গল্প :- ইলিশ কান্ডকলমে :- ছন্দশ্রী দাস *******18/6/2021**********
এই মিনতি হারাণবাবুর টাকের দেখা নেই কেন রে সকাল থেকে? ..জানি না গো ক্ষেপী মা। সকাল বেলা ঘুম চোখে দেখলুম বুমচ্যাম আর গেঞ্জি গায়ে, পায়ে চপ্পল পরে একটা লজজর সাইকেল নিয়…
গল্প :- ইলিশ কান্ড
কলমে :- ছন্দশ্রী দাস
*******18/6/2021**********
এই মিনতি হারাণবাবুর টাকের দেখা নেই কেন রে সকাল থেকে?
..জানি না গো ক্ষেপী মা। সকাল বেলা ঘুম চোখে দেখলুম বুমচ্যাম আর গেঞ্জি গায়ে, পায়ে চপ্পল পরে একটা লজজর সাইকেল নিয়ে মাথায় বাঁকানো টুপি দিয়ে কোথা
যেন গেল। আমাকে বলল মিন্টি দরজা ভালো করে দিয়ে দে। এই বৃষ্টিতে ক্ষেপী দেখছি নাক পর্যন্ত চাদর টেনে ঘুমচ্ছে। কেউ এসে বেল বাজালে দরজা খুলবি না।
..নাক পর্যন্ত চাদর টানবে না!! সকালে উঠেই শ্যামের বাঁশির সুরে যে সৌগন্ধ ছড়িয়ে গেল ঘুমের ঘোরে বমি করে ফেলছিলাম আর কি।
...তা সৌগন্ধ তো ছাড়াবেই ক্ষেপী মা। কাল রাতে খিচুড়ি, ডিমভাজা, পিঁয়াজি। তার রেশ যাবে কোথা?আবার বলে ইলিশ মাছ হলে আরো জমতো। ওহো খুব ভুল হয়ে গেছে গো!!
..কি ভুল রে মিনতি?
..মিনতি ক্ষেপী কে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলে হ্যাপি বার্থডে ক্ষেপী মা। আজ তোমার জন্মদিন তো। দেখ তুমি আষাঢ় মাসের প্রথম দিন জন্মে ছিলে আর বৃষ্টি সাথে এনে ছিলে।
..নারে মিনতি ও বৃষ্টি নয়। আমার চোখের জল।
..ও কি কথা! তোমার আবার দুঃখ কিসের?
..কিসের নয় বলতো? ভগবানকে বলেছিলাম মেম করে দিতে, করলো কালী, বলেছিলাম চুলেভরা মাথার বর দিতে, দিল টেকো বর। বলেছিলাম ....ধুত আর কিছু মনে পড়ছে না। তুই চা নিয়ে আয়। সাথে টাও আনবি।
..সে তো আনবো গো। আজ তোমার জন্মদিন। স্পেশাল কিছু রান্না করবো। ফ্রিজে বেশ খানিকটা মাটন আছে। চিকেন ও আছে। দেখি কি করা যায়। এখন কি খাবে?
..যা হোক দে। এখন আমার চিন্তা হচ্ছে।
..কেন গোওও?
..হারাণবাবু এই বৃষ্টি মাথায় করে কোন প্রেমিকার সাথে লটঘট করতে গেছে কে জানে? আবার কিছু কান্ড না ঘটিয়ে বসে। আর বৃষ্টিতে ভিজলে তার হাঁচি। উফ্ ঐ হাঁচির চোটে আমি পাগল হয়ে যাই।
..ঐ দেখ তোমার হারাণবাবু বেল বাজাচ্ছে। যাই দরজা খুলে দিই।
..খবরদার মিনতি দরজা খুলবি না। তোকে বারণ করে গেছে কেউ বেল বাজালে যেন দরজা না খুলিস।
..ওকি গো ক্ষেপী মা! কি বলছ। হয়তো টাকলুবুড়ো এসেছে।
..আসুক, আমাকে না বলে চুপিচুপি প্রেম করতে যাওয়া এই বাদলায় বের করছি।
..ক্ষেপী মা বেল এবার কেটে যাবে। দিই দরজা খুলে।
..না, সাড়া না দিলে খুলবি না। যদি ডাকাত হয়!
..ক্ষেপী মা এবার দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে দরজা ভেঙে ফেলবে।
..ভাঙুক আবার নতুন ডিজাইনের দরজা হবে। আগে চিল্লাচিল্লি করুক তারপর।
..বলি বাড়ির সবাই কি কানের মাথা খেয়ে বসে আছো!! এই মিন্টিইইই সেই থেকে বেল বাজাচ্ছি, দরজা ধাক্কাচ্ছি শুনতে পাচ্ছিস না কালা মানিক।
..যা মিনতি সাড়া দে এবার
..যাই গোওও টাকলুবুড়ো দরজা খুলছি।মিনতি গিয়ে দরজা খুলতেই হারাণবাবু কাকভেজা হয়ে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢোকে। হাতে তার প্লাস্টিকের প্যাকেট।
..সামনে ক্ষেপী কে সোফায় বসে চা খেতে দেখে বলে, বলি কানের মাথা খেয়ে বসে আছো নাকি!! এতবার বেল বাজাচ্ছি, দরজা ধাক্কাচ্ছি শুনতে পাওনি?
..পাবো না কেন? শুনে শুনে কান কালা হয়ে গেল।
..তবে খোলোনি কেন দরজা? ষাঁড়ের মত চেল্লাতে তবে দরজা খুললে।
..ক্ষেপী বলে তুমি ই তো মিনতিকে যাবার আগে বলে গিয়েছিলে কেউ বেল বাজালে দরজা খবরদার খুলবি না। আমি ভাবলাম হয়তো চোর ছ্যাঁচোর বা বদলোক হবে। বাড়িতে দুটো যৌবনবতী মহিলা রয়েছি। কি থেকে কি হয়
বলা তো যায় না। তাই তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। তা এখন দেখছি ক্ষ্যাপা ষাঁড়।
..ওরে আমার কথা শোনার পাত্রী রে! সব কিছু শুনে উল্টে যাচ্ছো। বলি বাড়িতে দুটো যৌবনবতী মহিলা কোথায়? আর আমি ষাঁড়!!
..ও মা তুমি ই তো এই মাত্র নিজে মুখে নিজেকে বললে। আর যৌবনবতী মহিলা মিনতি আর আমি! শ্রীমতী মৃণালিনী মুখোপাধ্যায়।
..ওরে আমার যৌবনবতী রমণীরে! বলি আর কতকাল কচি সেজে থাকবে। মেঘে মেঘে বয়স তো অনেক হল। এই তো আজি তোমার জন্মদিন। কত বছরে পড়লে তার হিসাব আছে কোনো!
..ক্ষেপী মিষ্টি হেসে বলে সুন্দরী মহিলাদের বয়সের হিসাব রাখতে নেই। বলি সাত সকালে বৃষ্টি মাথায় করে কোথায় যাওয়া হয়েছিল??
..তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে।
..কি সারপ্রাইজ?
..কাল বলেছিলাম না ইলিশ মাছের কথা! তাই আজ সকালে উঠে বাজারে গিয়েছিলাম টাটকা ইলিশ কিনতে। তা কি বলবো ক্ষেপী। তোমার জন্মদিনের জন্য একটা খাসা বড় ইলিশ পেলাম। প্রায় দেড়কেজি ওজন। চওড়া পেট, চকচকে গা। রূপ একেবারে ছলকে পড়ছে। ঠিক তোমার মতো। কিনলাম মাছটা। কেটেকুটে নিয়ে এসেছি। এই নে মিন্টি ধ অঅঅ ররর....
..কি গো তোমার হাওয়া বেরিয়ে গেল কেন?
..যখন নিয়েছিলাম তখন তো বেশ ভারি ছিল। এই বাড়ি ঢোকার আগে পর্যন্ত ঠিক ছিল এখন কেমন হালকা লাগছে।
..মিনতি হারাণবাবুর হাত থেকে মাছের প্যাকেট নিয়ে রান্নাঘরে একটা থালায় ঢেলে বলে ও টাকলুবুড়ো মাত্র তো
দশ পিস মাছ রয়েছে। গোটা মাছ কিনলে তার লেজা মুড়ো কোথায় গেল। ও মাগোওও। এই দেখ প্যাকেটের তলা ফুটো। টাকলুবুড়ো রাস্তায় ইলিশ মাছ বিলোতে বিলোতে এসেছে।
হ্যাঁ গো বুড়ো তোমার যখন মনে মনে ক্ষেপী মাকে জন্মদিনে ইলিশ মাছ খাওয়াতে ইচ্ছে করেছিল তখন তো বাড়ি থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে যেতে পারতে।
..হাতে ব্যাগ দেখলেই তো উকিলের মতো জেরা করতিস আর ক্ষেপী জেগে যেত। সব জানাজানি হয়ে যেত।
..ক্ষেপী বলে তাহলে মাছ ওলার কাছে আরো একটা প্যাকেট চেয়ে তাতে ভরে নিতে হয়। একদম মাথামোটা বুড়ো। একটু যদি বুদ্ধি খরচ করে।
..দেখ মেলা বকিও না। আমি কি করে জানবো যে প্যাকেটের তলা ফাটা। দাঁড়াও এর পরদিন গিয়ে বেটাকে ধরতে হবে।
..যাক গে টাকলুবুড়ো যা হবার হয়েছে। দশপিস ইলিশ মাছ তো আছে। ঐ দিয়েই হবে। আবার অন্য কোনোদিন এনো। আর ঘরে তো মাটন রয়েছেই।
..ক্ষেপী এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হারাণবাবুর দিকে। তারপর বলে তুমি কি সোজা মাছ নিয়ে বাড়িতে এসেছ?
..হারাণবাবু আমতা আমতা করে বলে, না বাড়ি আসার আগে ঐ মালতী বলল,জজবাবু এই বৃষ্টিতে এক কাপ চা খেয়ে যান। তাই...
..তাই তুমি যৌবনবতী মালতীর দোকানে বসে চা এর সাথে ভেজারূপ সুধা পান করলে আর মালতীর দোকানের ইঁদুর তোমার মাছের প্যাকেট কুটকুট করে কেটে দিল।
..মাইরি বলছি ক্ষেপী আমি মালতীর ভেজা রূপ দেখিনি। রতনা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। মালতী হলুদ ছাপা শাড়ি পরেছিল। আর ব্লাউজটা পেছনে ফিতের মতো বাঁধা।
..ক্ষেপী রাগে লাল হয়ে বলে মিনতি টাকলুবুড়োকে চিনি ছাড়া লাল চা দিবি। সুগার টা লেভেলের কাছাকাছি। বলে উঠে চলে যায়।
হারাণবাবু রেগে গিয়ে বলে, আমার মালতীলতা আছে।
..মিনতিইই ইলিশগুলো শুধু তোর আর আমার।
..একটু বেলা হতে রতন আসে হারাণবাবুর কাছে গল্প করতে।
..ক্ষেপী রতনের গলার আওয়াজ পেয়ে বলে কি ব্যাপার রতন এই বৃষ্টিতে!! কোনো খবর আছে নাকি?
..খপর বলে খপর এক্কেরে যাকে বলে বেকিং নুজ।
..মিন্টি ও এগিয়ে এসে বসে বলে, কি তোমার বেকিং নুজ গো রতনদা?
..রতন কার্পেটে বাবু হয়ে বসে মিনতির আনা চা পকোড়া খেতে খেতে বলে, কি বলবো গো মিনতিদিদি সবাই বলে ভগমান নেই। যদিও থাকে তবে তিনি কানা। গরীবের দিকে ফিরেও তাকান না।
..হারাণবাবু গম্ভীর হয়ে বলে, তা ঠিক বলেছিস রতন। ভগবান গরীব আর অভাগাদের দিকে ফিরে তাকায় না।
..না গো জজবাবু আজ আমার সে ভুল ভাঙল।
..ক্ষেপী জিজ্ঞাসা করে কি রকম শুনি..
..এই দেখ না ক্ষেপী মা, দুদিন ধরে উবুঝুড়ন্ত বৃষ্টি হচ্ছে। আমার সোহাগী মালতীলতা সমানে বলছে এই জানো গো
এমন বর্ষার দিনে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা খেতে দারুণ লাগে। আনবে গো?
আমি বলি গরীবের ঘোড়ারোগ। ইলিশের দর কত করে জানিস? দু’হাজার টাকা কেজি। আমাদের মত মানুষদের এই বর্ষায় খিচুড়ি আর ডিমভাজাই ভালো।
তা আজ সকালে হলো কি বৃষ্টিতে খদ্দের বেশি নেই। এই জজবাবুর মত দুচারজন যা হাতে গোনা খদ্দের। তাই মালতী তাড়াতাড়ি ঝাঁপ ফেলতে চায়। তাড়াতাড়ি রান্নাখাওয়া করে দুপুরে গড়িয়ে নিতে চায়। এমন সময় তার চোখে পড়ে খদ্দেররা যেখানে বসে সেখানে কতগুলো টাটকা ইলিশ মাছের টুকরো পড়ে আছে। আর কি তার গন্ধ।লেজা মুড়ো নিয়ে তা আট দশ পিস হবে। মালতী বলে কে এসেছিল ইলিশ নিয়ে। ইঁদুরে তার প্যাকেট ফুটো করে দিয়েছে। আর সে বাড়ি গিয়ে ভাবছে রাস্তায় পড়ে গেছে। বলে তুলে একটা প্যাকেট করে রেখে দেয়। বলে যদি কেউ আসে তো দিয়ে দেব। তা বেলা বারোটা পর্যন্ত কেউ এলো না।
তখন আমি বললাম মালতী বাড়ির পিছনে তোর বসানো পুঁইমাচা বেশ ছেয়েছে। সেখান থেকে দু ডাল কেটে মাথা দিয়ে চচ্চড়ি কর। আর সরষে ইলিশ। আজ দুপুরে জমিয়ে ভাত খাবো। দুমুঠো চাল বেশি নিবি। বলে এই তোমাদের বাড়ি এলুম একটু গল্প করতে।
..সব শুনে মিনতি বলে, ভাগে খায় না ভাগ্যে খায়। আজ তোমার কপালে ইলিশ মাছের মাথার ছ্যাঁচড়া নাচছিল তাই খেলে।
..তা ঠিক বলেছিস রে মিনতি। যাই দেখি রান্না বোধহয় শেষ হয়ে এল। চাট্টি গরম গরম খেয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুম লাগাই। বলে রতন চলে যায়।
..রতন চলে যেতে মিনতি বলে, টাকলুবুড়ো সোজাসুজি বললেই পারতে যে ক্ষেপী মার জন্মদিনে তোমার মালতী আর রতনকে ইলিশ মাছ খাওয়াতে ইচ্ছে করেছিল চুপিচুপি।
..হারাণবাবু একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে তা কখনো বলতে আছে? আসলে মালতী আর রতনের কথা শুনে মনে খুব লাগলো। তাই...
..ক্ষেপী জলভরা চোখে তাকিয়ে বলে আমার অনেক ভাগ্য যে তোমাকে পেয়েছি।
*****************18/6/3/2021*************