সৃষ্টি সাহিত্য যাপন
আধুনিকারা নাকি শুধু সাজতেই ব্যস্ত? তাদের নাকি কোনো ঘরের কাজ আসেনা? জানেনা নাকি তারা আতিথেয়তা, আপ্যায়ন? তাদের আপ্যায়ন নাকি একদম অর্ডার দিয়ে হোটেল রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনিয়েই শেষ? সত্যিই কী তাই? সেই ভাবনা থেকে…
সৃষ্টি সাহিত্য যাপন
আধুনিকারা নাকি শুধু সাজতেই ব্যস্ত? তাদের নাকি কোনো ঘরের কাজ আসেনা? জানেনা নাকি তারা আতিথেয়তা, আপ্যায়ন? তাদের আপ্যায়ন নাকি একদম অর্ডার দিয়ে হোটেল রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনিয়েই শেষ? সত্যিই কী তাই? সেই ভাবনা থেকে তারই পরিপ্রেক্ষিতে লেখা এই গল্পটা যা কিন্তু জীবন থেকে নেওয়া ।
#শিরোনাম_এলেম
#লিখনে_পম্পা_বন্দ্যোপাধ্যায়
সকালে উঠে তৈরী হয়ে অফিসে গেছে স্মৃতিলেখা, ও একটা আই টি কোম্পানির মার্কেটিং হেড । গিয়ে শুনলো অফিসের জেনারেল ম্যানেজার আজকে ভিসিট করবে। এদিকে সেদিন শুক্রবার, ফ্রাইডে ড্রেসিংয়ের কনসেপ্টে অফিসে সবাই ইনফরমাল ড্রেসে এসেছে, মানে ঐ জিন্স-টপ, স্কার্ট, ছেলেরা এসেছে পাজামা-পাঞ্জাবীতে, টি শার্টে। বড়ো আইটি কোম্পানিগুলোতে এসব আছে। এদিকে চেঞ্জ করা যাবে না এখন, সবারই দূরে দূরে বাড়ি আর আজকে সকালেই উনি জানিয়েছেন উনি ভিসিট করবেন আজকে । বেশ চিন্তা হচ্ছে মনে স্মৃতির, সঙ্গে ঈপ্সিতা, অদ্রিজা, দেবপর্ণা, সায়ক, সৌম্য সবাই ঘামছে।
জিএম শ্রীরামালিঙ্গম আবার খুব প্রাচীনপন্থী, তিনি উগ্র আধুনিকতাকে স্বেচ্ছাচারিতা মনে করেন। আসছেন তিনি মুম্বাই অফিস থেকে, মুম্বাই অফিসে ওঁর দাপটে সবাই কেঁচো হয়ে থাকে বলতে গেলে, খাওয়া নিয়ে, হাউস কিপিং নিয়ে ভীষণ নাক উঁচু আছে ওনার, লোকটা ভীষণ খুঁতখুঁতে, একেবারে দুর্বাসা মুনি । এদিকে রিজিওনাল হেড আলোকদাও একটু ফাঁপরে পড়েছেন, উনি এমনিতে দাপুটে মানুষ কিন্তু আদতে ভালোমানুষ, মানবিক । আর কিছুই নয়, ঐ শুক্রবারের চক্করে।
ঠিক সাড়ে এগারোটায় ঢুকলেন রামালিঙ্গম। একদম পাক্কা সাহেব তিনি, কোট-প্যান্ট-টাই পড়ে গটগট করে ঢুকলেন। অতো দাপুটে কিন্তু ভালোমানুষ আলোকদার মুখ শুকিয়ে গেছে আমসি হয়ে, ঘামছেন এ সি তে বসেও। রামালিঙ্গম এসে আলোকদাকে নিয়ে ঢুকে গেলেন কনফারেন্স রুমে, আস্তে আস্তে ডাক আসতে লাগলো এইচ আর ম্যানেজার সায়কের, একাউন্টস ম্যানেজার সৌম্যর, মার্কেটিং ম্যানেজার স্মৃতির। সেদিন স্মৃতি আবার পরে এসেছে ওর সদ্য কেনা ফ্লোরাল প্রিন্ট লং স্কার্ট আর কাঁথা স্টিচের কাজ করা টপ, চুলটা বেশ কালার করিয়েছে গত সপ্তাহে লেয়ার্স করে কেটে, পায়ে খুব লেটেস্ট জুতো, সব মিলিয়ে প্রেসেন্টেবল তো বটেই, আবার একটু বেশি আধুনিক মনে হচ্ছে ওর গেট আপ দেখে।
ও ধীরে সুস্থে ঢুকতেই রামালিঙ্গমের মুখে একটা বিরক্তি লক্ষ্য করল ও। অ্যাডমিন ম্যানেজার জিন্স টপ পরা দেবপর্ণাকে দেখলো ব্যাজার মুখে বসে আছে। আলোচনা শুনে ওর মনে হলো রামালিঙ্গম কোনো একটা কারণে রেগে আছে। ও কথা বলতে বলতে লক্ষ্য করল রামালিঙ্গম সব খাবারই রিফিউস করছে।
স্মৃতি আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, "আপনি কিছু নেবেন না স্যার? "
উনি বললেন, " আমার আকিউট গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম চলছে, হাল্কা বাড়ির খাবার ছাড়া সব বারণ। "
এবারে অ্যাডমিন ম্যানেজার দেবপর্ণা জিজ্ঞেস করল, "কী ধরণের খাবার খাচ্ছেন স্যার ? "
উনি বললেন, " এনিথিং যেটা বাড়ির রান্না, কম তেল, কম মশলা আর ভেজিটেরিয়ান খাবার।আমি আরো ভাবছি এই ফ্রাইডে ড্রেসিং আর রাখবো না, অফিসে ফর্মাল ড্রেসিংটাই ঠিক, তাই না? ফ্রাইডে ড্রেসিং দেখলে আমার মনে হয় লোকে উইকএন্ডের ফেস্টিভ মুড যেন এক্সটেন্ড করে গো-এস-ইউ লাইকে সেজে এসেছে।" ওরা চুপ করে শুনলো, একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় হল নিজেদের ভেতরে।
বুদ্ধিমতী স্মৃতি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেল ওনার অসুবিধেটা কোথায় হয়েছে। এটা তো ও আগেই বুঝেছিল। রামালিঙ্গম আবার বলল, " You know, modern girls dont know any hospitality". কথাটা স্মৃতির ভীষণ গায়ে লাগলো, স্মৃতি দেবপর্ণাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল আলোকদার অনুমতি নিয়ে। কনফারেন্স রুমের বাইরে এসে ও দেবপর্ণাকে বলল, "চল আজকে আধুনিকা বাঙালিনীর এলেমটা ঐ তেঁতুল রামালিঙ্গমকে বুঝিয়ে দিই, হসপিটালিটি কী জিনিস চল ওকে আজ দেখাই আমরা ।" আলোকদাকে বাইরে ডেকে এনে একটু ম্যানেজ করতে বলে দুজনে ঢুকলো ক্যান্টিনে।
সেখানে দুঘন্টা ঝড়ের গতিতে ক্যান্টিনের ছেলেদের সহায়তায় ওরা নামিয়ে ফেলল ঘরের হাল্কা রান্না। আড়াইটে নাগাদ সব সেরে টেবিলে বাঙ্গালী কায়দায় কলাপাতা, নুন লেবু দিয়ে গুছিয়ে আলোকদার মোবাইলে ফোন করে বলে দিল রামালিঙ্গমকে নিয়ে ওপরে আসতে। রামালিঙ্গম আসতে আসতে চারতলার ক্যান্টিনে ক্লায়েন্ট ফোন করল স্মৃতিকে, ওদের কোম্পানির সফটওয়্যারের কোটেশন সব চেয়ে লোয়েস্ট, তাই মাল্টিক্রোড় অর্ডারটা ওরা পাচ্ছে সেটা কন্ফার্ম করে মেল করল আর টেক্সট করল স্মৃতির মোবাইলে।
খেতে বসলো রামালিঙ্গম, সাদা ভালো চালের ভাত, ঘি, ঝুরো আলু ভাজা, পাতলা মুগের ডাল দিয়ে শুরু হল, শুকতো, ছানার ডালনা, মোচার ঘন্ট, থোড় পোস্ত, ফুলকপির রোস্ট,চাটনি,ভাপা দই, রসগোল্লা আর পান দিয়ে শেষ হলো নিরামিষ আহার পর্ব। রামালিঙ্গমের প্রশংসা আর শেষ হচ্ছে না, পান হাতে নিয়ে বারবার যখন থাঙ্কস দিচ্ছে স্মৃতি আর দেবপর্ণাকে, তখন টুক করে এক ফাঁকে আলোকদার হাত দিয়ে ক্লায়েন্ট অর্ডারের খবর আর মেসেজটা দেখিয়ে দিল ও। রামালিঙ্গমের হাঁড়ির মত মুখে আর হাসি ধরে না।
তখন আশ্বস্ত আলোকদা বলল, " আমাদের বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। আজকে এরা সেটা প্রমাণ করে ছাড়লো। "
শুনে রামালিঙ্গম, " হ্যাঁ হ্যাঁ, সেতো নিশ্চয় সেতো নিশ্চয়। " বলে যখন গলে যাচ্ছে স্মৃতি আর দেবপর্ণা দুজনেই বলল, " পোশাকে মডার্ন হলেও আজও আমাদের যে সংস্কৃতি যে অতিথি নারায়ণ সেটা আমরা মনে প্রাণে মেনে চলি, আপনি আমাদের জি এম কিন্তু তারও আগে আপনি আমাদের গেষ্ট, তাই আমাদের অফিসের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাঙালিয়ানার চ্যালেঞ্জ ছিল এটা যে আমরা আধুনিকা হলেও নিজেদের সংস্কৃতি বজায় রেখে আতিথেয়তা ঠিক মত করতে পারছি কিনা। "
রামালিঙ্গম সঙ্গে সঙ্গে আলোকদাকে বললেন, " এদের দুজনের জন্যই স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার ব্যবস্থা কর।"
ওরা দুজনেই বলল, " তাহলে ক্যান্টিনের ছেলেদেরও কিছু দেওয়া উচিৎ কারণ ওরা সহযোগিতা না করলে এতো কম সময়ে এই আয়োজন করা সম্ভব হত না। "
রামালিঙ্গম উদার হয়ে বললেন, " You are not only modern girls, but at the same time you have a big heart, I appreciate your outlook.Ok, done."
আলোকদা গেলেন সন্ধের ফ্লাইটে রামালিঙ্গমকে তুলে দিতে, রামালিঙ্গম আবার স্মৃতি আর দেবপর্ণার কাছে আবদার করে গেলেন পরেরবার এলেও যেন ওরা এই বেঙ্গলি কুইসিনই খাওয়ায় ওঁকে, ওঁর ভীষণ ভালো লেগেছে বাঙ্গালী সাবেকি রান্না ।ওরা হেসে সম্মতি দিল।
উনি বেরিয়ে যেতে স্মৃতি দেবপর্ণাকে বলল, " আসলে ব্যাটার খিদে পেয়েছিল বুঝলি তো, তাই ঐ তেঁতুলের মুখে সবই ভালো লেগেছে, দ্যাখ, পেট যে হৃদয়ের কাছে পৌঁছনোর সেরা রাস্তা আরো একবার প্রমাণিত হল । "
দেবপর্ণা বলল, " ভাগ্যিস তুই এই বুদ্ধিটা দিলি, নাহলে আজকে যে কী হত!!!" স্মৃতি বলল, " প্রতিকূল পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসাটাও কিন্তু আধুনিকতার একটা মাপকাঠি, নাহলে অফিসে এসে কে আর হেঁসেলের কাজটা শখ করে করে, একটা প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে গেছিল, তাই না বল ? " শুনে একাউন্টস ম্যানেজার সায়ক পাশ থেকে সায় দিল, "বাঙ্গালী আধুনিকাদের এলেম আছে বলতেই হচ্ছে বস।" বলে একটা হাই ফাইভ দিল ওদের।