Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

রবি রঞ্জনী সাপ্তাহিক সেরা সাহিত্য সম্মাননা

৮-৯-২০২১
-গল্প-               •আকাশকন্যা•                       অজয় কুমার দত্ত
               জলের ওপর পোকাটা লাফিয়ে পড়তেই তাকে কেন্দ্র করে একটা ছোট বলয় রচিত হয়- তারপর সেটা বাড়তে থাকে। বেশী বড় হওয়ার সুযোগ পায় না। প্রবল আবর…

 


৮-৯-২০২১


-গল্প-               •আকাশকন্যা• 

                      অজয় কুমার দত্ত


               জলের ওপর পোকাটা লাফিয়ে পড়তেই তাকে কেন্দ্র করে একটা ছোট বলয় রচিত হয়- তারপর সেটা বাড়তে থাকে। বেশী বড় হওয়ার সুযোগ পায় না। প্রবল আবর্তনে নীল জলের সাদা ফেনারাশি গ্রাস করে নেয় বালিকা হতে কিশোরী হয়ে ওঠা জলের বলয়টিকে। এরকমই হতে থাকে- হতেই থাকে।

               মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে পিয়াস দেখে জলের পোকা বলে যেগুলো সে দেখছিল সেগুলো আসলে মাছ। উড়ন্ত মাছ বা ফ্লাইং ফিস। জলের ওপর কিছুটা সাঁতার কেটে মারে এক লাফ। প্রায় আট দশ ফুট দুরে গিয়ে পড়ে। মনে হয় উড়ে গেল। সবটাই চলে বিদ্যুৎগতিতে। ফটো তোলার চেষ্টা করে ক’বার- কিন্তু লেন্সেই আসে না কিছু।

               পিয়াস দাঁড়িয়ে ছিল লঞ্চের ডেকের ওপর। যাচ্ছে নীল নামে একটা দ্বীপে৷ দু'দিন আগে পোর্টব্লেয়ার থেকে হ্যাভলক দ্বীপে এসেছিল কোস্টাল ক্রুজের বিলাসবহুল জলযানে। সে এক অসাধারণ জলযাত্রা ! তবে ডেকে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। এখন যাচ্ছে হ্যাভলক থেকে নীল আইল্যান্ডে।

               এটা সাধারণ জাহাজ। বড় ধরণের লঞ্চও বলা যায়। সুযোগ পেয়ে সবাই ভীড় জমিয়েছে ডেকে। চড়চড়ে রোদে মাথা যেমন জ্বালা করে আবার উথালপাথাল সমুদ্রের হাওয়া যেন উড়িয়ে নিয়ে যায়। গরমটা গায়ে বসতে না পেরে মাছির মতো পিছলে যেতে থাকে।

               সমুদ্রের জলটা আশ্চর্য রকম নীল। নীল- কিন্তু যেন সবুজ রঙে গোলা। বিস্তার করা ময়ূরের পেখমে অসংখ্য গোলাকার চিত্রে অমন রঙের দেখা মেলে। তীর থেকে জলের ওপর দিয়ে সোজা এগিয়ে এসেছে কংক্রীটে বাঁধানো এক লম্বা জেটী। কবে তৈরী হয়েছে কে জানে ! গাত্রে ক্ষয় চিহ্ন এবং জমে থাকা শ্যাওলা এর প্রাচীনতারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। জাহাজটা এসে ভিড়লো ওরই গায়ে। অনেক অনেক মাল বোঝাই ঝুড়ি নামাবার পরে যাত্রী নামাবার সময় এল। প্রথমেই লাফ দিয়ে নামলো যে মানুষটি তার নাম পিয়াস। বাতাসে একটা আঁশটে গন্ধ। মরচে ধরা সাইনবোর্ডের বিবর্ণলিপি সম্ভাষণ জানালো তাকে-ওয়েলকাম টু নীল।

               চাকা লাগানো সুটকেসটা টানতে টানতে পিয়াস এগিয়ে চলে। তীরঘেঁষা সাগরের জলে ইতঃস্তত অনেকগুলো ডিঙি নৌকো ধীবরদের অন্নসংস্থানের কাজে লাগার ফাঁকে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। কাচের মতো স্বচ্ছ সবুজ নীল জলের গভীরে তাকিয়ে আছে প্রবালের স্তুপ। তারই ওপরে হলুদ রঙা মাছেদের খেলা পিয়াসের মন ভালো করে দেয়। অদূরে রাধাচূড়া কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় ঘেরা  জনপদ পদার্পণের সাথে সাথে পিয়াসকে আত্মীয়ের মতো আপন করে নিল। সবুজ পাতার অরণ্যে লুকিয়ে থাকা পাখীগুলো একটানা ডাকতে লাগলো-- টিই, টিই, টিই- এসো, এসো, এসো।

               পিয়াস এখন খুঁজছে রণজিৎ নামে একটা ছেলেকে। তাকে সে চেনেই না। মোবাইলে সঞ্চয় করে রাখা যোগাযোগ সূত্রে সে আঙুল রাখে। তারস্বরে একটি লোকগীতির রিংটোন তার কানের অভ্যন্তরে বেজে যায়- বেজেই যায়। সাড়া আর আসে না। এদিকে নেমে আসা পর্যটকদের ভীড় হাল্কা হয়ে গেছে। কাপড় পেতে কিছু গাছপাকা নিটোল আম কলা নিয়ে বিকোবার আশায় বসে আছে এক বৃদ্ধা। ডানদিকে সার দিয়ে চালকবিহীন তিনটি ত্রিচক্রযান। আরও দূরে দু’হাতে একটি সবুজ ডাব ধরে পাইপ মুখে আকন্ঠ পিপাসা মিটিয়ে যায় এক কিশোরী। তার পোষাক লাল, জুতো লাল এমনকি মাথার বিশাল ছড়ানো নাইলনের টুপীটাও লাল রঙের।

               পিয়াস একটা আকর্ষণ অনুভব করে। পায়চারী করতে করতে তাকিয়ে থাকে আপাদমস্তক লালসায়রে ভেসে যাওয়া মেয়েটির দিকে। বারকয়েক দৃষ্টি বিনিময়ও ঘটে। কিন্তু সে পরাবর্তে অগ্রসর হবার সাহস গড়ে তুলতে পারে না পিয়াস। শুধু ভাবে ও-ও কি আমার মতো একা?

               পিয়াসের ভাবনার তন্তুকে ছিন্ন করে আপন অস্তিত্ব জানান দেয় তার মোবাইল। কানে দিতেই পেশাদার কিন্তু পরিশীলিত কণ্ঠে শোনা যায়- আমি রণজিৎ বলছি। দেরী হবার জন্যে আন্তরিক দুঃখিত। আপনি পিয়াস সেন তো ? স্বপ্নজাল ছিঁড়ে যাওয়ায় কিছুটা ক্ষুণ্ণ পিয়াসকে নিশ্চিন্ত করে অচিরেই সামনে এসে দাঁড়ায় একটি দুধসাদা অলটো। চালক নেমে এসে নমস্কার করে বলে- আমার নাম রণজিৎ। এই নীল আইল্যান্ডে যে কদিন থাকবেন- থাকা এবং ট্যুর- সব দায়িত্ব আমার। থাকার বুকিং করেছি হাওয়াবিল নেস্টে- গভমেন্টের। খাওয়া ওখানেই। আর বেড়ানো, দৈনিক চার্জ এই কাগজে- বলে একটা ছাপানো কাগজ ও নিজের নাম লেখা কার্ড বাড়িয়ে ধরলো।

               পিয়াস দেখলো পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের এক উজ্জ্বল যুবক। কিছুটা গ্ৰাম্য চেহারা- চোখ দু’টোতে তাকিয়ে ভরসা করা যায়। গাড়ীতে উঠে সে ভাবলো- মেয়েটিতো একা পড়ে রইলো। যদি রাজী থাকে তো একটা লিফট দেওয়া যেতে পারে ! কিন্তু তাকিয়ে দেখে কোথায় সে! ত্রিসীমানায় কেউ নেই। কৃষ্ণচূড়ার দু'টো ফুল খসে পড়ার ফাঁকে শোনা গেল সেই পাখীটা ডাকছে- টিটি ট্টিউ, টিটি ট্টিউ- চলে গেছে, চলে গেছে!

               সরু পিচের রাস্তা ধরে যেতে যেতে পিয়াস বললো- কোলকাতা থেকে এত দূরে বাঙলা কথা শুনে খুব ভালো লাগছে। এখানে অনেক বাঙালী- রণজিৎ বলে ওঠে- প্রায় সিক্সটি পারসেন্ট। বাকিরা বেশীর ভাগই মেইনল্যান্ডের দক্ষিণ দিকের।

               পিয়াস জানলো ভারত ভূখন্ড এখানে মেইনল্যান্ড নামেই অভিহিত। কি একটা জিজ্ঞেস করার আগেই গাড়ী প্রবেশ করলো রিসর্ট এরিয়ার মধ্যে। গেটে গাঢ় নীল রঙের বোর্ডে লেখা- ওয়েলকাম টু হাওয়া বিল নেস্ট। পরিবেশ দেখে পিয়াস তৃপ্ত। বেশ বড় ছিমছাম একটা ঘর- সুন্দর সাজানো রিসেপসনে সাগরবেলায় সূর্যের উদয়-অস্তের ছবি, লতাপাতা, ফুলগাছ, প্রবালের টুকরো আর ঝিনুক দিয়ে তৈরী আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের মানচিত্র। লনে খাটো উচ্চতার বোগেনভিলিয়া লাল ফুলে ভরা শাখা বিস্তার করে মাটিকে আদর করতে চাইছে।

               রণজিৎ বলে- আপনি স্নান খাওয়া সেরে নিন। আমি আসবো একঘণ্টা পর। তারপর ভরতপুর বীচ দেখাতে নিয়ে যাবো। মনে করলে সেখানেও স্নান করতে পারেন।

                               ***

               পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিনিটের মাথায় রণজিৎ চলে এলো। পিয়াসের চান খাওয়া সারা। সাদা প্যান্টের ওপর ডিপ ব্লু গেঞ্জীটা চাপিয়ে গাড়ীতে ওঠার সময় পিয়াস দেখে পেছনের সীটে জানালায় ডান কনুইটা রেখে বাইরে তাকিয়ে আছে সেই, সেই মেয়েটি। পরণে লাল লেগিংস, গায়ে লাল ফুলহাতা টাইট রেশমী টপ, মাথার চুলকে ঢেকে আছে সেই চওড়া লাল টুপী। ফুলে ফুলে উপচে পড়া বোগেনভিলিয়ার একটা শাখা বুঝি গাড়ীর ভেতর কেউ রেখে গেছে। পিয়াস খুব খুব অবাক হয়ে গেল।

               হয়তো প্রায় খালি গাড়ী দেখে রণজিৎ আরো একজন ট্যুরিস্টকে নিয়েছে পিয়াস ভাবলো। কিন্তু রণজিতের কি তাকে একবার বলা উচিৎ ছিল না ! শত হলেও পিয়াস তো গাড়ীটা অগ্রিম রিজার্ভ করেছে কোলকাতা থেকে দু'মাস আগে ঘুরে যাওয়া বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর কাছ থেকে রণজিতের ফোন নম্বর পেয়ে। যাই হোক সহযাত্রী যখন ফুলের মতো একটি কিশোরী- যাকে সে নীল দ্বীপে পা দিয়েই দেখতে পেয়েছিল পিয়াসের ক্ষোভ মূহুর্তের মধ্যে বাষ্প হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল।

               গাড়ী চালু হতে পিয়াস ভালো করে মেয়েটির দিকে তাকালো। চল্লিশ বছরের ব্যাচেলর জীবনে এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম। অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটি। জামাকাপড়ের বাইরে দৃশ্যমান মুখমণ্ডল এবং হাতের আঙুল একদম দুধেআলতা মেশানো রঙের। পিয়াস ভাবলো বোধহয় আলতার ভাগ একটু বেশীই। বয়েস ষোলো সতেরোর বেশী হবেই না !

               তিন চার মিনিটের মধ্যেই এসে গেল সমুদ্রতট ভরতপুর বীচ। রণজিৎ বললো- এখানে যতক্ষণ খুশী কোরাল দেখুন। নানারকম ওয়াটার স্পোর্টসও আছে। হয়ে গেলে আমার মোবাইলে একটা কল দেবেন, আর একটা বীচে নিয়ে যাবো।

               পিয়াস দেখলো সমুদ্র এখানে যেন আরো আরো সবুজ। তীরঘেরা ম্যানগ্রোভ গাছের ঝোপ। ঢেউগুলো বড়ো সুন্দর নিজের মনে খেলছে, হাসছে। ঢেউএর তালে ছোটছোট নৌকো দুলছে, ভাসছে। সী-স্কুটার আর স্পীড বোট গুলো সাঁ সাঁ করে ছুটে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে। দূরে একটা জাহাজ চলে গেল কোন অজানার ডাকে, কে জানে! পিয়াস ক্যামেরা বার করে। কিন্তু মেয়েটা। মেয়েটা গেল কোথায় !

               তার গাড়ীতেই যখন এসেছে একলা মেয়ে পিয়াসের মনে একটু অভিভাবক সুলভ দায়িত্ববোধ সাড়া জাগায়। তার দু'চোখ খুঁজে বেড়ায় সাগরবেলা আন্তরিক ভাবে। প্যান্ট গুটিয়ে নেমে পড়ে খানিকটা জলের মধ্যে। সমুদ্রের জলকে কোন ভরসা নেই। এই পায়ের পাতা ভেজা জল- একটু বাদেই হাঁটু ছুঁতে চায়। পিয়াসের প্যান্ট একটু ভিজে গেল। তবু সে খুঁজে চলে সামনের দিকে। তার উৎকণ্ঠা দেখে সবুজ সমুদ্র হাসে।

                             ***

               পিয়াস বড় প্রকৃতি প্রেমিক। দেশ বিদেশের নানা বড় শহরে নগরে সে কয়েকবার গিয়েছে। কিন্তু তার মন আশ্রয় খুঁজে পায় পাহাড়, জঙ্গল, নদী, সমুদ্রের নিবিড়তায়। তার ক্যামেরার লেন্সে বন্দী হতে থাকে বিশাল বিস্তৃত নীর, নীরদ আর নীরধির অনিবার ক্রীড়া।

               অকস্মাৎ পিয়াস স্থির হয়ে যায়। তার জুম করা ক্যামেরার লেন্সে- নীল আকাশ, সাদা মেঘ আর সবুজ জলের পটভূমিকায় ধূসর এক বিরাট পাথরের ওপর একটি লাল বিন্দু। অঙ্গুলি হেলনে বিন্দু ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। মেয়েটা অতদূরে গেল কি করে ! পিয়াস জল ছেড়ে তীরে ওঠে- বালির ওপর কষ্ট করে দৌড়তে থাকে। পাথরটার কাছে পৌঁছে পিয়াসের হাঁফ ধরে যায়।

সেই মেয়ে নিশ্চল বসে আছে পিয়াসের দিকে পেছন ফিরে। জলে তার পরিধেয় অনেকটাই ভেজা।

               পিয়াস ডাকে- শুনছো ! ও মেয়ে ! বলেই নিজের ভুল বুঝতে পারে। এ বাংলা বুঝবে কেমন করে! সংশোধন করে আবার বলে- হ্যালো, হ্যালো, লিসন প্লীজ। গেট ডাউন। ডোন্ট সীট হিয়ার। ইটস রিস্কি। হ্যালো !

               পিয়াসের উৎকণ্ঠা হাওয়ায় মিশে কোথায় চলে যায়। ও মেয়ে কানও করে না। পিয়াস আবার বললো তুমহারা নাম কেয়া হায় ? ইধার মত বৈঠো- খতরা হো সকে। বাঁ হাতে টুপীটা খুলে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে পিয়াসের দিকে তাকায় পরির মতো সেই মেয়ে। হাওয়ায় উড়তে থাকা অবাধ্য চুলের অরণ্য অপর হাতে সামলে সে বলে- আমি আকাশকন্যা। পিয়াস মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দ্বীপের মতো চোখের দিকে। সে চোখের রং আকাশের মতো নীল।

               পিয়াসের পা যেন ভেজা বালিতে গেঁথে গেছে। সমুদ্রের হাওয়া থেকেও জোরে বইছে তার নিঃশ্বাস। উপরে ঘন কালো হয়ে ওঠা মেঘের গুমগুম আওয়াজের থেকেও জোর শব্দ হচ্ছে তার বুকের ভেতর। এ হাওয়া উতরোল অন্তরাত্মার হাওয়া। এ শব্দ উদ্বেল হৃদয়ের শব্দ। এক পশলা বৃষ্টি এসে ধারাস্নান করিয়ে দেয় দুজনকে।

পিয়াস ডান হাতটা বাড়িয়ে ধরে। সেই প্রসারণে মিশে আছে আহ্বান, মিশে আছে আকুলতা৷ প্রসারিত সেই হাত ধরে আকাশকন্যা নেমে আসে সাগরবেলায়- তারপর বালুতটে অঙ্কিত হতে থাকে তাদের দুজনের পদচিহ্ন।

               রণজিৎ বললো-এত দেরী করলেন! আর একটা বীচে যেতে হবে যে ! আবার গাড়ীতে চেপে বসে দু'জনে। মেয়েটি আঁকড়ে ধরে আছে পিয়াসের হাত। পিয়াস মনে মনে চাইলো কোনদিন যেন এই হাত সে না ছাড়ে। গাড়ী থামিয়ে রণজিৎ বললো- এ বীচটা হচ্ছে লক্ষ্মণপুর বীচ। একটু হেঁটে এগিয়ে যান- এখানে সানসেট খুব সুন্দর !

               চারদিকে ম্যানগ্রোভ গাছের ঝোপ। মাঝে অপ্রশস্ত পায়ে চলা পথ। মেয়েটির হাত ধরে পিয়াস উঁচুনীচু সামলে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। মনে মনে উচ্চারণ করে আকাশকন্যা- আকাশকন্যা! তার মনটা যেন হঠাৎ খুব ভালো হয়ে গেল।

               হাঁটতে হলো বেশ খানিকটা। শেষমেষ পৌঁছলো এক বীচে যার কোন বালুময় বেলাভূমি নেই। পাথরের মতো বিশাল বিশাল প্রবালের স্তুপের ওপর দিয়ে সাবধানে পা ফেলে যেতে হয়। জায়গাটা বেশ অপরিচ্ছন্ন। পিয়াস ভাবলো আর এগোবে না! কিন্তু মেয়েটির আবদার তাকে রাখতেই হয়। ধীরে ধীরে এগিয়ে তারা পৌঁছলো এমন এক জায়গায় যেখানে সমুদ্র এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পাথরের মতো প্রবালদ্বীপের ওপর। প্রবালের খাঁজে খাঁজে জল ঢুকে যাচ্ছে- আর সেই জমে যাওয়া জলের মধ্যে ভাসছে লাল নীল মাছ- যেগুলো শহুরে মানুষ অ্যাকোরিয়মে দেখে থাকে। আরও দেখতে পেল পাঁচ পা ওলা তারা মাছ বা স্টার ফিস, সী-কিউকাম্বার বা সমুদ্রশশা বলে একটা সামুদ্রিক প্রাণী। আকাশকন্যা আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। পিয়াসের একটা হাত সে দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে আছে। পিয়াস মনে মনে চাইলো- এ বাঁধন যেন কোনদিনও না ছিন্ন হয়।

               লক্ষ্মণপুরেই দ্বিতীয় আরো একটি বীচ আছে যেখানে সূর্যাস্ত দেখা যায়। অস্তগামী সূর্য ঢেউয়ের ওপর তার সোনালী রং ছড়িয়ে দিচ্ছে- মাঝখানে ধীরগতিতে ভেসে যাচ্ছে একটি পালতোলা নৌকো। আকাশকন্যাকে এই পটে দাঁড় করিয়ে পিয়াস ক্যামেরার সাটারে আঙুল রাখলো। আর মনে মনে প্রার্থনা করলো মেয়েটি যেন চিরকালের মতো তার হয়ে যায়। তার বুকের ভেতর শুধু একটাই ছবি- আগামী সোনালী দিনের- যেখানে মায়ার বাঁধনে বাঁধা শুধু তারা দু’জন। সাক্ষী রইলো আকাশ, সমুদ্র আর সমুদ্রে বিলীন হতে থাকা অপরাহ্নের রবি।

               রণজিৎ বললো- কাল খুব ভোরে উঠবেন কিন্তু। সীতাপুর বীচে সানরাইজ দেখাবো। পিয়াস সানন্দে রাজী। এবার ফেরার পালা। আকাশে মেঘ ঘন হয়ে এসেছে। সন্ধ্যা মেয়েও আঁচল বিছিয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে। ফেরার পথে এক জায়গায় পিয়াস দেখলো মেঘ যেন রাস্তার পাশে ছড়িয়ে থাকা প্রান্তরে একটি বড় গাছের তলায় ঘন হয়ে জমেছে। মেয়েটির কথায় পিয়াস গাড়ি থামাতে বলে। সে নিজেও নেমে সবুজ ঘাসে পা রাখে। আকাশের মতো নীল চোখদু’টি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বিদায় নেয়। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে গাছটির দিকে। পিয়াস সতৃষ্ণ হয়ে তাকিয়ে থাকে। আর দেখা যায় না। ঘন মেঘ গ্রাস করে নেয় আকাশকন্যাকে। 

                              ***

               সারারাত পিয়াসের ঘুম আসে না। পরদিন খুব ভোরে রণজিৎ গাড়ি নিয়ে আসে। গন্তব্য সীতাপুর বীচে সূর্যোদয়। পিয়াস দেখলো গাড়িতে আর কেউ নেই।

               খুব অবাক হয়ে রণজিৎকে জিজ্ঞেস করে-ও কোথায় ? রণজিৎ বলে-কে? কার কথা বলছেন ?

               আরে ওই মেয়েটা- পিয়াস বোঝায়- কাল যে সারাদিন ছিল আমার সঙ্গে গাড়িতে ! রণজিৎ আরও অবাক হয়ে বলে গাড়িতে আবার কে ছিল ? আপনি তো একাই ট্যুরিস্ট আমার গাড়িতে ! নিন উঠুন।

               তার অদ্ভুত আচরণে পিয়াস ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। ধমকে ওঠে রণজিৎকে কি উল্টোপাল্টা বকছো ? কাল একা ছিলাম ? আমায় না জানিয়ে আর একজন ট্যুরিস্ট মেয়েকে তোলো নি কাল গাড়ীতে ?

               খুব অসন্তুষ্ট ভাবে রণজিৎ বলে- শহরের বাবুরা অনেক সময় ভাড়া করা মেয়েদের নিয়ে স্ফুর্তি করে। সেটা তাদের ব্যাপার। আমরা ওসব দিকে তাকাই না। আমরা ট্যুর অপারেটর। আপনি কাকে নিয়ে কাল ঘুরেছেন তার আমি কি জানি ? আজ যোগাড় করে নিন আর একটা ! হুকুম করলে বেশ্যাপাড়া ঘুরেও যেতে পারি।

               ড্রাইভারের এই অপমানে পিয়াস আরো রেগে যায়। কিন্তু মুখে কথা যোগায় না। তার মন যে সবটাই চুরি হয়ে গিয়েছে। কোথায় খুঁজে পাবে সে এখন তার তন্দ্রাহরণীকে !

               সীতাপুর বীচে পৌছে রণজিৎ গম্ভীর ভাবে গাড়ী থামিয়ে দেয়- কোন কথা বলে না। পিয়াস বলে-এখানে নামবো ? 

               আপনার মর্জি। পয়সা দিয়ে গাড়ী ভাড়া করেছেন। এখন নামবেন কি বসে থাকবেন..... রণজিৎ কথা শেষ করে না।

               পিয়াস আর কথা বাড়ালো না। সাতসকালে এই মনোমালিন্য তার মনে বিতৃষ্ণা জাগিয়ে তুলেছে৷ গাড়ী থেকে নেমে বীচের দিকে হাঁটতে থাকে। ভোরের মিষ্টি বাতাস তাকে আপন করে নেয়। লাল থালার মতো এতবড় সূর্য জল থেকে উঠে আসছে। পিয়াসের সেদিকে নজর নেই। তার দু'চোখ সন্ধান করে যায় অন্য কিছুর। হঠাৎ তার বুকটা ছলাৎ করে ওঠে। দুরে ঝোপের ফাঁকে একটু লাল দেখা যাচ্ছেনা ? ও সেদিকে এগিয়ে যায় দেখে সেই মেয়েটিই। আজ পরনে শাড়ী- নতুন ওঠা সূর্যের মতো লাল। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে যেখানে নীল জলের সাদা ঢেউ বারবার এসে ধুইয়ে দিচ্ছে বালির তট আর রেখে যাচ্ছে ছোটবড় ঝিনুক, প্রবালের টুকরো। পিয়াসের দৃষ্টি দূর থেকে অনুসরণ করে মেয়েটির ঝিনুক কুড়নোর দৃশ্য।

               কিন্তু একি ! একি ! মেয়েটি ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে জলের দিকে এবং খুলে ফেলতে থাকে শরীরের সমস্ত পোষাক। পিয়াস স্তম্ভিত নয়নে দেখে সম্পূর্ণ নগ্নিকা এক মৎস্যকন্যার জলকেলি। তার শরীরের বর্ণও লাল। একি বাস্তব না মায়া ! নাকি দৃষ্টি বিভ্রম !

               মেয়েটি এবার তার আকাশের মতো নীল চোখ তুলে তাকায় পিয়াসের দিকে। অমোঘ আকর্ষণে পিয়াস এগিয়ে যেতে থাকে। দু'দিকে দুই হাত ছড়িয়ে তাকে যেন আহ্বান করে অপ্রাকৃতা এক অবয়ব। একদম সামনে পৌঁছে অবাক বিস্ময়ে সে দেখে যে মেয়েটির ছড়িয়ে দেওয়া হাত দু’টি আস্তে আস্তে পরিণত হচ্ছে দু'টি ডানায় ! রক্তগোলাপ কুঁড়ির মতো দু'টি স্তন অনাবিল পরশে ফোটার অপেক্ষায়। মেঘের মতো ছড়ানো চুল উড়িয়ে নীল আকাশে ডানা মেলে উড়ে যায় জবাকুসুমের মতো আকাশকন্যা। তার রক্তবর্ণা ভেজা শরীর থেকে নীল সায়রের উপর ঝরে পড়ে জলের ধারা। সূর্য তখন কিছুটা পরিণত হয়ে সোনালী ছটা ছড়িয়ে দিচ্ছে অন্তহীন নৃত্যরতা ঊর্মিরাশির গায়ে।

               পিয়াস আবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে থাকে নীল আকাশে বিলীন হয়ে যেতে থাকা প্রণয়িণীর দিকে। তার শূন্য হয়ে যাওয়া হৃদয়ে বারবার নীর নিক্ষেপ করে যায় অতল সাগরের ঢেউ।

                             ---------------

©অজয়


ছবি-সংগৃহীত