সৃষ্টি সাহিত্য যাপন
** একটি কিশোর ছেলে **&& শ্যামল নিয়োগী
দেখতে দেখতে চল্লিশটা বছর কোথা দিয়ে কেটে গেলো বুঝতেও পারলো না কৃষ্ণেন্দু,যেন প্রকৃতিরজাদুদন্ডের ছোঁয়ায় মুহুর্তের মধ্যে সব কিছু পালটে গেছে।আজ ষাটোর্ধ কৃষ্ণেন্দু মুম্…
সৃষ্টি সাহিত্য যাপন
** একটি কিশোর ছেলে **
&& শ্যামল নিয়োগী
দেখতে দেখতে চল্লিশটা বছর কোথা দিয়ে কেটে গেলো বুঝতেও পারলো না কৃষ্ণেন্দু,যেন প্রকৃতির
জাদুদন্ডের ছোঁয়ায় মুহুর্তের মধ্যে সব কিছু পালটে গেছে।আজ ষাটোর্ধ কৃষ্ণেন্দু মুম্বাইয়ের নরিম্যান পয়েন্টের আকাশ ছোঁয়া বিল্ডিং এর বিশ তলার নিজের অফিসের এক্সিকিউটিভ দামি রিভলভিং চেয়ারে বসে আনমনে জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকে দিগন্ত বিস্তৃত আরব সাগরের নীল জলের দিকে। সমুদ্রের ঢেউএর মত মনের তটে আছড়ে পড়ে অনেক অনেক অতিতের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি গুলো। সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত চোখের
সামনে ভেসে ওঠে নর্থ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি। ওই রাস্তাতেই ঠাকুর বাড়ির চারটে বাড়ির ছেড়ে কৃষ্ণেন্দুদের আদি বাড়ি।
এখানেই কৃষ্ণেন্দুর জন্ম, শৈশব আর যৌবনের অনেক অনেক গুলো বছর কেটে গেছে। গায়ের রঙটা একটু চাপা ছিল তাই ওকে সবাই কৃষ্ণ বলে ডাকত। ধীরে ধীরে এখানেই বড় হয়ে ওঠা। বর্ধিষ্ণু একান্নবর্তী পরিবার কৃষ্ণেন্দুদের। ঠাকুর বাড়ির
কাছা কাছি থাকাতে পরিবারের সবাই কিছুটা হলেও রবীন্দ্র চেতনায় উদ্বুদ্ধ। কৃষ্ণেন্দুর মনে পরে যখন কিশোর বয়েসে ভালোলাগা শুরু হলো, তখন কি জানি কেন সব কিছুই ভালো লাগতো। শরতের নীল আকাশ, পেঁজা তুলোর মত মেঘ আর ওর মনের মাঝে গুন গুন করা কিছু মিষ্টি মিষ্টি শব্দ। স্কুলের খাতাতে লিখে রাখতো সেই শব্দগুলো।
ওরই সমবয়েসি সুন্দর মিষ্টি মেয়েদের দিক থেকে কেন যে ও চোখ ফেরাতে পারতো না, কিছুতেই বুঝতে পারত না তাকিয়েই থাকত, মনের ভেতরে
কেমন যেন একটা অদ্ভুত ভালো লাগা
আছড়ে পোড়তো। নিজের চেম্বারে চেয়ার থেকে উঠে ধীরে ধীরে খোলা জানলার পাশে এসে দাঁড়ায় কৃষ্ণেন্দু। দেখতে পায় কয়েকটা মাছ ধরার ট্রলার গভীর সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্র বকেরা ডানায় নীল জলের ছোঁয়া নিয়ে ঢেউয়ের তালে তালে উড়ে বেড়াচ্ছে। বেয়ারা কফি নিয়ে ডাকতেই
সম্বিত ফিরে আসে কৃষ্ণেন্দুর। আজ কোনো কাজ করতে ইচ্ছে করছে না কৃষ্ণেন্দুর। চেয়ারে বসে
হেলান দিয়ে কফিতে একটা সিপ দেয় । চোখের সামনে ভেসে ওঠে, কিশোর বেলার ভালো লাগা একটা মিষ্টি মুখ। মনে আছে একদিন সন্ধ্যাবেলা দাঁড়িয়েছিল বাড়ির কাছেই মহাজাতি সদনের সামনের বাস স্টপে। বাস আসছে যাচ্ছে, কোনোটা থামছে কোনোটা থামছে না। হটাৎ একটা বাস এসে থামলো কৃষ্ণেন্দুর সামনে, কৃষ্ণেন্দুর সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো, একটি কিশোরী মেয়ে সুন্দর করে দু বিনুনি বাধা, চোখ দুটো কাজল টানা, ঠোঁটে খুব হাল্কা লিপগ্লস, দুপায় নুপূর পরা বাস থেকে নেমে দাঁড়ালো। মুগ্ধ চোখে কৃষ্ণেন্দু
তাকিয়ে দেখছে মেয়েটিকে। মনে হচ্ছে আকাশ থেকে যেন নেমে এসেছে কোনো পরী। সেদিন সারা
রাত ঘুমতে পারেনি কৃষ্ণেন্দু, চোখ বুঁজলেই বাস স্টপের পরী এসে দাঁড়াচ্ছে ওর চোখের পাতায়।
সেই শুরু পরের দিন থেকে রোজ সন্ধ্যা বেলার ওই সময়টাতে কৃষ্ণেন্দু মহাজাতি সদনের সামনের বাস
স্টপে এসে দাঁড়ায় কোনো এক অদৃশ্য টানে। আর রোজই দেখতে পায় মেয়েটিকে বাস থেকে নামতে,
তখন কেমন যেন মোহাবিষ্ট এর মত শুনতে পায় মেয়েটির পায়ের নুপূরের রিনিঝিনি মিষ্টি আওয়াজ। খুব ইচ্ছে করতো ওর সাথে কথা বলতে, নামটা জানতে।
কফির কাপটা হাতে নিয়ে আবার ধীরে ধীরে কৃষ্ণেন্দু জানলার কাছে এসে দাঁড়ায়। তাকিয়ে দেখে নরিম্যান পয়েন্টের ব্যাস্ত অফিস টাইম।
স্রোতের মত মানুষের চলাচল, জ্যাম জট। অদ্ভুত এই বানিজ্য শহর মুম্বাই। সারাদিন সারারাত এক মুহুর্তের জন্য থেমে নেই এই শহরটা।
আজ যে কি হয়েছে কৃষ্ণেন্দুর কিছুই বুঝতে পারছে না কেন অনেক অনেক অতিতের হারিয়ে যাওয়া একটি মিষ্টি মুখ বার বার এসে হানা
দিচ্ছে মনের আয়নায়। মনে আছে সেই মহাজাতি সদনের বাস স্টপে দেখা কিশোর মনের রাজকন্যার নাম দিয়েছিল কিশোর কৃষ্ণেন্দু
রুবী রায়। আর রাতের পর রাত জেগে বাস্তবের রাজকন্যার কাল্পনিক নাম নিয়ে পাতার পর পাতা কবিতা লিখেছিল। আর স্বপ্ন দেখতো নিজের
হাতে সেই কবিতার মালা গেথে রুবী রায়ের গলায় পড়িয়ে দিচ্ছে।
কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি কৃষ্ণেন্দু। অফিস থেকে বেড়িয়ে আসে। আজ কেন জানি এখুনি বাড়ি ফিরতেও ইচ্ছে করছে না। হাটতে হাটতে সমুদ্রের ধারে এসে শেষ বোল্ডারটার ওপরে দাঁড়ায় কৃষ্ণেন্দু। দুপাশে আরব সাগরের নীল জল, দূরে দেখা যাচ্ছে আলো ঝলমল কুইনস নেকলেস আর মেরিন ড্রাইভ। একটা অদ্ভুত স্মৃতির
আবেশ নিয়ে বোল্ডারটার ওপরে বসে পর কৃষ্ণেন্দু। মনটা চলে যায় আবার অতিতে। এই ভাবেই কিশোর কৃষ্ণেন্দুর দিন কেটে যাচ্ছিল স্বপ্নের রাজকন্যা রুবী রায়কে স্বপ্নের মাঝে কবিতার মালা পড়িয়ে। কিন্তু জীবনের স্রোত একভাবে বয়ে চলেনা, জীবনের মুহুর্ত গুলো সবসময় পরিবর্তনশীল, তাই হটাত একদিন কিশোর কৃষ্ণেন্দুর জীবন থেকেও রুবী রায় হারিয়ে
গেলো। প্রকৃতির নিয়মে বাঁধা কৃষ্ণেন্দুর জীবনও অনেক পরিবর্তন হতে হতে আজকের ষাটোর্ধ কৃষ্ণেন্দু বসে আছে মুম্বাইএর নরিম্যান পয়েন্টের
সমুদ্রের ধারে একটা বোল্ডারের ওপরে। আকাশে আজ যেন তারার চাঁদোয়া, সমুদ্রের ঢেউ গুলোর ওপর তারার ছাঁয়া ঝিকমিক করছে।
আকাশের দিকে তাকায় কৃষ্ণেন্দু আর ভাবে কোথায় আছে ওর স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা রুবী রায়। আতি পাতি করে খোঁজে আকাশে বাতাসে সমুদ্রে ওর হারিয়ে যাওয়া রুবী রায়কে।
নিজের অজান্তেই কৃষ্ণেন্দুর দুচোখ ভড়ে ওঠে জলে, আজ সব কবিতা হারিয়ে গেছে কবিতার খাতা থেকে ওর হারিয়ে যাওয়া রাজকন্যা
রুবী রায়ের সাথে।......
কবিতার খাতা পরে আছে পাশে
অতীত স্মৃতিরা ফিরে ফিরে আসে ,
তোমার মনের আঁধার নিয়ে ক্লান্ত বাতাস,
কলমের কালি গুড়ো গুড়ো হয়ে
ঢেকে দেয় মনের আকাশ i
থেমে গেছে স্রোত জীবন থেকে
থমকে গেছে দিন রাতের মাঝে ,
কবিতার খাতা খোলা পরে আছে
শুধু কবিতা পাইনা খুঁজে i
আজও সন্ধ্যা বেলা তুলসী তলে
তোমার দেয়া প্রদীপ জ্বলে i
কেন পাইনা খুঁজে মনটা বারে বারে
কোথায় হারিয়ে গেছে কোন সুদূরে
খাতার মাঝে কবিতা হারিয়ে গেছে ,
কবিতার খাতা পাশে খোলা পরে আছে i
( আমার কল্পনায় " মনে পড়ে রুবী রায় " এর সেই
কিশোর ছেলেটি)
( শ্যামল।)