Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#স্বাধীনতার_ডাক#সুজাতা_দে
বিকাশবাবু অফিসের পি এফ থেকে সারাজীবনের জমানো টাকার বৃহদাংশ তুলে ফিরছিলেন ঘরে। উদ্দেশ্য ছিল দামী বিদেশি পাত্রটিকে মোটা টাকা পণ আর যৌতুকের দামী গহণা, আসবাব সামগ্রী দিয়ে কিনে নেবেন। নিজের মোটা-রঙময়লা অল্পশিক…

 


#স্বাধীনতার_ডাক

#সুজাতা_দে


বিকাশবাবু অফিসের পি এফ থেকে সারাজীবনের জমানো টাকার বৃহদাংশ তুলে ফিরছিলেন ঘরে। উদ্দেশ্য ছিল দামী বিদেশি পাত্রটিকে মোটা টাকা পণ আর যৌতুকের দামী গহণা, আসবাব সামগ্রী দিয়ে কিনে নেবেন। নিজের মোটা-রঙময়লা অল্পশিক্ষিতা,তৃতীয় কন্যাটিকে গছিয়ে দিতে পারলেই একটা গতি হয়ে যায় তার। কিন্তু দু দুটো ব্যাগ সামলে অতি সাবধান হতে গিয়ে  ব্যাঙ্কের খাম সমেত মোটা টাকার একটা  বান্ডিল পথেই খোয়া যায়। সাথে সাথে পুলিশ স্টেশনে ডায়েরি করেও কিছু সমাধান মেলেনি। পরদিন অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসে। ফোনে এক যুবকের প্রশ্ন, আপনার কিছু হারিয়েছে কি?ব্যাঙ্কে টাকা তোলার লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে গিয়ে  ভাগ্যিস আনমনে প্যাকেটের গায়ে নিজের মোবাইল  নম্বরটা লিখে রেখেছিলেন। যোগাযোগ করে সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার নিজেই বাড়ি বয়ে এসে সব টাকা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে যায়। 

বেতনের একটি পয়সাও না ছুঁয়ে সারাজীবন ঘুষের পয়সায় সংসার চালিয়েছেন বিকাশবাবু। পয়সার লালচ থাক২লেও ছেলেটিকে খুশি হয়ে কিছু টাকা বকশিস  দিতে গেলে সে নিতে অস্বীকার করে।

চোখটা কেন জানি ভিজে ওঠে কৃতজ্ঞতায়। বিকাশবাবু তার নাম জিজ্ঞেস করতেই সে বলে ওঠে তার নাম, স্বাধীন। 

নামটা শুনেই চমকে ওঠেন বিকাশবাবু। আজই তো স্বাধীনতা দিবস। মোহের শৃঙ্খল ছিঁড়ে স্বাধীন হবার দিন।

আজকের শুভ দিনে- শুধুই ধন্যবাদটুকু নিয়ে সৎ ছেলেটিকে ফিরে যেতে দেখে; আত্মগ্লানিতে তাঁর মনটা যেন শুদ্ধ হয়ে ওঠে। 


#


অর্থবান গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের মা হারা কিশোরী ঝুমা লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত। নেগেটিভ ও গ্রুপের রেয়ার ব্লাড সহজে মিলছে না। নামী নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ  শুধুমাত্র ডোনারের রক্তদানের বিনিময়েই ব্লাড যোগাড় করতে  রাজি হয়েছে। পয়সার বিনিময়েও ডোনার মিলছে না। শহরে এই গ্রুপের ব্লাড প্রায় অমিল। 

পরিবারের একমাত্র প্রিয় কন্যাটির প্রাণের সুরক্ষায় তার জ্যেঠিমা মলিনা দেবী বাড়িতে নিয়মিত যাগযজ্ঞ পূজাপাঠ ব্রাহ্মণভোজন  শুরু করে দিলেন।  সৌভাগ্যক্রমে ঝুমার জাঠতুতো দাদা প্রসূনের অফিস কলিগের ব্লাডগ্রুপ এক। তিনি ব্লাড ডোনেট করতে রাজি হলেন। তিনি নার্সিংহোমে ব্লাড ডোনেট করতেই ঝুমাকে একই গ্রুপের ব্লাড দিয়ে দিল নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ । চোখে মেলে চাইল ঝুমা। আপাতত তার প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা আর নেই। 

নার্সিংহোমের কম্পাউন্ডে অপেক্ষারত ঝুমার পরিবার। কিছু সময় বিশ্রাম  নিয়ে প্রসূনের সাথে ছেলেটি হাসিমুখে বেরিয়ে আসতেই মলিনা দেবী তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বেঁচে থাকো বাব। তোমার এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবার নয়। ছেলেটি হাসিমুখে বলে,  কি আর এমন করেছি মাসিমা! বিপদের দিনে মানুষের পাশে দাঁড়ানো; এতো মানুষেরই ধর্ম।

কৃতজ্ঞ মলিনা দেবী প্রশ্ন করেন, তা তোমার নামটি কি বাবা? 

আমি শাহনাজ মাসিমা, বলে তাঁর চরণ ছুঁয়ে প্রণাম করতে যায় ছেলেটি। সংস্কারে আবদ্ধ মন নিয়ে দুপা পিছিয়ে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন মলিনাদেবী।

 শাহনাজের থুতনি ছুঁয়ে মুখচুম্বন করতে গিয়ে তাঁর দুচোখে নেমে এল অশ্রধারা।

নার্সিংহোমের লনে ওদের কর্মীরা সেই মুহুর্তে ফ্লাগ উত্তোলন করে স্যালুট জানাচ্ছে। পতপত করে আকাশে উড়ছে ভারতের জয়পতাকা। 

পাশের স্কুল থেকে যেন ভেসে আসছে সমবেত স্টুডেন্টদের গাওয়া জাতীয় সঙ্গীতের সুর,"...তব শুভ নামে জাগে,তব শুভ আশিশ মাগে, তব জয় মঙ্গলগাথা..।"


#


কথায় কথায় খিল্লি আর  খিস্তিখেউড় করা পাড়ার গুন্ডা তোলাবাজ গৌরাঙ্গ আজ সবার চোখের মণি। 

মহামারি আজ কিছুটা আয়ত্তে। তাই পাড়ার ছেলেরা গৌরাঙ্গকে পনেরই আগষ্টের দিনে  দোলতলার মাঠে সম্বর্ধনা জানাতে চায়। তীব্র মহামারি আর লকডাউনের  সময়ে স্টোর করা চাল ডাল আর আটাকে মজুদদারদের হাত থেকে ভয় দেখিয়ে ছিনিয়ে এনে সাধারণ কর্মহীন মানুষ ফুটপাতবাসী সবাইকে অকাতরে বিলিয়েছে গৌরাঙ্গ। পাড়ার ছেলেদের সাহায্য নিয়ে নিজেরাই রান্না করেছে সব্জি মেশানো খিচুড়ি।  করোনা আক্রান্ত মানুষদের ঘরে ঘরে সব্জি মেশানো খিচুড়ি আর ডিমভাজা ভরে ইউজ এন্ড থ্রো খোপকাটা থালি পোঁছে দিয়ে এসেছে দুইবেলা। আজ এই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে এসেছেন বিশিষ্ট অতিথিরা এবং অর্থবান মানুষেরা। তাঁরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এগিয়ে এসে পাড়ার ক্লাব ফান্ডে মুক্তহাতে দান করেছে।

 ভীড় ঠেলে সাত বছরের বাবুসোনা বাবা মায়ের কোলে চেপে এসেছে গৌরাঙ্গ চাচাকে প্রাইজ দিতে। 

নিজহাতে ঝাঁটার কাঠি আর স্কুলের খাতা ছিঁড়ে প্যাস্টেল রঙ দিয়ে বানিয়ে এনেছে ভারতের জাতীয় পতাকা।  নিঃসন্তান পুলকবাবু আর রত্নাদেবী সদ্য পিতা মাতার পরিচয়ে পরিচিত হতে পেরে ধন্য। তা শুধু সম্ভব হয়েছে গৌরাঙ্গের জন্য। 

অন্য পাড়ার ছেলে বসির, মহামারি করোনাতে আব্বু আর আম্মিকে হারিয়ে অসহায়ভাবে অনাথের মতো  পাড়ার ক্লাবে দিন কাটাচ্ছিল। পুলকবাবুকে রাজি করিয়েছিল গৌরাঙ্গ। আইনি সহায়তায়  দত্তকপুত্র হিসাবে আজ সাত বছরের  বসির হয়ে উঠেছে ওঁদের আদরের সন্তান বাবুসোনা।

 পতাকা উত্তোলন পর্বের শেষে; সকলের আশীর্বাদ ও সম্বর্ধনা নিয়ে সভামঞ্চ থেকে নেমে এল গৌরাঙ্গ।  দুহাত বাড়ালো বাবুসোনার দিকে। বাবুসোনাকে কোলে তুলে নিয়ে  তার হাত থেকে ছোট্ট পতাকাটা নিয়ে উঁচু ক রে তুলে  ধরলো। গৌরাঙ্গ চুমো এঁকে দিল বাবুসোনার কপালে। সর্বসমক্ষের উদ্দ্যেশ্যে  বলে উঠল, এটাই আমার জীবনের সেরা পুরষ্কার। হাততালির ঝড় উঠল।সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।


#


কর্মক্ষেত্রে মদ খেয়ে চুর  হয়ে না থাকলে হিমঘরে লাশ নিয়ে কাজ করা যায়না। প্রায় গলতে পচতে থাকা লাশগুলো থেকে প্রচন্ড  দুর্গন্ধ বের হয়। মদ খেয়ে থাকলে লকারে সরকারি হাসপাতালের লাশগুলোকে সংরক্ষণে করতে অসুবিধা হয় না রুবাইয়ের। 

বাবার অকাল মৃত্যুতে পড়াশোনা ক্লাস এইটে এসে থেমে গেল। তখন বদলিতে লাশঘর সংরক্ষণের চাকরিটাতে অস্থায়ীভাবে  ঢুকিয়ে  দিয়েছিল অসুস্থ মেহেরচাচা। স্থায়ী কর্মচারীদের কেউ লম্বা ছুটি নিলেই ডাক পড়তো রুবাই এর। এইভাবেই একসময়  সরকারী হাসপাতালের লাশঘরের পাকা চাকরিটা হয়ে যায় রুবাইয়ের। শিশু অবস্থায় মাতৃহারা রুবাই লাশঘরের বয়স্ক লাশগুলোকে পিতামাতা জ্ঞানেই যত্ন করে দেখভাল করতো। তিরিশোর্ধ রুবাই আজও অবিবাহিত। করোনার প্রথম ঢেউতে ভারতে শুধুই  বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের করুণভাবে মরতে দেখেছে রুবাই। তাদের সন্তানেরা বেশির ভাগ নিজেদের বাবা বা মায়ের লাশটাকে শেষবারের মতো চোখের দেখা দেখতেও আসেনি। মৃত্যু আতঙ্কে মানুষ তখন ছিল দিশেহারা। করোনায় মৃত লাশগুলি ধাপার মাঠে  আত্মীয়স্বজন ছাড়াই  দাহ করতে হয়েছে রুবাইদের মতো মানুষদের সাহায্য নিয়ে।এর বিনিময়ে রুবাইয়ের স হ কর্মীরা মৃতের আত্মীয়দের থেকে মোটা টাকা নিলেও মদখোর রুবাই একটা পয়সাও নেয়নি কারো থেকে।

রুবাই যে বাড়িতে ভাড়া ছিল সেখানে দোতলার একটা ঘরে শেয়ার করে থাকতো তাদেরই হাসপাতালের দুই নার্সদিদি। তাদের অপরাধ তারা হাসপাতেলের কর্মী। ওদেরকে করোনা আতঙ্কে বাড়িওয়ালা ঢুকতে দিতে নারাজ। পাড়ার লোকেরাও তাকেই সাপোর্ট দেয়। বাধা দেওয়ায় প্রথম ও একমাত্র প্রতিবাদ করে রুবাই। পাবলিককে বোঝায় ডাক্তার আর নার্সরা না থাকলে তোমরা কেউই বাঁচবে না। বিনা চিকিৎসায় মরবে সকলে। বাড়িওয়ালা, নার্সদের দুজনকে দুটো আলাদা ঘরে থাকার নোটিশ দিয়ে-ঘর ছাড়তে বলেন। রুবাই নিজের ঘর ছেড়ে দেয় এক নার্স দিদিকে। সে থেকে যায় হাসপাতাল চত্বরে। চাপে পড়ে গিয়ে বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয় বাড়িওয়ালাকে। পাবলিকও তখন কার মতো শান্ত হয়।

মানুষকে বাঁচাতে একাকী নিজেই চেষ্টা চালায় রুবাই।করোনার দ্বিতীয় ঢেউতে আর্তের সেবায় নিজের বেতনের জমানো সব টাকা পাড়ার ছেলেদের দিয়ে দেয়। চারিদিকে বেডের সমস্যা,অপ্রতুল ওষুধ ও অক্সিজেন সিলিন্ডার। অতিমারির তীব্রতায় হাহাকার ঘরে ঘরে। দুচারজন ইচ্ছুক,নির্ভয় এবং সাহায্যকারী মানুষকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ায় অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের অস্থায়ী  ইউনিট ক্যাম্প খুলে ফেলে রুবাই। নিজের উদ্যোগে চেনা ডাক্তারদের সাহায্যে দু চার বেডের ফ্রি চিকিৎসার ক্যাম্প খুলে দেয় জনসাধারণের সুবিধার্থে ।

রুবাই একটা প্রখ্যাত এনজিও সংস্থাকে  যুক্ত করে নেয় ফেসবুকের বন্ধুদের সহায়তায়। এক এনজিও-কর্মী উচ্চশিক্ষিতা;ধনী; মঞ্জরী তার কাজকর্ম দেখে মুগ্ধ হয়ে - তাকে ভালোবেসে ফেলে। সে নিজে রুবাইকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।

 রুবাইয়ের দুই নার্সদিদি আর দ্বিতীয় অতিমারিতে যুক্ত  সহযোগী ডাক্তারেরা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে ওদের বিয়ে দিচ্ছে আজ স্বাধীনতা দিবসের শুভ মুহুর্তে । ওদের আশীর্বাদ করতে আপনারাও আসছেন তো? জাতীয় পতাকা উত্তোলনের শেষে মিষ্টিমুখ করতে আসবেন না ওদের শুভেচ্ছা জানাতে? 

স্বাধীনতার মানে আজও অনেকেই বোঝেনা, কিন্তু এরা বুঝতে পেরেছে। সেই দলে আপনিও আছেন তো? 


শুভ স্বাধীনতা দিবস।

***********************