#স্টেথো_বদল#সোমা_ত্রিবেদী২৮•০২•২০২১
স্যার কে রুমেলার ভালো ভালো লাগে সেটা স্যার বেশ বুঝতে পারেন। যদিও মুখে কিছু বলেন না। স্যারের যখন ক্লাস চলতো একটা কারো চোখের পলক পড়ত না। একটা পিরিয়ড যেন মুহূর্তে শেষ হয়ে যেতো। ক্লাসের সমস্ত কন্…
#স্টেথো_বদল
#সোমা_ত্রিবেদী
২৮•০২•২০২১
স্যার কে রুমেলার ভালো ভালো লাগে সেটা স্যার বেশ বুঝতে পারেন। যদিও মুখে কিছু বলেন না। স্যারের যখন ক্লাস চলতো একটা কারো চোখের পলক পড়ত না। একটা পিরিয়ড যেন মুহূর্তে শেষ হয়ে যেতো। ক্লাসের সমস্ত কন্ট্রোল স্যার যেন নিজে নিয়ে নিতেন। ক্লাসের প্রায় সব মেয়েরই ক্রাশ ছিলেন এই দত্ত স্যার।
রুমেলাদের ব্যাচের অনেকেই এম•ডি• পড়ার জন্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলে দত্ত স্যার প্রায় স্মৃতির অতলেই চলে গেলেন। রুমেলা বিদেশি ডিগ্রী নিয়ে ফিরে প্রত্যন্ত গ্রামে পরিষেবা দেওয়ার বাসনা প্রকাশ করলে ওকে বাড়ি থেকে সবাই বোঝাতে শুরু করে আর বন্ধুরা ইমোশনাল ফুল বলতে থাকে। তা সত্ত্বেও রুমেলাকে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও সরানো যায় না।
রুমেলার প্রথম পোস্টিং হয় বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানেই সে নিজের থাকার একটা বন্ধবস্ত করে নেয়। এখানে মানুষ আসেন নানা রকম ব্যাধি নিয়ে। আর ব্যাধি ছাড়াও সাপে কাটা রোগীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। বিশেষত বর্ষায় বাড়ে আরও বেশি। তাও নাকি অনেকেই ওঝা গুনীনের কাছেই চলে যায়। যতই সরকারি বিনা পয়সার চিকিৎসা থাকনা কেন, এক শ্রেণির মানুষ আছেন যাঁরা এখনো ডাক্তারের থেকে ওঝা গুণীনে বেশি ভরষা রাখেন। সেই জন্য একদিন গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে সচেতনতার প্রোগ্রাম আয়োজন হয় সেখানে ডা•রুমেলা, একজন ওঝা এবং কিছু কোলকাতার ডাক্তারদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেই খোলা মঞ্চে সমস্ত গ্রামবাসীর ও উপস্থিত থাকার কথা। কোলকাতা থেকে কোন কোন ডাক্তার আসছেন তার একটা লিস্ট আগের দিন মেল করে দিয়েছেন আয়োজকেরা। তাতেই ডা•ঋষিরাজ দত্তের নামটাও জ্বলজ্বল করছে আরও দুই একজন ডাক্তারের নামের সঙ্গে। রুমেলা মণিটরের দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যেতে থাকে বছর আষ্টেক আগে। সেই দত্ত স্যার, যার ক্লাস সে একশো দুই জ্বর নিয়েও ক্লাস করতে চলে এসেছিল। ক্লাসের বাকি মেয়েরা যখন স্যারের প্রশংসা করত কি ভীষণ হিংসা হতো। রুমেলার একটা সিক্সথ সেন্স যেন বলতো ডা•ঋষিরাজ দত্তেরও তাকে দেখেই ধ্যান ভঙ্গ হয়েছে। কিন্তু কখনও উভয় তরফের কেউই তা প্রকাশ করেনি। সেই দত্ত স্যার আবার চোখের সামনে কাল আসবেন। মুখে একটা মুচকি হাসি খেলে যায় রুমেলার। তারপর নিজেই নিজেকে সংযত করে মনকে শাষন করে ভেবে নেয়, ধুস কতো বছর সব আগের কথা, কি প্রচন্ড ছেলেমানুষী ছিল, স্যারের হয়তো এতোদিনে বিয়ে হয়ে সংসারি হয়ে গিয়েছেন।
আজ পেসেন্টের ভীড় কম। তাই ব্যাচ মেট সুতপাকে ফোন করে রুমেলা। সে প্রাইভেট প্রেকটিস করে। বিয়ে করে দুই কন্যার মা। এখনো অবধি ওর সঙ্গেই যেটুকু ঘনিষ্ঠতা রয়েছে রুমেলার। বাকি সবার সঙ্গেই তো হাই, হ্যালো রিলেশন। অবশ্য আবিরটা জোর করে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে, কখনও হোয়াটসএপে তো কখনও ফোন করে। ও একটা কোলকাতার সরকারি মেডিক্যাল কলেজে আছে। খানিকটা ফোন বেজে যাওয়ার পর সুতপা ফোনটা ধরল। বল? রুমেলার উত্তেজিত জবাব, এই জানিস, আমাদের বাঁকুড়া হসপিটালে কাল দত্ত স্যার আসছেন রে। ওপারে নির্লিপ্ত কন্ঠের প্রশ্ন কোন স্যার? একই রকম উত্তেজনা নিয়ে বলে রুমেলা আরেএএ, ডা•ঋষিরাজ দত্ত রে। সেই হ্যাণ্ডসাম স্যারটা। তুইকি ভুলেই গেলি? ভুলব কেন ঠিকই মনে আছে। শুধু তোর মতন এখনো আর পাগলামিটা নেই। বারবার বলি একটা বিয়ে কর তা না, উনি বাবু গ্রামে বসে সেবা ব্রতো পালন করবেন। শোন, বিয়ে করে নিজের একটা দুটো ট্যাবলেট, ক্যাপসুল সামলে প্রাইভেট প্র্যাকটিস বজায় রাখতে গিয়ে না দত্ত স্যারর নাম তো কোন ছার নিজের নামটাই মনে পড়েনা ঠিক মতন। রুমেলার মনের মধ্যে পুরোনো স্মৃতিচারণে যে মৃদু সুখানুভূতি জাগছিল তা সুতপার ধ্যাতানি খেয়ে বাস্তবের জমিতে মুখ থুবড়ে পড়লো। রুমেলা ব্যাজার হয়ে প্রশ্ন রাখল কিরে রজতদার সাথে খিটিমিটি হয়েছে মনে হয়। সুতপার কাটা ঘায়ে মলম পড়ার আশায় লাভা স্রোতের মতন স্বামীর বিরুদ্ধে যতো ক্ষোভ ছিল উগরে দিল। যার মদ্দা কথা হলো, বিয়ে যদি করতেই হয় তবে ডাক্তারকেই করা উচিত। একজন ডাক্তারই ডাক্তাররের সমস্যা বোঝে। আর আইটির লোককে তো কক্ষণোই নয়। কারণ তারা সারাদিন মেশিনের সামনে বসে বসে মানুষের মেকানিজম ভুলে যায়।
সুতপার সঙ্গে একটু কথা বলে বুঝল সংসার করা কেসটা একটা ক্রিটিকাল কেস সামলানোর থেকে বেশি টাফ। যাক বাবা সে তো এই পথের পথিক হতেও চায়না। ফোনটা রাখার পর মিনিট দশেক বেশ বিশ্রামে ছিল হঠাত করে বেজে উঠল আগুনের পরশমণি... স্ক্রিনে ফুটে উঠল ডা•আবির সরকার নামটা। নিস্পৃহ কন্ঠে রুমেলা ফোনটা ধরে বলে উঠল, হ্যাঁ বল। ওপার থেকে অসম্ভব উত্তেজিত কন্ঠে আবির বলল, কাল দেখা হচ্ছে অবশেষে, খুব এক্সাইটিং লাগছে কি বলিস? রুমেলা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে, ও কালকের তুইও আসছিস? আবির ততোধিক আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করে কেনো তুই মেল পাসনি? আরও দুই একটি কথার পর ফোন রেখে দেয় রুমেলা।
সারাদিন অনেক ব্যাস্ততায় কেটেছে। বিকেলের চা হাতে ডাক্তার দত্ত, ডাক্তার সরকার আর রুমেলা একধারের টেবিলে বসে। টুকটাক কথা চলছিল। হঠাৎই প্রশ্ন করেন ডাক্তার দ্ত্ত, কি রুমেলা স্টেথো বদল সেরে ফেলেছ নাকি... রুমেলা লাজুক হেসে, জবাব দেয়, না স্যার পছন্দের মানুষটাকে জানাতেই পারলামনা যে ভালোবাসি। ঋষিরাজ একটা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রুমেলার দিকে। এমন সময় ঋষিরাজের মোবাইলটা বেজে উঠল, ফোনটা ধরার আগে স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে রুমেলার সামনে বাড়িয়ে বলে উঠল আমার স্ত্রী। ফোনের ওপ্রান্ত থেকে প্রচণ্ড বেগে কথা ভেসে এলেও এপ্রান্ত শুধু হ্যাঁ হু করে গেল। ফোনটা রেখে ডাক্তার দত্ত আক্ষেপের সুরে বললেন, আমারও ভালোবাসার মানুষটিকে বলা হয়নি সময় মতন। বিয়ে করেছি, স্ত্রীর প্রচন্ড সন্দেহবাতিক। খনিকের নীরবতা নেবে এলো।
ঋষিরাজ ম্লান মুখে রুমেলার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভালোবাসা চিনতে বারবার ভুল কোরোনা রুমেলা, আবিরের সঙ্গে কিন্তু তুমি খুব সুখী হবে। তারপর কিঞ্চিত রসিকতা করে বলেলন আবির সেরে ফেলো আমার সামনে স্টেথো বদলটা। আবির রুমেলার চোখে চোখ রেখে বলল, আমি তো স্যার সেই কবে থেকেই স্টেথো হাতে প্রস্তুত শুধু রুমেলাই আমার পারমানেন্ট পেশেন্ট হতে চাইছে না। রুমেলা কোনো রকম বাক্য ব্যায় না করে, সলজ্জ হাসি নিয়ে নিজের স্টেথোটা খুলে আবিরের গলায় ঝুলিয়ে দিলো। দুরের কোন একটা মন্দিরে