চারুসাল উনিশশো সত্তর,এমনই এক বর্ষায় সেদিন বাড়িতে মহা ধুমধাম!পর পর চারটি কন্যা সন্তানের পর,সেদিন একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলো চারু।চারু বয়স তখন তিরিশ।
সেই ছোটবেলায়,চারু তার মা কে হারিয়েছে,চারুর বয়স যখন নয় বছর,তখন সে তার বাবা…
অর্পিতা কামিল্যা |
সাল উনিশশো সত্তর,এমনই এক বর্ষায়
সেদিন বাড়িতে মহা ধুমধাম!
পর পর চারটি কন্যা সন্তানের পর,
সেদিন একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলো চারু।
চারু বয়স তখন তিরিশ।
সেই ছোটবেলায়,চারু তার মা কে হারিয়েছে,
চারুর বয়স যখন নয় বছর,
তখন সে তার বাবার সাথে এদেশে চলে আসে,
বাংলাদেশ থেকে ---চিরকালের জন্যে।
একটা ছোট ভাই আর বাবাকে মাতৃস্নেহে
আগলে রেখে, উত্তর কোলকাতার ছোট্ট একটা
ভাড়া বাড়িতে, চারুর জীবন যুদ্ধের লড়াই শুরু হয়।
এক পিঠ ঘন কালো চুল, ফর্সা টুকটুকে গায়ের রঙ, গড়নে বেশ ছোট্টখাটো হলেও, কাজল পরা ডাগর, টানা টানা চোখ দুটোতে চারু ছিলো যেন, সাক্ষাৎ পার্বতী!
বয়স তখন চারুর ষোলো, তার বাবা কোনো একটা অফিসে পিয়নের চাকরি করতেন।
সে গিয়েছিল তার বাবাকে খাবার পৌঁছে দিতে।
সেই অফিসের বড়বাবু চারুকে দেখেন,
আর তারপর চারুকে পুত্রবধূ করতে চাইলে
অনায়াসে একপ্রকার অনেক উচ্চবিত্ত পরিবারে চারুর বিয়ে হয়ে যায়।
যদি ও চারুদের বাংলাদেশের জমি বাড়ি,
নেহাত কম ছিলো না। কিন্তু ওদেশের সত্যিটাকে, এদেশের বেশিরভাগ লোকে বলে, বানানো গল্প!
যাইহোক, যৌথ পরিবারে , শাশুড়ি ননদ সবার সাথে মানিয়ে নিয়ে সুখী দাম্পত্য জীবনে বেশ আনন্দেই থাকে চারু।
পরে কল্যানীতে,চারুর স্বামীর বদলী হলে,
চার কাঠা জমির উপর সুন্দর একটা তিনতলা বাড়ি বানায় চারুর স্বামী। আম ,কাঁঠাল,লিচু,লেবু,জবা, টগর, হাসনুহানায় সুন্দর সাজানো গোছানো একটা বাড়ি,
বাড়ির নাম রাখে চারুর স্বামী-- 'চারুভিলা'।
চারটি মেয়ের পরে ছেলে হয়েছে বলে,
উনিশশো সত্তরের এক বর্ষায়,তখন খুব ধুমধাম হয়েছিলো, এই চারুভিলায়।
আস্তে আস্তে এক এক করে মেয়েদের সুপাত্রস্থ করে চারু।
তিন মেয়ে সরকারি হাসপাতালে নার্সের চাকরী করে।
ছোট মেয়ে গ্ৰ্যাজুয়েট কোনো এক বেসরকারী সংস্থায় কাজ করে।
চারুর মেয়েরা মোটামুটি নিজের সংসারে বেশ ভালোই থাকে।
ওদিকে বাবাকে হারিয়ে ভাইকেও কখনো একা হতে দেয়নি চারু। ভাইএর সংসার ও গুছিয়ে দিয়েছে সে।
চারুর ছেলের যখন তিরিশ বছর বয়স,
চারুর তখন ষাট।
চারটি দিদির আদরে বাঁদর বখাটে চারুর ছেলে,
মা বাবার কথা না শুনে নিজের পছন্দে করলো একটা বিয়ে।
ছেলের বৌ আসতে না আসতেই হাজার অশান্তি শুরু।
এসব দেখে শুনে চারুর স্বামী আর বেশী দিন বাঁচতে চাইলেন না।
একদিন সত্যি সত্যি চলে গেলেন না ফেরার দেশে!যাওয়ার আগে লিখে গেলেন সমস্ত সম্পত্তি,
চারুর নামে।
কল্যানীতে মেইন স্টেশনের কাছে ,
সেই তিন তলা বাড়ির জমি সহ মূল্য প্রায়, দেড়কোটী!
প্রোমোটার রা মুখিয়ে বসে থাকে, এসব পজিশনে বাড়ি টাড়ি কেনার জন্যে।
ওদের বললে ওরা হাসতে হাসতে দুকোটী দিয়ে দেবে!
ওদিকে ছেলের বৌ সব সময় বলতে থাকে-- 'ননদদের এই বাড়ির একটা ইঁট ও দেবোনা।'
সব সম্পত্তি চারু যেন তার ছেলেকেই লিখে দেয়। একথা একরাতে, চারুর কানে যায় ! ---
আর সব সম্পত্তি চার মেয়ে এবং এক ছেলের মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করার কথা বলে চারু।
ছেলের পছন্দ করা বৌ এসব দেখে শুনে ডিভোর্সের কথা বলে।
অবশেষে ডিভোর্স হয়ে ও যায়।
কারণ ঐ বৌ চারুর ছেলে কে নয়, তার বাড়িটিকে ভালোবাসতো। চারু সে কথা ঠাউর করতে পেরেছিলো আগেই।
ছেলের ডিভোর্সের পর পাড়ার লোকজন,
সবাই সমানে চারুকেই দোষ দিতে থাকলো।
এমনকি বাড়ির কাজের লোক অবধি বলেছে--'কি দরকার ছিলো ,সম্পত্তি লিখে দিলেই পারতো।ডিভোর্স টা অনন্ত হতো না। সব কিছু তো নাতিই পেতো।'
চারুর একটি নাতি ও আছে ছয় বছরের । অন্তত সেই বাচ্চার কথা ভেবে ডিভোর্সটা আটকানো যেতো। এটাই ছিলো স্থানীয় লোকজনের বক্তব্য।
কিন্তু, ছেলের মা বাবা যখন ছেলের কথা না ভেবে ডিভোর্স করার কথা ভাবে,সেক্ষেত্রে চারু তখন নাতির কথা কোন মুখে ভাববে!
ভাগ্যের দোষে সব দোষ হয়ে যায় চারুর।
চারুর বাড়ি এখনো চারুর নামেই আছে।
কিন্তু চারু খুব অসুস্থ। কিডনির সমস্যায় ভুগছে।মাসের অর্ধেক দিন, তাকে নার্সিং হোমে থাকতে হয়। ডায়ালিসিস চলে।
চারুর বয়স এখন আশির কাছাকাছি।
চারুর ছেলে এখন ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর,
খবরের কাগজ থেকে খুঁজে, কোথা থেকে একটা বছর চল্লিশের,ডিভোর্সী বৌ যোগাড় করেছে।
এই তো এখনো একমাস হয়নি।
সেই বৌ টি সকালে ঘুম থেকে উঠেই মুখে ফেসপ্যাক মেখে বসে থাকে।
সব সময় এটা ওটা হাতে মুখে মাখছে আর মাখছেই। আর সারাদিন বাড়ির কাজের লোক রান্নার লোকের উপর হুকুম করে বেড়ায়। কাকে যেন ফোনে বলেছে-- 'বুড়িটা মরলে আমি বাঁচি'।
আর চারু, এখন শয্যাশায়ী! মৃত্যুর অপেক্ষায়...
------------/-//////-/----------