#নজীপুর_কতদূর #সিরাজুল_ইসলাম।
কলিজার সাথে কবে কিভাবে পরিচয় তা আজ আর মনে নেই।আবহমান বাংলার শাশ্বত নারীজাতির আবাল্য সরলতায় ঘেরা সবুজ-শ্যামল গাঁয়ের আটপৌরে ঘরানার স্নিগ্ধতায় মোড়ানো ভরা অষ্টাদশীর সারল্যে ভরপুর কলিজার স্থলপদ্মের কমনীয়তা…
#নজীপুর_কতদূর
#সিরাজুল_ইসলাম।
কলিজার সাথে কবে কিভাবে পরিচয় তা আজ আর মনে নেই।
আবহমান বাংলার শাশ্বত নারীজাতির আবাল্য সরলতায় ঘেরা সবুজ-শ্যামল গাঁয়ের আটপৌরে ঘরানার স্নিগ্ধতায় মোড়ানো ভরা অষ্টাদশীর সারল্যে ভরপুর কলিজার স্থলপদ্মের কমনীয়তা মাখানো মুখশ্রী প্রথম দেখাতেই মন কেড়ে নিয়েছে আমার। অপকটে অকুন্ঠচিত্তে তাই নির্দ্বিধায় কলিজাকে মনের গহীনে সযতনে আগলে রেখেছি সাতরাজার ধণ মানিক করে। আমার ব্যস্তদিনের অলস প্রহরে মনের দরজা খুলে ঝরকাকাটা কাঁঠের সিন্দুক খুলে আমি গলায় পরে নিই সাতনরী হার। আবেগাপ্লুত হয়ে কলিজাকে সাজাই মনের মাধূরী মিশিয়ে সাতরংয়ে রাঙানো রংধনু বাহারে।
ফোটা পদ্মের মত কলিজার মুখখানা ভালোলাগার মোহময়তায় আমায় জড়িয়ে রাখে চৌপর দিনভর সারাক্ষণ। আমি ভুলে যাই আমার রাজ্যপাট, ঘর গেরস্থালী। দিকচক্রবালে তখন আমি আর কলিজা ছাড়া আর কেউই নেই। ধনেখালী শাড়ী পরিয়ে ভালোবাসার পরতে পরতে সাজিয়ে, পেঁজাতুলোর মেঘের ভেলায় ভাসতে ভাসতে তাকে নিয়ে যাই তেপান্তরের উদাসী ফাঁকামাঠে।
ছায়াঘেরা সুনীবিড় নিঃস্তব্ধ নিঃসঙ্গ দীঘির ঘাটলায় বসে থাকে আমার কলিজা ; সোনার নূপুর পায়ে খাঁড়ুজলে তার আলতারাঙা পা দুটো ডুবিয়ে। আর আমি তার কোলে মাথা রেখে দু'চোখ মুঁদে ভুলে আমার অতীত, আমার বর্তমান। ভুলে যাই ভুত-ভবিষ্যৎ।
কাজলকালো নিটোল দীঘির জল তিরতির কেঁপে ওঠে কলিজার মৃদ্যু শ্বাস-প্রশ্বাসে। দীঘিপাড়ে হিজলের ফুল ঝরে পড়ে টুপটাপ আবেশী আবেগী বাতাসে। অপার্থিব চেনা আলোয় কলিজাকে তখন অচেনা মনে হয়। যেন সে কোন মর্তালোকের মানবী নয় ; স্বর্গীয় অপ্সরী। যেন কোন দূর-দ্বীপবাসীনী। তার বুকের কাঁপনে সুর ছুঁয়ে যায় পানকৌড়ির সরব ডানায়। ভেসে যায় শ্বেত-শুভ্র রাজহাঁসের ঝাঁক। মেহেদী আল্পনা আঁকা হাতে কলিজা আমার চুলে বিলি কেটে দেয় পরম মমতায় সযতনে। এলোমেলো কাঁপনে কেঁপে ওঠে তার হাতের লালনীল কাঁচের বেলোয়ারী রেশমী চুড়ি। কলিজার প্রগাঢ় শ্বাসে-প্রশ্বাসে আমিও কেঁপে উঠি জলতরঙ্গের মত থরোথরো। কী যে এক ভালোলাগার মূহুর্ত! সেসবের বিনিময়েও আমি চাই না স্বর্গ কিম্বা বেহেস্ত।
এখানে কাস্তের মতন বাঁক খাওয়া ক্ষীণকায়া স্রোতস্বিনী যমুনার জল শুকিয় জমে গেছে পলিমাটি। তাই তো তেমনি নরম নরম আমার কলিজার হৃদয় প্রান্তর। যমুনার তীর ঘেঁসে ধূঁপখোলা মাঠ। মাঠের প্রান্ত ছুঁয়ে আদিগন্ত বিস্তৃত হলুদ ফুলে ফুলে ছেঁয়ে থাকে অবারিত শর্ষ্যের জমিন। বিলোল সুরভী ছড়িয়ে আমায় বুকে টেনে নেয় কলিজার ভালোবাসা। উদ্ভাসিত আলোয় হলুদজমিনে কলিজা যেন হলুদ বরণ কন্যা। তার রাঙা ঠোঁটের উষ্ণ আহবানে আমি এক কাব্য-কৃষক। ভ্রমর আর প্রজাপতি গুঞ্জনে হয়ে পড়ি বিমুগ্ধ বিমোহিত।
ধূঁপখোলা মাঠ অবারিত ফসলীজমি, হেমন্তের বিদায়ী বেলায় পৌষালী শীতার্ত আমেজে হিম হয়ে আসে। একটুসখানী উষ্ণতার খোঁজে আমি আঁকড়ে ধরি কলিজার হাতে বোনা নক্সীকাঁথা। সাঁঝবেলা ঘিরে এলে গোধুলি আলোয় আবীর রঙে রাঙিয়ে নীড়ে ফিরে যায় ঘরমুখো সারিবদ্ধ পরিযায়ী পাখির ঝাঁক তাদের আপন ঠিকানায়।
ঘরহারা মানুষ আমি। ভালোবাসার কাঙাল হয়ে ঘুরেফিরি আসমুদ্রহিমাচল। জোনাকি আলোয় ঘিরে আসে সন্ধ্যার আবহ। কর্মক্লান্ত ব্যস্তদিনের শেষে কৃষানী বউয়ের কাঁঠের খড়িতে আগুন জ্বলে। মাটির হাঁড়িতে টগবগ ফোটে জুঁইফুলের শূভ্রতা নিয়ে সরুচালের ভাত ; মশুরের ডাল। ক্ষীণকায়া স্রোতশ্বীনির বাঁক থেকে ধরে আনা ট্যাংরা চাঁপিলা পুঁটি কৈ।
দীপজ্বলা সন্ধ্যায় পিদিমের আলোয় উজ্জ্বল কলিজার নাকের মটর-দানার সোনার নাকফুল! দু'ভ্রুর মাঝখানে ঠিক কপালের মধ্যিখানে জ্বলজ্বল করে কাঁচপোকা লালটিপ। আহা, কী যে ভালোলাগা। ভালোবাসী ভালোবাসী ও আমার মনপাখি ময়না / এরচেয়ে আর বেশী ভালোবাসা যায় না।
ভোরের শিশিরের আবরণে মোড়া দুর্বাঘাস। সেখানে ঘাসফড়িং এর ওড়াউড়ি। মেঠোপথ আলপথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে দূর বহুদূর। যেন কলিজার মাথায় সঘন-ঘন কালোচুলের সিঁথি কাটা কোন মেঠোপথ।সেঁজুতি আলোয় আমি পথ খুঁজি হরপ্পা মহেন-জো-দাঁড়ো বিদর্ভ নগরীতে।
হায়-
কতদূর সেই নজীপুর!
#নজীপুর_কতদূর
©সিরাজুল ইসলাম।