Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

(আজ বরাকের ভাষা আন্দোলনের ৬০তম বর্ষ)
বরাকের বাংলাভাষা আন্দোলন@@@জটাধারী@@@
অসম প্রদেশের করিমগঞ্জ জেলা ও কাছাড় জেলা নিয়ে যে ভূ-ভাগ, সেটাই "বরাক উপত্যকা" নামে পরিচিত| অবিভক্ত ভারতবর্ষে ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ সরকার ব্রহ্মপুত্র উপ…

 


(আজ বরাকের ভাষা আন্দোলনের ৬০তম বর্ষ)


বরাকের বাংলাভাষা আন্দোলন

@@@জটাধারী@@@


অসম প্রদেশের করিমগঞ্জ জেলা ও কাছাড় জেলা নিয়ে যে ভূ-ভাগ, সেটাই "বরাক উপত্যকা" নামে পরিচিত| অবিভক্ত ভারতবর্ষে ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ সরকার ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও পার্বত্য এলাকার কিছু অঞ্চল নিয়ে পৃথক অসম বা আসাম প্রদেশ গঠন করে| 


শ্রীহট্ট বা সিলেট ও কাছাড় জেলাকে নবগঠিত অসম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়| অসম প্রদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সিলেট ও কাছাড় জেলার ভাষাসহ নানান ভিন্নতা ও স্বাতন্ত্রতা রয়েছে| সম্ভবত এ কারণেই ব্রিটিশ রাজশক্তি সিলেট ও কাছাড় জেলাকে নিয়ে "সুরমা ভ্যালি ডিভিশন" নামে একটি আলাদা প্রশাসনিক ইউনিট গঠন করেছিল| 


১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় সিলেট জেলার সাড়ে তিন থানা অঞ্চল বাদে বাকি অংশটুকু সিলেট জেলা থেকে কেটে ভারতে আনা হয়| সেটারই নাম হয় "করিমগঞ্জ মহকুমা" এবং পরবর্তীকালে করিমগঞ্জ মহকুমা জেলায় পরিনত হয়| এর সঙ্গে সম্পূর্ণ কাছাড় জেলা রয়ে যায় ভারতের অংশে| এভাবে মূল সিলেট জেলা থেকে সম্পূর্ণ কাছাড় জেলা নিয়ে ভারতের যে ভূ-খন্ড গঠিত হয়, তারই নাম পরবর্তীকালে তারই দেওয়া হয় "বরাক উপত্যকা"| কাছাড়, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জ জেলা বরাক উপত্যকার অন্তর্ভুক্ত|


অসমের বরাক উপত্যকার বাংলাভাষা আন্দোলন ছিল আসাম সরকারের অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ| যদিও অসমের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বরাবরই বাংলাভাষী ছিল| এরপর ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর অসমে হিন্দু বাঙালি শরণার্থীর সংখ্যা আরো বাড়ে| যদিও বরাক উপত্যকায় স্বাধীনতার আগে থেকেই বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল|


১৯৬০ সালের ১০ই অক্টোবর অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চাহিলা অসমীয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি হিসেবে গণ্য করার জন্য বিধানসভায় প্রস্তাব রাখেন| তখন উত্তর করিমগঞ্জের বিধায়ক রনেন্দ্র মোহন দাশ এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধীতা করেন| কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে ২৪ শে অক্টোবর ১৯৬০তে অসম বিধানসভায় অসমীয়া ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়| 


অসমীয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করার প্রতিবাদ ১৯৬০ সালের শেষ থেকেই বিক্ষিপ্তভাবে সারা রাজ্য জুড়েই চলছিল| ১৯৬১ সালের ১৫ই মে থেকেই শিলচর শহরে সরকারি পুলিশ ও সামরিক বাহিনী আন্দোলন দমন করতে তৎপর হয়ে ওঠে| আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল ১৯ শে মে বরাক উপত্যকা জুড়ে সত্যাগ্রহ পালন করা হবে| পরের দিনের সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সমর্থনে ১৮ মে সন্ধ্যায় শিলচর শহরে একটি বিরাট গণ-মশাল মিছিল বের করে সত্যাগ্রহীরা| আন্দোলনকে দমন করার জন্য অসম সরকার সবধরনের দমনমূলক নীতির ব্যবস্থা গ্রহণ করে|


তখন অসমের সবচেয়ে বড় পরিবহন ব্যবস্থা ছিল রেল| আন্দোলনকারীরা ১৯শে মে সত্যাগ্রহের দিন রেলকে আটকানোর চিন্তা করে যাতে পুরো রাজ্যকে স্তব্ধ করে দেওয়া যায়| অন্যদিকে অসম সরকারও রেল চলাচল অব্যাহত রাখতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করে|


সত্যাগ্রহীরা প্রস্তুতি নেয় ১৮ই মে রাত ১২ টার পর রেল স্টেশন দখল করে নিতে| সে অনুযায়ী সত্যাগ্রহী বাহিনী রাতে রেল স্টেশনে পৌঁছে যায় ঠিকই, কিন্তু পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা স্টেশনের দখলে নিতে পারেনা| কারণ তার আগেই অসম পুলিশ, সিআরপি, পিএসসি এবং আসাম রাইফেলসের জোয়ানেরা স্টেশনের চতুর্দিক কর্ডন করে নিয়েছে| 


এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মহিলা সত্যাগ্রহীরা সরকারি বাহিনীকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এক অভিনব পন্থা গ্রহণ করে| মহিলা সত্যাগ্রহীদের কয়েকজন সাহসী মেয়ে অতর্কিতে সরকারি বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে| 


ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত সরকারি বাহিনীর লোকেরা পালিয়ে গেলে সত্যাগ্রহীরা দলে দলে স্টেশনে চত্বরে ঢুকে পড়ে| অন্যদিকে ১৯ শে মে ভোর হবার আগেই হাজার হাজার সত্যাগ্রহী তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির সামনে দৃঢ় অবস্থান নেয়| আরও কয়েক হাজার সত্যাগ্রহী প্রস্তুত থাকে নেতৃত্বের নির্দেশ পালন করার জন্য|


১৯ শে মে ১৯৬১ তে সারা শিলচর শহর সত্যাগ্রহীদের দখলে ছিল| ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাঘাট লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়| পুরুষ-নারী নির্বিশেষে সবাই আন্দোলনের সমর্থনে এবং বাংলাভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাস্তায় নেমে পড়ে| সত্যাগ্রহীরা সবাই ছিলেন নিরস্ত্র এবং অহিংসপথ অবলম্বনকারী| তবুও পুলিশ তাদের উপর লাঠিচার্জ এবং কাঁদানো গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে| সত্যাগ্রহীদের কেউ কেউ পুলিশের শেলই তুলে নিয়ে পালটা ছুড়ে মারে পুলিশের দিকে| তবুও স্টেশন থেকে সত্যাগ্রহীদের সরানো যায় না|


অবশেষে দুপুর ২:৩৫ নাগাদ সাত মিনিটের মধ্যে অসম পুলিশ এবং সিআরপি মিলিয়ে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে ১৭ রাউণ্ড গুলি চালায়| ১২ জন লোকের দেহে গুলি লাগে| তাদের মধ্যে ন'জন সেদিনই নিহত হয়| ২০ মে শিলচরের সত্যাগ্রহীরা ৯ জন শহীদের শবদেহ নিয়ে শিলচর শহরজুড়ে প্রতিবাদ মিছিল করে| 


বীরেন্দ্র সূত্রধর শিলচর রেল স্টেশনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হাসপাতালে ২০ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন| ঐ দিনই সত্যেন্দ্রকুমার দেবের ক্ষতবিক্ষত লাশ শিলচর রেল স্টেশন লাগোয়া পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়| তাদের মৃতদেহ নিয়ে ২১ শে মে আবার শোকমিছিল বের করা হয়|


এই ঘটনার প্রতিবাদে ২৪ মে পশ্চিমবঙ্গে ২৪ ঘন্টার সাধারণ হরতাল পালন করা হয়| বিধান পরিষদের সদস্যরা গনহারে পদত্যাগ করে| পরিস্থিতির গুরুত্ব আঁচ করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অসমে ছুটে আসতে হয়| এই ঘটনার পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে "প্রধান সরকারী ভাষা" হিসাবে ঘোষণা করে| পরবর্তীকালে অসমে অসমিয়ার পাশাপাশি বাংলাকেও সে রাজ্যের অন্যতম সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়|


ঘটনার দিন যে ৯ জন শহীদ হন তারা হলেন : কানাই লাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদ রঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, সুকোমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য্য| ঘটনার পরদিন যে দু’জন শহীদ হন তারা হলেন - বীরেন্দ্র সূত্রধর এবং সত্যেন্দ্রকুমার দেব| এ ঘটনায় কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস গুলিবিদ্ধ হয়ে আরও ২৪ বছর বেঁচে ছিলেন|


সেদিনের সেই শহীদদের মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য্য ছিলেন ১৬ বছরের এক কিশোরী| তিনি বিশ্বের একমাত্র নারী চরিত্র, যিনি মাতৃভাষার অধিকারের দাবীতে প্রাণ দিয়েছিলেন| পরবর্তীকালে আরো দুজন যুবকের মৃতদেহ পাওয়া যায়| তাদের নাম ছিল জগন্ময় দেব ও দিব্যেন্দু দাস|


অথচ বাঙালির এই দিনের কথা মনেই থাকে না| তারা ২১ফেব্রুয়ারী নিয়ে ব্যস্ত কিন্তু উনিশে মে র কথা তাদের মনেই থাকে না|