সৃষ্টি সাহিত্য যাপননামঃ-রাই কিশোরী (৬)কলমেঃ- তপন কুমার রায়তারিখঃ- ১৪/০২/২১
জিনিয়ার বাড়ী বয়ে বিয়ের নিমন্ত্রণঘ করতে আসার ঔদ্ধত্য টা রাইকিশোরী সহ্য করতে পারে নি।মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল। তীব্র রাগে মাথার সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রী যেন একে…
সৃষ্টি সাহিত্য যাপন
নামঃ-রাই কিশোরী (৬)
কলমেঃ- তপন কুমার রায়
তারিখঃ- ১৪/০২/২১
জিনিয়ার বাড়ী বয়ে বিয়ের নিমন্ত্রণঘ করতে আসার ঔদ্ধত্য টা রাইকিশোরী সহ্য করতে পারে নি।মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল। তীব্র রাগে মাথার সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রী যেন একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে বাহ্য জ্ঞান লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সারা শরীরের মধ্যে এক উথাল -পাথাল মোচড় দিতে থাকে। পাগলের মতো মোচড়াতে থাকে রাইয়ের শরীরটা।
রাইকে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় দাদা।
যুগলবাবু তাড়াতাড়ি তাঁদের হাউস ফিজিসিয়ান সুবীর দাসকে খবর দেন। ডাঃ সুবীর দাস ও তাড়াতাড়িই এসে যান।রাইয়ের দাদা ডাক্তারবাবুকে নিয়ে রাইয়ের ঘরে নিয়ে যায়। রাইয়ের সেই তীব্র খিঁচুনী একটু যেন কমেছে। বৌদি রাইয়ের চোখেমুখে একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে জল দিয়ে যাচ্ছে।
ডাঃ দাস ঘরে ঢুকে ই একটু ঘরের ভির খালি করতে বললেন। দুচার জন বেরিয়েও গেল। আগে আনুপূর্বিক ঘটনার কথা শুনে নিলেন ডাক্তার বাবু, তারপর স্মেলিং সল্টের শিশি নাকের কাছে ধরতেই রাই যেন একটু কেঁপে উঠলো প্রথমে, তারপর ধীরে ধীরে রাই চোখ মেলল।
--- কেমন লাগছে মা? ডাঃ দাস জিজ্ঞাসা করলেন। বললেন বিশেষ কিছু না সাময়িক মেন্টাল শক থেকে হয়েছিলো, ঠিক হয়ে যাবে। একটা ঘুমের ইনজেক্সন দিয়ে যাচ্ছি। আজ রাতটা একটু ঘুমাবে।তারপর রাইয়ের কে একগ্লাস গরম দুধ খাওয়াতে বলে, একটা প্রেসক্রিপশন লিখে চলে গেলেন।
যুগলবাবু বললেন,-- সুমনদের বাড়ী একটা খবর দেওয়ার উচিত । ওদের সবটা জানিয়ে রাখা দরকার। ওরা মানুষ তো খারাপ নয়। এখনো কি অমায়িক ব্যবহার।
"সুমনের বাড়ীর লোক এর মাঝে তো কোনো খোঁজ খবরই করেন নি। ওদের আবার বলার কি দরকার"--, রাইয়ের দাদার মত দেয়।
রাইয়ের মা বলেন-- "রাই হলো ওদের ঘরের বউ, ওদের সব কিছু জানানো দরকার। হাজার হলেও ডিভোর্স তো হয়নি রে বাবা।"
যুগল বাবু ফোনে সুমনকে ও তার বাড়ীতে খবরটা জানিয়ে দেন।খবরটা পেয়েই সুমনের বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়েন-- কি হল আবার মেয়েটার? একটু খবর তো নেওয়া দরকার।সুমনের মাকে বলেন,-- "চলো চলো, তৈরী হয়ে নাও, একবার দেখে আসি কি হলো আবার মেয়েটার"। সুমনের মায়ের রাইয়ের ওপর একটা চাপা রাগ যে ছিল না তা নয়। এই মেয়েটাই সুমনের জীবনটাকে লন্ডভন্ড করে দিল,এখন কি হবে ছেলেটার কে জানে! তবুও সুমনের বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারেন না।উনি যা ভাল বোঝেন তাই করেন।সুমনের বাবা একবার সুমনকে ফোন করে রাইয়ের কথা জানায়। সুমন বলে,--" তাকে রাইয়ের বাড়ী থেকে জানিয়েছিল। এ আর হাতিঘোড়া কি হয়েছে। যাক না,মা বাবা ঘুরে আসুক, সে আরযাবে না।"
. . .. সুমনের বাবা পৌছাঁতেই যুগলবাবু তাদের নিয়ে রাইয়ের ঘরে গেলেন। রাই ঠিক জ্ঞানেও নেই, আবার অজ্ঞান ও নয়। ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞাসা করলো---" সুমন কই? সুমন আসে নি এখনো?"
---- "অফিস থেকে ফেরেনি এখনো। ফিরে, সোজা আসবে এখানে।" মিথ্যেই বলেন সুমনের মা। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যি কথাটা বলতে পারলেন না। সুমনের বাবা দেখলেন রাইকিশোরী কাঁপতে কাঁপতে কেমন যেন ঝিমিয়ে যাচ্ছে, এলিয়ে পড়ছে মাথাটা। কেমন যেন লক্ষনটা ভালো ঠেকলো না। যুগলবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন,--- কোন ডাক্তার দেখছেন? তাকে কি আর একবার আনা যেতে পারে।
--- কেন আনা যাবে না? আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান। রাত একটু হয়েছে বটে তাও বললেই আাসবেন।
---- "তা হলে একটু খবর দিন।টেম্পারেচার কতটা দেখুন তো একবার। আমার তো রাইকে খুব ভালো ঠেকছে না। কেমন যেন সিঙ্ক করছে মনে হচ্ছে।" সুমনের বাবা বলেন।
ডাঃ দাস কে খবর দেওয়া হলো। তিনি এসে টেম্পারেচার, পালস চেক করেই বলে দিলেন-- এখুনি হসপিটালাইজ করুন।বাড়ীতে রেখে আর চিকিৎসা সম্ভব নয়। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ী নিয়ে ওরা বেরিয়ে গেল।পোদ্দার হসপিটাল কাছেই তাও ওরা বেলভিউয়ের ইমারজেন্সিতে নিয়ে গিয়ে ডাঃ মৈত্রর আন্ডারে ভর্তি করল রাইকে। কি ঠিক ওসুখটা আগে তো ঠিক হোক, িতারপর ডাঃ মৈত্রর পরামর্শ মতো স্পেশালিষ্ট ডাক্তারকে দেখানো যাবে। সৌভাগ্যক্রমে ডাঃ মৈত্র তখনও ছিলেন সেদিন।উনি দেখেশুনে আই সি সি ইউ এ এ্যাডমিট করে সাপোর্ট সিস্টেম গুলো চালু করে দিলেন। আর এম ও কে ইন্সট্রাকশন দিয়ে, পরের দিন টেস্ট গুলো করাতে বলে বেরিয়ে গেলেন। সুমন তার বাবাকে ফোন করে ডেভেলপমেন্টগুলো জেনে নিয়েছিলো। আই সি সি ইউ শুনে ভাবলো, তার কি এখন কোন ডিউটি আছে? আইনত রাই তার স্ত্রী । আর একদিকে, হিসেব মতো তাদের কোন সম্পর্ক ই তৈরী হয়নি যে হাসপাতাল ছুটতে হবে। সুমন ফিরে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো তার কি একবার হাসপাতালে যাওয়া উচিত?
--- নিশ্চয়।তোমার স্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি, আর তুমি আসবে না?এটা তোমার ডিউটি। বাবা বলেন।
সুমন, মা ফেরা পর্যন্ত খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো,।থাক, সময় মতো যা হোক কিছু খেয়ে নেবে। আবার গাড়ী বার করে সুমন নারসিং হোম চলে এলো। এই নারসিং হোমের সাথে তার অফিসের টাই আপ আছে দীর্ঘদিন। এরা ভালো পয়সা পায় বছরে ওদের অফিস থেকে। পি আর ও থাকা কালীন তার বেলভিউ কতৃপক্ষের সঙ্গে নিত্য জানাশোনা। এই সূত্রে হসপিটালের ভিতর তার অবাধ গতি। সুমন ঢুকতেই রিসেপশনের ছেলেটি উঠে এলো -- কি হলো স্যর? আপনাদের কেউ ভর্তি আছেন নাকি?
----- "হ্যাঁ। রাইকিশোরী রায় দেখো তো, কত নম্বর!"
ছেলেটি কম্পিউটার স্ক্রীনে চোখ বুলিয়ে বললো , "স্যর, আই সি সি ইউ সেভেন।"
সুমনকে ছেলেটিই নিয়ে গেল। ফ্লোরেই বাবা, মা ও রাইয়ের পরিবারের সকলের সাথে দেখা হয়ে গেল। সুমন জানতে চাইলো ---এখন কেমন আছে?
----"ঘুমাচ্ছে এখন। কাল সব টেস্ট হবে।
"ও " বলে সুমন ভেতরে ঢুকে গেলো।
ভেতরে গিয়ে একবার দেখেও এলো সুমন। ঠিক স্বাভাবিক ঘুম বলে মনে হলো না। আর এম ও এর সাথে দেখা করতে, তিনিই জানিয়ে দিলেন --- "ওয়ান টাইপ অফ ম্যানেনজাইটিস্। নাউ সী ইজ ইন কোমা। উই আর টু ওয়েট টিল সী কামস টু সেন্স। ডোন্ট ওরি।এভরি মেজারস আর অন।"
--- "থ্যাঙ্কস। সী ইজ মাই ওয়াইফ।টেক প্রপার কেয়ার প্লীজ"।
এই কথা গুলো বলে ফেলেই মনে হলো আরে একথা আবার বললো কেন? এগুলো তো সে ভাবেই নি। এখনও ওয়াইফ ভাবছে কি? না ভাববে যদি, এলোই কেন এখানে। এমন উদ্বিগ্ন হয়ে খোঁজই বা নিতে গেল কেন? সুমন যেন নিজেকেই চিনতে পারে না।
বাইরে এসে কাউকে কিছু জানালো না ডাক্তারের বলা কথা গুলো। বললো, --"-ঘুমাচ্ছে, কাল টেষ্ট হবে সব বলল। আজ আর সবাইয়ের এখানে থাকার দরকার নেই, সুমন থাকছে। কাল এলেই হবে।"
বলে, সবাইকে বাড়ী রওনা করিয়ে দিলো। সবাই চলে যাওয়ার পর সুমনের মনে হলো খিদেটা অনেকক্ষন থেকে চাপা আছে। এবার কিছু খেতে হবে,ভেবে পাশের রাস্তাটা দিয়ে পার্ক-স্ট্রিট চলে গেল। মোকাম্বোতে ঢুকে এক কোনে বসলো। পরিচিত অনেকেরই রেগুলার এখানেপ যাতায়াত, কারো সাথে দেখা হোক ও চাইছে না। ওয়েটার কে খাবার অর্ডার দিয়ে বসে আছে, এমন সময় জিনিয়া আর তার অফিসের ছেলেটি এসে তার টেবিলে বসলো-- মদ গিলে দুজনই একেবারে ভূত হয়ে আছে।
এই মাঝরাতে এরা এখানে? যার যা খুশী করুক সুমনের কি? ছেলে টি একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে--- "গুড ইভিনিং স্যর।গিভ মি ইয়োর ব্লেসিংস স্যর।" আর জিনিয়া বলছে-- "আই স্টীল লাভ ইউ সুমন, আই মিশ ইউ।"
শালা, মাঝরাতে এ মাতাল দুটো জুটলো! জিজ্ঞাসা করে কি প্রোগ্রাম এর পর? ওরা জানায়-" নাইট ক্লাব-- হুক্কাবার"
--- দেন, গো টু দ্য হেল। আমার খিদে পেয়েছে,খাবোঔ। ততক্ষনে সার্ভ করে দিয়েছে খাবার। সুমন খাওয়ায় মন দেয়। জিনিয়ারা উঠে যেতে বাধ্য হলো টেবল থেকে।আর এটাই চাইছিলো সুমন।
পুরো পাঁচটা দিন রাই পুরোপুরি কোমায় রইলো। ডাক্তাররা কোন রকম আশ্বাস দিতে পারে নি। সব সময় বলে গেছে আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করছি, বাকিটা ঈশ্বরের হাত।লাইফ সাপোর্টের সাথে ওষুধ ও ডিপস দিয়ে সমানে চলার পর ছদিনের দিন রাইয়ের জ্ঞান ফিরল। একদিন সুমন নারসিং হোম ছেড়ে বাড়ী যায় নি, অফিস টুকু কোনরকমে করেছে। আর সামনের চৌহান গেস্ট হাউসে একটা ঘর নিয়ে চান খাওয়া করে নিয়েছে। রাই একটু আাধটু কথা বলছে আর ডাঃ মৈত্র বলেছেন যে বিপদ কেটে গেছে এই শুনে সুমন বাড়ী ফিরে এলো। রাই কোমায় থাকা কালীন দিনে দশ বার তাকে দেখতে গেছে সুমন, কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর একবারও গেলো না।মা বারবার বলা সত্ত্বেও গেলো না।বাড়ী চলে গেলো। মা কে বলে গেলো তোমরা তো রয়েছো,এবার দেখে নিও। কি অদ্ভুত মানসিকতা, নাকি গভীর এক অভিমান বোধ? ডিউটি তে ফাঁকি দেয় নি কিন্তু একফোঁটা।
(ক্রমশ)