Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপনগল্প -- ছেলের হাতের আগুনকলমে --পৃথা ব্যানার্জী29-6-21
---"মা শ পাঁচেক টাকা দাও, হাত একদম ফাঁকা। মাইনে পেতে আরও ছটা দিন বাকি"।---"আমার কাছে যা আছে তা আমার ওষুধের খরচা"।----"ওষুধ তো এক্ষু…

 


#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন

গল্প -- ছেলের হাতের আগুন

কলমে --পৃথা ব্যানার্জী

29-6-21


---"মা শ পাঁচেক টাকা দাও, হাত একদম ফাঁকা। মাইনে পেতে আরও ছটা দিন বাকি"।

---"আমার কাছে যা আছে তা আমার ওষুধের খরচা"।

----"ওষুধ তো এক্ষুনি কিনছ না। আমি দেখেছি পনেরো দিনের আছে"।

----"আমার অন্যান্য খরচা ও তো আছে, তোমরা তো দু বেলা ভাত রুটির থালা ধরিয়ে কর্তব্যের দায় থেকে রেহাই পাও। কিন্তু পেট টা তো আমার। খিদে পেলে আমাকেই তো খাবার টা খেতে হবে। তাই সেগুলো কিনতে তো টাকা চাই"।

---"আর যখন চোখ উল্টে শুয়ে পড়বে তখন কে দেখবে? আর শেষ সময়ে ছেলের হাতের আগুন,---

সেটাও তো চিন্তার বিষয়"!

---"চিন্তা করিসনা বাবা, সব ঠাকুরের কৃপা। কপালে যা আছে তাই হবে"।

বাবাই মিনতির একমাত্র ছেলে তাই একটু আদর দিয়েই মানুষ করেছে। ছেলে তার বাধ্য ছিল। কিন্তু সব কিছু ওলোটপালট হয়ে গেল এই বিথি মেয়েটাকে বিয়ে করে। যে ছেলে মা ছাড়া কিছুই জানতো না সে এখন সব কিছুতেই মায়ের দোষ দেখে। বেহিসেবী খরচার জন্য মাসের মাইনেতে কুলিয়ে উঠতে পারে না। বৌয়ের বাইরে খাওয়া চাই সপ্তাহে দু দিন। তার ওপর প্রয়োজন ছাড়া কেনাকাটা।

প্রথম দিন থেকেই মিনতি দেখেছে বৌ তাকে সহ্য করতে পারে না। একবার ঘর অপরিস্কার রাখার জন্য  মিনতি বৌকে বকাবকি করে। সাংঘাতিক হয়েছিল তার ফল। বিথির বাপের বাড়ির লোকজন এসে মিনতি কে বলেছিল,

---"আগামী দিনে এমন অত্যাচার মেয়ের ওপর করলে থানা পুলিশ করতে বাধ্য হবো আমরা"।

সবাই চলে গেলে বাবাই বলেছিল থানা পুলিশ হলে তার চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে। সেই কথাটা যেন মা মনে রাখে।

সেই থেকে মিনতি মুখ বন্ধ করেই থাকতো।


বাড়তি খরচার জন্য প্রতি মাসেই বাবাইকে মায়ের কাছে হাত পাততে হতো।

মিনতি প্রথম কয়েক মাস টাকা দিয়ে ছেলে বৌ দুজনকেই বুঝিয়েছে নির্দিষ্ট টাকায় কি ভাবে সংসারে চলতে হয়। 

কিন্তু দেখলো লাভ কিছু নেই। ওরা নিজেদের পথেই চলছে। পেনশনের টাকা সে এইভাবে নষ্ট করবে না। কতদিন যে বাঁচবে কিছু ঠিক নেই। 


ছেলে কথাগুলো বলে চলে যাবার পর থেকেই সারাটা দিন মিনতি নানা চিন্তার মধ্যে কাটাল। শেষে ঠিক করলো এভাবে বাঁচা যায়না। তার তো গ্রামের বাড়ি আছে। সেখানেই সে চলে যাবে কাল। 

সকালে মাকে ব্যাগ নিয়ে বার হতে দেখে বাবাই আশ্চর্য্য হয়ে বললো,

---"তুমি কোথায় যাচ্ছ"?

----"গ্রামের বাড়িটা ঠিক করাতে হবে। কিছুদিন ওখানে থেকে বাড়ি জমির সব ব্যাবস্থা করে ফিরবো"।

---"কিন্তু তুমি একলা কিভাবে থাকবে? তোমার রান্না খাওয়া কে দেখবে? সবার বড় তোমার যদি শরীর খারাপ করে, ডাক্তার ও তো ভালো নেই ওখানে"!

---"গ্রামের লোক সবাই সবার আত্মীয়। ও নিয়ে তুই চিন্তা করিসনা। তাছাড়া সেখানের জায়গা জমি বাড়ি দেখাশোনা করা দরকার"।

----"ওগুলো এবার বিক্রি করে দাও। তাহলে এই বাড়িটাকে একটু ঠিকঠাক করা যায়"।

----"আমি মরে গেলে সব তো তোর তখন করবি, এখন আমি যাই"।

বাইরে গাড়ির হর্ন। বাবাই অবাক হয়ে বললো,

----" তুমি ধীরু কাকাকে দিয়ে গাড়ি ও আনিয়ে নিয়েছো! আমার জন্য অপেক্ষা করলে না"?

---"শেষের দিনে তোর দেওয়া মুখের আগুনটার জন্য অপেক্ষা করব"।

বাবাইয়ের মনে হলো কালকের কথাটা বলা খুব অন্যায় হয়েছে।


মিনতি যখন এসে গ্রামে পা রাখলো তখন দুপুর। বাড়িটার অবস্থা দেখলো খুব খারাপ। আগাছায় চারিদিক ভরে আছে। ভাবছে কি করবে, এমন সময় দেওরের ছেলে টুবাই এসে বললো,

----"জেঠিমনি তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কেন? বাড়ি চলো। মা ওই যে দাঁড়িয়ে আছে"।

মিনতি দেখলো ছোটো জা হাত নাড়ছে। পড়ন্ত দুপুর টা ওদের সঙ্গে কাটিয়ে বিকেলে মাধাইয়ের বাড়ি এলো। মাধাই মিনতি দের জমি চাষ করে। মিনতি কে দেখে মাধাই একটু অপ্রস্তুত।

----"কি রে বাড়ি ঘরের অবস্থা এতো খারাপ কেন? ক বছর দেখাশোনা করিসনি"?

---"প্রকৃতির চোখ রাঙানি তে কাবু হয়ে আছি কাজ কি করে করবো?আপনি একটা দিন সময় দেন, কাল দুপুরের মধ্যেই সব পরিষ্কার পাবেন"।

পরদিন বিকেলে নিজের ঘরে পা দিয়ে মিনতি দু হাত জোর করে গৃহ দেবতাকে প্রনাম জানালো। নিজের মতো করে নিজের ঘরে থাকবে। এ স্বাধীনতা সে কোনোদিনই ছাড়বে না।

রান্না, ঘরের কাজকর্ম, বাগানের দেখাশোনা করার জন্য লোক ঠিক হয়ে গেল। এক অদ্ভুত আনন্দের সঙ্গে দিন কাটতে লাগলো মিনতির।

সেই দমবন্ধ করা শহরের ঘর আর সাথে দু বেলা অশান্তি ছেড়ে আরও আগেই তার চলে আসা উচিত ছিল।

এমন যখন দিন কাটছে তখন হঠাৎ একদিন বাবাই আর বিথি এসে হাজির। এমন সুন্দর বাড়ি ঘর দেখে তো দুজনেরই চক্ষু স্থির। 

মিনতি সেদিন নিজেই রান্না করলো বাবাইয়ের প্রিয় পদগুলো। পুকুর থেকে জাল ফেলে মাছ ধরিয়েছিল।

এক সময় চোখ ভর্তি জল নিয়ে বাবাই মাকে জড়িয়ে বললো মা যেন তার সাথে ফিরে চলে। মাকে ছাড়া তার খুব কষ্ট হচ্ছে।

মিনতি ছেলের কথায় ঘাড় নেড়ে জানালো এখন সে যাবে না। কারণ এগুলো দেখাশোনা করার জন্য এখানে থাকতে হবে।

শেষে বাবাই বললো তার একজন বন্ধু গ্রাম দেখেনি সে আসতে চায়।

মিনতি জানিয়ে দিল যে কোনো অসুবিধা নেই। যে কেউ আসতে পারে তার গ্রাম দেখতে।

ফেরার পথে বাবাই আর বিথি ভাবতে লাগলো বাড়ি আর জমি মিলিয়ে কত দাম হবে। ওই টাকা গুলো দিয়ে তারা তাদের জীবনটাকে কেমন সুন্দর করে সাজিয়ে তুলতে পারবে।

প্রপার্টি কেনার লোক খুঁজতে লাগল। দিন পনেরো পরে একজন বেশ মনের মতো দামের লোক পেলো। 

গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এসে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখিয়ে দিল। দর দামের ব্যপারটাও ফাইনাল হয়ে গেল। তবে মুশকিল হলো যখন বার হচ্ছে। মাকে প্রনাম করে দু পা এগিয়েছে সেই সময় মিনতি লোকটাকে বললো,

---"শুনুন, আপনি যে জায়গা গুলো দেখলেন তা সব দান পত্র করা। বিক্রি হবে না। এই বাড়ি হাসপাতাল হবে আর ওই জমি থেকে হাসপাতালের খরচা"। 

বাবাই চিৎকার করে বললো,

---"এ তুমি করতে পারোনা"।

---"পারি, আমার সম্পত্তি আমি সব পারি। গ্রামের লোক বিনা চিকিৎসায় মারা যায় এটা মেনে নেওয়া যায়না"।

----"তোমার শেষের দিনের পথ তুমি নিজেই বন্ধ করলে। আমি আর আসবো না। বিনা আগুনে, বিনা মুখাগ্নি তে পড়ে থাকবে তুমি"।

আট মাস পর বাবাই একটা চিঠি পেলো। তাতে লেখা,

---"মিনতি দেবি মারা গিয়েছেন। গ্রামের মানুষদের তিনি সন্তান সম স্নেহ করতেন তাই তাঁর ইচ্ছানুসারে আমরাই তাঁর মুখাগ্নি ও শেষ কাজ করেছি। সব শেষে আপনাকে খবর দেওয়া হোক এটাই তাঁর ইচ্ছা ছিলো"।


চোখের জলের সাথে বাবাই ভাবলো ছেলে হয়ে মাকে মুখাগ্নির কথা ওই ভাবে বলা তার উচিত হয়নি। মা তার কিছুই নিলনা। এক ফোঁটা জল ও মাকে দিতে পারলাম না।