না থাকলে  জীবন কি ভীষণ শূন্য। মাত্র চার দিনের চাক্ষুষ পরিচয়ে  বিদায় বেলাটা ভাবলেই কেন এত গভীর বিষাদে আচ্ছন্ন হচ্ছে,মন? এলিসার সাথে কেন এমন একাত্মতা বোধ ? চিন্তার জগতও এক মনে হয় । কম কথায় কত কিছুই না বলে সে।


 ___ দূরত্ব,  সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারেনি কোনদিনও। আমি আবার আসব। তুমি লিওনে এস।

এয়ারপোর্টে পৌঁছে সিদ্ধার্থকে জড়িয়ে ঠোঁটে  আলতো চুমু দিয়ে কথাটা বলে এলিসা। তার হাতের মুঠোয় ছিল পলাশ ফুলের পাপড়ি মেশানো আবীর । সিদ্ধার্থর  কপালে গালে আলতো করে মাখিয়ে দিয়ে, নিজের গাল ,কপাল  ঠেকায় সে সিদ্ধার্থর গালে কপালে।  সিদ্ধার্থর গাল ও কপালের  রং মেখে  ধীরে ধীরে এয়ারপোর্টের ভেতর সে মিলিয়ে যায়। অপলক দৃষ্টিতে সিদ্ধার্থ  চেয়ে থাকে তার যাবার পথের দিকে।  

মনের দিক থেকে সে এখন আত্মপ্রত্যয়ে  ভরপুর। এ দেখা কখনওই শেষ দেখা নয়।


শেষ।।