#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন
#শিরোনাম_প্রহেলিকা#কলমে_রিমলী
বাস থেকে নেমেই কিছুটা পথ হাঁটতেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল। বড় রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা ভেতরে রিক্সাস্ট্যান্ড।তবে এই শীতের সন্ধ্যায় কোন রিক্সা পাব বলে মনে হয় না।প্রায় দশ বছর পর আ…
#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন
#শিরোনাম_প্রহেলিকা
#কলমে_রিমলী
বাস থেকে নেমেই কিছুটা পথ হাঁটতেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল। বড় রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা ভেতরে রিক্সাস্ট্যান্ড।তবে এই শীতের সন্ধ্যায় কোন রিক্সা পাব বলে মনে হয় না।
প্রায় দশ বছর পর আবার এখানে আসতে হল। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে এখানে আর আসা হয়নি। অবিবাহিত পিসি এতদিন আগলে রেখেছিলেন বাড়ীটা।গত পরশু তিনিও মারা গিয়েছেন। যতই হোক বংশপ্রদীপ হিসেবে একমাত্র আমিই টিমটিম করে জ্বলছি। পৈতৃক সম্পত্তি রক্ষা করার দায়িত্বটা একা আমার ওপরই বর্তায়। ভাঙাচোরা হলেও বেশ বড় বাড়ী। ব্যবস্থা না করলে বেহাত হতে সময় লাগবে না। তাও তো গ্রামের লোকেদের ভালোই বলতে হয়, খবরটা অন্তত দিতে পেরেছে আমাকে।
শহর আর গ্রামের মধ্যে এখনো যে একটা সূক্ষ্ম তফাৎ রয়েছে তা এখানে না এলে বোঝা যেত না। তাও তো এখন বড় রাস্তা দিয়ে বাসটা আসছে। না হলে আগে লঞ্চ পেরিয়ে, অনেকটা পায়ে হেঁটে, ভ্যানরিক্সা করে আসতে হতো। এখনও কত জায়গায় কাঁচা রাস্তা, কত ঘরে আলো নেই, রাস্তার দু'পাশে ল্যাম্পপোস্ট গুলো শুধু দাঁড়িয়েই রয়েছে।আলো নেই।
ভাগ্যক্রমে একটা রিকশার দেখা পেয়ে গেলাম। তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ি পালাচ্ছিল। শীতের সন্ধ্যায় এ তল্লাটে কুকুর বিড়ালও রাস্তায় বেরোয় না। কোনরকমে বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে রাজি করাতে পেরেছি।
রাস্তাঘাটের যা অবস্থা, দশ মিনিটের পথ পেরোতে গেলে মনে হয় হিমালয় পর্বত পেরিয়ে এলাম। তবে বাড়ির সামনে পৌছতেই সব যন্ত্রণার উপশম হয়ে গেল। এক এক করে ছেলেবেলার স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠল।
ভাঙাচোরা আধখোলা দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই,টিমটিম করে জ্বলতে থাকা বাল্বের আলোয়, সামনের ভাঙা দালানে তিনজনকে বসে থাকতে দেখলাম।
__"শম্ভুর ব্যাটা না? এত দেরি হল যে আসতে?"
__"আপনাকে তো ঠিক..."
__"চিনতে পারলে না? না পারারই কথা. কতকাল আগে দেখেছো আমাকে। আমি বিষ্টুকাকা।কতবার ঘাড়ে চাপিয়ে গ্রামের মেলায় পাঁপড় ভাজা খাওয়াতে নিয়ে যেতাম..."
আমি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললাম
__"ভালো আছেন কাকাবাবু?"
__" ওই একরকম। তোমাকে আমার ছেলেই খবরটা পাঠিয়েছে। শেষদিনগুলোয় বিন্তি নিজের লোকের সেবাটুকুও পেল না।"
__"কতবার তো বলেছিলেন বাবা, পিসিমাকে কলকাতায় চলে যেতে।"
__"সবাই যদি মাটির টান ছেড়ে চলে যায় তাহলে আর বাকি কি থাকে বল? যাইহোক, টেবিলের ওপরে তোমার আজকের মত খাবার, আর কিছু চাল ডাল আলু ডিম রেখে গেলাম।এবাড়ীর একটা ব্যবস্থা করে যেও... তোমার ঠাকুরদা অতি কষ্টে বাড়িটি তুলেছিলেন।"
__"হ্যাঁ...সেতো বটেই। আমি চেষ্টা করব।"
__"কি করবে কিছু ভেবেছো?"
__" আমার পেশার সূত্রে আমায় কলকাতাতেই থাকতেই হবে। কাজেই বেচে দেওয়া ছাড়া আর তো কোন উপায় দেখছি না।"
আমার এ কথায় বিষ্টুকাকার মনক্ষুন্ন হলো বলে মনে হল বাকি দুজনের একজন বলে উঠলেন..
__"দরকার পড়লে নিশ্চয়ই জানাবেন..."
__"আপনি?"
__"আমি বিকাশ রায়। জমি বাড়ির দালালি করি।"
বিষ্টুকাকার মুখটা আরএকটু গম্ভীর হয়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি বললাম,
__"আমরা কাল কথা বলি আজ ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।"
ওনারা বেরিয়ে যাওয়ার আগে কাকাবাবু হঠাৎ নিচু স্বরে বললেন...
__"একটা কথা মনে করিয়ে দেওয়ার ছিল, পশ্চিম দিকের জানলাটা কিন্তু সন্ধ্যের পরে আর খুলো না। আর কোনভাবেই যেন দীঘির ধারে সন্ধ্যার পর, না যাওয়া হয়।"
__"এখনও সেই..."
__"কিছু জিনিসের কোন পরিবর্তন হয়না।"
কথাটা খুব গম্ভীর গলায় বললেন কাকাবাবু। বিকাশবাবু বলে উঠলেন...
__"শুধুমুধু ভয় দেখাচ্ছেন কেন কাকু আপনি অশিক্ষিত বলে সবাই তাই হবে? উনি শহরের মানুষ, উনি আপনার এসব কথা এখন মানবেন কেন?"
অপমানিত কাকাবাবুকে মাথা নিচু করে বেরিয়ে যেতে দেখলাম। খারাপ লাগলো একটু।
যাওয়ার আগে বিকাশবাবু ফিসফিস করে বলে গেলেন
__"সকালে আসছি।"
সকালে বিকাশবাবুর হাঁকাহাঁকিতে তন্দ্রা কাটলো। যদিও মশার কামড় আর চরম ঠান্ডায় ঘুমই আসেনি সারারাত। আর এমনিতেও বাড়ির ভগ্নদশার দিকে তাকালে বুক কেঁপে ওঠে।
__"উঠে পড়ুন,চা নিয়ে এসেছি..."
মনে মনে লোকটাকে অজস্র ধন্যবাদ দিলাম।
__"বলুন কি ভাবলেন?"
চায়ের কাপটা নিয়ে দুজনে দালানে বসলাম।
__" বেচতে তো হবেই... কিন্তু বাড়ির যা অবস্থা, কে কিনবে?"
__"ওসব নিয়ে ভাববেন না। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।"
__"বেশ..."
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নজর পড়লো দিঘীর ওপর, মনে পড়ে গেল কাকাবাবুর কথাটা।
__"এখনও দীঘিতে যাওয়া বারণ?ছোটবেলায় কত মাছ ধরতাম বাবার সাথে।"
__"যদি ব্যবস্থা করি আবার ধরবেন?"
এক নিমেষে মনটা আনন্দে ভরে উঠল। একগাল হেসে বললাম...
__"সম্ভব কি?"
__"সব সম্ভব। আজ বিকেলে তৈরি থাকবেন।"
__"বিকেলে? তখন তো অন্ধকার হয়ে যাবে। কিছু দেখা যাবে না।"
__"বললাম তো সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।তার আগে জেলেদের ভীষণ কড়াকড়ি। তৈরি থাকবেন চলে আসব..."
সাড়েচারটে নাগাদ বিকাশদার সাথে দিঘীর ধারে পৌছতেই,আমাদের পথ আটকে দাঁড়ালো একজন।
__"একি বিকাশ? উনি কে? এখন কোথায় যাচ্ছ?"
__"উনি গ্রামেরই লোক। বহুদিন বাদে শহর থেকে এসেছেন।একটু দিঘীর ধারটা ঘুরিয়ে আনছি।"
__"সন্ধ্যার সময় দিঘির পাড়ে যাওয়া বারণ।নিশ্চয়ই জানেন?"
বিকাশদা কিছু বলতে গেলে আমি কথা আটকালাম...
__"কি সমস্যা বলুন তো?"
__"এ দীঘি অভিশপ্ত।সন্ধ্যার পর এখানে আলেয়ার দেখা পাওয়া যায়।কেউ সচরাচর আসতে চায়না। যারা সাহস দেখিয়ে এসেছেন, তারা আর ফিরে যাননি।"
লোকটা যতটা গলার স্বর নামিয়ে যতটা গম্ভীরভাবে কথাটা বলার চেষ্টা করছিল, আমি থাকতে না পেরে হোহো করে হেসে উঠে ওনার সব গাম্ভীর্য নষ্ট করে দিলাম। বৈদ্যুতিক আলোর সাথে সাথে এই গ্রামে শিক্ষার আলো ঠিকমত পৌঁছায়নি। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
__" আলেয়া কোন ভূত বা অপদেবতার কারনে হয় না। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। গাছপালা পচনের ফলে,যে মার্শ গ্যাসের সৃষ্টি হয়,তার থেকে আগুন লাগে।ওটাই আলেয়া।"
উলুবনে মুক্ত ছড়িয়ে কি লাভ...লোকটা আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বলল__
__" বিশ্বাসটা সম্পূর্ণ নিজের ব্যাপার। সাবধান করাটা আমার উদ্দেশ্য। আপনারা ফিরে যান।"
বিকাশদা কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন
__"ফিরে চলো। কাল চেষ্টা করে দেখব।"
দুপুরে বিকাশদার বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজন সারতে সারতে,আজ সন্ধ্যায় দিঘীর ওপারে যাওয়ার প্ল্যানটা পাকা করে নিলাম।আলেয়া দেখার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি। সে কোন ছোটবেলায় ইচ্ছে। তাছাড়া হাতে সময় কম।
আমাকে তাড়াতাড়ি কলকাতায় ফিরতে হবে। শীতের ছুটি প্রায় শেষ। স্কুল খুলবে। ছেলেদের সাজেশন দিতে হবে। বাড়িটা বিক্রি হলে ভালোমতন টাকা পাব, তা দিয়ে আরামসে চলে যাবে। ছাত্রদের পেছনে আর মাইনে মাইনে করে তাগাদা দিতে হবেনা ।বিকাশদা একজন ক্রেতার সন্ধান দিয়েছেন।লোকটা রাজিও হয়েছে মনে হল।
জামা কাপড় গুলো ব্যাগে তুলতে তুলতে, বিকেলের সূর্যকে ঘুমিয়ে পড়তে দেখলাম দীঘির জলে।
দীঘির ধারটা সত্যিই ভীষণ থমথমে। ঝিঁঝিঁ পোকার গানে, কেমন যেন ঘোর লেগে যায়।দূরে দু তিনটে বাধা নৌকা। আমি মশার কামড় খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি।এদিকে বিকাশদার আসার নামই নেই।
একহাত দূরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। পাতা পচা গন্ধে, মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়।
হঠাৎ কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ চমকে দেখি,বিকাশদা আঙ্গুল দিয়ে কি একটা দেখাচ্ছে। তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই দুটো আলোর মত কি যেন জল থেকে উঠছে আর নামছে।
__"আ...লে...য়া"
__"সামনে থেকে দেখি চলো।"
সত্যি বিশ্বাস হচ্ছেনা।অপূর্ব দৃশ্য। এতটুকুও ভয় তো লাগছে না। মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ টের পেলাম হাঁটুর কাছে ভিজে ভিজে লাগছে। হুঁশ ফিরতেই দেখি আমি একবুক জলে দাঁড়িয়ে।
প্রচন্ড ভয় পেয়ে উঠে আসার চেষ্টা করতে গিয়ে যখন দেখলাম আমি আরো তলিয়ে যাচ্ছি,মাথাটা সত্যিই ঘুরে গেল। হাজার চেষ্টা করেও উঠে আসতে পারছিনা। দূরের আলোটা ভীষণরকম কাছে লাগছে। "বিকাশদা..."
চীৎকার করেও কোনো সাড়া পেলাম না। ততক্ষণে আমি প্রায় হাবুডুবু খেতে বসেছি। প্রাণপণে চেষ্টা করেও উঠতে পারছি না। তবে কি?...
জ্ঞান ফিরতে, কোনরকমে দুচোখ মেলে দেখলাম মুখের সামনে অনেকগুলো মাথা, আর কয়েক জোড়া ভীত চোখের ভীড়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম বাড়িতেই আছি। বিষ্টুকাকা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
__"কতবার বারণ করেছিলাম ওখানে না যেতে। এইভাবেই তো বশ করিয়ে নিয়ে যায় তেনারা। হারান যদি না দেখতো কাল..."
__"হারান কে?"
একটা বারো-চোদ্দ বছরের ছেলে এগিয়ে এল।
__"আমি হারান।বিকাশকাকুর পাশের বাড়িতে থাকি। কাল আপনি চলে আসার পর থেকেই কাকুর খুব জ্বর। মাথা তুলতে পারছেন না।আপনাকে খবর দিতে বলেছিলেন, যে আজ উনি দীঘির ধারে যেতে পারবেন না। আপনার বাড়িতে এসে আপনাকে না দেখতে পেয়ে দীঘির ধারে গেলাম, সেখানে গিয়েই তো দেখি আপনি হাবুডুবু খাচ্ছেন। কোনরকমে পাড়ার লোকজনকে ডেকে এনে আপনাকে তুলেছি।"
__"বিকাশদা কাল যাননি?"
__"বললাম তো খুব জ্বর..."
হারান বলেই চলেছে। আমায় ঘিরে থাকা কয়েকজনেরাও নিজেদের মতন কাহিনীর জাল বুনছে।
শুধু আমার চোখের সামনে থেকে সেই দুটো আলো এখনও সরছে না। এখনো চোখে ধাঁধা লেগেই আছে। হয়তো এখনও কোনো ঘোরেই আটকে আছি...