Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

।। ভালোবাসার গল্প।।।। সুনির্মল বসু।।
দুধেল জ্যোৎস্না ধোয়া রাত্রি। আকাশে বাঁকা চাঁদ। দূরে ঝাউবন। শালবনে অরণ্য পাখির ডানা ঝাপটানো। গভীর জঙ্গলে সোম শেখর পাহাড়িয়া রাস্তায় ল্যান্ড রোভার জিপ চালিয়ে যাচ্ছিল। সঙ্গে ওর সদ্য বিবাহিতা স…

 


।। ভালোবাসার গল্প।।

।। সুনির্মল বসু।।


দুধেল জ্যোৎস্না ধোয়া রাত্রি। আকাশে বাঁকা চাঁদ। দূরে ঝাউবন। শালবনে অরণ্য পাখির ডানা ঝাপটানো। গভীর জঙ্গলে সোম শেখর পাহাড়িয়া রাস্তায় ল্যান্ড রোভার জিপ চালিয়ে যাচ্ছিল। সঙ্গে ওর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী মধুরিমা।


সোম শেখর এই ফরেস্টের রেঞ্জার। মধুরিমা শহরের মেয়ে। এই প্রথম এমন গভীর জঙ্গলে ওর প্রথম আসা। এমন গভীর জঙ্গল, এমন সবুজ বনানী, শহরে বসে ভাবা যায় না। চন্দন ওকে ছেড়ে চলে যাবার পর, প্রবল বিষন্নতা ঘিরে ধরেছিল মধুরিমাকে। তাই মা বাবা যখন এখানে বিয়ে ঠিক করলেন, ও আপত্তি করেনি। পাঁচ বছর ধরে ভালোবেসে, বিয়ের আশ্বাস দিয়ে এভাবে চন্দন ওকে একলা ফেলে রেখে চলে যাবে, মধুরিমা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি। 


হৃদয়ের এই ক্ষত ভুলে যাওয়া সহজ নয়। চন্দন সুযোগসন্ধানী, প্রবল স্বার্থপর। এখন বড়লোকের মেয়ে বিয়ে করে, চাকরি বাগিয়ে সুখে সংসার করছে। মধুরিমা ভাবে, সকলে ভালোবাসার মূল্য বুঝতে পারে না, আর অংক করে ভালবাসতে শেখে নি ও।

পাহাড়ের পাকদণ্ডী পথ পেরিয়ে সোমশেখর গাড়ি চালাচ্ছিল, হঠাৎ মধুরিমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,

তোমার ভালো লাগছে তো,

হুঁ,

তুমি কলকাতায় থাকা মানুষ, প্রথম প্রথম অসুবিধা হবে, পরে মানিয়ে যাবে।

মধুরিমা এমনিতেই যথেষ্ট সুন্দরী। আজ আবার বরের সঙ্গে বেরোবার সময় দারুন সেজেছে। ও বলল, ভালো লাগছে, এখানে শহরের কোলাহল নেই।

পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছো,

হুঁ,

চাঁদটাকে কি শান্ত দেখাচ্ছে,

আমি পাহাড়ে চাঁদ দেখি নি কোনদিন,

গাছের ফাঁক দিয়ে তারা দেখা যাচ্ছে,

ভারী সুন্দর তো,

কাঁঠালি চাঁপা ফুলের গন্ধ পাচ্ছো,

হ্যাঁ, এই এগুলো কি গাছ,

দোলনচাঁপা,

আহ, ভারি সুন্দর তো,

তোমার ভাল লাগছে,

খুব,

আমাদের বাড়ির জানালা দিয়ে লোটা পাহাড় দেখা যায়,

তাই বুঝি,

হ্যাঁ তুমি ঝর্ণাও দেখতে পাবে, তোমাকে একদিন নিয়ে যাবো,

জায়গাটা ভারী নির্জন,

নির্জনতার আলাদা পরিভাষা আছে, দেখতে দেখতে ভালো লেগে যাবে,

আমারতো প্রথম দিনেই ভালো লেগে গেছে,

তোমার শীত করছে,

নাতো,

গভীর অরণ্যে সোম শেখর অর্জুন গাছের পাশে গাড়ি দাঁড় করালো। 


পাহাড়ের ঢালপথে দাঁড়িয়ে রাতের জ্যোৎসনা দেখল। নীল নিবিড় গাছগাছালির ভিড়ে তখন বন ময়ূর সেগুন গাছের মাথায় বসে ছিল। এভাবেই অনেকটা সময় কেটে যায়। হিমেল বাতাস বয়ে যায়। একসময় ওরা গাড়িতে উঠে পড়ে। 

সোম শেখর স্টিয়ারিং এ হাত রেখে গাড়ি স্টার্ট করে। পাহাড়িয়া পথে ল্যান্ড রোভার এগিয়ে চলে।


মধুরিমার চন্দনের কথা মনে পড়ছিল। চন্দন কলেজে ওর দু বছরের সিনিয়র। দারুন সপ্রতিভ, অতিশয় সুদর্শন। ওর বান্ধবী প্রিয়ার দাদা। ওদের বাড়িতেই চন্দনের সঙ্গে প্রথম মধুরিমার আলাপ।

তারপর চন্দন ওকে একদিন ভালোবাসার কথা জানায়। মধুরিমা সময় চায়, ভেবে দেখার।


এরপর একদিন চন্দন ওকে কফি হাউসে দেখা করতে বলে,

মধুরিমা কফিহাউসের পৌছে রবি ঠাকুরের ছবির সামনে চন্দনকে বসে থাকতে দ্যাখে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। মধুরিমা সামনে যেতেই চন্দন হেসে বলে, এসো, তোমার আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো,

না,

তাহলে কি ডিসিশন নিলে,

বাড়ি থেকে বিয়ের কথা ভাবা হচ্ছে না,

তুমি কি ভাবছো,

আগে পড়াশোনা কমপ্লিট হোক,

আমি কি ওয়েট করব,

এ ব্যাপারে আমি এখনই কিছু ভাবি নি,

চন্দন বলেছিল, কিন্তু আমি যে তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি,

চন্দনের আসল চেহারাটা বুঝতে অনেকটা সময় লেগেছিল মধুরিমার।


সোম শেখর অনেকক্ষণ মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল, হঠাৎ বলল, এই, চুপচাপ যে,

এমনি,

কি ভাবছো,

কিছু না,

বাড়ির জন্য মন খারাপ,

না না,

আমাকে তোমার ভালো লাগেনি,

হ্যাঁতো,

আর, এই জায়গাটা,

ভারী সুন্দর,

থাকতে থাকতে ভাল লেগে যাবে,

আপনি খুব গাছপালা ভালোবাসেন, না।

আপনি নয়, তুমি। হ্যাঁ ,প্রকৃতি আমার খুব প্রিয়।

তাই,

সকাল হলে দেখতে পাবে কত বনফুল ,কত রকমের পাখি,

প্রকৃতি বন্ধু হলে কেমন লাগে,

মনটা পবিত্র হয়,

আর,

মনটা শিশুর মত হয়, শহরে এ সব পাওয়া যাবে না,

ঠিক বলেছো, শহরে মেকি মানুষের ভিড়,

আমি সরল মানুষ ভালবাসি, প্রকৃতির মধ্যে সেই সরলতা পাই, এখানকার আদিবাসী মানুষেরা আমায় ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে।


মধুরিমা সোম শেখরের কোলে হাত রাখলো।

কিছু বলবে,

না,

মনে মনে বলল, এমন স্বপ্নময় পুরুষ ঈশ্বরের আশীর্বাদে মেলে,

আমাকে ভালবাসবে তো তুমি,

মধুরিমা বলল, বাসি তো,

সোম শেখর বললো, আমি কবিতা ভালোবাসি। কিছু লিখেছিও কবিতা। তুমি সঙ্গে থাকো, জীবনটাকে আমি কবিতার খাতা বানিয়ে তুলবো,

তাই বুঝি,

মধুরিমা, তুমি আমার কবিতা হবে,

ওদের গাড়িটা তখন একটা ঝর্নারপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। মধুরিমা ভাবল,চন্দনের মত চালিয়াত স্বার্থপর পুরুষ এই ভালোবাসার মূল্য বুঝবে না।


মধুরিমা মনে মনে বলল, আমি প্রতিদিন তোমার কাছে বারে বারে নতুন হয়ে আসবো,

সোম শেখর বলল, আমি কবিতার স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে চাই, তুমি সঙ্গে থেকো,

ততক্ষনে ওরা ওদের বাংলায় ফিরে এলো। গেটে দারোয়ান ওদের দুজনকে স্যাল্যুট জানালো।

সোমশেখর বলল, তোমাদের মালকিন।

দারোয়ান  মধুরিমাকে

 বলল, রেঞ্জার সাব বহুৎ আচ্ছা আদমী আছে, এরিয়ার লোক ওনাকে ভগমান মানে।


মানুষটার জন্য মনে মনে গর্ব হলো মধুরিমার। এই স্বপ্নময় পুরুষটির সঙ্গে সুন্দর একটা মনের মত সংসার রচনা করছে হবে ওকে। এমন মহার্ঘ মানুষটিকে সুখী করাই হবে ওর একমাত্র কাজ।

নীল পর্দা সরিয়ে মধুরিমা ঘরে ঢুকলো।


সোম শেখর গাড়ি গ্যারেজ করে ঘরে ঢুকে মধুরিমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, তোমাকে আমি কবিতা বলে ডাকবো, তোমার আপত্তি নেই তো,

মধুরিমা বলল, কেন,

সোম শেখর বললো, আমার জীবনে এতদিন ছন্দ ছিল না, তুমি এলে, ছন্দ এলো, তুমি আমার কাছে কবিতা ছাড়া আর কি,

মধুরিমা তখন গভীর আবেগে স্বামীর বুকে মুখ রেখে গভীর আবেগে, প্রবল ভালবাসার সুখে কেঁদে ফেললো। 


এই প্রথম ও অনুভব করল, ওর জীবনে এমন সুখের কান্না অপেক্ষা করেছিল, মধুরিমার জানা ছিল না।