Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

||হারিয়ে যাওয়ার আগে||
গত কয়েকদিন যাবৎ-ই মনটা ভালো নেই তিতিরের। এরকম একটা সময় অভিকে খুব দরকার ছিল ওর। অভির ফোনটা সেই যে সেদিন হঠাৎ কেটে গেল, তারপর থেকে আর ওকে লাইনে ধরতে পারেনি তিতির। অভিও পায়নি নিশ্চয়ই।অভি আর তিতিরের গল্পটা স…

 


||হারিয়ে যাওয়ার আগে||


গত কয়েকদিন যাবৎ-ই মনটা ভালো নেই তিতিরের। এরকম একটা সময় অভিকে খুব দরকার ছিল ওর। অভির ফোনটা সেই যে সেদিন হঠাৎ কেটে গেল, তারপর থেকে আর ওকে লাইনে ধরতে পারেনি তিতির। অভিও পায়নি নিশ্চয়ই।

অভি আর তিতিরের গল্পটা সেই ছোট্টবেলার, উমম-হুমম বন্ধুত্ব, কিংবা শত্রুতার নয়। ওদের গল্পটা একটা horror story। খুব ছোটবেলায় ওরা দুজনেই মাকে হারিয়েছে। একটাই দুর্ঘটনা, কেড়ে নিয়েছিল দু-দুটো মায়ের জীবন। ওরা মিলিটারি কোয়ার্টারে থাকত। দুজনের বাবাই একই ক্যাম্পের মিলিটারি জওয়ান। ওদের বাবাদের সাথেই দেখা করে ফিরছিলেন মায়েরা, ওরা তখন নিজের নিজের স্কুলের সামার ক্যাম্প-এ। মিলিটারির গাড়ি চেপেই ফিরছিলেন দুজনে, রাস্তায় ব্রেকফেল, পাহাড়ি রাস্তায় টাল সামলাতে না পেরে গাড়ি সোজা খাদে। তারপর অনেক চেষ্টার পর প্রায় দিনদুই বাদে উদ্ধার হয়েছিল ঐ ছিন্নভিন্ন মানুষগুলো।

   সামার ক্যাম্পে খবর দিয়ে বাবা যখন অভিকে বাড়ি নিয়ে আসেন তখনও অভি জানে না কেন ক্যাম্প শেষ হওয়ার আগেই নিয়ে আসা হল ওকে। বাড়ি ফিরে অভি দেখেছিল কোয়ার্টারের হলে একটু দূরে দূরে রাখা সাদা চাদরে মোড়া দুটো দেহ। যাদের একজন তার মা, অন্যজন কে তখনও জানে না অভি, মাকে জড়িয়ে বাবা খুব কাঁদছিল, কিন্তু অভি কাঁদেনি। অভি লক্ষ্য করেছিল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ঐ মেয়েটাও কাঁদেনি একটুও। সবাই সাধাসাধি করছিল ওদের। 'একটু কাঁদ', 'এটাই শেষ দেখা', 'চাইলেও আর দেখতে পাবিনা, কাছে পাবিনা কোনোদিন', 'কাঁদ, কাঁদ'। কাঁদেনি অভি। কেন কাঁদবে? বাবা যে বলে, একজন সেনার বাড়ির লোকেরাও সবাই সৈনিক। আর সবচেয়ে বড়ো সৈনিক তার স্ত্রী। এরা জানেনা সৈনিকের মৃত্যুতে কাঁদতে নেই, কিন্তু ও জানে। তাই ওর মায়ের মৃত্যুতে ও কাঁদবে না। পরে জেনেছিল তিতিরও একই সত্যি বিশ্বাস করত তাই কাঁদেনি সেদিন। মায়েরা চলে যাওয়ার পরই মূলত শুরু হয়েছিল ওদের একা বাঁচার horror story টা, বাবারা দেশের সীমানায় যুদ্ধ করছে, মায়েরা নেই, ঐ চরম নিঃসঙ্গতার ভয়ার্ত জীবনে ওরা একে অপরকে আঁকড়ে ধরেছিল খড়কুটোর মতো। অভির বাবার বুকে গুলি লাগার পর অভি যখন আরও একা তখন ওকে ভীষণ আগলে রাখত তিতির, আর তিতিরের বাবা। 

   হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করে অভি সিদ্ধান্ত নেয়, ও-ও মিলিটারি ফোর্স জয়েন করবে, তবে স্হলসেনা হিসেবে নয়, আকাশসেনা হিসেবে। 

- শোন, তোকে একটা কথা বলব।

- কি?

- ভাবছি পাইলট হব।

- এ তো দারুণ হবে।

- কিন্তু সাধারণ উড়োজাহাজের পাইলট নয়।

- মানে? 

- মানে যুদ্ধবিমান চালাব।

- না।

- কি না? 

- তুই আর্মি জয়েন করবি না অভি।

- আগে সুযোগ তো পাই। আমি শুধু আমার ইচ্ছেটা তোকে জানালাম।

- আমি তোকে তোর চেয়ে অনেক বেশি চিনি অভি। তুই যেটা ভাবিস সেটা তুই করিস-ই।

সেই প্রথম তিতিরের চোখে জল দেখেছিল অভি। তিতির দুহাতে চোখের জল সামলাতে সামলাতে বলেছিল,

- তুই ওখানে চলে গেলে আমি আর পারব না রে অভি। বাবাকে নিয়ে চিন্তা করতে করতে আমি এমনিই শেষ হয়ে যাই। এবার কি তুই আমায় পুরোপুরি মেরে ফেলতে চাস! 

- শোন, তিতির, ছেলেমানুষি করিসনা। মাকে এমন সময়ে হারিয়েছি যে মায়ের জন্য কিছুই করতে পারিনি, আমি দেশমায়ের জন্য অন্তত কিছু করতে চাই। তুই আর কাকু ছাড়া আমার আর কেউ নেই। তুই বাঁধা দিসনা প্লিজ। তুই না চাইলে আমি সুযোগ পেলেও যেতে পারব না, কিন্তু না গেলেও শান্তি পাব না। আপাতত চেষ্টা করতে দে। এখোনি বাঁধা দিস না প্লিজ।

 আর সেরকম কিছু বলেনি তিতির। শুধু বলেছিল 'যা ভালো বুঝিস কর'।

  সুযোগ এসেছিল খুব তাড়াতাড়ি। চলে যাওয়ার দিন অভির হাতদুটো ধরে তিতির বলেছিল, 'অভিকে ছাড়া তিতির অসম্পূর্ণ। সামলে রাখিস আমার অভিকে'। সেই প্রথম একে অপরকে 'বন্ধু', 'অবলম্বন', 'নির্ভরযোগ্য' এসবের চেয়ে অনেক বেশি কিছু বলে মনে হয়েছিল দুজনেরই। পরের তিনটে বছর নিজের কলেজ, ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও একটা চরম একাকীত্বে ডুবে থাকত তিতির। বন্ধুবান্ধবদের ভিড়েও বারবার মনে হত ও ভীষণ একা। কারণটা কি টের পেলেও কিছু করার ছিল না ওর। তিনবছর পর অভি একমাসের ছুটিতে যেদিন বাড়ি ফেরে সেদিন তিতির আর সামলাতে পারেনি নিজেকে।

- তিনবছরে একবারও মনে পড়লনা বল! নিজে তো ফোন করতিস-ই  না। আর আমি ফোন করেও পাইনি কোনোদিন। কিভাবে কাটিয়েছি এই তিনটে বছর তা শুধু আমিই জানি। কেন এতগুলো দিন নষ্ট করলি আমার?

- আমার ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোর কোথাও-ই প্রায় নেটওয়ার্ক থাকত না। আর বেস ক্যাম্পের নম্বর blood relatives ছাড়া আর কাউকে দেওয়ার নিয়ম নেই। আমি চেয়েছিলাম তোকে বা কাকুকে নম্বরটা দিতে কিন্তু পারমিশন গ্রান্ট হয়নি। I am really very sorry. 

- blood relatives ছাড়া নম্বর দেওয়া যায় না? 

- না।

- স্ত্রী blood relatives এর মধ্যে পড়ে। তাই তো?

- হ্যাঁ, তা তো পড়বেই।

- বিয়ে করবি আমায় অভি? আমি মিস তিতির সেন থেকে মিসেস অভিমন্যু মিত্র হতে চাই। প্লিজ অভি।

- তিতির! কি যা তা বলছিস? এটা সম্ভব না। 

- কেন? অন্য কাউকে ভালোবাসিস?

- পাগল হলি? সত্যি বলতে কি অন্য কাউকে যেমন ভালোবাসিনা তোকেও তো আমি সেইভাবে কোনোদিন...

- দরকার নেই। অন্য কাউকে যখন ভালোবাসিস না, তখন আর তো কোনো সমস্যা নেই। কাকু-কাকিমা থাকলে কারোর না কারোর সাথে তো তোর বিয়ে দিতোই,  সেই কেউটা নাহয় আমিই হলাম। এভাবে দিনের পর দিন তোর খবর টুকুও না পেয়ে বেঁচে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি তোকে ভালোবাসি, তুই ছাড়া চরম শূন্যতা অনুভব করি, তুই অন্যকাউকে ভালোবাসিস না, দেখতে শুনতে আমি খুব একটা খারাপ নই, লেখাপড়া জানি, চাকরি-বাকরি জুটিয়ে নেব, তোকে খাওয়াতে পরাতে হবে না। এগুলোই যথেষ্ট। তুই আমায় বিয়ে করছিস, ব্যাস। আর বিয়েটা তোর এই ছুটিতেই হচ্ছে। আমি আর কিছু জানতে চাই না। 

  কথাটা শুনে তিতিরের বাবাও খুব একটা গররাজি হননি। মনে মনে তিনিও এমনই কিছু চাইতেন। তিনিই যে ওদের একমাত্র অভিভাবক। অভির চেয়ে ভালো পাত্র তিতিরের জন্য সত্যিই তিনি পাবেন না। আর অভিকেও তিতিরের মতো করে কেউ বুঝবে না। কিন্তু অভি কেন গররাজি সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি।

- অভি!

- এসো কাকু।

- তোর সাথে কিছু কথা ছিল।

- বলো।

- তিতির আমায় তোর আর তিতিরের বিয়ের কথা বলেছে। শুনলাম ঐ