#সহমর্মী#নবনীতাসই26,8,21
রোজ সকালে কলের জলের জন্য প্রায় খণ্ডযুদ্ধ লেগে যায়৷ কল দুটো পরিবার সাতটা৷ মাঝের চিলতে জায়গাটা আর যাই হোক উঠোন বলা যায়না৷ ওটা সবার গলি৷ দু পাশে ঘর আর চিলতে গলি৷ সাতটা ঘরে ছটি পরিবার থাকে৷ একটা ঘরে থাকে বিশু …
#সহমর্মী
#নবনীতাসই
26,8,21
রোজ সকালে কলের জলের জন্য প্রায় খণ্ডযুদ্ধ লেগে যায়৷ কল দুটো পরিবার সাতটা৷ মাঝের চিলতে জায়গাটা আর যাই হোক উঠোন বলা যায়না৷ ওটা সবার গলি৷ দু পাশে ঘর আর চিলতে গলি৷ সাতটা ঘরে ছটি পরিবার থাকে৷ একটা ঘরে থাকে বিশু পাগলা৷ সে সারামাস থাকেনা৷ ঘর বন্ধ থাকে৷ মাসের শেষে আসে দুদিনের জন্য ৷ সারা রাজ্যে ভিক্ষা করে , ঘরের মেঝেতে পুঁতে রেখে যায়৷ সবাই তাই বলে ৷ বাকি ছটা ঘরে ছটি পরিবার ৷ নিম্ন মধ্যবিত্ত , এই পরিবার গুলোয় সব দিন আনা দিন খাঁটা মানুষ৷ সারাদিনের কঠোর পরিশ্রম আর বঞ্চনায় জীবনের চাকায় পিষে চলেছ৷
আর এই ঘরগুলোর মাঝের এতটুকু যে গলি সেইটুকু নিয়েও কম ক্যাচাল না৷ কেউ বসে কুটনো কুটছে, কেউ ছেলে স্নান করাচ্ছে৷ সবকাজ গলিতে৷ কারোর সাইকেলটা হেলান দেওয়া তো কারোর টিনের দেওয়ালে ঝুলছে সংসারের বাড়তি জিনিস৷ ছেলে পেটানো থেকে বৌয়ের সাথে হাতাহাতি সবকিছুর সাক্ষী এই গলি৷ নিজেদের
পায়রার খোপের বাইরে , এই গলিটা দম ফেলার জায়গা৷ ঘরের ভিতরের দমবন্ধ পরিবেশ৷ একটা ঘরে শোওয়া , বসা, পড়াশোনা৷ বারন্দার কোনে রান্না আর তার সামনের গলিটা এদের সবার সম্পত্তি৷
সকাল থেকে এখানে কেউ চুপ থাকেনা ৷সে রঙের কাজ করা শ্যামলী হোক, বা লোকের বাড়ি কাজ করা মালতী৷ সবার মুখ চলছে ৷ গলিটা সবাই মোটামুটি কাজে লাগায়৷ টোন কাটা থেকে , ঝগড়া , মারামারি থেকে, বিয়ে সব এই গলিতে৷
আজ হারুর বৌ চম্পা আর মালতীর মধ্যে ঝগড়া ৷ চম্পা সক্কাল অবধি মালা গাঁথে৷ তারপর কাজে যায়৷ আর মালতীর দুটো মেয়ে , সে ভোরে থেকে কাজ সেরে রান্না করে তবে একেবারে বের হয় ৷ সক্কালবেলাই কলের জল নিয়ে মারামারি ৷ এসব জায়গার এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, খানিক চুলোচুলির মজা দেখার পর , সবাই যে যার কাজে দৌড়ায়৷
চম্পা সিগন্যালে মালা বিক্রি করে ৷ আর মালতী চার বাড়ি কাজ করে ৷ চম্পা কাজে গেলে বর ছেলেকে স্কুলে দিয়ে কাজে যায়৷ মালতীর বর অন্য সংসার পেতেছে , মালতী কে সবকাজ নিজেকে করতে হয়৷ বড় মেয়েটা বোনকে নিয়ে স্কুলে যায়৷ আজ তো দুজনের দেরী হয়ে যায় কাজে যেতে৷
চম্পার নখে মালতীর গালে চিরে গেছে ৷ চম্পার ও মাথা ব্যাথা করছে৷ কিন্তু এ নিত্য দিনের ব্যাপার ৷ কাজের জায়গায় গেলে সব ঠিক৷ দুজনেই দৌড়ায় কাজে৷
চম্পা হারুর এনে দেওয়া ফুল নিয়ে ভোর থেকে মালা গাঁথে৷ সকাল থেকে বিক্রি শুরু করে৷ বারোটার পর বাড়ি ফেরে ৷ আর মালতী ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা৷ চম্পার বাড়ি ফিরে দুপুরের রান্না করে, হারু আসে রাতে৷
মাতলীর বরটা মাতাল৷ দুটো মেয়ে স্কুলে যায়৷ ফিরে এসে দুজনে খেয়ে এই গলিতেই থাকে৷ খেলা করে৷ পড়ে৷ বৃষ্টি হলে , বা ভয় পেলে চম্পার ঘরে বসে থাকে৷
বাপটা ন মাসে , ছমাসে টাকা নিতে আসে৷ অন্য সংসার পাতলে কি হবে, মাঝে মাঝে মালতীর টাকা আর শরীরের অধিকার ছাড়েনা৷
চম্পার ছেলেটা মেয়ে দুটোর খুব ন্যাওটা৷ মাঝে মাঝে চম্পাও বিস্কুট মুড়ি দেয় মেয়ে দুটোকে৷
আজ হঠাৎ মালতীর বর কালু ঘরের সামনে ছকছুক করছিলো৷ চম্পার সাথে ঝগড়া তাই মালতীর ঘরের দিকে না তাকালেও কথা শুনতে পারছিলো৷ বড় মেয়েটা বলছিলো , না যাবো না, মা আসুক৷ না যাবোনা, বোন ও যাবেনা৷ হঠাৎ মেয়ে দুটোর কান্না শুনে , হাতে বটিটা নিয়ে চম্পা দাঁড়ায়৷ মাতালটা বড় মেয়েটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো৷ নিয়ে গিয়ে নাকি বড় স্কুলে পড়াবে৷
চম্পা লাফ দিয়ে পড়ে গলিতে, চিৎকার করে লোক ডাকে৷ মালতীর মাতাল বর ও তেড়ে আসে৷ আমার মেয়ে , আমি নে যাবো , কার কি?
চম্পা বলে ওঠে , ওরে আমার বাপ, মাগীর টাকায় মদ গেলে, তিনি আবার পড়াবেন৷ খবরদার !!
কোথায় গিয়ে বেঁচে দেবে তার ঠিক নেই ৷ দেখি কি করে নিয়ে যাস৷ বটি নিয়ে তেড়ে যায় কালু৷ কিন্তু চম্পাও কম যায়না৷ সাংঘাতিক মুখরা চম্পা যখন গালি দিতে শুরু করে বটি নিয়ে কালুর দিকে এগোয়, প্রাণ নিয়ে ভেগে যায় মাতাল কালু৷
মালতী ফিরে এসেই সব শোনে, চম্পার হাতদুটি ধরে কেঁদে পরে৷ চম্পা মনে মনে ভাবে, তাকে কেউ বাঁচায়নি, তার বাপ তাকে বিক্রি করে গিয়েছিলো কোলকাতার লালবাড়িতে৷ কত কেঁদেছিলো চম্পা৷ মায়ের জন্য , বোনের জন্য আজও মন ছটপট করে৷ হারু যদি সেখান থেকে না নিয়ে পালাতো৷ চোখটা মুছে নিয়ে চম্পা বলে, নে নে কাপড় টা গুছিয়ে পড়েনে৷ হারু বলেছে থানায় গিয়ে জানাতে হবে৷ আর শোন ঐ তো হাড় ক্যালানে বুড়ো৷ তাও বারো মাতারির সাথে শুয়ে বেড়ায়৷ কোথা থেকে কি রোগ দিয়ে যাবে, তুই এবার ওকে বিছানায় নেওয়া বন্ধ কর৷ চল চল থানায় না জানালে আবার আসবে৷
সবাই মিলে স্থানীয় ক্লাবে আর থানায় জানিয়ে আসে৷ ভয়ে মাতাল কালু আর আসেনি ৷ চম্পা আর মালতীর আবারও ঝগড়া হয়েছে ৷ কিন্তু আজও মালতীর মেয়ে দুটোকে চোখে চোখে রাখে চম্পা৷ দুজনে যে সহমর্মী৷
শেষ৷