Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

আগুনযোদ্ধা অপূর্ব চক্রবর্ত্তী
ভোট এসে গেলো। বিভিন্ন দলের প্রার্থীগণ বেরিয়ে পড়েছেন তার দলের সাফল্য আর বিরোধীদের বিফলতার খতিয়ানের ফর্দ নিয়ে।পাঁচ বছর অন্তর এই চেনা দৃশ্যটি দেখতে অভ্যস্ত ভোটার নামের এই মানুষগুলো। কে যেন বলেছিল একদিন &…

 


আগুনযোদ্ধা 

অপূর্ব চক্রবর্ত্তী


ভোট এসে গেলো। বিভিন্ন দলের প্রার্থীগণ বেরিয়ে পড়েছেন তার দলের সাফল্য আর বিরোধীদের বিফলতার খতিয়ানের ফর্দ নিয়ে।পাঁচ বছর অন্তর এই চেনা দৃশ্যটি দেখতে অভ্যস্ত ভোটার নামের এই মানুষগুলো। কে যেন বলেছিল একদিন 'খেলা হবে'। আর কি নতুন খেলা হবে? এমন খেলা তো মানুষ প্রতি নির্ব্বাচনেই দেখে আসছে। জানিনা আর কেমন কেমন খেলা এখনো বাকি আছে। কিন্তু আজ যে খেলাটা হলো সেটা চিরদিন মনে থাকবে আমার।

  দক্ষিণপন্থী একটি দলের ভোট প্রার্থী হয়ে বাহাত্তর বছরের সুভাষবাবু বেড়িয়েছেন ভোট ভিক্ষায়। যদিও তার প্রার্থীপদ স্থির হয়েছে প্রায় তিন সপ্তাহ আগে।কিন্তু তাকে যখন এই বিধান সভার প্রার্থী করা হলো,তখন এখানকার দলীয় কর্মীরা মেনে নেয়নি সেই প্রার্থীকে। রাস্তা অবরোধ ও আরো নানারকম ভাবে তারা বিক্ষোভ দেখাবার চেষ্টা করেছে। কারন একটাই সুভাষবাবু অন্য এলাকার মানুষ। কলকাতার মানুষ হয়ে প্রার্থী হয়েছেন এই বিধানসভায়। অতঃপর দলের এক শীর্ষস্থানীয় নেতার মধ্যস্থতায় ক্ষোভের আগুন কিছুটা স্তিমিত হওয়ার পর আজই প্রথম প্রচারে বেড়িয়েছেন সুভাষবাবু।

ধবধবে সাদা ধুতি,পাঞ্জাবী, পায়ে চকচকে চামড়ার স্লিপার। মুখে সুন্দর ছাঁট দেওয়া দাঁড়ি।শরীর থেকে দামী ও ব্র্যান্ডেড বডি স্প্রের সুগন্ধ ভেসে আসছে।আগাপাশতলা ভদ্রলোক।ওনাকে দেখলে মনে হবে, বয়েস তার শরীরে ছাপ ফেলতে পারে নি। 

এই বিধানসভার এই অঞ্চলটা একদম গ্রাম। সুভাষবাবু সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে পদব্রজেই চলেছেন। অনেক ঘর ঘুরতে ঘুরতে বেশ কিছুটা ক্লান্ত।আসলে অভ্যেস নেই।

অবশেষে গ্রামের শেষ ঘরটির উঠানে এসে দাঁড়ালেন। ছোট্ট একটা মাটির বাড়ি, খড়ের চাল, দারুণ লাগছে জায়গাটা। কারণ এই বাড়িটির চারিপাশে বড় বড় আম,জাম,

কাঁঠালের ছায়ায় এতক্ষণ রোদে পোড়া শরীরটা যেন জুড়িয়ে যাচ্ছিল। একটি বছর বাইশের ছেলে ঘর থেকে দুটি প্ল্যাস্টিকের চেয়ার এনে বসতে দিল। সুভাষবাবুও যেন একটু বসতেই চাইছিলেন।

   পিপাসাও পেয়েছে, সঙ্গে দামী কোম্পানীর জলের বোতল ও আছে। কিন্তু তিনি ছেলেটিকে বললেন 'একটু খাবার জল.....'

 ছেলেটি ভিতরে গেল। একটু পরে একটি চকচকে করে মাজা তামার ঘটি ও একটি ততোধিক চকচকে কাঁসার বড় গ্লাসে জল নিয়ে এলো এক ভদ্রমহিলা। ভদ্রমহিলার পোশাক দেখে বোঝাই যায়, নিম্নবিত্ত মানুষ এরা।সুভাষ বাবু জলের গ্লাসটি নিয়ে খুব তৃপ্তি ভরে পিপাসা মেটালেন। তারপর গ্লাসটি ফেরত দিতে দিতে বললেন- 'ভোট এসেছে। আপনাদের ভোটটা পাবো নিশ্চয়ই'।আমাদের চিহ্ন মনে আছে তো?

                  ভদ্রমহিলা ডাকলেন তার নাতিকে, 'রবি তোর দাদুকে ডেকে দে।বল উনি ডাকছেন।'

-'আহা আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি। ভোটটা আমাকে দেবেন তো?'

ভদ্রমহিলা মাথার ঘোমটা একটু টেনে স্পষ্ট ভাষায় উত্তর দিলো - না। 

একটু যেন চমকে উঠলেন সুভাষবাবু, চকিতে তাকালেন মহিলার মুখের দিকে। ভদ্রমহিলা ততক্ষনে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছেন।

   সঙ্গের সাঙ্গপাঙ্গরা একসাথে যেন ঝাঁপিয়ে পড়লো কথা আর বিদ্রুপের খোঁচায়।

কারণ সামনাসামনি এমন উত্তর স্বভাবত কেউ দেয় না। সুভাষবাবু হাতের ইশারায় তাদের নিরস্ত করলেন।

 কে যেন পিছন থেকে বলে উঠলো-'সুভাষ দা এটা তো সরাসরি আপনাকে অপমান।' 

সুভাষবাবু তার দিকে তাকিয়ে একটা বিরক্তিসূচক আওয়াজ করলেন 'আহ থামো'

-আচ্ছা,আমাকে কেন ভোট দেবেন না একটু কি বলবেন?

ঘরের মধ্যে থেকে একটি মানুষ বেরিয়ে আসছে।পরনে মলিন একটি পাজামা আর একটা পুরোনো পাঞ্জাবী। বেশ কিছু দিন দাঁড়ি কামায় নি। লোকটিকে দেখেই সুভাষ বাবুর গা টা গুলিয়ে উঠছে।কিন্তু ভোট বড় বালাই।তাই হাসি হাসি মুখ করে হাত জোড় করলেন।

'তোকে কেন ভোট দেবো বলতে পারিস বেইমান?'

সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে এ কথায়। সুভাষবাবু ভাবছেন এত স্পর্ধা এই ভিখারিটা পেলো কোথায়? কান দুটো লাল আর গরম হয়ে উঠেছে সুভাষবাবুর।

   মানুষটি এবার সাঙ্গপাঙ্গদের উদ্দেশ্য করে বললেন-'তোমরা একটু বাইরে যাও, আমি ওর সাথে একটু একা কথা বলতে চাই'।

 সুভাষবাবু কি বুঝলেন কে জানে,তবে এ টুকু বুঝলেন এ লোকটা তার কোনো ক্ষতি অন্তত করতে পারবে না। তাই ছেলেদের বললেন-তোমরা একটু অপেক্ষা করো বাইরে। আমি কথা বলে আসছি। হাজার হোক পুরোনো রাজনীতিবিদ।উনি জানেন দুটো কথা বললেই এই ভিখারী গুলো গদগদ হয়ে পড়বে। ছেলেরা সরে গেলে, সুভাষ বাবু একটি কিং সাইজের সিগারেট বের করে ধরালেন, একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন- 'বলো কি বলতে চাও'?

লোকটি চিৎকার করে ডাকল তার স্ত্রীকে। 

একটি বিড়ি বের করে বলল আমি বিড়ির নেশাটাই করি।বলে বিড়িটি ধরালো।

লোকটার স্ত্রী মানে যে ভদ্রমহিলা জল দিয়েছিল সে এলো। তার হাতে একটা ছোট্ট পুঁটলি, সেটা খুলতেই বেরিয়ে এলো একটা ভাঁজে ভাঁজে কেটে যাওয়া কাগজ আর একটা লাল কাপড় কাস্তে হাতুড়ি আঁকা। কাগজটা সুভাষ বাবুর হাতে দিয়ে লোকটা বললো-'এটা চিনতে পারিস বেইমান'? 

সুভাষ বাবু আতঁকে উঠে তাকালেন লোকটার মুখের দিকে। তার মুখ দিয়ে অস্ফুটে একটা শব্দ বেরিয়ে এলো 'অগ্নিভ'

তুই.........!

লোকটা যেন একটা টাইম মেশিনের চাবি দিয়ে দিলো হাতে।সুভাষবাবু দ্রুত পিছনে হাঁটতে লাগলেন, হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলেন প্রায় অর্ধ শতাব্দীর ও বেশি সময়ে, তখন সে সদ্য যুবক, পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট চলছে। আগুনের তাপে টগবগ করে ফুটছে শরীরের রক্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই তাকে নেতৃত্ব দিতে দেখে খুশি। বুকের মাঝে স্লোগান চলছে ' সংসদ শুয়োয়ের খোয়ার',বন্ধুকের নলই ক্ষমতার উৎস' ইত্যাদি।সবসময় একটা জ্বালিয়ে দাও,পুড়িয়ে দাও মনোভাব। নকশাল শব্দটার সাথে জুড়ে গেছে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। রাষ্ট্র ওদের শত্রুই মনে করে।একটা আগুন জ্বলা সময়ে যুদ্ধে মেতেছে ওরা।এক অসম যুদ্ধ।

হঠাৎ লোকটা তার ভাবনার সূত্র টা কেটে দিলো।

-'ইচ্ছে করলেই পঞ্চাশবছর আগের সেইদিনের প্রতিশোধটা এখুনি নিতে পারি রে সুভাষ।কিন্তু তোকে বেইমান,বিশ্বাস ঘাতক জেনেই ক্ষমা করেছি আমি আর সুরমা। তোর কোনো ভয় নেই।

এই পতাকাটা চিনতে পারিস? যেদিন তোর হাতে গুলি লেগেছিল পুলিশের, এটা দিয়ে ব্যান্ডেজ করে তোকে কাঁধে নিয়ে তের কিলোমিটার রাস্তা হেঁটেছিলাম আমি, সুব্রত, সুরমা,অভীক আর বল্টু। 

সুরমা তোর চিহ্নটা রেখে দিতে চেয়েছিল।তাই ওটা আমার কাছে থেকে গেছে।

 সুরমার কাছেও একটা চিহ্ন আছে। সারাজীবন সেই চিহ্ন আঁকড়ে মেয়েটা আজও বেঁচে আছে।

সেটা তোর দেওয়া উ