Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

শ্রী শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভু : এক অনন্ত মহা জিজ্ঞাসা

।। রথযাত্রা উপলক্ষে বিশেষ নিবন্ধ ।।=====================

শ্রী শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভু : এক অনন্ত মহা জিজ্ঞাসা
✍️ *সোমনাথ মুখোপাধ্যায়* 
আজ ১২ই জুলাই। শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের পবিত্র রথযাত্রা। করোনা অতিমারি আবহে সর্বত্রই বিধিনিষেধের বেড়া…

 

।। রথযাত্রা উপলক্ষে বিশেষ নিবন্ধ ।।

=====================



শ্রী শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভু : এক অনন্ত মহা জিজ্ঞাসা


✍️ *সোমনাথ মুখোপাধ্যায়* 


আজ ১২ই জুলাই। শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের পবিত্র রথযাত্রা। করোনা অতিমারি আবহে সর্বত্রই বিধিনিষেধের বেড়া। পুরীতে লক্ষ লক্ষ ভক্তদের উপস্থিতিতে রথযাত্রার পরিচিত দৃশ্য এবারে দেখা যাবে না। তবু প্রাচীন রীতি মেনেই রথযাত্রা হবে। প্রাচীনতার নিরিখে সবথেকে জনপ্রিয় পুরীর রথযাত্রা। জগন্নাথ মহাপ্রভু সেজেগুজে রথে চড়ে গুন্ডিচা মন্দির (মাসির বাড়ি বলে খ্যাত) যাবেন। ভালো মন্দ খাবেন। পুজো হবে। নিয়ম রীতি মেনে হবে নানাবিধ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান।

পুরী যাননি এমন ব্যক্তি বিরল। তবু রথযাত্রা উপলক্ষে আরো একবার ফিরে দেখা শ্রীক্ষেত্রের শ্রী মন্দির। ফিরে দেখা সেই মন্দিরে অধিষ্ঠিত জগন্নাথ মহাপ্রভুকে। শ্রীক্ষেত্র পুরীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী বিমলা। তাঁর ভৈরব স্বয়ং জগন্নাথ। দুর্গা পুজোর নবমীতে এখানে বলি হয়। তাই পুরী যেমন বৈষ্ণবক্ষেত্র, তেমনি শক্তিপীঠ বটে! 


প্রথমে আসা যাক মন্দিরের কথায়। যে মন্দির বর্তমানে দেখা যায় সেটি আনুমানিক ১০৪২ থেকে ১১৪২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত হয়েছে। ওড়িশার রাজা অনঙ্গ ভীমদেবের শাসনকালে। চারটি প্রবেশদ্বার মন্দিরে। পূর্বে সিংহদ্বার, পশ্চিমে ব্যাঘ্রদ্বার, উত্তরে হস্তিদ্বার ও দক্ষিণে অশ্বদ্বার। চারটি দরজার দ্বাররক্ষক চার হনুমান। বর্গী হনুমান, ফতে হনুমান, তপস্বী হনুমান ও কানপাতা হনুমান। তিনি কান পেতে আছেন সমুদ্রের গর্জন যেন না প্রবেশ করে মন্দিরে! মন্দির ঘিরে আছে এক বিশেষ শব্দ নিরোধক প্রাচীর যা মেঘনাদ বলে খ্যাত। 

মন্দির বিভক্ত চারটি ভাগে। বিমান, মুখশালা, ভোগমন্ডপ ও জগমোহন। আছে রান্নাঘর, যেখানে মাটির তৈরি হাঁড়ির ওপর হাঁড়ি বসিয়ে তৈরি হয় নানাবিধ পদ। একটি অদ্ভুত ব্যাপার শোনা যায়। রান্নার কোনো গন্ধ পাওয়া যায় না! একমাত্র ভোগ নিবেদনের পরই গন্ধ পাওয়া যায়। কথিত স্বয়ং লক্ষ্মী দেবীর তত্ত্বাবধানে রান্না হয়!

আর আছে আনন্দবাজার। এক বিশাল ফুডকোর্ট। জগন্নাথ দেবের প্রসাদ মেলে এখানে। মন্দির চূড়ায় আছে নীলচক্র। গর্ভগৃহে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা আসীন রত্নবেদীতে। কথিত ১০০৮টি মতান্তরে ১০৮টি শালগ্রাম শিলা এই বেদীতে প্রোথিত। জগন্নাথের বামদিকে দন্ডায়মান সুদর্শন।


এবারে আসা যাক রথের কথায়। এই রথযাত্রার কথা পাওয়া যায় ব্রহ্মপুরাণ, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণে। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার তিনটি আলাদা রথ। জগন্নাথের রথ নন্দীঘোষ বা গরুড়ধ্বজ। রথে ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন ধরনের ২০৬টি কাঠের টুকরো। লক্ষ্যণীয় মানব দেহে হাড়ের সংখ্যা কিন্তু ওই ২০৬টি! লাল ও হলুদ কাপড়ে রথ আচ্ছাদিত। চাকার সংখ্যা ষোল যা কিনা দশ ইন্দ্রিয় ছয় রিপুকে ইঙ্গিত করে! অর্থাৎ সব তাঁর অধীনস্থ। রথের রক্ষক গরুড়। সারথী দারুক। শঙ্খ, বল্হুক, শ্বেতা ও হরিদাশ্ব নামে চারটি সাদা ঘোড়া রথ টানছে। 


বলরামের রথ তালধ্বজ বা লাঙ্গলধ্বজ। লাল ও নীলাভ সবুজ কাপড়ে আচ্ছাদিত। চাকার সংখ্যা চোদ্দ যা কিনা চোদ্দ ভুবনকে ইঙ্গিত করে। রথের রক্ষক বাসুদেব। সারথী মাতলী। রথ টানছে তীব্র, ঘোরা, দীর্ঘশর্মা ও স্বর্ণনাভ নামে চারটি কালো ঘোড়া।


সুভদ্রার রথ দর্পদলণ বা পদ্মধ্বজ। লাল ও কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত। চাকার সংখ্যা বারো যা কিনা বারো মাস ভক্তি সহকারে ভজনের ইঙ্গিতবাহী। রথের রক্ষক জয়দুর্গা। সারথী অর্জুন। রথ টানছে রোচিকা, মোচিকা, জিতা ও অপরাজিতা নামে চারটি লাল ঘোড়া।

কিংবদন্তি যে একবার রথ কিছুতেই এগিয়ে যেতে পারছিল না। হাতি দিয়েও তাকে বিন্দুমাত্র নাড়ানো গেল না। তৎকালীন পুরীতে অবস্থান করছিলেন চৈতন্য মহাপ্রভু। তিনি এসে মাথা দিয়ে ঠেলতেই গড়াতে শুরু করেছিল রথের চাকা! 

বিষ্ণুপুরাণের কথায়, জগৎপালক নারায়ণ শৃঙ্গার করেন বদ্রীনারায়ণ ক্ষেত্রে। আহারাদি করেন নীলাচল পুরীতে। দিনে পাঁচ বার ভোগ নিবেদন করা হয় তাঁকে। ছাপ্পান্ন পদ। কম কথা নয়! সেবা চলে ছত্রিশ রকমের। রাজা গজপতি দিব্যসিংহের স্বর্ণ সম্মার্জনি দ্বারা ধূলি প্রক্ষালণ তেমনি এক সেবা।


এবার একটু অন্য দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ। প্রতি বারো বা তেরো বছর অন্তর নবকলেবর হয় জগন্নাথ মহাপ্রভুর। নতুন মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন প্রবীণ পুরোহিত ব্রাহ্মণ। চোখ বেঁধে কোনো এক রহস্যময় বস্তু পুরনো মূর্তির থেকে নিয়ে নতুন মূর্তির ভিতরে স্থাপন করা হয়। পুরনো মূর্তি সমাধিস্থ করা হয় তুলসীবনে। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন মন্দির সহ সমস্ত পুরী থাকে নিষ্প্রদীপ। এ এক রহস্য। কী সেই বস্তু যা মূর্তিতে স্থাপন করা হয়? কেউ বলে শালগ্রাম শিলা। কেউ বলে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের নাভিপদ্ম! যেটি প্রভাসে শ্রীকৃষ্ণের দেহরক্ষার পর নিমকাঠের প্রকোষ্ঠে সাগরে ভেসে ঠেকেছিল নীলাচলে। সেটিই জগন্নাথের মূর্তির ভিতরে আছে। যেটাই হোক, এর পোষাকী নাম ব্রহ্মবস্তু। কেউই সঠিক জানে না। সবটাই অনুমান। কিছু রহস্য বোধহয় থাকাই ভালো! আসলে জগন্নাথ মহাপ্রভু যে চিরকালীন এক অনন্ত মহা জিজ্ঞাসা! কথিত যে এই ব্রহ্মবস্তু স্থাপনের পর সেই পুরোহিত আর বেশি দিন ইহলোকে থাকেন না!  


নিমকাঠে তৈরি হয় জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি। দারুব্রহ্ম রূপে জগন্নাথ মহাপ্রভু এক পরম আনন্দময় রূপ। তিনিই সচ্চিদানন্দ স্বরূপ পরম ব্রহ্ম। তিনিই পরমাগতি। তিনিই সব। তিনি অনাদির আদি গোবিন্দ। তিনিই স্বয়ং শ্রীহরি। দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণ সেই তিনিই। তিনিই নিত্য, সত্য, পরম ব্রহ্ম। একমেবাদ্বিতীয়ম সর্বশক্তিমান ভগবান বিষ্ণুনারায়ণ। শ্রী শ্রী মদ্ভাগবৎ গীতায় তিনিই বলেছেন, "অহম্ একম্ দ্বিতীয় নাস্তি"। তিনিই এক ও অভিন্ন। তাঁর দ্বিতীয় নেই। হয় না। হবেও না। তিনিই সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে অবস্থান করছেন। আর তাঁর মধ্যেই সমগ্র সৃষ্টি বিরাজমান। চন্দ্র সূর্য রূপ বড়ো বড়ো দুই চোখ দিয়ে ভক্তদের আকুল আহ্বান করছেন! সেই প্রাণকাড়া আহ্বান এড়িয়ে যেতে পারে এমন সাধ্য কার!

সেই পরম আনন্দময় রূপের সমুখে প্রণিপাত-"জগন্নাথ স্বামী নয়নপথ গামী ভবতূমে"...