স্বপ্ন নবনীতা সই 25,6,21ছোটো গল্প
বৌমা আমি রনিত কে নিতে এলাম৷ একবার শেষ দেখা কি দেখতে চাও ?মানে??মানে রনিত আর থাকতে চায়না তোমাদের সাথে ৷ইয়ার্কি নাকি?? কাল রেজাল্ট বেরোবে৷ আর টিউশন না থাক, আঁকা, কমপিউটার ক্লাস, স্পোকেন ইংলিশ ক্লাস…
স্বপ্ন
নবনীতা সই
25,6,21
ছোটো গল্প
বৌমা আমি রনিত কে নিতে এলাম৷ একবার শেষ দেখা কি দেখতে চাও ?
মানে??
মানে রনিত আর থাকতে চায়না তোমাদের সাথে ৷
ইয়ার্কি নাকি?? কাল রেজাল্ট বেরোবে৷ আর টিউশন না থাক, আঁকা, কমপিউটার ক্লাস, স্পোকেন ইংলিশ ক্লাস, সব কামাই হবে৷ আর ঐ ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে গিয়ে করবে কি?
কেন গাছে চড়বে৷ পাখিদের গান শুনবে৷ বড় মাঠে খেলা করবে৷
হ্যাঁ তাহলেই হয়েছে৷ গরু হবে৷
কেন আমার ছেলে তো হয়নি৷ আজ অমিতেষ যে চাকরী করে সে তো ঐ গাঁয়ের স্কুলে পড়েই পেয়েছে৷ তোমাদের এই ফ্ল্যাট, গাড়ি, আরাম আয়েশ সব তো করতে পেরেছে৷
সে যুগ আর নেই ৷
কে বললো? আজও মাধ্যমিক , উচ্চমাধ্যমিক সব গাঁয়ের স্কুল গুলোর ছেলে মেয়েরা পশ্চিমবঙ্গে ভালো ফল করে৷
রাখুন তো৷ যাবেনা রনিত৷
এমন বোলোনা বৌমা৷
ধুর আপনি কি মনে করেন আমি কিছু বুঝিনা৷ সব চালাকি৷ ছেলের মাথা তো ঘোরাতে পারেননি আজ আমার ছেলের মাথায় ঐ সব ঢোকাতে চান৷
তোমার ছেলে? অমিতেষ তো আমাদের ছেলে , কই আমরা তো বলিনি কেন আমার ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছো? কি হবে বৌমা গেলে? কিছু নম্বর কম পাবে৷ হয়ত দুটো জিনিস কম শিখবে৷ তাতে কি ক্ষতি হবে?
বাহ্ অসাধারণ ৷ কি ক্ষতি হবে? পিছিয়ে পড়বে না?
কার থেকে পিছিয়ে পড়বে? বন্ধুদের থেকে? এই দৌড়টা কবে শেষ হবে?
আমি জানিনা৷ শুধু জানি রনিত যাবেনা৷ ওর ভবিষৎ এখানে৷ আমি ওকে বড় করতে চাই৷ হয় ডাক্তার নয় ইঞ্জিনিয়ার৷
শুধু পড়াশুনায়?
না তা কেন? আঁকা শেখে, কমপিউটার শেখে৷
আর গান?
ওসব ফালতু ৷
কিন্ত রনিত যে বড় গাইতে ভালোবাসে৷ অমিতেষ ও ভালো গাইতো৷
হ্যাঁ গান করে করে জীবন নষ্ট করুক৷
বড় ডাক্তার হবে অনেক টাকা রোজগার করবে৷
সারাজীবন রেস করবে৷ মানুষ কবে হবে?
কেন ডাক্তার হওয়া কি মানুষ হওয়া নয়?
অবশ্যই ৷ কিন্ত বৌমা অতীত ভুলে কারোর ভবিষৎ ভালো হয়না৷
আপনি তো তাই চান৷ গাঁয়ের মাষ্টার হয়ে বসে থাকুক আপনার মতন৷
খারাপ কি? আমি জীবনে অমিতেষ কে মানুষ করেছি৷ অদিতি কে পড়িয়েছি৷ সে তার ঘরে সুখে সংসার করছে৷ চাকরী করছে৷
যথেষ্ট নয় বাবা৷ রনিত কে আরও বড় হতে হবে৷
আর শৈশব আর কৈশর কে মেরে? বইয়ের স্থুপ চাপা দিয়ে? কি হবে বৌমা? চারটে পয়সা বেশী রোজগার করবে, আরও বড় ফ্ল্যাট , আরও বড় গাড়ি৷ জীবনে চাওয়ার আর পাওয়ার তো শেষ নেই ৷শুধু চাই চাই করে কোথায় শেষ হবে চাহিদার?৷
আমি অসব বুঝিনা৷
বুঝতে হবে তো৷ জীবনে উন্নতির কোনো শেষ নেই ৷ কিন্ত জীবন শেষ হয়ে যায়৷ আরও ভালোর নেশা বড় সব্বনাশের৷
আপনি তো বলবেনই৷ সেজন্য তো অমিতেষ আজ এখানে, নইলে যা ট্যালেন্ট ওর আরও ভালো কিছু হতো৷
কেন বৌমা খারাপ আছো? আরও ব্যস্ত কি হয়ে যেতো না? এখনি রনিতের জন্য সময় পায়না৷ অফিস, সোসাল মিডিয়া, তোমাদের পার্টি সব মিলিয়ে সময় কোথায় ? সবাই ছুটছো৷ পৃথিবীতে, গাছ থাকবে না, জল থাকবে না, তবুও সবার শুধু চাই চাই ৷ শিশুদের শৈশব থাকবে না, খেলাধূলা থাকবে না তবুও চাই চাই ৷ অনেক টাকাই কি অনেককিছু ৷ জানি টাকা ছাড়া জীবন ব্যর্থ কিন্ত জীবনের ছোটো ছোটো আনন্দ গুলো? তোমরা আত্মীয় চেনোনা৷ স্বজন তোমাদের কাছে বোঝা৷ কাল অদিতির ছেলে মেয়ে বড় হলে রাস্তায় রনিতের সাথে দেখা হলে হয়ত চিনবে না৷ তোমরা আমরা কদিন ? এরাই তো আগামী তে বাঁচবে ৷
কে বলেছে আপনাকে ? সবাই সবাই কে চেনে অদিতির ছেলে কুশল তো রনিতের ফেসবুক ফ্রেন্ড৷
হয়ত৷ আমি তো বুড়ো মানুষ বুঝিনা৷ উন্নতি আর সভ্যতার নামে পৃথিবীর আয়ু কমছে, আর মানুষের শৈশব বলে কিছু থাকছেনা৷ নিজের মাটি চিনছে না ৷ হ্যাঁ বছরে বছরে বাইরে ঘুরে আসছে৷ থামতে হবে বৌমা , থামার গুন আছে৷ মাঝে মাঝে সময় দিতে হবে, মা ছেলের সম্পর্ক , ছেলে পিতার সম্পর্ক কে৷ নিজের মাটির স্পর্শ ৷ সবকিছু বড় দরকার৷
আপনার ঘ্যানঘ্যান বন্ধ করুন তো৷ রনিত যাবেনা৷
কিন্ত রনিত তো থাকতে চায়না৷ আচ্ছা আসি আমরা৷
না না না
ঘামে নেয়ে রুপালী চিৎকার করে জেগে ওঠে৷ ফোনটা টানা বেজে যাচ্ছে৷ অমিতেষ মোষের মতন ঘুমাচ্ছে৷ রাতে দু পেগ খেলে আর হুশ থাকেনা৷ পাশের টুলে রাখা জগ থেকে ঢকঢক করে জল খায় রুপালী৷ কি বিচ্ছিরি স্বপ্ন ৷ ধুর ৷ ফোনটাও বাজছে৷ কি জ্বালা রাত তিনটে বাজে কে জ্বালাচ্ছে?
হ্যালো
হ্যালো বৌমা!!
হ্যাঁ কি ব্যাপার ? এই মাঝরাতে? জানেন তো কাল আপনার ছেলের অফি...
কি করবো বৌমা , জানি বিরক্ত হবে কিন্ত খোকার বাবা....
কি হয়েছে ? হ্যাঁ গো শুনছো ? দ্যাখোনা মা কি বলছে৷
অমিতেষ কে ঠেলে উঠায় রুপালী ৷
কান্নায় ভেঙে পড়ে অমিতেষ মায়ের কথা শুনতে শুনতে ৷ রুপালী বুঝতে পারে তার শশুর মশাই আর নেই ৷
ধক করে ওঠে রুপালীর বুকটা৷ বাবা তো বলছিলেন রনিত কে নিয়ে যাবেন!
ছিটকে গায়ের চাপাটা সরিয়ে বেড়িয়ে আসে রুপালী ৷ ধুমদাম করে দরজায় আঘাত করে রনিতের ৷
কিছুক্ষন পর ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে রনিত বেড়িয়ে আসে৷
রুপালী ঘরে ঢুকেই বলে , এ কি করতে যাচ্ছিলি রনিত?
মা মা সরি৷ আমি হয়ত নাইনটি সারপেন্ট পাবোনা৷ আমি বাঁচতে চাইনা ৷
না রনিত৷ স্বপ্নেও এসব ভাববি না বাবু৷ কিছু হবেনা৷ কিছু না৷ জীবন অনেক বড়৷ কি হবে দুটো নম্বর কম পেলে৷
তুমি যে আপসেট হবে মা৷ কষ্ট পাবে৷
বোকা ছেলে তোর কিছু হয়ে গেলে আমরা দুজন বাঁচবো? বাবু তুই আমাদের সব৷ কিছু না বাবু৷ তুই মানুষ হ আর কিছু না৷
মায়ের বুকে আজ বেশ কিছু বছর পর মুখ লুকিয়ে কেঁদে ওঠে রনিত৷
কিছুক্ষন পর অমিতেষ রেডি হয়ে বলে , রুপালী আমি আসছি৷
কোথায় যাচ্ছো?
আজ বাঁধা দিও না৷বাবা আর নেই ৷
বাঁধা দিচ্ছি না৷ বলছি আমাদের ফেলে যাচ্ছো কেন? আমরাও যাবো৷
তুমি যাবে? আর রনিতের রেজাল্ট ৷
রেজাল্ট কি উড়ে যাবে৷ সে রনিত নেটে দেখে নেবে৷ আজকাল সব নেটে হয়ে যায়৷ তুমি দাঁড়াও ৷ বাবু চট করে রেডি হয়ে নে৷
পনেরোদিন পর৷
চলো৷ কাজ তো মিটে গেলো৷
হ্যাঁ গুছাচ্ছি৷
বাবু তুই থাক৷
মানে?
মানে রনিত এখানে থাকবে৷ ওর ভর্তি তো হয়ে গেছে৷ স্কুল যতদিন না খোলে থাকবে ঠামির কাছে৷
আর স্পোকেন ? টিউশন?
কদিন যাবেনা৷ মায়ের ভালো লাগবে৷ তোমার তো আর ছুটি নেই৷ চলো আমরা ফিরি৷
থ্যাঙ্কস মা৷
না বাবু৷ তোর যতদিন ভালো লাগে তুই থাক৷ ঠামি কে জ্বালাবি না৷ পারলে ফেরার সময় ঠামিকে নিয়ে ফিরিস৷ আর হ্যাঁ তোর মন যা চায় কর বাবু৷ ডাক্তার না হবি হবিনা ৷ তোর যেটা মন চায়৷
লাভ ইউ মা৷
মা আমরা আসি৷
এসো বৌমা দুগ্গা দুগ্গা ৷ ভালোভাবে যেও৷
আপনি অমত করবেন না, বাবুকে নিয়ে চলে আসবেন কোলকাতা ৷
শশুরের ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে রুপালী নমস্কার করে মনে মনে বলে বাবা আপনি আমার সন্তান কে বাঁচিয়েছে৷ সেদিন স্বপ্নে আপনি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন৷ রনিত কে আশীবার্দ করবেন ও যেন মানুষ হয়৷
সমাপ্ত