Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন #বিষয়_সামাজিক#শিরোনাম_নতুন জীবন#অয়ন্তিকা সেন
আজ সকাল থেকেই ভবেশ বাবু খুব ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর নিজের হাতে সাজানো ঘরটিতে বার বার গিয়ে দেখে আসছেন সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি নিজেদের জায়গায় রাখা আছে …

 


#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন #বিষয়_সামাজিক

#শিরোনাম_নতুন জীবন

#অয়ন্তিকা সেন


আজ সকাল থেকেই ভবেশ বাবু খুব ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর নিজের হাতে সাজানো ঘরটিতে বার বার গিয়ে দেখে আসছেন সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি নিজেদের জায়গায় রাখা আছে কিনা। মেয়ে আসছে বলে কথা! তার সুবিধা-অসুবিধার দিকে একটু নজর রাখতে হবে না?

কিন্তু ভবেশ বাবুর স্ত্রী উত্তরা সেই যে সকাল থেকে নিজের ঘরে দোর দিয়েছেন, আর খোলার নাম নেই। শেষ একমাস ধরে স্বামীকে বুঝিয়ে-ধমকিয়েও যখন কোনো লাভ হয়নি, তখন শেষে নির্জলা উপবাসের বাহানাকেই বেছে নিলেন স্বামীর জেদ ভাঙানোর জন্য। কিন্তু ভবেশ বাবুও তাঁর লক্ষ্যে স্থির। নিজের সিদ্ধান্তে তিনি অটল। স্ত্রী, পরিবারের বাকী সদস্য, এমনকী যেই সমাজের তিনি একটি অংশও বটে, সেই সমাজকেও বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার প্রমাণ রাখতে চলেছেন। নিজের পিতৃত্বকে নতুন করে আবিষ্কার করতে চলেছেন তিনি।

"দাদা, তুমি যেটা করছ, ঠিক করছ না। বৌদি সকাল থেকে নিজেকে ঘরে আটকে রেখেছেন। এখন ভালো-মন্দ কিছু একটা করে বসলে, কী হবে ভাবতে পারছো"?

ভবেশ বাবু নিজের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত খোশ মেজাজেই বললেন, "আরে না না। উত্তরাকে নিয়ে তোরা এত ভাবিস না তো? তোর বৌদি জাতে মাতাল, কিন্তু তালে ঠিক। নিজের ক্ষতি অত সহজে সে করবে না"।

ভবেশ বাবুর ভাইয়ের স্ত্রী মল্লিকাও এবার নিজের ভাসুরকে দুটো কথা শুনিয়ে দিলেন।

"আপনাকে দুটি কথা না বলে থাকতে পারছি না দাদা। আপনার কাছে আমাদের থেকে বেশী আপন হয়ে গেল বাইরের ওই অপবিত্র মেয়েটা? যে কিনা আপনার ছেলের মৃত্যুর কারণ? যাকে নিজের পরিবারও পর্যন্ত ঠাঁই দেয়নি। তাকে আপনি নিজের ঘরে আশ্রয় দিচ্ছেন? এ কেমন বিচার দাদা? দিদি তো ভুল কিছু করেনি।একজন সন্তানের মা হয়ে, সে কী করে মেনে নেবে সন্তানের খুনীকে"? ছোটো জায়ের কথা শেষ হতে না হতেই উত্তরা দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো।


"কাকে কী বলছিস ছোটো? তোর দাদা পাগল হয়ে গেছে, বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়েছে ওঁর। না তো এইরকম একটা সিদ্ধান্ত তিনি নিতেন না। নিজের ছেলের খুনীকে মা মা করে আদিখ্যেতা দেখাতেন না। বুঝবেন বুঝবেন একদিন এর ফল ঠিক বুঝবেন। কিন্তু ওই নষ্টা মেয়ের সাথে এক ছাদের তলায় আমি থাকতে পারব না"।

ভবেশ বাবু আর নিজেকে নিজের বশে রাখতে পারলেন না।

"বেশ তো, তুমি যদি সব জেনে শুনে অন্ধ হয়ে থাকতে চাও, থাকো। আমার আপত্তি নেই তাতে। কিন্তু বার বার মধুকে খুনী বা নষ্ট মেয়ে বলবে না। আর কে বলেছে তোমাকে মধু খুনী? পুলিশ কী প্রমাণ করতে পেরেছে সেই আমাদের ছেলেকে খুন করেছে? যদি সেরকমই কিছু প্রমাণ পেত, তাহলে ওকে কী পুলিশ ছেড়ে দিতো? কিন্তু তোমাদের এসব বুঝিয়ে লাভ নেই। তাই আমি চললাম আমার নতুন মেয়েকে নিতে।" কথাগুলো বলে ভবেশ বাবু আর পিছন দিকে তাকালেন না।গাড়ি নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলেন মধুকে ওর বাড়ি থেকে আনতে। কারণ তিনি জানেন বাপ-মা মরা মেয়েটি একমাত্র তাঁর জন্যই অপেক্ষা করে আছে। ওর নিজের বাড়িতেই ওর আর ঠাঁই হবে না। কাকা-জ্যেঠারা কেউই সমাজে নাম খোয়ানোর ভয়ে নিজেদেরই রক্তকে আশ্রয় দেবে না। এই অবস্থায় মেয়েটি যায় কোথায়?

যেখানে উত্তরার উচিৎ ছিল একজন মেয়ে হয়ে আরেক মেয়েকে বোঝার, নিজের সন্তানের মতো মধুকে স্বীকার করে নেওয়ার, তা না করে তিনি মধুকে দোষারোপ করছেন সবকিছুর জন্য। ভবেশ আর উত্তরার ছেলে সুজিতের সাথে মধুর বিয়ে ঠিক করেছিলেন সুজিতের জ্যাঠা-কাকারা। সুজিত ছিল মধুর জ্যাঠা-কাকাদের অফিসের বস। একদিন একটি বিশেষ কারণে মধু সুজিতের অফিসে গিয়েছিল..সেখানেই দুজন দুজনকে প্রথম দেখে। প্রথমে আলাপ, তারপর বন্ধুত্ব এবং তারপর প্রেম। একদিন সেই প্রেমের জোয়ারে ভেসেই মধু, সুজিতের সন্তানকে নিজের গর্ভে ধারণ করে। মধু একথা জানতে পেরে দৌড়ে গিয়েছিল সুজিতের কাছে, তবে অনুরোধ বা আকুতি-মিনতি করতে নয়, নিজদের সন্তানের বৈধ অধিকার, বৈধ পরিচয় দেওয়ার দিনটি জানার জন্য।


সুজিত প্রথমে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল, এইরকম একটা খবরের জন্য ও হয়তো প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু জানার পর থেকে নিজের অংশকে পিতৃত্বের পরিচয় দিতে অস্বীকার করেনি। খুব খুশী হয়েই মধুকে বলেছিল, "চলো মধু, একটা নর্মাল চেকআপ করিয়ে নিয়ে আসি। তারপর বাড়িতে তোমায় নিয়ে গিয়ে সব জানাব। এখন আমার বাচ্চার দায়িত্ব আমারই"।

মধু মনে মনে ভেবেছিল ঈশ্বর বোধহয় জীবনের সকল সুখগুলিকে একসূত্রে গেঁথে তার আঁচলে ভিক্ষা দিয়েছেন।

কিন্তু উপরওয়ালা বোধহয় খুব কম মানুষেরই ইচ্ছে পূরণ করেন। ডাক্তারের ক্লিনিক থেকে আসার সময় পথের একটি ব্রীজ ভেঙে পড়ে। বহু মানুষের মৃত্যু হয় তাতে। সুজিত আর সুজিতের সন্তানও এই পৃথিবীর আলো দেখার আগেই না ফেরার দেশে চলে যায়। লোকমুখে প্রচলিত একটি কথা আছে, "মেয়ে মানুষের প্রাণ, নাকি কই মাছের প্রাণ"। সেই কারণেই কী তবে মধু বেঁচে গেল? না ভাগ্যের জোরে?

যাই হোক, মধুকে গুরুতর অবস্থায় কাছের হাসপাতালে ভর্তি করার পর ডাক্তার জানান, মধু তার ভালোবাসার শেষ চিহ্নটুকুও হারিয়েছে। বাকরুদ্ধ হয়েছিল সে এক অব্যক্ত বেদনায়। ভবেশ বাবুও পেয়েছিলেন নিজের ছেলের মৃত্যু সংবাদ। দৌড়ে এসেছিলেন তিনিও একই হাসপাতালে। নার্স জানিয়েছিল, আপনার ছেলে আর ছেলের সন্তানকে বাঁচাতে পারিনি, কিন্তু আপনার বউমাকে কোনোরকমে বাঁচানো গেছে। ওকে ঘরে নিয়ে যান, ওর পাশে থাকা অত্যন্ত জরুরী এখন। না তো মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সে।

ভবেশ বাবু অবাক হয়ে যান এসব শুনে। ছেলে তাদের কিছুই জানায় নি। আসলে তিনি জানতেন তাঁর ছেলে তাঁরই মতো ছিল, চাপা স্বভাবের। উপযুক্ত সময় না এলে কোনো বিষয়ে ঢাক পেটানোর অভ্যেস তার ছিল না।

কিন্তু একমাত্র মধুই জানে আজকেই সুজিত বলেছিল, বাড়িতে সবকিছু জানাবে এবং আজই বিয়ের তারিখ ঠিক করবে। কিন্তু ঈশ্বর যে আবারও একবার তার কাছ থেকে প্রিয় মানুষ দুটিকে কেড়ে নেবেন, সেটা বোধহয় ভাবেনি।


"ম্যাডাম, কে এসেছেন দেখুন, আপনার বাবা এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে"..

নার্সের কথায় কোনোরকমে মাথাটা সরিয়ে দেখে সদ্য সন্তানহারা এক পিতা, করুন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন নতুন করে এক সন্তান প্রাপ্তির আশায়। ঘৃণায় নয়, সস্নেহে মধুর মাথায় নিজের হাতটা বুলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি..মধু সেই মুহূর্তে একটি শব্দই উচ্চারণ করেছিল, "বাবা"।

ভবেশ বাবু তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন, এই সন্তানকে হারাতে দেবেন না তিনি। কিন্তু বেঁকে বসেছিলেন উত্তরা আর তার পরিবারের মানুষজন। অনেকবার বুঝিয়েও তিনি তাদের বিশ্বাস করাতে পারেননি যে, মধু সুজিতের মৃত্যুর কারণ নয়। তাই তিনি মধুর হাত ছাড়তে পারবেন না। তার জ্যেঠা-কাকারা একদিনের জন্যও মধুকে দেখতে না এলেও ভবেশ বাবু ততদিন এসেছিলেন যতদিন না মধু শারীরিকভাবে সুস্থ হয়।

আজ সকালে মধুকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ভবেশ বাবু চেয়েছিলেন একেবারে নিজের ঘরেই এনে তুলতে। কিন্তু মধু জানিয়েছিল একবার সে নিজের বাড়ি যেতে চায়, ওর একান্তই কিছু নিজের জিনিস আনার জন্য এবং এতদিন যাদের কাছে বড়ো হল, তাদের একটাই প্রশ্ন করতে, কী ছিল তার অপরাধ?যেখানে নিজেরাই এই বিয়েতে একদিন মত দিয়েছিলেন, সেখানে একটি দুর্ঘটনায় সব বদলে গেল? এমনকি সে বেঁচে আছে না মরে গেছে এটুকু জানারও প্রয়োজন বোধ করেনি তারা?

না কোনো উত্তর পায়নি সে। শুধু নীরব বিরোধীতা পেয়েছিল মধু, যেখানে স্পষ্ট ছিল একথা যে, তার সাথে জ্যাঠা-কাকাদের আর কোনো সম্পর্ক নেই। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মধু বুঝতে পারে পিতৃসম এক অসহায় পিতা এসেছেন, তাকে নিজের মেয়ে করে নিয়ে যেতে।

"তুমি সেই নিয়ে আসলে এই মেয়েকে? আমার ছেলেকে খেয়ে শান্তি হয়নি, এখন আমার স্বামীকেও খেতে চলে এলো"?

নিজের স্ত্রীয়ের কথায় অত্যন্ত লজ্জিত হলেন ভবেশ বাবু। মধুকে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি স্ত্রীকে বললেন, "আজ যদি তোমার ছেলে বেঁচে থাকত আর মেয়েটি নিজের প্রাণটি হারাতো, তখন কী তুমি তোমার ছেলেকে খুনী বলতে উত্তরা? বলতে না নিশ্চয়ই। বরং বলতে, 'যা হয়েছে ভুলে যা, নতুন করে জীবন শুরু কর'। কী, তাইতো? তবে মধুর ব্যাপারে কেন এটা ভাবতে পারছ না? আরেকটা কথা জেনে রাখো, মধু একটু আগে আমাকে বলছিল, 'বাবা, আমি তোমার জন্য নতুন করে বাঁচতে চলেছি, না তো আমার এই জীবনের মূল্য শূন্য'। কিন্তু মধু আমিও তোকে একই কথা বলছি, তোর জন্যই আমি আবার নিজের পিতৃত্বকে ফিরে পেয়েছি। তাই তুইও আমার নতুন করে বাঁচার কারণ।


উত্তরা, তোমার যদি মধুর সাথে থাকতে অসুবিধা হয়, তুমি তোমার পছন্দের জায়গা বলো, আমি সেখানেই তোমায় রেখে আসব। কোনো কর্তব্যের ত্রুটি হবে না তোমার। কিন্তু এ বাড়িতে থেকে আমার মেয়েকে কষ্ট পেতে দেখতে আমি চাই না"।

কথাগুলো বলে ভবেশ বাবু মধুকে নিয়ে ছেলের ঘরে চলে গেলেন।

উত্তরা আর বাকী সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন এক পিতার পিতৃত্বের জয়ের দিকে, একজন পিতার দৃঢ়তার দিকে..