Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

।। একটি কাঁঠালি চাঁপা ফুলের গাছ,এক টুকরো স্মৃতির ক্যানভাস।।
।। সুনির্মল বসু।।
তখন আকাশটা অনেক ঘন নীল ছিল, নীল আকাশে রংবেরঙের ঘুড়ি উড়তো, ঘুড়ির পেছনে ছুটতে গিয়ে একবার পা ভেঙ্গে ফেলেছিলাম। চারদিকে অনেক সবুজ ছিল। সংসারে মানুষগুলোকে…

 


।। একটি কাঁঠালি চাঁপা ফুলের গাছ,

এক টুকরো স্মৃতির ক্যানভাস।।


।। সুনির্মল বসু।।


তখন আকাশটা অনেক ঘন নীল ছিল, নীল আকাশে রংবেরঙের ঘুড়ি উড়তো, ঘুড়ির পেছনে ছুটতে গিয়ে একবার পা ভেঙ্গে ফেলেছিলাম। চারদিকে অনেক সবুজ ছিল। সংসারে মানুষগুলোকে উপন্যাসের চরিত্র বলে মনে হতো। মানুষের শৈশবে যে কত রহস্য লুকানো থাকে, আর ছিল একটা কাঁঠালি চাঁপা ফুলের গাছ। আমার ছেলেবেলার বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম একজন বন্ধু। আমার ব্যর্থতার দিনগুলোর সাক্ষী। আমার অনেক কান্না ও বেদনার সব কথা ওকে তখন বলতাম।


তখন চারদিকে ধূ ধূ মাঠ। বাটা ফ্যাক্টরীর এক ফোরম্যান বিভূতি ঘোষ কয়েক বিঘা জমি কিনেছিলেন, তারপর পুকুর কাটালেন। পুকুর পাড়ে

ছিল ওই কাঁঠালিচাঁপা গাছটি। ফুল ফুটলে, চারদিকে মাতাল মাতাল গন্ধ বের হোত। আমাদের বন্ধুদের স্কুল ছুটির পর, ওখানেই ছিল আড্ডা দেবার জায়গা।


চব্বিশে ডিসেম্বর স্কুলের রেজাল্ট বেরুলে, পরীক্ষায় ফেল করে পাড়ার মোড়ে আসতেই, পাড়ার মেয়ে খুকু ছো মেরে আমার হাত থেকে রেজাল্ট কেড়ে নিয়ে মাকে বলতো, মাসিমা, বাবলু ফেল করেছে।

সেই ব্যর্থতার দিনে কাঁঠালিচাঁপা গাছটা আমার বন্ধু হয়ে গেছিল।


কলেজ লাইফে এ পাড়ায় এক নতুন ভাড়াটে এলো।

ও বাড়ির মেয়েটি যেচে পড়ে ভালবাসার কথা জানালো। একদিন সন্ধ্যায় পথে আমাকে জানালো,

তোমাকে না পেলে, আমি মরে যাবো।

সেই মেয়ে হঠাৎ একদিন তাঁর আসন্ন বিয়ের নেমন্তন্ন করেছিল। আমি গেলাম। মাইকে মান্না দের গান বাজছিলো, ক ফোটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালোবাসবে। ভালোবাসার ডিগবাজি খাওয়া দেখে,

গভীর রাতে আমি কাঁঠালিচাঁপা গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার কান্না, আমার পরাজয়ের কথা কাঁঠালিচাঁপার গাছটি সম্পূর্ণ জানতো।

তারপর জীবনের কত উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে একদিন আমি জীবনে প্রতিষ্ঠার সিঁড়ি পেলাম।


একটি নামী স্কুলের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রধান হলাম। পাশাপাশি লেখালিখি চলছিল। সেই সূত্রে সামান্য পরিচিতি।

কাজের পরিবেশে বেড়ে গেল। আজকাল আর কাঁঠালিচাঁপা গাছটার কাছে যাওয়া হয় না। ওর কথা সব সময় মনে পড়ে, কিন্তু আমার হাতে সময় কম। ইদানিং কাঁঠালিচাঁপা গাছটার কাছে যেতে পারিনি।


ততদিনে আমার জীবনে স্ত্রী হিসেবে মনোলীনা এসেছে। ওকে কথায় কথায় কাঁঠালিচাঁপা গাছটার গল্প শুনিয়েছি। আমার প্রিয় নদীর পাড়, কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়া, ঠান্ডা পুকুর, কাঠ বাদাম গাছের জঙ্গল দেখিয়েছি।

এক রোববার সকালে ওকে কাঁঠালিচাঁপা গাছটা দেখাতে নিয়ে গেলাম। আমার শৈশবের সঙ্গী, আমার দুর্দিনের বন্ধু ওই গাছটা মনোলীনার দেখা উচিত। 

স্যান্ট্রো গাড়িটা রাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে আমি কাঁঠালিচাঁপা গাছটির কাছে গেলাম।

নাহ, গাছটা কোথাও নেই। আধুনিকতার উতরোল ঝড়ে তার প্রাণসংহার ঘটেছে।


কষ্ট পেলাম। প্রতিদিনের সুখ দুঃখের সঙ্গীকে হারিয়ে। এখন আমার যা বয়েস, তাতে প্রতিদিন কিছু-না-কিছু দুঃসংবাদ শুনবার জন্য মনকে প্রস্তুত রাখতে হয়। কাঁঠালিচাঁপা গাছটির মৃত্যু, আমার শৈশবের স্মৃতিকথাকে কত দূরে নিয়ে গেল। আধুনিকতা আমাদের কত কি দেয়, কত  কী কেড়ে নেয়।


একসময়ে কাঁঠালিচাঁপা গাছটির কাছে ব্যক্তিগত দুঃখ জানাতে যেতাম আমি, আর সেই দিন মনোলীনাকে সঙ্গে নিয়ে ওকে আমি জানাতে চেয়েছিলাম, আমার দিনবদলের কথা। আমার পরাজয়, আমার হার জিত ওকে না বললে, আমার স্বস্তি হোত না।

দিনগুলো পেছনে চলে গিয়েছে। চরিত্রগুলো এখন জীবনের শেষ প্রান্তে।


মানুষের শৈশবের স্মৃতিতে কত কি থাকে। এতোকাল বাদেও, সেই কাঁঠালি চাঁপা ফুলের গাছটি অবিকল আমার স্মৃতি পথে জেগে আছে। চারদিকে বয়ে যাচ্ছে উতরোল বসন্তদিনের উদাস হাওয়া। কল্পনায় আমার মনে হোল, দুধেল জ্যোৎসনা এসে পড়েছে গাছটির সারা শরীরে।


গভীর রাতে গাছটি কানে কানে যেন আমায় বলে গেল, আমি  হারিয়ে যাইনি, সুনির্মল। এই দ্যাখো, তোমার স্মৃতির মধ্যে সেদিন আমি যেমন বেঁচে ছিলাম, আজও ঠিক একই ভাবে বেঁচে আছি।


আমার অজস্র কান্না দিয়ে তখন আমি কাঁঠালি চাঁপা গাছটিকে বারবার অভিষিক্ত করে ফেলছি। বললাম, একদিন তোমাকে ভালবাসায় বেঁধে ছিলাম, আজো ভালোবাসায় আছো, মৃত্যু পর্যন্ত এই ভালোবাসাকে বহন করে নিয়ে যাবো আমি।