Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

গল্প 
              বনবীথির আত্মকথন               **** ** *************
                                             বনবীথি চৌধুরী                                                  শিলিগুড়ি
....রুদ্র ,          দীর্ঘ বিশ বছর পর  তোম…

 


গল্প 


              বনবীথির আত্মকথন 

              **** ** *************


                                             বনবীথি চৌধুরী     

                                             শিলিগুড়ি


....রুদ্র , 

         দীর্ঘ বিশ বছর পর  তোমাকে চিঠি লিখছি । আগে তোমার নামের আগে প্রিয়তম লিখতাম। এখন ঠিক কোন শব্দটা তোমার জন্য উপযুক্ত বুঝতে পারছিনা  । একবার ভাবলাম ' স্বার্থপর ' লিখি , তারপর ভাবলাম ' বেইমান ' , নাকি ' কাপুরুষ ' ঠিক কোন শব্দটা তোমাকে মানায় রুদ্র ....আসলে এই সব বিশেষণ তোমার জন্যই । তোমার নামের আগে চারটা ডট ছাড়লাম । মানানসই বিশেষণটা তুমিই বসিয়ে নিও । 


                আমার চুলে পাক ধরেছে । চল্লিশ পার হল গতমাসেই । এই বয়সে এসে নিশ্চয়ই নতুন করে আর প্রেমপত্র লিখছিনা । বিশ বছর পর রবীন্দ্রসদনে সাহিত্য সভায় তোমার সাথে দেখা । তোমার স্ত্রীও টুকটাক লেখালিখি করে , স্ত্রী'র সুবাদে তুমিও  গিয়েছিলে , দর্শকাসনে বসে কৌতুহলবশে আমাকেই দেখছিলে । অবাক হচ্ছিলে আমার শিক্ষা , ডিগ্রী ব্যক্তিত্ব সৌন্দর্য্য দেখে । তোমার চোখ তোমার স্ত্রী'কে ফাঁকি দিয়ে শুধু আমাকেই দেখছিল ছলে আড়চোখে । মুগ্ধ হয়ে তুমি শুনছিলে আমার স্বরচিত কবিতাপাঠ । বছরের সেরা সাহিত্যিক সম্মান শিরোপা যখন আমার হাতে উঠছিল , উত্তরীয় স্মারক , পুষ্পস্তবক দিয়ে আমাকে সম্মান জানাতে বড় বড় লেখক সাহিত্যিকরা উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছিলো , তোমাকেও উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে হয়েছিল । আমি বেশ উপভোগ করছিলাম তোমার অস্বস্তিবোধ ( যেটা তুমি কাউকে বুঝতে দিতে চাইছিলে না ) অনুশোচনাবোধ ছিল তোমার ব্যর্থ চোখে । ভয় দেখেছিলাম তোমার চোখে , ভয় পেয়েছিলে তুমি রুদ্র । বিশ বছর আগের আমাদের সম্পর্কটা , তোমার মুখোশটা তোমার স্ত্রী'র সামনে না খুলে দিই । সেরা সাহিত্যিক বনবীথিকে মাইকে কিছু বক্তব্য দিয়ে সভাকক্ষকে ধন্য করতে বলা হল , আমি মাউথস্পিকারের সামনে যেতেই তোমার ভয়ার্ত  দৃষ্টি আমার দিকে , হাতে হাত ঘষছো । আমি বুঝছিলাম তুমি করজোড়ে বলতে চাইছো , '' বনো ক্ষমা করো , আমার কথা কিছু বোলোনা '' । 


সাহিত্য সমাজ নিয়ে কিছু বক্তব্য রেখে আমি বেড়িয়ে আসতেই তোমার স্ত্রী প্রায় ছুটে এসে আলাপ করতে চাইলেন । আমার লেখা বইয়ে অটোগ্রাফ নিলো । খুব মিষ্টি , আন্তরিক ব্যবহার ওর । ফোন নং সহ তোমাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বলেছিল , আমার লেখার গুনমুগ্ধ ভক্ত ও । সন্তান না হওয়ার মানসিক কষ্ট ভুলে বাঁচার প্রেরণা পায় আমার সব কাব্যসাহিত্য পড়ে । খারাপ লাগছিল জেনে যে ও কখনো মা হতে পারবেনা আর । 


লেখিকা তো তাই বড্ড অনুভবী । বুঝতে পারছিলাম আমার সাথে কথা বলার জন্য তোমার মনপ্রাণ ছটফট করছিল কিন্তু পাছে স্ত্রী'র কাছে ধরা পরে যাও তাই তুমি এগিয়ে না এলেও তোমার চোখ আমাকেই দেখছিল ...শুধুই আমাকে । 


চিঠিটা তোমার স্ত্রী'র নামে লিখতে পারতাম কিন্তু কি লাভ তোমার চরিত্র জানিয়ে ...থাক না , ওর স্বামী ওর চোখে আর্দশপুরুষ হয়ে । ও যে আমারই মতো এক নারী যে কিনা ভালোবেসেছে । ভালোবাসায় বিশ্বাসভঙ্গ হবার কষ্ট আমি পেয়েছি , চাইনা আর কেউ পাক । 


রুদ্র তখন ক্লাস নাইন আমি । স্কুলে প্রথম শাড়ি । তুমি কলেজের ফাইনাল ইয়ার । প্রথম প্রেম আমাদের । প্রতিদিন স্কুল ছুটির আগে গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে সাইকেল নিয়ে । আমার সাথে সাইকেল ধরে বেশ কিছুটা পথ হাঁটতে । তারপর কোনদিন ফুচকা কিংবা একটু বাদামভাজা । তারপর তুমি সাইকেল নিয়ে চলে যেতে টিউশনি পড়াতে । রাতে পড়তে বসে মন লাগতো না , শুধুই ছবি আঁকতাম মনের ক্যানভাসে ...তোমার আর আমার রূপকথার ছবি । তোমার চিঠি বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতাম । বাথরুমে যেতাম বারবার ...আসলে বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করলে তোমাকে একান্ত নিজের করে অনুভব করতে পারতাম । বুকে গোঁজা চিঠি বের করে কতবার চুমু খেতাম , প্রতিটা চিঠি অনেকবার... বারবার পড়তাম । পড়ার বই ও অত পড়তামনা । তুমি জানো তো মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে আমার বালিশের তলায় তোমার চিঠি পায় আমার মা । প্রেম করার শাস্তি দিতে মা ঘরের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয় , বাবা জীবনে প্রথম থাপ্পড় মারে । শাসনে বারণে প্রেম কি আটকে রাখা যায় ? ?  একবছর আমার সাথে তোমার প্রায় দেখা হয়নি । তোমার বন্ধুরা লুকিয়ে চিঠি দিয়ে যেও , বলতো তুমি আমাকে না পেলে পাগল হয়ে যাবে । 


দ্বাদশশ্রেণী অষ্টাদশী দেখতে বেশ সুন্দরী । চারিদিক থেকে প্রেমের অফার । তুমি তখনও চাকরি পাওনি । টিউশনি পড়ানো ছেলের সাথে বাবা মা বিয়ে দেবেননা বুঝতে তুমি । অগত্যা তুমিই চাইলে আমরা বিয়ে করে নেবো লুকিয়ে কালীমন্দিরে । আমি তখন তোমাকে ...তোমার প্রেমকেই চিনি । বাবা মায়ের জন্য কষ্ট হলেও তোমার চোখের জল দেখে পালিয়ে বিয়ে করতে রাজী হলাম । 


দুর্গাপুজোয়  প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে তোমার হাত ধরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তোমারই এক বন্ধুর বাড়ি নিয়ে গেলে । বন্ধুর ফাঁকা ঘরে তুমি আর আমি দুজনে । বাইরে দেবীর আরাধনা , ঢাকের বাদ্যি । আলোর রোশনাই , বাজিপটকার শব্দ । আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলে । এর আগে কখনো এতো ঘনিষ্ঠ হইনি । আমার মৃদু আপত্তি তোমার সুন্দর মিষ্টি প্রেমের কথায় হারিয়ে গেল । বললে কিছুদিন পরই তো তোমার বউ হচ্ছি , তোমার আদর সোহাগে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম । 

পরে কেঁদেছিলাম পাপবোধে ...বিয়ের আগে মিলন । তুমি আমার মাথা তোমার কাঁধে নিয়ে বলেছিলে , তুমি সব আয়োজন করে রেখেছো ...কদিন পরই বউ করে বাড়িতে নিবে । 


দেওয়ালীর পর থেকেই তোমার মধ্যে অনেক পরির্বতন লক্ষ্য করছি । আগেরমতো ব্যাকুলতা নেই আমার জন্য , বিয়ে করার জন্য পীড়াপীড়ি নেই । বরং আমি বললে তুমি এড়িয়ে গিয়েছো । তারপর তোমার এক বন্ধুর কাছে জানতে পারলাম , ফরাক্কার সরকারী স্কুলে মাস্টার হয়েছো তুমি । বিশ্বাস করো আনন্দে আমি সেদিন বাবা মা জানিয়ে দিয়েছিলাম , যে ছেলের চাকরি নেই বলে বিয়ে দিতে চাওনি ...আজ ও সরকারী স্কুল শিক্ষক। 

না জানিয়ে যাওয়ায় অভিমান হয়েছিল ঠিকই কিন্তু আনন্দে প্রতীক্ষা করছিলাম তোমার ফিরে আসার। 

চিঠি দিয়েও জানালে না । বেশ কিছুদিন পর খবর পেলাম তুমি এসেছো । তুমি দেখা করতে চাইছোনা । ইতিমধ্যে আমার পিরিয়ড বন্ধ হল । অনেক ভয় অভিমান আশা হতাশা নিয়ে তোমার বাড়িতে এলাম । তোমার বাবা মা যারা একসময় আমাকে বউ করে তোলার জন্য ব্যস্ত হয়েছিল , তারা অপমান করে তাড়িয়ে দিল । দু'চোখে তিস্তা তোর্সা নিয়ে তোমার পায়ে এসে লুটিয়ে পরে সব জানালাম । তখন তিনমাসের প্রেগন্যান্ট ....বিয়ে করার জন্য আকুতি মিনতি করলাম । তুমি কত সহজে বলে দিলে , '' আমাদের মধ্যে যা হয়েছিল , সেসব বন্ধুত্ব । আমাকে নাকি ভালোবাসোনি কখনো । যা ঘটেছে সব ভুলে যেতে । তোমার স্কুলেরই এক শিক্ষিকার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে '' । 


একনিমিষে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায় । বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার তফাৎ বুঝার বয়স হয়েছিল, রুদ্র । আসলে সরকারী চাকরি পেয়ে তোমার মূল্য বেড়েছিল । তাই তখন আমার থেকে বেশি মূল্যের প্রেম কেনার ক্ষমতা হয়েছিল তোমার । ঘরে দরজা বন্ধ করে কাঁদতাম। তুমি দেরী করোনি ।  দিন সাতেকের মধ্যেই শুনলাম তোমার বিয়ে হয়ে গেছে ফরাক্কার এক স্কুল শিক্ষিকার সাথে । 


এতো তাড়াতাড়ি , আমি একটু ধাতস্থ হবার আগেই ঘটে গেল সব । অসুস্থ হয়ে পড়লাম । নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের সম্মানটুকুই সম্পত্তি সম্বল ...যেটা আমি হারিয়েছি , অপাত্রে বিলিয়েছি । বাবা মা আত্মীয় পরিজনরা জেনে গেল .....পিটুনি বকুনি,  বেরিয়ে যেতে , মরে যেতে বললো । দুঃখে অভিমানে অপমানে ঠিক করলাম আত্মহত্যা করবো ।


বাড়ির সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে এক সন্ধ্যায় চলে এলাম রেলস্টেশনে। ট্রেনের অপেক্ষা ...টিকিটের প্রয়োজন নেই , ট্রেনের কামরার ভিতরে নয় , চাকার তলায় যাবো । রাতের দিকে একটা ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে আসতেই ঝাঁপ দিতেই হ্যাচকা টান দিয়ে টেনে কে যেন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো । জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফিরে দেখি ছোট্ট কুঁড়েঘরে এক বৃদ্ধা মাথায় জল দিয়ে , পায়ে তেল ঘষে সুস্থ করলো । জানলাম ওনার ছেলের রেল স্টেশনে ছোট্ট বইয়ের দোকান , সেই আমাকে আত্মহত্যা করা থেকে বাঁচিয়েছে । কিছুতেই আমি আর বাড়ি ফিরে যেতে চাইলামনা কারন বুঝি বিয়ের আগে প্রেগন্যান্ট হওয়া , ঘর থেকে পালিয়ে যাওয়া , বদনাম কুড়ানো মেয়ে ফিরে গেলে অন্য ভাইবোনদের জীবনে প্রভাব পড়তো । বৃদ্ধার আদর স্নেহযত্ন ভালোবাসায় গরীবের ঘরেও বাঁচার পথ পেলাম । বুঝালো , আত্মহত্যা মহাপাপ তার উপর সন্তানসম্ভবা অর্থাৎ নিজের সাথে আত্মজর প্রাণ নেওয়া মহাপাপ । আমি মানসিক শক্তি পেলাম । ঠিক করলাম সন্তানের জন্ম দেবো । 


বস্তি এলাকা । সুন্দরী পড়াশুনা ইংরেজী জানা যুবতী মেয়ে কি পরিচয়ে থাকবে ?  তাছাড়া সন্তানের বাবার পরিচয় ছাড়া বস্তিসমাজে বদনাম হবে । আমার প্রাণ বাঁচানো ছেলেটির সাথে বিয়ে দিলো । বস্তিবাসী সবাই ধন্য ধন্য করলো । কালো অসুন্দর মাধ্যমিক ফেল পাত্রের সাথে ফর্সা সুন্দরী পাত্রীর বিয়েতে সকলেই খুশি । 


আমার তথাকথিত অশিক্ষিত , অসুন্দর স্বামী অভ্র আমাকে খুব সম্মান করতো । কোনদিন আমাকে ছুঁয়েও দেখেনি । জোরজবরদস্তি দূরের কথা , উল্টে আমার কাছে শ্রদ্ধায় মাথা নিচু করেই প্রয়োজনের কথাটুকু বলতো । আমি ওকে ভালোবাসিনা । ঘৃণা আসতো । ও আরো বেশি কাজ করে বাড়তি উপার্জন করে আমার সাধআহ্লাদের সব সামগ্রী এনে মাথা নিচু করে দাঁড়াতো । ফুটফুটে ছেলের জন্ম দিলাম । অভ্রদীপ , ওর মা আর আমি ছাড়া সবাই জানলো সন্তানের বাবা আমার প্রাণবাঁচানো স্বামীই । বাপের নাম হল অভ্রদীপ চৌধুরী । ওর , ওর মা আর  প্রতিবেশীদের স্নেহযত্নে লালিত হচ্ছে । রাতে কাজ থেকে ফিরে ঘরে বই বাঁধাইয়ের কাজ করতো ছেলেকে যেন ভালোভাবে বড় করতে পারি । ধীরে ধীরে কালো অসুন্দর অভ্রদীপের প্রতি মায়া জন্মাতে লাগলো । ওর বাঁধাই করা বই নিয়ে পড়তাম । আমাকে ইংরেজী বই পড়তে দেখে প্রতিদিন আমার জন্য বাংলা ইংরেজী সাহিত্যের বই আনতো । ঘরে বসে শুধুই বই পড়ে মন ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম । পড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে আমাকে প্রাইভেটে পড়াশুনা শুরু করালো । উচ্চমাধ্যমিক , গ্রাজুয়েশন , মাস্টারডিগ্রী করলাম । কবে যেন ভালোবেসে ফেলেছি এই বস্তিকে , ওর মাকে , প্রতিবেশীদের আর ওকে । আসলে বস্তির সহজ সরল মানুষেরা অত হিসেবী নয় ...বেহিসেবী ভালোবাসা দিতে জানে । বয়স পঁচিশ হল ...পরিণত মানসিকতার হলাম । নতুন করে প্রেম ....বেশ ভালো লাগতে লাগলো আমার স্বামীকে । ডিগ্রী নেই অথচ এতো ভালো মানুষ .... আমার শরীর পর্যন্ত কখনো ছোঁয়নি অথচ আমার সন্তানের বাবা সে ...সব দায়িত্ব পালন করছে । 


প্রতি রাতে কাজ থেকে ফিরে আপনমনে গান গায় , সুর বাঁধে নিজে । ওর গান প্রথম লিখলাম ডায়রিতে তারপর একটা পত্রিকায় পাঠালাম । ছাপার অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে ওর কথাকলি আমার নামে । বুকের ভিতর কেমন করে উঠলো । এবার প্রথম ওকে জড়িয়ে ধরলাম । বললাম , তুমি কি ...তুমি কি মানুষ ? আমার দিকে তাকাও পর্যন্ত না । তুমি কি দয়া করছো আমার প্রতি ...আমার সন্তানের প্রতি ? ? 


ও বললো , ও খুব ভালোবাসে কিন্তু আমার পাশে ওর রূপের , শিক্ষার যোগ্যতা কম । ভালোবাসা দেবার মধ্যেই ভালোবাসাকে অনুভব করে । ওর বুকে কেঁদে ফেললাম ...প্রথম জড়িয়ে ধরলো ও । ভালোবাসার ছোঁয়ায় দুজনে দুজনের মধ্যে হারালাম। 

এবার সত্যিকারে সংসার করার পালা । ও কাজে যেত , আমি ঘরকন্না সাজিয়ে লিখতাম ওদের কথা , মানুষের কথা । শীতলপাটি বিছিয়ে দিতাম , ওর ক্লান্ত শরীরে হাত বুলিয়ে দিতাম । আর আমাদের ভালোবাসার আলপনা , বস্তিবাসীর দুঃখযন্ত্রণা .....লিখতাম সবার মনের কথা , নিজের কথা । লেখিকা বনবীথি চৌধুরীর সুনাম ছড়িয়ে পড়লো । শান্তির সংসারে কবেই ভুলে গিয়েছিলাম রুদ্র তোমাকে । 


ততদিনে মোবাইল ফোন এসেছে , ফেসবুক , সোশ্যাল মিডিয়া এসেছে । চাইলেই তোমাকে খুঁজে নিতে পারতাম কিন্তু তোমাকে কবেই ক্ষমা করেছি । কারন তুমি ফ্লার্ট করেছো , সুন্দর সুন্দর কথায় প্রেম দিয়েছো কিন্তু ভালোবাসা দিতে পারোনি । পরিণত বয়সে এসে বুঝি আমিও হয়তো তোমাকে ভালোবাসতে পারিনি ....কমবয়সের প্রেম ওসব । প্রেম হল পূর্ণিমার চাঁদ ...যা ক্ষয় হয় । আবার নতুন আকাশে নতুনভাবেও উদয় হয় । প্রেম বারবার হতে পারে । 

অভ্রদীপ শিখিয়েছে ভালোবাসা । ভালোবাসা ধ্রুবতারার মতো ক্ষয় নেই , স্থির ....সঠিক পথ দেখায় । ভালোবাসা হিসেব জানে না ...শুধু দিতেই জানে ; দেওয়ার মধ্যেই পাওয়া । 


অভ্রদীপের ঔরসে আমার দ্বিতীয় সন্তান সৃজিতা । তোমার ঔরসে প্রথম সন্তান সৃজন যাকে তুমি অস্বীকার করেছিলে সে এখন সাবালক হয়েছে , সরকারী খরচে ডাক্তারী পড়ছে । ভাইবোনে বড্ড মিল ....খুব ভালোবাসা পরষ্পরে । 


রুদ্র কুড়ি বছরের হিসেব লেখা যায়না । তবু লিখলাম তোমার হিসেব মিলেনি দেখে । হিসাবশাস্ত্রের ছাত্র তুমি চাকরি পেয়ে হিসেব কষেছিলে চাকুরিরতা বিয়ে করলে আার্থিক উন্নতি তরতরিয়ে হবে , সুখ হবে , শান্তি হবে । হিসেব মিলেনা । দুজনের মাইনের পয়সায় অর্থপ্রাচুর্য হলেও সন্তান সুখ নেই ...কারো মনে শান্তি নেই । তামাক ঠোঁটে জ্বালিয়ে বুক পোড়াও .......ঈশ্বর তোমাকে শাস্তি দিয়েছে । 


কষ্ট হচ্ছে তোমার বউকেও আসলে তুমি ভালোবাসতে শেখোনি ...তাই সে যন্ত্রের মতো স্কুলে চাকরি করছে ...অভ্যাসবশত তোমার সঙ্গে জীবন ধারাপাত পড়ছে আর মনের গভীরে জমা দুঃখগুলো আমার কাব্যসাহিত্যের চরিত্রে নিজেকে খুঁজছে । ভালোবাসার রূপ কেমন হয় একবার বউকে নিয়ে এসে দেখে যেও .....দামি আসবাব নেই কিন্তু ঘরের কোণায় কোণায় ভালোবাসা আর শান্তি খুঁজে পাবে । আমার ছোট্ট উঠোনে বস্তির শিশুদের খেলা দেখতে পাবে । একের বিপদে অন্যকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখবে । টিনের চালে মাধবীলতা ....সন্ধ্যায় শাঁখ বাজিয়ে বাজিয়ে তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালাই । এলাকার সবাই মান্য করে , ভালোবাসে । ভিন্ন ঔরসের হলেও আমাদের ছেলে আমাদের মেয়ের মধ্যে স্নেহের বন্ধন দেখবে । 


আর ভালোবাসার ঘরে ঈশ্বরের বাস ।  আমার স্বামীর রোজগারের পয়সায় এককাপ চা খেও অন্ততঃ .....বিশ্বাস করো ভালোবাসতে শিখবে । 


পারলে এসো একবার । আর জেনো হিসাবশাস্ত্রে গোল্ডমেডালিষ্ট হলেও জীবনের হিসেব মেলানো সম্ভব নয় । 


                 রাখছি । ভালো থেকো । ভালো রেখো । 


                           ইতি ....

                                            প্রাক্তন 


রুদ্র দত্ত 

ফরাক্কা