#ছোটোগল্পসাত লহরী তপতী মন্ডল চ্যাটার্জী২২/১/২১
রায় বাড়ির বড় বউ সুধাময়ীর মুখ দেখে তাঁর শাশুড়ী মা একটি সাত লহরী হার দিযেছিলেন।বিয়েতে দুই বাড়ি মিলে বালিকাটি ৩০০ভরী সোনার গয়না পেয়েছিলো।তাঁর মধ্যে এই হারটি ছিলো সকলের চেয়ে আলাদা।
সাত স…
#ছোটোগল্প
সাত লহরী
তপতী মন্ডল চ্যাটার্জী
২২/১/২১
রায় বাড়ির বড় বউ সুধাময়ীর মুখ দেখে তাঁর শাশুড়ী মা একটি সাত লহরী হার দিযেছিলেন।বিয়েতে দুই বাড়ি মিলে বালিকাটি ৩০০ভরী সোনার গয়না পেয়েছিলো।তাঁর মধ্যে এই হারটি ছিলো সকলের চেয়ে আলাদা।
সাত সাতটি লহর বা প্যাঁচ দিয়ে হারটি পরতে হয়।লহরগুলি ছোট থেকে বড় হতে হতে গলা থেকে নাভি অবধি বিস্তৃত। লহরগুলি যাতে জড়িয়ে বা পেঁচিয়ে না যায়, তার জন্য অনেকগুলি নকশা করা সোনার ক্লীপকাঠি দিয়ে প্রতিটি লহরকে আলাদা করে রাখা যেতো। সেগুলি খুলে হারটিকে পূর্ণ দৈর্ঘ্যে মেলে দিলে তা বড় বউয়ের উচ্চতা ছাড়িয়ে যেতো।
শাশুড়ী মা বলেছিলেন বংশের বড় বউয়ের এই হারের ওপর অধিকার। তিনিও তাঁর শাশুড়ীর বড় বউ ছিলেন বলে এটা পেয়েছিলেন।
কিন্তু সুধাময়ীর প্রথম দুটি সন্তান মারা যায়।তৃতীয় সন্তানটি কন্যা।আর তখনই তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সাতনরীর যাবতীয় প্রথা ভেঙে তিনি তাঁর সন্তানদের মধ্যে এই হার ভাগ করে দেবেন।
যৌবন উত্তীর্ণ করার পর তাঁর সন্তান সংখ্যা দাঁড়ালো নয়। শাশুড়ী চোখ বুজলে তিনি বাড়ির স্যাকরা ডেকে হারটি সমান নয়টি ভাগে ভাগ করেলেন।কিন্তু কাটলেন না। নয় সন্তানের নাম ছিলেকাটা সোনার পাতে লিখে সম দূরত্বে হারের ওপর ঝালাই করে দিলেন।যাতে এক এক জনকে প্রাপ্য অংশ বুঝতে অসুবিধা না হয়।আর তাঁর অবর্তমানেও যেন হারের সঠিক বিভাজন হয়।
হারে প্রথম ছেদ হলো, সুধার বড় ছেলে ও তৃতীয় সন্তানের বিয়ের সময়।ততদিনে তাঁর বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।কিন্তু শাশুড়ীর ভয়ে হারখানা কাটতে পারেননি এতোদিন।
এবার তিন সমান টুকরো করে বউ আর দুই মেয়েকে দিলেন। হারের গায়ে সন্তানদের নাম লেখা থাকায় বিভাজনে তো অসুবিধা হলই না বরং নাম লেখা সোনার পাতগুলি সন্তানদের বুকের ওপর লকেটের মতো ঝুলতে লাগলো।মেয়েরা নিজেদের নাম আর বউমা তার স্বামীর নাম গলায় ঝুলিয়ে ভারী আনন্দ পেলো।
বাকি ছয় সন্তানের নাম লাগানো হারখানা সুধাময়ী বক্ষে ধারণ করলেন।দৈর্ঘ্য তার কিছু কমেছে।পুরনো ক্লীপকাঠি ভেঙে নতুন ছোট ক্লীপকাঠি বানানো হয়েছে, যাতে পাঁচটি লহর আটকে রাখা যায় নিদিষ্ট দূরত্বে।
সুধাময়ীর এমন আশ্চর্য অলংকার বিভাজনে সবাই অবাক হয়ে গেল।তাঁর জায়েরাও তাঁদের চুড়ি, বালা, আর্মপ্লেটে সন্তানদের নাম ঝোলাতে লাগলেন। কিন্তু কোনোটাই সুধার মতো এতো চমকপ্রদ হলো না।
কিন্তু বিধাতারা এমনি বিচার, তাঁর দ্বিতীয় পুত্র সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে গেলেন।সুধাময়ী ভাবলেন বাকী অংশ ছোট পাঁচ সন্তানের মধ্যে ভাগ করে দেবেন আর মেজো ছেলের নাম লেখা পাতখানি হার থেকে তুলে নেবেন।কিন্তু ঈশ্বর তাতেও বাধ সাধলেন।
মাত্র তিনদিনের জ্বরে তাঁর সব থেকে ছোট সন্তান মারা গেলো।এই মেয়ে তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। সবচেয়ে সুশ্রী ও বিদুষী ছিলো।ওর চলে যাওয়ায় সুধার জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে যায়।
তবু জীবন তার নিজের নিয়মে চলে।তৃতীয় কন্যার বিয়ে সময় সেই মেয়ের জন্য নির্ধারিত অংশ সাত লহরী থেকে কেটে তাঁকে দেওয়া হলো। যে দুই সন্তানকে হারগুলি দিতে পারবেন না তাদের অংশ বুকের সাথে আঁকড়ে এখন সে হার চার লহরে ঝোলে। নতুন আরো ছোটো ক্লীপকাঠি তাকে আটকে রাখে সুধার হৃদপিণ্ডের ওপর।
শেষ তিন ছেলের বিয়ে সুধা দেখে যেতে পারেননি।সুধার স্বামী বেঁচে ছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবন প্রকৃত অর্থেই সুধাহীন নিরস হয়ে পড়েছিলো।
তবে তাঁর সন্তানরা ভাইদের বিয়ে দিতে কোনো কার্পণ্য করেনি।পৈতৃক অগাধ সম্পত্তি থেকে তাঁদের প্রচুর আয়।সকলেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সফল।ফলে সুরোজগেরে।তাই বিয়ের আড়ম্বর যথা নিয়মেই হলো।
দুজনের ক্ষেত্রে সাত লহরীর বিভাজন ঠিকই নিয়মেই হয়েছিল ।কনিষ্ঠ পুত্রবধুকে তিন সন্তানের জন্য বরাদ্দ হার দিয়ে দেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্ত ছিল স্বয়ং তাদের বাবার।তাই কেউ আর আপত্তি করেনি।
ঠাকুর ঘরের সামনে সুধাময়ীয় একটি আবক্ষ মর্মর মূর্তি ছিলো।সবাই সেখানে প্রনাম করে শুভকাজের শুরু আর শেষ করে। ছোটবউ যখন
শ্বশুর বাড়ি এসে শাশুড়ী মূর্তিতে প্রনাম করলো, তখনই মূর্তির গলায় পাথরে খচিত সেই হারটি তাট চোখে পড়ে।তার নিজের গলা আড়াই লহরের সেই হারের অংশ।যার ওপর তার স্বামী, ভাসুর আর ননদের নামযুক্ত পাত লাগানো।
কালরাত্রিতে নতুন বউটি শুয়েছিলো তাদের পিসি শাশুড়ীর সাথে।সারা রাত ধরে সে তার প্রয়াতা শাশুড়ীর গল্প শোনে।বিশেষ করে সাত লহরীর গল্প তাকে অবাক করলো।
বউভাতের রাতে শেষ ব্যাচে বাড়ির সবাই এক সাথে খেতে বসেছে।এমন সময় নতুন বউ তার শাড়ী গয়না সামলে উঠে দাঁড়িয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো
---এখানে বাড়ির সবাই আছেন।তাই আমি একটি প্রস্তাব পেশ করতে চাই।মায়ের যে হারখানা তিনি তাঁর সন্তানদের মধ্যে টুকরো করে দিয়েছেন, আমরা যদি সেই লহরগুলি আবার জোড়া লাগিয়ে মায়ের গলায় পরিয়ে দিই, তবে কেমন হয়??
এমন অদ্ভুত প্রস্তাব শুনে সবাই হতোবাক।বড় ননদ বলল
---তাতে লাভ?
----মা যেখানেই থাকুন দেখবেন যে, তাঁর যে ভালেবাসা তিনি সন্তানদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, সন্তানরা তা আবার তাকে জড়ো করে দিলো।
বড় বউ বললেন
---মা তো চেয়েছিলেন আমরা সেগুলি পরি।
নতুন বউ বলল
----কিন্তু তাঁর চাওয়া যে কোনদিন পূর্ণ হবে না, তা তে আমার গলার এই আড়াই প্যাঁচই বলে দিচ্ছে।
মেজো জা বলল
---তাছাড়া এটা বংশের সম্মান।তাই পরের প্রজন্মের এর ওপর অধিকার আছে।
নতুন বউ অবিচলিত
--পরের প্রজন্মের সবাই যাতে সম্পূর্ণ সাত লহরী নিয়ে গর্ব করতে পারে, আমি তো তাই চাই।
বড় ছেলে বলল
---আমার কিন্তু এই প্রস্তাব খুব ভালো লেগেছে। সব থেকে বেশি যে পেয়েছে সে যখন তা ফিরিয়ে দিতে চেয়েছে তখন বাকিদের আপত্তি থাকা উচিত নয়।
সেজো মেয়ে বলল
---আমিও রাজি।মায়ের গলায়ই এ হার মানায়।
সভায় যখন গুঞ্জন, তখন নাতি নাতনীর দল মুখর ও স্পটবাদী।তাদের প্রতিনিধি বড় নাতনী বলল
--আজ আমাদের হেরিটেজ প্রিসার্ভ করার সুযোগ এসেছে। তাই এই নিয়ে আর কোনো তর্ক নয়।ছোটমামীর কাছে তিনভাগ আছে।বাকি ছয়ভাগ তোমরা ফেরত দেবে।আমরা কালকেই বড় কোনো জুয়েলারি হাইসে গিয়ে সুন্দর করে নয়টি ভাগ জুড়ে সাত লহরী বানাবো।দিদিমার ছবি দেখে যতদূর সম্ভব কাছাকাছি ডিসাইনে ক্লীপকাঠি বানিয়ে দিদিমার মূর্তিতে পরিয়ে দেবো।
সুধাময়ীর এই নাতনীটি লন্ডনে প্রত্নতাত্বিক বিভাগে গবেষণা করে।সে সুধার ছোট সন্তান ও তাদের বউদের থেকেও বড়।তাই তার কথা আর কেউ ফেলতে পারলো না।
সবার হার যখন বায় বাবুর হাতে এলো তখন আর তিনি চোখে জল ধরে রাখতে পারলেন না
---সুধা,দেখো তোমার পুরো সংসার আবার তোমার বুক জুড়ে থাকবে।তুমি নিজেকে তাদের নামে বিলিয়ে দিয়েছিলে।আজ সম্মান আর ভালোবাসার ঝালাই করে তারা তোমায় জোড়া লাগালো।
সেই কাহিনী অঞ্চলে লোকের মুখে মুখে ছড়ালো।তখন থেকেই সবাই ও বাড়িকে 'সাত লহরি রায় বাড়ি'বলেই চেনে।
তপতী মন্ডল চ্যাটার্জী