Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#আমি অপার হয়ে বসে আছি...পারে লয়ে যাও আমায়#সুস্মিতা
 পার্কের দোলনায় একবার উঠলে কিছুতেই আর নামতে চায়না টিকলি।  ঠাকুমা সুভদ্রা নাতনিকে অনেকক্ষণ ধরে ডেকেই চলেছেন- "সন্ধে হয়ে যাচ্ছে টিকলি, এবার বাড়ি চলো সোনা, মা কিন্তু রাগ করবে।&q…

 


#আমি অপার হয়ে বসে আছি...পারে লয়ে যাও আমায়

#সুস্মিতা


 পার্কের দোলনায় একবার উঠলে কিছুতেই আর নামতে চায়না টিকলি। 

 ঠাকুমা সুভদ্রা নাতনিকে অনেকক্ষণ ধরে ডেকেই চলেছেন- "সন্ধে হয়ে যাচ্ছে টিকলি, এবার বাড়ি চলো সোনা, মা কিন্তু রাগ করবে।" কিন্তু কে শোনে কার কথা। 

বিকেল পাঁচটা নাগাদ প্রায় রোজই নাতনিকে নিয়ে পাড়ার পার্কে বেড়াতে আসেন সুভদ্রা। আর প্রত্যেকদিনই বাড়ি ফেরার সময় বায়না করে টিকলি। ওর খেলা আর শেষ হতেই চায়না।


 এখানেই মাঝেমধ্যে দেখা হয়ে যায় পাড়ার আরও দুচারজন মহিলার সঙ্গে। তারমধ্যে উজ্জয়িনীর সঙ্গে প্রায় রোজই। বয়সে সুভদ্রার থেকে বেশ কিছুটা ছোট হলেও মেয়েটি সুভদ্রার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে বেশ আগ্রহ দেখায়। সুভদ্রা নিজেকে বড্ড গুটিয়ে রাখেন। তার ভয় করে। "বন্ধুত্ব" "ভালোবাসা" শব্দগুলোকে তার খুব ভয় করে আজকাল। শব্দগুলো বড় ভারী। পুরোনো আমলের মানুষ সুভদ্রা এই যুগের বন্ধুত্ব ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। নিজের স্বভাব অনুযায়ী তার মনে হয় বন্ধুত্বের, ভালোবাসার কিছু দাবি দাওয়া থাকে। দু তরফ থেকেই সেগুলো না মেটাতে পারলে তার অনিবার্য পরিণতি ভুল বোঝাবুঝি। বড় আঘাত, বড় যন্ত্রণা সেই বোঝাপড়ার অভাবে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। বয়স হচ্ছে সুভদ্রার। এই জীবনে আর নতুন কোনও ব্যাথা তিনি নিতে পারবেন না। নিজের হৃদয়কে নিজের কাছে সযত্নে আগলে রাখেন তিনি। 


আজও দেখা হল উজ্জয়িনীর সঙ্গে।


 "ঠামি, ওই আন্টিটা বুঝি তোমার বেস্টফ্রেন্ড? বলো না প্লিজ...আমার থেকেও বেশি বন্ধু?"

সাত বছরের নাতনি টিকলির হাত ধরে পার্ক থেকে বাড়ির দিকে ফিরছিলেন সুভদ্রা। আকাশে তখন গোধূলির মায়াবী আলো। বিকেল আর সন্ধের মাঝামাঝি সন্ধিক্ষণ।

সুভদ্রার বয়সটাও এখন জীবনের দ্বিতীয় বয়সন্ধিতে। যৌবন প্রায় চলেই গিয়েছে, বার্ধক্য এসে গেল বলে...দরজায় কড়া নাড়ছে। সে দরজা বন্ধ রাখার জন্য প্রৌঢ়ত্বের কি সংগ্রাম। বার্ধক্যকে বড্ড ভয় করে সুভদ্রার।

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি দেখেছেন- বার্ধক্য একটা চেনা মানুষকে একেবারে অন্য মানুষ করে দিতে পারে। যেন একটা অন্য জীবন। সে জীবন দয়ালু না হলে বার্ধক্যে একটা মানুষের সদর্থক তেজ, দাপট, ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মানবোধ সবকিছুই ধুলোর গড়ের মতো মাটিতে মিশে যায়।

সত্যি ভয় করে সুভদ্রার। আগামী বার্ধক্যের দুশ্চিন্তা তার মনকে সত্যিই বড় ভারাক্রান্ত করে। প্রৌঢ়ত্বের এও এক জ্বালা।


মাঝেমাঝে স্বামী দিব্যেন্দুকে তার খুব হিংসে হয়। কি সুন্দর স্বার্থপরের মতো একাএকা রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। একেবারে পারফেক্ট টাইমিং। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর একটা বছর হই হই করে ছুটি উপভোগ করল দিব্যেন্দু। তারপরে দ্বিতীয় বছরেই সুভদ্রাকে একা ফেলে রেখে...। 

  চলে যাওয়ার আগে বিদায় জানানোর সৌজন্যটুকুও দেখাল না স্ত্রীকে। রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই চিরঘুমের দেশে পারি দিয়েছিলেন তিনি। বার্ধক্যের একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা, অসহায়ত্ব, অপমান তাকে সহ্য করতে হয়নি। 

এসব কথা ভাবলেই অভিমানে চোখ ভরে যায় জলে। কিন্তু চাইলেই তো আর ভুলে থাকা যায়না। নিজের খেয়ালে মন স্মৃতিতে ডুব দেয়। আর এভাবেই নানা দুঃখের স্মৃতি সুভদ্রাকে বড় জর্জরিত করে।


"জানো ঠামি, রুবাই কিন্তু খুব দুষ্টু মেয়ে, ও আমাকে কখনও খেলায় নিতে চায়না। আজও আমাকে রুবাই খুব জোরে ধাক্কা দিলো। ঠামি, তুমি তো আমার ঠামি...তুমি কিন্তু রুবাইকে কক্ষনো ভালোবাসবে না, আদর করবে না, কথাও বলবে না কেমন।" 


সুভদ্রা একটু চুপ করে থাকলেন। দু এক মুহূর্ত একটু ভাবলেন। এও বুঝি বন্ধুত্বের এক দাবি। সত্যি তো বন্ধুকে কেউ কষ্ট দিলে কি তার সঙ্গে আর কথা বলা যায়। কার দোষ? কে ঠিক কে ভুল এসব কি বিচার করা যায়? "আমার বন্ধুকে কষ্ট দিয়েছে, অতএব হোক তার নির্বাসন।" প্রকৃত বন্ধুত্ব কিন্তু এই অন্ধত্বটুকু দাবি করে। 


যত দিন যাচ্ছে একটা ভয় ক্রমশ গ্রাস করছে সুভদ্রাকে। মনোনিজ্ঞানের ভাষায় এই ভয়টার কি নাম কে জানে? কিছু  একটা ফোবিয়া হবে হয়ত। 

কিসের ভয়? 

মাঝেমাঝে নিজের কাছে স্বীকার করতেও ভয় করে- "সুভদ্রার আজকাল মানুষকে বড় ভয় করে, যে কোনও মানুষকে, মানুষের সঙ্গে সম্পর্ককে...সম্পর্কের রং বদলকে বড্ড ভয় করে।" 

যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্বের দিকে দিকে এগোতে এগোতেই সুভদ্রা টের পেয়েছেন- "বয়স যত বাড়ে, মানুষের জীবনে বিচ্ছেদের ইতিহাস তত লম্বা হয়। সব বিচ্ছেদের কারণ কিন্তু মৃত্যু নয়। সম্পর্কের জটিল গোলকধাঁধায় হারিয়ে যায় কত মানুষ।

যৌবনের একটা নিজস্ব তেজ, একটা শক্তি আছে। বিচ্ছেদবেদনা, আঘাত, অপমান সে সইতে পারে। কত কাজ থাকে তখন জীবনে। কর্মব্যস্ততা অনেক দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।

কিন্তু প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য বড় একা, অসীম শূন্যতা। অবসাদ এসে বাসা বাঁধে মনে। এই সীমাহীন মনখারাপ আর অবসাদকে বড্ড ভয় করে সুভদ্রার। কে সহ্য করবে তার এই মানসিক বিলাসকে? বার্ধক্যের অবসাদকে। কেউ করেনা...কেউ কারুকে বোঝেনা। তিনি নিজেও কি বোঝেন অন্যের মনের ভাষা? সব মানুষই আদতে বড় একা। এই জীবনে সত্যিকারের বন্ধুত্বের শখ, স্বপ্ন, আশা সবই নিভে গিয়েছে সুভদ্রার।


টিকলি আবার ঠামির হাত ধরে টান দিয়ে বলে- "ও ঠামি, বলো না প্লিজ, ওই আন্টিটা কি সত্যিসত্যি তোমার বেস্টফ্রেন্ড? যখনই দেখা হয় তখনই তোমার হাত দুটো ধরে কি সুন্দর করে কথা বলে।"


সুভদ্রা এবারও চুপ করে থাকেন, কোনও উত্তর দেন না। পার্কের নুড়ি পাথরগুলোর ওপরে সন্তর্পণে পা ফেলতে ফেলতে কি যেন ভাবছেন তিনি- " বন্ধু? বেস্টফ্রেন্ড? শব্দগুলো জীবন থেকে কেমন হারিয়ে গেল।সত্যিই তো কি বন্ধুহীন আজকের এই জীবন। 


টিকলি কিন্তু বকবক করেই চলেছে। ঠামির কাছ থেকে জবাব না পাওয়া পর্যন্ত ওর শান্তি নেই। "আচ্ছা ঠামি এই আন্টিটাই তো রোজ তোমাকে ফোনে কি সুন্দর সুন্দর মেসেজ পাঠায়, ফোন  করে, তাই না?"


নাতনির কথা শুনে সুভদ্রার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলে গেল। ঠিকই তো বলছে টিকলি।  আজকাল বোধহয় ওয়াটসআপে দৈনন্দিন শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানোটাই বন্ধুত্ব। তিনি নিজেও তো পাঠান কতজনকে, নিয়মিত। কিন্তু কেউ কি কারুর হৃদয়ের ভাষা টের পায়? বুঝতে পারে একে অপরের নৈশব্দের বাঙময়তা? একজনের কষ্ট অন্যজনের বুকে বাজে? একজন আরেকজনের হয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়?

শৈশবে জেনেছিলেন- শ্মশানে, রাজদ্বারে যে সঙ্গে থাকে, সেই প্রকৃত বন্ধু। আজকাল সেরকম হয়?


কোনও প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে পেলেন না সুভদ্রা।  কথা ঘোরানোর জন্য   বলে উঠলেন-  "তাড়াতাড়ি পা চালাও টিকলি, দেখ তো কত দেরি হয়ে গেল। আজ স্কুল থেকে কত হোম ওয়ার্ক দিয়েছে ম্যাডাম। ঠিক সময়ে সেসব শেষ না করলে মা কিন্তু খুব রাগ করবে।"


হোমওয়ার্কের কথায় একটু যেন ঘাবড়ে গেল সাত বছরের শিশুটি। ঠামির হাতদুটো জড়িয়ে ছলছল চোখে সে বলে উঠল- "ঠামি তুমি তো আমার বেস্টফ্রেন্ড। তুমি কিন্তু মাকে বলে দেবে না, আমি পার্কের স্যুইংয়ে অনেক দেরি করে ফেলেছি। প্লিজ ঠামি প্লিজ।"

টিকলিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন সুভদ্রা।


 বাড়ির দরজায় কলিংবেল বাজাতেই গম্ভীর মুখে দরজা খুলে দিলো বৌমা তিলোত্তমা। ওর এই রাগী মুখটা দেখলেই ভেতরে ভেতরে বড্ড কুঁকড়ে যান সুভদ্রা। ভয়ের অনুভূতিটা টের পান তিনি। অল্পবয়সী মানুষদের বড্ড ভয় করে আজকাল। কখন যে কোন কাজে ভুল হয়ে যায়। ছোটদের কাছ থেকে আঘাত পাওয়ার ভয়, অপমানিত হওয়ার ভয়।


ঠান্ডা গলায় বলে উঠল তিলোত্তমা- "আপনার তো একটা আক্কেল আছে মা, টিকলি নাহয় অবুঝ, অন্ধকার হয়ে গিয়েছে...টিকলির কাল স্কুল আছে, এতগুলো হোমওয়ার্ক বাকি...আপনার পার্কে বেড়ানো আর শেষ হয়না।"


 টিকলি তখনও সুভদ্রার হাতটা ছাড়েনি। তারও ভয় করছে। মাকে বড্ড ভয় করে টিকলিরও। 

 নাতনির হাতটা আরেকটু শক্ত করে নিজের মুঠোয় ধরে সুভদ্রা বললেন- "সত্যি বৌমা আমার জন্যই দেরি হয়ে গেল...টিকলি আজ একটুও বায়না করেনি। তাড়াতাড়িই ফিরছিলাম গো আমরা...হঠাৎ পাথরে ঠোকর খেয়ে এমন হোঁচট খেলাম আমি...টিকলি সোনা সঙ্গে না থাকলে আজ তো হাড়গোড় ভেঙেই যেত আমার। লোকজন ছুটে এসে আবার বেঞ্চে বসালো আমাকে, জল টল  খাওয়ালো। আধঘণ্টা সময় তো ওইভাবেই নষ্ট হয়ে গেল।"

সাজিয়ে গুছিয়ে কতগুলো বলার সঙ্গেসঙ্গেই ঠামি আর নাতনির চোখে চোখে একটা দুষ্টুমির ঝিলিক খেলে গেল। সেই ঝিলিকটার নাম বন্ধুত্ব। সেই ঝিলিকটার নাম ভরসা, বিশ্বাস।


তিলোত্তমা মেয়ের হাত ধরে ভেতরে চলে গেল। সত্যি এখন ওদের অনেক কাজ। হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসাতে হবে টিকলিকে।


ক্লান্ত পায়ে ঠাকুরঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন সুভদ্রা। সন্ধ্যাবাতি জ্বালিয়ে একটু জপ করতে বসবেন।


ঠাকুরের মূর্তির সামনে বসে কিছুতেই আজ স্থির হতে পারছেন না সুভদ্রা। বারবারই নিজের মনকে প্রশ্ন করছেন তিনি- "কাজটা কি ঠিক হল আজ? ছোট শিশুটির সামনে এই মিথ্যাচার? টিকলি যদি এইভাবে মিথ্যা বলতে শেখে, তবে কি হবে? বড়দের দেখেই তো ওরা শেখে।"

বিগ্রহের চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন সুভদ্রা। "হে ঈশ্বর  উত্তর দাও, পথ দেখাও প্রভু।" বুকের মধ্যে বড় আলোড়ন চলছে। ঠিক ভুল ন্যায় অন্যায়ের দ্বন্দ্ব। কিছু ভাবতে পারছেন না প্রৌঢ়া ঠামি।


 ঠাকুরের সামনে আসনে বসে সুভদ্রা শুধু অনুভব করতে থাকেন তার হাতের মধ্যে টিকলির কচি হাতের মুঠি। শিশুটি তার দু চোখের করুণ দৃষ্টি দিয়ে বলছে- "বেস্টফ্রেন্ড তুমি কিন্তু মাকে বলে দিওনা আমার দুষ্টুমির কথা...মা তাহলে আমাকে খুব বকবে।"


দুচোখ বেয়ে  জলের ধারায় ভাসতে থাকেন সুভদ্রা। সত্যিই তো বন্ধুত্ব, ভালোবাসা কি অত ন্যায়-অন্যায় ঠিক-ভুলের নিয়ম মেনে হয়। বন্ধুত্বের তো একেবারে নিজস্ব কিছু দাবি থাকে। 

বার্ধক্যের  দোরগোড়ায় পৌঁছে নাতনি টিকলিটা ছাড়া সুভদ্রার জীবনে যে আর কোনও কাছের মানুষ নেই। সাত বছরের বাচ্চাটাই তো তার একমাত্র বন্ধু। বেস্টফ্রেণ্ডের আব্দার কি অস্বীকার করা যায়? তাকে কি কষ্ট দেওয়া যায়? 


তবু ভয় করে সুভদ্রার। বড় ভয়... সংসারে অশান্তির ভয়। সম্পর্কে ফাটল ধরার ভয়...বুকের মধ্যে চেপে বসে ভয়।


বিগ্রহের চোখের দিকে তাকিয়ে আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে গান গেয়ে ওঠেন সুভদ্রা...গেয়ে ওঠেন লালন সাঁইয়ের সেই হৃদয় নিংড়ানো গান- "আমি অপার হয়ে বসে আছি...ওহে দয়াময়...পারে লয়ে যাও আমায়।"


*********