Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#অপান
©Abhijeet Panja
রবিবার সন্ধ্যেবেলা চানাচুর আর মুড়ি সর্ষের তেল দিয়ে মেখে একগাল মুখে দিতে না দিতেই ওয়াক শব্দ করে শাড়ির আঁচল মুখে চেপে বাথরুমের দিকে দৌড়ে গেলেন প্রণতি দেবী। রিমোট টা হাতে নিয়ে অল্প একটু সাউন্ড বাড়িয়ে চায়ে চুমুক দ…

 


#অপান


©Abhijeet Panja


রবিবার সন্ধ্যেবেলা চানাচুর আর মুড়ি সর্ষের তেল দিয়ে মেখে একগাল মুখে দিতে না দিতেই ওয়াক শব্দ করে শাড়ির আঁচল মুখে চেপে বাথরুমের দিকে দৌড়ে গেলেন প্রণতি দেবী। রিমোট টা হাতে নিয়ে অল্প একটু সাউন্ড বাড়িয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে তন্ময় হয়ে দেওয়ালে ঝোলানো টিভির দিকে তাকিয়ে রইলেন বঙ্কা দা। প্রণতি দেবী ঘরে এলেন মিনিট খানেক পর। মুড়ির কাঁসিটা বিছানা থেকে নিয়ে ছুঁড়ে দিলেন সোফায়, শুধু সোফা নয় সারা ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো মুড়ি চানাচুর। সোফায় বসে থাকা বঙ্কা দার কোনো বিকার নেই। আস্তে করে পেছন টা তুলে সেকেণ্ড মিসাইল টা ছাড়তেই নাকে চাপা দিয়ে গডরেজের স্টিল আলমিরা খুলে বেশ কিছু জামা কাপড় বের করে একটা ব্যাগে ভরতে ভরতে পিকি কে ফোন করলেন প্রণতি দেবী...


- 'শোন, আমি এইভাবে আর কিছুতেই পারছি না, এরকম একটা অসভ্য নোংরা লোকের সাথে সাতাশ বছর কাটিয়েছি। আর নয়। তুই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছিস, এখন আমি ঝাড়া হাত পা। আমি তোর দিদার কাছে চলে যাচ্ছি, আর হ্যাঁ, পারমানেন্টলি যাচ্ছি এবার'। 


ফোন টা রেখে ঠাকুর ঘর থেকে গোটা চারেক চন্দন ধূপ জ্বালিয়ে এনে ড্রেসিং টেবিলের পায়ার কাছে রাখা ধূপদানী তে গুঁজে দেবার পর ঘর টা ঝাঁট দিয়ে তারপর অন্য ঘরে পোশাক পরিবর্তন করতে যান প্রণতি দেবী। বঙ্কা দা উঠে রান্নাঘরের কলে নিজের চায়ের কাপ ধুয়ে রেখে পুনরায় ঘরে ফেরেন, আয়েস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বাবু হয়ে সোফায় বসে চ্যানেল পরিবর্তন করে সংবাদ দেখার সময় ঘরে আসেন প্রণতি দেবী। পাশের ঘর থেকে নিয়ে এসে আরও কিছু জিনিস পত্র ব্যাগে ভরে চেন টা টানতে টানতে বঙ্কা দাকে বলেন উল্টোডাঙ্গা যাবার একটা ক্যাব বুক করে দিতে। টিভির পর্দায় চোখ রেখে বঙ্কা দার উত্তাপহীন প্রশ্ন..


- কি বলবে তোমার মা আর বড়দা বড় বৌদি কে? স্বামীর পাদের গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে এই বয়সে বাপের বাড়ি চলে এসেছো? 


- লজ্জা করে না, একটা বাজে লোক কোথাকার! তুমি সমাজে মেশার যোগ্যই নয়। আজ অবদি এমন কোনো অনুষ্ঠান, এমন কোনো জায়গা আছে যেখানে তুমি তোমার এই বাতকম্মের জন্য আমায় অপ্রস্তুতে ফেলনি? গুড্ডুর পৈতের দিন ব্যাটার ফ্রাই খেতে খেতে এমন একটা বোম্ব ফাটালে খাবার টেবিলে বমি করে ফেললো স্বান্তনা দি। মান ইজ্জত কিচ্ছু রেখেছিলে সেদিন? বড়দার বিয়ের পর নতুন বৌদি, থিয়েটার দেখতে দেখতে তুমিই যে সেদিন নিঃশেব্দ বিষিয়ে দিয়েছিলে গোটা হলের পরিবেশ সেটা কেউ না জানুক আমি তো জানি, ইশ্ ছিঃছিঃ ছিঃ কি লজ্জা, কি লজ্জা। আমার ছোটবেলার বন্ধু সর্বাণীর গোটা ফ্যামিলির সাথে দার্জিলিং যাবার সময় বদ্ধ এ সি কামরায় কি করেছিলে মনে নেই? কাকুমণি কাশতে কাশতে অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রায়, সর্বাণী ছেলে কে হিসি করাতে যাবার নাম করে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় আর তুমি গ্যাস টি ছেড়ে চুপ করে বই পড়ার ভান করছিলে, তোমার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো আসামী টা আসলে কে! 


অনেক হয়েছে আর নয়। ইঞ্জিনিয়র মেয়ে, দু দিন পর জামাই হবে, তার সামনেও যদি... ও মা গো!! 

তুমি বুক করেছো ক্যাব? 


এতক্ষণ পর্যন্ত ধৈর্য ধরে শুনতে শুনতে অবশেষে নিজের পক্ষে কিছু বক্তব্য রাখেন বঙ্কা দা...


আহা এত চটছো কেন গিন্নি? আমি জানি আমার এই বাতকর্মের জন্য সত্যিই তোমাকে বিভিন্ন স্থানে একাধিক বার বিব্রত বোধ করতে হয়েছে কিন্তু তুমি তো বায়োলজির ছাত্রী, তুমি নিশ্চয় জানো পাদ হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনে স্তন্যপায়ী প্রাণীকূলের বিজ্ঞানভিত্তিক একটি অপরিহার্য শারীরিক কাজ, এটি আমাদের পাচনতন্ত্র এবং রক্ত সংবহনতন্ত্রের সাথে জড়িত। স্বাভাবিক পাচন ক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন পলিস্যাকারাইড নিম্ন অন্ত্রের অন্তরে প্রবেশ করলে লোয়ার ইন্টেস্টাইনে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া ওগুলোকে খেয়ে ফেলে যার ফলে হাইড্রোজেন সালফাইড, মেথানেথিওল বা ডাইমিথাইল সালফাইড তৈরি হয়। তুমি হয়তো জানো না পাদ চেপে বসে থাকলে সাময়িক ভাবে হয়তো সম্মান রক্ষা হয় কিন্তু জীবনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় বহুগুণ, কারণ হাইড্রোজেন সালফাইড ফুসফুস অথবা হৃদপিন্ডে বড়সড় সমস্যা তৈরি করতে পারে যাতে করে জীবন সংশয় সৃষ্টিকারী স্ট্রোক, হার্ট অ্যাট্যাক,ডিমেনশিয়া এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে মানুষের। গা পিত্তি জ্বালানো কেমন একটা ফিচেল হাসি হেসে বঙ্কা দা ইশারা করে বলে 'ওই যে হর্ণ দিচ্ছে উবার'। এসো তাহলে।।


কেমন যেন একটু দমে যান প্রণতি দেবী, কিন্তু জেদ তো তার ও কম নয়, দুদিন পরে চলে আসবে নিজেও জানে কিন্তু এই ব্যাগ গুছিয়ে উবার ডেকে তারপর না গেলে কত্তার সামনে পুরো প্রেসটিজ পাংচার হয়ে যাবে সুতরাং যেতে হবেই। ব্যাগ টা কাঁধে ঝুলিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলতে গেলে পিছু ডাকেন বঙ্কা দা...


আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি গো...


একজন জীবিত মানুষ দিনে বারো থেকে চোদ্দ বার বাতকর্ম করে, সেটা কি জানো? 


ঠোঁট টা বেঁকিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যাবার ঠিক আগে পেছন থেকে প্রণতি দেবীর কাঁধে হাত রাখেন বঙ্কা দা..


গিন্নির কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলেন 'মানুষের মৃত দেহ থেকেও কিন্তু গ্যাসের অণুসমূহের নিঃসরণ হয় গিন্নি - এটা কি জানতে'? 


কাছে টেনে গিন্নির কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে ওর নরম গাল দুটোয় আলতো করে একটু আদর করে দেওয়ার সময় কাঁধ থেকে ব্যাগটা মার্বেলের মেঝেতে পড়ে যায়, চোখের কোণ দুটো চিকচিক করে ওঠে, বঙ্কা দার চওড়া বুকে মাথা রাখেন প্রণতি দেবী। মেঝে থেকে ব্যাগ টা কুড়িয়ে গিন্নির কাঁধে ঝুলিয়ে বঙ্কা দা বলেন ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে, মনস্থির যখন করেছো একবার যাও, মায়ের সাথে দেখা করে কাল বরং ফিরে এসো বিকেল বিকেল। 


রওনা হবার পর ট্যাক্সির মধ্যে মন টা একেবারে অন্যরকম হয়ে যায় প্রণতি দেবীর। মনে পড়ে কত পুরোনো কথা, স্মৃতির পাতায় ভিড় করে একাধিক আনন্দঘণ মুহুর্ত। লোকটাকে বড্ড ভালোবাসে যে, এমন মানুষকে স্বামী হিসাবে পাওয়া যে কতটা ভাগ্যের সেটা ভেবে চোখ দুটো জলে ভিজে যায়। সত্তর বছর বয়সী শাশুড়ি মায়ের জন্য নিজের একটা কিডনি দান করে দেওয়া মানুষটা যে তার স্বামী এটা ভেবে বরাবরের মতই আজ ও কান্না পায় প্রণতি দেবীর। গর্ব হয়।


সেদিন রাতে শুতে যাওয়ার আগে উল্টোডাঙ্গা থেকে শেষ বারের মত বঙ্কা দার সাথে কথা হয় প্রণতি দেবীর কারণ পরের দিন সকালে বার বার ল্যান্ড লাইন আর মোবাইলে ফোন করলেও গড়িয়ার ফ্ল্যাটে ফোন রিসিভ করেন নি কেউ। পাশের ফ্ল্যাটের ইন্দ্র কে ফোন করেন প্রণতি দেবী। নটা পনেরো নাগাদ বড়দা, বড় বৌদি আর গুড্ডুর সাথে ফ্ল্যাটে এসে উপস্থিত হন তিনি।পুলিশ আসেন তার একটু পরেই। দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করলে দেখা যায় সেগুন কাঠের খাটে বুকের উপর দুটো হাত রেখে নিদ্রাচ্ছন্ন বঙ্কা দা বা বঙ্কিম চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। চারতলার ফ্ল্যাট থেকে ডাক্তার শান্তনু সরকার আসেন। জানা যায় মধ্যরাতে ঘুমের মধ্যেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আনন্দলোকে পাড়ি দিয়েছেন তিনি। 


পিকি অর্থাৎ বঙ্কা দা আর প্রণতি দেবীর একমাত্র মেয়ে প্রিয়াঙ্কা এসে উপস্থিত হয় হায়দ্রাবাদ থেকে। যথা সময়ে শেষ হয় শ্রাদ্ধ শান্তি এবং যাবতীয় পারলৌকিক কাজকর্ম। ডেলোয়েটে কর্মরতা প্রিয়াঙ্কা মাকে সাথে নিয়ে যেতে চাইলেও গড়িয়ার ফ্ল্যাট ছেড়ে যেতে কিছুতেই রাজি হন না প্রণতি বন্দোপাধ্যায়। 


সময় বয়ে যায় সময়ের নিয়মে। গড়িয়ার ফ্ল্যাটে একাকী প্রণতি দেবী বেঁচে থাকেন বঙ্কিম বাবুর স্মৃতি আঁকড়ে। মাঝে মাঝেই কেমন একটা বিশ্রী গন্ধ ভেসে আসে বাতাসে..


নিজের অজান্তেই ফিক করে হেসে ফেলেন প্রণতি দেবী। মনে পড়ে যায়..


'মানুষের মৃতদেহ থেকেও কিন্তু গ্যাসের অণুসমূহের নিঃসরণ হয়'....!!

©Abhijeet Panja