Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

বসন্তের ছোঁয়ানবনীতা সই 23,4,21
লাভ-লোকসান দেখে প্রেম করা যায়৷ প্রেমে পড়া যায়না৷ তা বলে এমন লোকের সাথে প্রেম করবি?আরে তোরা কেন আমাকে নিয়ে পড়েছিস? তোদের সমস্যাটা কি?
আমাদের সমস্যা , তোর মতন মেয়ে যে কিনা পড়াশোনায় ভালো৷ কলেজে সবার ক্রা…

 


বসন্তের ছোঁয়া

নবনীতা সই 

23,4,21


লাভ-লোকসান দেখে প্রেম করা যায়৷ প্রেমে পড়া যায়না৷ 

তা বলে এমন লোকের সাথে প্রেম করবি?

আরে তোরা কেন আমাকে নিয়ে পড়েছিস? তোদের সমস্যাটা কি?


আমাদের সমস্যা , তোর মতন মেয়ে যে কিনা পড়াশোনায় ভালো৷ কলেজে সবার ক্রাশ , তাকে দেবায়ন ডিজার্ভ করেনা৷ 


কেন শুনি?


ধুর দেবায়ন নেশা করে৷


আমরা নেশা করিনা?


তুই বুঝছিস না৷ দেবায়নের কোন মাথার ঠিক আছে ? কারোর সাথে মেশে না৷ অসামাজিক৷ আরে ওর চালচুলো নেই৷


হ্যাঁ এটা হচ্ছে আসল কথা৷ ওর আর্থিক সংগতি কম৷ দ্যাখ, ঢ্যামনামো করিস না৷ আমরা সবাই রোজ গালি দিচ্ছি , ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সিগারেট বিয়ার সব টানছি৷ কেউ ধোয়া তুলসীপাতা নই৷ 


 কিন্তু অহনা তুই বুঝতে পারছিস না সবচেয়ে বড় কথাটা৷ আমরা জীবন সম্পর্কে সিরিয়াস৷ আমরা জানি কতটুকু কি করতে হবে৷ কেরিয়ার আর এনজয়মেন্ট দুটোই ব্যালান্স করতে জানি৷

এগজ্যাটলি, সেটাই আমরা তোকে তখন থেকে বোঝাতে চাচ্ছি ৷ আমরা সিরিয়াস আর দেবায়ন জীবন সম্পর্কে সিরিয়াস নয়৷


তো? কি হয়েছে ? সব ঠিক হয়ে যাবে৷ 


তুই পস্তাবি৷


সেটা আমার ডিসিশান হবে৷


পুরো উইক এন্ডের আনন্দটাই মাটি৷ সবাই মিলে হইচই করে আনন্দ করবো তা নয় , সেই এক কথা৷ বলেই অহনা ঘরে থেকে বের হয়ে যায়৷ 


ছাদে গিয়ে সিগারেট ধরায়৷ এটা তো বসন্ত কাল ৷ কাউকে বোঝানো যাবে না, জীবনে বসন্তের ছোঁয়া টাই দেবায়ন৷ 

কিছুতেই কাউকে বোঝানো যাবে না, হাজার লোকের মাঝে কেন একজন কেই ভালো লাগে৷ শত শত পুরুষের হাজার স্পর্শের মাঝে কেন একজন কে পেলেই দেহমন শিহরিত হয়৷


এরা সবাই বন্ধু৷ 

কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে অহনা, যখন প্রায় কলেজের অর্ধেক ছাত্র কে না বলে, বাউণ্ডুলে দেবায়নের প্রেমে পড়লো তখন আর যাইহোক বন্ধুরা কেউ সেটাকে ভালো চোখে দেখলো না৷

দেবায়ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হলেও বাউণ্ডুলে৷ সবসময় ছবি আঁকা নিয়ে পড়ে আছে৷ এত্তবড় নামকরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েও কোন হেলদোল নেই ৷ 

ওর সামান্য চাকুরে বাবা নিশ্চয়ই অনেক ধারদেনা করেই ভর্তি করিয়েছেন ৷ সেটা ভেবেও তো উচিত পড়াশোনায় মন দেওয়া৷ সেই জন্য এরা দেবায়ন কে পছন্দ করেনা৷ 


বাইরে এসে অহনা এসব ভাবতে ভাবতে আবার সিগারেট ধরায়৷ আজ দেবায়ন আসেনি৷ 

আসল কথা অহনার এই গ্রুপটাকে দেবায়ন পছন্দ করেনা৷ এরাও এড়িয়ে চলে দেবায়ন কে৷

 অহনা কি করবে? দেবায়নের তাকানো, স্পর্শ সবকিছু অহনা কে পাগল করে রাখে ৷

এমন আকর্ষণে হয়ত মানুষ ঘর বাড়ি ছেড়ে বাউণ্ডুলে হয়৷ সমাজের নিয়ম ছাড়িয়ে চলে যায় ভালোবাসার জগতে৷ অহনা কে যে দেবায়ন খুব খুব টানে৷ 


অহনা বুঝতে পারে, এই টান সহজে যাবার নয়৷ বন্ধুদের বুঝাতে পারে না ৷ ভালোবাসে অহনা দেবায়ন কে৷ ছেড়ে কোথাও গিয়ে শান্তি পাবে না৷ এই যেমন আজকে৷ এমন উইক এন্ডের হইচই গুলোতে অহনা ছিলো , আনন্দ করার মাষ্টার৷ আজকে কিছুই ভালো লাগছে না৷ মনে হচ্ছে দেবায়নের সেই ছোট্ট স্যাতস্যাতে ঘরটায় , পুরানো বিছানায় দেবায়নের বুকে শুয়ে কবিতা শুনতো, হয়ত অনেক বেশী ভালো লাগতো৷ 


মাঝে মাঝে যখন দেবায়ন , অহনা কে মডেল বানায়৷ পোশাক গুলো এলোমেলো অথবা খুলেই ছবি আঁকে৷ নেশার মতন অহনা বসে থাকে৷ নড়ে না৷ অহনা জানে , দেবায়ন কে চাকরী , সংসারে জড়ানো হয়ত যাবে না৷ আবার ভোলাও তো যাবেই না৷ সো মাচ কনফিউসন অহনার মনে৷ 

তবুও অহনা দেবায়ন কে ভালোবাসে৷


এই ঘটনার...


মাস ছয়েক পরে, হঠাৎ দেবায়ন কলেজ ছেড়ে দেয়৷ তখন অহনারা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত৷ কাউকে কিছু না বলে কোথায় যে হারিয়ে যায়৷ ভাড়াবাড়িতে না পেয়ে অহনার খুব রাগ হয়৷ 


পরে পরীক্ষা হয়ে গেলে, অহনা দেবায়নের বাড়ি গিয়ে জানতে পারে, দেবায়নের বাবা আর নেই৷ সে তার মা কে নিয়ে চলে গেছে৷ বাড়িঘর সব তালাবন্ধ৷ 


ফোন করে করে না পেয়ে অহনার প্রচন্ড রাগ হয়৷ কিন্তু কতদিন? মাস খানেক রাগ হয়৷ কোনদিন কথাই বলবে না৷ তারপরে আস্তে আস্তে চিন্তা৷ তারপর মনে হয়, একবার ফোন করুক , অন্তত একবার৷ 

বন্ধু - বান্ধব সব ছুটি কাটাতে ব্যস্ত৷ কেউ কেউ ভবিষৎ নিয়ে ব্যস্ত৷ অনেকে ক্যাম্পাসিং এ চাকরী পেয়ে গিয়েছিলো সেই নিয়ে ব্যস্ত৷ রেজাল্ট বের হওয়ামাত্র জয়েন হবে৷ অনেকে বিদেশে পড়তে যাচ্ছে৷ 


অহনার চাকরী আগেই ব্যঙ্গালুরুতে হয়ে গেছে৷ অহনা বাবার একটাই মেয়ে৷ অঢেল স্বাধীনতা পেয়েছে সবসময় ৷ 

বাবা ব্যঙ্গালুরুতে ফ্ল্যাট কিনে রেখেছেন৷ মেয়ে থাকবে৷ মাঝে মাঝে তারাও যাবেন৷ 

কিন্তু মেয়ের কোনকিছুতে মন নেই৷ সবসময় আনমনা হয়ে থাকে৷ 


অহনার বন্ধু বান্ধবীরা বলে, দেবায়ন জাস্ট পালিয়ে গেছে৷ আর কিছু না৷ 

অহনার তাতে কষ্ট বাড়ে আর কিছু না৷ 


সেই কলেজে প্রথম দেখা হওয়াটা মনে পড়ে৷ সবাই তো গুনমুগ্ধের মতন অহনার চারিদিকে ছড়িয়ে ছিলো৷ খোলা জানালার পাশে ছবি আঁকছিলো দেবায়ন৷ 

প্রথমদিন অহংকারী মনে হয়েছিলো , যেমন সবার মনে হয়৷ পরে বুঝেছিলো দেবায়ন আলাদা৷ খুব স্পর্শকাতর ৷ হইচই কম করে৷ হয়ত গুটিয়ে থাকে নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য৷ 


পরিচয় হয়েছিলো আরও ইন্টারেস্টিং ভাবে৷ 

খুব বৃষ্টিতে অহনা আটকে গিয়েছিলো সেবার কলেজে৷

 সেদিন কিসের জন্য ছুটি হয়ে যায় কলেজ ৷বন্ধু বান্ধব আসেনি কলেজে তেমন৷ নিজের স্কুটিতে করে ভিজেই বেরিয়ে পড়েছিলো অহনা৷ 

কিছুটা দুরে গিয়ে বন্ধ হয়ে যায় স্কুটি৷ সেই সময় আলাপ দেবায়নের সাথে৷ নিজের ঘরে নিয়ে গিয়েছিলো দেবায়ন৷ পাশেই তো ভাড়া থাকতো৷ পুরানো বাড়িটার দেওয়াল ভর্তি শ্যাওলা জমা৷ ঘরের ভিতর তো আলো কম অন্ধকার বেশী ৷ সামান্য আলাপ , গরম চা আর অনেক সময় বৃষ্টির মাঝে যেন প্রেমে পড়ছিলো অহনা৷ 


দেবায়নের পাঞ্জাবী পরে ফিরেছিলো সেদিন৷ তারপর অনেক গেছে৷ অনেক অন্তরঙ্গতা ৷ এখন ভাবে, সব ভুলে গেলো দেবায়ন?


সবার কথায় মন শক্ত করে, ব্যঙ্গালুরুতে চলে যায় অহনা৷ চোখ থাকে ফেসবুকের পাতায়৷ কোনদিন তো কোন পোষ্ট করবে দেবায়ন৷

ফোনের অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যায় অহনা৷ 


এই ঘটনার....

বছর দুয়েক পরে৷ অফিসের এক সিনিয়ার , সায়ন অহনাকে খুব বিয়ের জন্য বলতে থাকে৷ 

বাবা মায়ের কাছে অবধি সায়নের বাবা মা গিয়ে প্রস্তাব দেয়৷ 

বাবা মা পরিস্কার জানিয়ে দেয়, অহনা রাজী হলে তারাও রাজী৷ 

একমাত্র ছেলে সায়ন৷ বাবা মা দুজনেই ডাক্তার৷ এমন ছেলে তো ভাগ্যবানরা পায়৷ 

বন্ধু-বান্ধবরা সবাই খুব খুশি হয়৷ 

অহনা ও সায়ন কে পছন্দ করে৷ বাস্তব কথা ভাবলে সায়ন পারফেক্ট৷ সে নিজেও অহনার কম্পানি তে আছে৷ ভালো বুঝবে, চাকরীর সমস্যা গুলো৷ কেরিয়ারে অনেক হেল্প হবে৷ সায়নের বাবা মা কোলকাতার নামকরা ডাক্তার৷ বেশ বনেদী পরিবার৷ আর কি চাই? দুজনের বন্ধুত্ব হয়৷ 


অহনা আর সায়ন অনেক গুলো বছর পর কোলকাতা আসে৷ দুজনেই কানাডায় চাকরীর অফার পেয়েছে৷ বাড়ির লোক খুব খুশি ৷ সায়ন চায় বিয়ে সেরে কানাডায় যেতে৷


 আজ প্রায় চারবছর হয়ে গেলো, দেবায়ন নিরুদ্দেশ৷ অহনার চোখ তবুও দেবায়ন কে খোঁজে৷

খুব গরমে অহনার কোলকাতা ভালো লাগে না৷ 

কিন্তু এবার বাবা মা হোলিতে বারবার আসতে বলেছে৷ সায়ন এসেছে৷ আগামীকাল সপরিবার নিমন্ত্রণ অহনার সায়নদের বাড়িতে৷


 নিজের ঘরে বসে অহনা গান শুনছিলো৷ সায়ন অনেক ছবি পোষ্ট করেছে৷ ওদের বাড়ির৷ দূর্গাপুজোর৷ পরিবারের৷ অহনা ভাবছিলো, এত পারফেক্ট ফ্যামিলি৷ আর হয়ত পাবো না৷ সায়ন ভালো ছেলে৷


 তবুও .... তবুও কেন অহনার মন মানে না৷ এমন চৈত্র মাসের একটি দুপুরে, ঘামে ভিজে গিয়েছিলো শরীর৷ খুব কাছাকাছি থাকা দুটি শরীর৷ দেবায়ন সব ভুলে গেলো?


অহনা অস্ফুট স্বরে বলে, এ কেমন টান সব পেয়েও, সব হারানোর জন্য পিছন টানে? এ কেমন জ্বালা সব পেয়েও মেটেনা? দেবায়ন৷ 


অহনার মা ঘরে ঢুকেই বলেন, তোর জন্য এত ভালো ছেলে পাবো ভাবিনি৷ কাল কি পড়বি তুই অনু? আর শোন না, সায়ন কে তো তুই চিনিস ভালো৷ কেমন? ভালো ছেলে তো? শোন না, তোর পছন্দ না হলে আমরা কিন্তু বারন করে দেবো৷ তুই তো জানিস , তোর জন্য আমরা ...


আচ্ছা মা আমি যদি বাউণ্ডুলে কাউকে বিয়ে করতাম?


এ কেমন কথা? কেন করবে? তুমি বুদ্ধিমতী ৷ শিক্ষিতা৷


তবুও যদি করতাম ?


আহ্ বাজে কথা রাখো৷ কিসব বলছো৷


বলো না মা৷ আমি যদি এমন ছেলে বিয়ে করতাম৷


তো কি হতো ? নিজের কপাল নিজে পুড়াতে৷ নিজেই বুঝতে৷ বন্ধু বান্ধব বিদেশ ঘুরতো৷ তাদের স্বামীরা বড় বড় গাড়ি কিনতো৷ আর তুমি আয় করে খাওয়াতে কুঁড়ে বর কে৷


আচ্ছা মা৷ বড় গাড়ি, বিদেশে টুর সেসব আমিও পারি ৷ তারজন্য বরের কাজ করার দরকার নেই ৷ আর মা মনটা যদি কুঁড়ে কে ভালোবাসে তো কি করা যাবে৷ আমি এমন করলে??


কি আর হতো? তোমাকে আমরা যোগ্য মানুষ করেছি৷ নিশ্চয়ই বুঝে শুনেই করতে৷


ধুর তুমি রাগ করে বলছো৷


মোটেই না৷


মোটেই হ্যাঁ ৷ রাগ করলেই তুমি আমাকে তুমি করে বলো৷


শোনো না মা৷ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও না৷


ছাড় আমাকে৷


বসো না৷ এমন করছো যেন আমি কোন বাউণ্ডুলের সাথে চলে গেছি৷ আমার বাউণ্ডুলে হারিয়ে গেছে মা৷ আমার দেবায়ন হারিয়ে গেছে৷


কি নাম? কি নাম বললি?


দেবায়ন৷ দেবায়ন ব্যানার্জী৷


কেন মা?


নামটা চেনা চেনা লাগলো৷ 


কবে শুনেছো? কি ব্যাপার ? বলো না৷


মনে নেই ৷ চল এখন খাবি চল৷


সারারাত ধরে অহনার মা অমৃতা দেবীর মনে অস্বস্তি হচ্ছে ৷ সেদিন তো অহনার বন্ধুরা কিছু বললো না৷ কেন বারন করেছিলো ? কি ঘটনা? সত্যি কি অহনা দেবায়ন কে ভালোবাসে ?


সেদিন ধরা গলায় ছেলেটা এসেছিলো৷ অহনা সেদিন ছিলোনা৷ ওর সেদিন ক্যাম্পাসিং ইন্টারভিউ ছিলো৷ সেখান থেকে সোজা গিয়েছিলো কোথায় কেউ জানতো না৷ 

বন্ধুরা সবাই খোঁজ নিতে এসেছিলো কি হয়েছে জানার জন্য৷

 আর ছেলেটা ঢুকেছিলো যখন সবার মুখের হাবভাব পাল্টে গিয়েছিলো৷ 

অহনার বন্ধু রাহুল বলেছিলো কি সব ছেলেটাকে৷

অমৃতা রান্নাঘরে ছিলো৷ তবুও শেষ কথাটা শুনে ছিলো৷

 ছেলেটা বলেছিলো, ভালোবাসা ভালোবাসার জন্ম দেয়৷ অহনা আসবে৷ নিজেই আসবে৷ 


তখন অমৃতা গুরুত্ব দেয়নি৷ যখন চায়ের ট্রে টা নিয়ে ঘরে ঢুকেছিলো, ধরা গলায় সেই ছেলেটার অমন মায়াবী চোখ দুটো দেখে অবাক হয়েছিলো৷ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রাহুল বলেছিলো , তুই যা আমরা দিয়ে দেবো৷ কি যেন হাতে ছিলো রাহুলের ? মনে পড়ছে না৷ একটা খাম৷ 

সেদিনের পর আর কোনদিন ছেলেটা আসেনি৷ রাহুল কি খামটা অহনা কে দেয়নি? 


অমৃতা ভেবে পায়না, আজ কি অহনা কে সেগুলো বলা উচিত ? খামটা কি রাহুলের কাছে?


পরের কটাদিন কেটে যায় হাওয়ার মতন ৷ সায়নদের বাড়িতে গিয়ে , অহনার বাবা মা দুজনেই খুব খুশি হন৷ অহনার সাথে সায়নের মা অনেক সময় গল্প করেন৷ এখন শুধু অহনার হ্যাঁ বলার অপেক্ষা৷ সায়ন তো হ্যাঁ ধরেই নিয়েছে৷ শপিং করার জন্য রোজ সায়নের মা ফোন করছেন৷ সামনের বৈশাখে বিয়ে সারতে চান৷ হাতে মাত্র কটা দিন৷ তাও তো নিজেদের বাড়িতে থেকে বিয়ে হবে৷


 নইলে এত অল্প সময়ে তো ঘর বুক করা অসম্ভব৷

অমৃতা অহনার মনের নাগাল পাচ্ছেন না৷ মেয়েটা সবকিছুর মাঝে আছে , তবুও কিছুতে নেই৷ মনটা কেমন উদাস৷


হঠাৎ সেই রবিবার সায়ন উপস্থিত৷ সোজা অহনার ঘরে চলে যায়৷

তোমার কি ব্যাপার বলো তো?

কেন কি হয়েছে ?

আরে কিছু তো বলো? ডেট ঠিক হবে তো?

বিয়ের?

তো ? কি আশ্চর্য ! তোমার কোন সমস্যা আছে ? শোনো তুমি দেবায়ন কে ভালোবাসো আমি জানি ৷ আর তোমাদের মাঝে যা যা হয়েছে সেগুলো খুব নর্মাল ব্যপার বাবু৷ আজকাল ওসব কেউ মনে রাখেনা৷ আমি তো সব জানি৷ তবুও কেন এত ভাবছো? 


আমি কিছুই ভাবছি না সায়ন৷ সময় দাও৷

একদম না৷ ভেবে ভেবে সময় নষ্ট ৷ আগামী তেইশে বৈশাখ বিয়ে ৷ চলো শপিং করবো৷


বিয়ে করবেই ?

হ্যাঁ দরকার হলে , জোর করে৷ আই লাভ ইউ বাবু৷ 


আচ্ছা৷ ঠিক আছে ৷ তবে শপিং রবিবার থেকে শুরু করি?


তুমি যা বলবে৷ আমরা মে মাসটা সুইজারল্যান্ডে কাটিবো৷ জুনে সোজা আমাদের নতুন অফিস কানাডায় জয়েন করবো দুজনে৷ সব কাগজপত্র কিন্তু রেডি করতে হবে৷ তুমি কিন্তু আমার সাথেই এ কম্পানি ছাড়বে৷ 


বাবা কত প্ল্যান৷ 


হবেনা? জানো সুইজারল্যান্ডের প্ল্যানটা কিন্ত বাবা মায়ের সারপ্রাইজ৷ হানিমুন প্যাকেজ৷ 


আমি আজ আসি৷ অনেককিছু গোছাতে হবে৷ দাঁড়াও সবার আগে , মা কে বলি৷ বাবা টেনশানে পরে গিয়েছিলাম তোমার মতিগতি দেখে৷ 


হ্যালো মা? ওটাই ফাইনাল ৷ তেইশ৷ হুম৷ আসছি৷ 


ঘর থেকে বের হতেই অমৃতা কে দেখে সায়ন প্রণাম করে ৷ 


অমৃতা খুব খুশি হয় , অহনা রাজি৷ সায়ন খুব ভালো ছেলে৷ 

অহনার বাবা তো আরও খুশি৷ অনেক কাজ সামনে৷ দুজনে প্ল্যান করতে বসেন৷ 


তখন অনেক রাত৷ অমৃতা সব দরজা দেখে , রাধুর মা কে শুতে বলে, দোতলায় যেতে দ্যাখে অহনার ঘরের দরজা তখনও বন্ধ হয়নি৷ ভেজানো৷ ঘরটা অন্ধকার ৷ 

দোল পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ঘর ভরে গেছে৷ জানালায় অহনা দাঁড়িয়ে ৷ কি মায়াবী আলোয় ভরে গেছে অহনার মুখটা৷ অহনা কে মনে হচ্ছে , বহু যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করা কোন পাথর প্রতিমা৷ 


অমৃতা চমকে ওঠে ৷


এ কোন সদ্য বিয়ে ঠিক হওয়া সলাজ বধুর মুখ নয়৷ আগামী ভবিষ্যৎ ভেবে সুখের আবেশে জেগে থাকা মানবী নয়৷ যেন বহুযুগ ধরে অপেক্ষায় জমে গেছে শরীর, মন৷ পলক স্থির৷ অপেক্ষায় চোখের জল শুস্ক৷


পরদিন অমৃতা রাহুল কে ফোন করে নিজেদের বাড়িতে ডাকে৷ অহনা আর সায়ন গেছে শপিং করতে ৷

রাহুলের কাছে সব শোনে অমৃতা৷ 

দেবায়নের বাবা হঠাৎ মারা যান৷ হার্ট এ্যাটাক৷ দেবায়ন কাউকে ফোন করার সময় পায়নি৷ বাড়ি পৌছানোর আগে সব শেষ৷ দেবায়নের মা তখন প্রায় পাগলের মতন৷ ধারদেনা প্রায় গলা সমান৷ নিজেদের বাড়ি বিক্রি করে দেবায়ন সব দেনা শোধ করে মা কে নিয়ে চলে যায় পুরুলিয়া৷

যাবার আগে, ধরা গলায় নিয়ে এসেছিলো অহনা কে সব বলতে৷ দেবায়নের ফোনটা চুরি হয়ে গিয়েছিলো৷ তাই নিজেই এসেছিলো৷ জানতো অহনা ভীষন রাগ করবে, কষ্ট পাবে৷ তাই নিজের ঠিকানা আর সবকিছু লিখে নিয়ে এসেছিলো একটা চিঠিতে৷ 

সেদিন রাহুলরা সবাই মিলে দেবায়ন কে অনেক অনেক অপমান করে৷ ওরা কেউ চাইতো না অহনার সাথে দেবায়ন যোগাযোগ রাখুক৷ বিশেষ করে রাহুল অহনা কে খুব ভালোবাসতো৷ আজও বাসে৷ 


সব শুনে সেই খামটা হাতে করে অমৃতা বসে থাকে পাথরের মতন৷ কি করবে? অহনা কে বলবে? 

খামটা খুলে চিঠিটা পড়ে অমৃতা৷ প্রতিটা শব্দে যেন ভালোবাসা জরিয়ে আছে৷ 

ছেলেটা কি আজও অহনা কে ভালোবাসে ? সায়নের মতন ছেলে ফেলে সত্যিই দেবায়ন কে বিয়ে করলে অমৃতা খুশি হবে? 


ছেলেটা যেখানের ঠিকানা দিয়েছিলো তার ফোন নাম্বার নিয়ে সেই অফিসে ফোন করে অমৃতা৷ 

কিছুক্ষণ পর ফোন ধরে দেবায়ন৷ 

দেবায়ন আজকাল এক নামকরা শিল্পীর আন্ডারে কাজ করে৷ ভাস্কর্য নিয়ে রিসার্চ করছে ৷ 

 মা চলে গেছেন দুবছর হয়েছে৷ বাবার শোকটা নিতে পারেন নি৷ দেবায়ন একাই থাকে৷ 


সেদিন সারাটা দিন অমৃতা ছটপট করতে থাকে৷ সারিদিন নিজের সাথে যুদ্ধ চলে৷ 

অহনার বাবা প্রবাল বাবু সারাদিন পর বেশ রাতে , বিয়ের কার্ডের স্যাম্পেল নিয়ে ফেরেন৷ খাবার টেবিলে অনেক আলোচনা করেন বিয়ে নিয়ে৷ 

দাদা কি কি বললেন৷ শুধু অমৃতা গভীর চিন্তায় আর অহনা উদাসীন সেটাই খেয়াল করেন না৷ 


প্রবাল বাবু ঘুমিয়ে পড়লে অমৃতা সব কাজ সেরে আস্তে আস্তে দোতলার ছাদে আসেন৷ 

ছাদের আরেক প্রান্তে অহনা৷ পাশে ফোনটা গোঁ গোঁ করে যাচ্ছে৷ হয়ত সায়ন ফোন করছে৷ অহনা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে৷ হালকা চাঁদের আলোয় বড় মায়াবী লাগছে৷ 


আস্তে আস্তে অমৃতা পিছনে এসে দাঁড়ায়৷ অহনা কে দু হাত দিয়ে ধরতেই অহনা একটুও না চমকে মায়ের বুকে মুখ রেখে কেঁদে ওঠে ৷ অমৃতা মেয়ের মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেয়৷ আর ছাদের বসার জায়গায় অহনা কে বসিয়ে বলে,


তোকে আমি যা বলবো তুই চুপচাপ শুনবি৷ আমি নিজেই জানিনা তোকে আমি এগুলো কেন বলছি৷ কিন্তু আজ আমি মা হয়ে না একজন নারী হয়ে বলছি৷ আমি জানি দেবায়ন কে তুই ভালোবাসিস৷ আবার আমি সবসময় চাইবো সায়নের মতন ছেলের সাথেই তোর বিয়ে হোক৷ 

সব মা তাই চাইবে৷ কাল অবধি কেন আজ বিকাল অবধি আমি তাই চাইতাম৷ 

কেন চাইবো না? সায়ন ভালো ছেলে , তোকে ভবিষৎ সুরক্ষিত থাকবে৷ তারপর কি ভাবলাম জানিস? শুধুমাত্র সংসার করতে হবে বলেই কি মানুষ বিয়ে করে? হয়ত যারা সহায়হীন তারা করতে পারে৷ কিন্তু আমি তো তোকে যোগ্য করে গড়ে তুলেছি ৷ ভাত কাপড়ের চিন্তায় বিয়ে করতে হবে এমন করে তো গড়ে তুলিনি৷ জীবন একটাই আর আমি চাই তুই জীবনটা কে ভালোবাসার জন্য বাঁচ৷ অহনা ভেবেছিলো মা বিয়ের কার্ড তার হাতে দেবে৷ অমৃতা অহনার হাতে দেয় দেবায়নের খাম টা৷ 


পরদিন ভোরে অহনা ট্রেন ধরে৷ সে পৌছে যায় দেবায়নের কাছে৷ তারপর???? সেটা আরেকদিন বলবো৷ অন্য গল্পে৷ এ গল্প শেষ৷


শেষ৷