Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

লেখিকা মনীষা পলমল-এর লেখনী সম্ভার

# শিরোনাম- জীবন রঙ্গ# কলমে -মনীষা পলমল2/2/22
 মাঘের সূর্য ধীরে ধীরে অস্তাচলগামী হচ্ছে! মায়াবী আঁধারে চরাচরে ঢাকা পড়তে চলেছে। আজ "আইখ্যান দিন"! প্রান্তিক মানুষজনের শিকার যাত্রার শুভ দিন। সুন্দরী পলপলা নদী আর ঘন জঙ্গল যে…

 


# শিরোনাম- জীবন রঙ্গ

# কলমে -মনীষা পলমল

2/2/22


 মাঘের সূর্য ধীরে ধীরে অস্তাচলগামী হচ্ছে! মায়াবী আঁধারে চরাচরে ঢাকা পড়তে চলেছে। আজ "আইখ্যান দিন"! প্রান্তিক মানুষজনের শিকার যাত্রার শুভ দিন। সুন্দরী পলপলা নদী আর ঘন জঙ্গল যেন একে অপরকে আগলে রেখেছে। অসাধারণ সৌন্দর্য্যমণ্ডিত অরণ্যভূমি আর এখানকার আরাধ্য দেবী মা স্বর্গবাউরী। মকর সংক্রান্তি আর আই খান দিনে ভক্তের ঢল নামে এখানে। স্থানীয় লোকজন ছাড়াও ওডিশা ও ঝাডখন্ড থেকেও বহু মানুষ আসে এখানে। হাতি ঘোড়ার ছলনে ভরে যায় মায়ের থান ।গ্রামীণ মেলায় লোকের ভিড়ে টুসু ঝুমুরের সুরে সুরে জঙ্গলমহলের বাতাস মুখর হয়ে ওঠে। আজও তাই হয়েছে। মায়ের মন্দিরে হাতি ঘোড়ার ছলনে স্তুপ জমে উঠেছে ধূপধুনা র সুগন্ধে মানুষের আনন্দ কোলাহলে মুখরিত সুন্দরী বনভূমি। আকাশ ও অরণ্য দুজনেই জল মুকুরে মুখ দেখে। অরণ্যে হাতির বড় উৎপাত ।পলপলা জলে জলকেলি করে মহাকালের দল। শুঁডের জলফোয়ারার জলকণা ভিজিয়ে দেয় নদীতটের ঘাসের বনকে। বেনা কাশের ঝাড় জলকণার স্ফটিকের হীরক দ্যুতিতে জ্বলজ্বল করতে থাকে। সূর্য ডোবার বেলাতে আস্তে আস্তে মায়ের থান জনশূন্য হয়ে পড়ছে। শেষ দলটিতে রয়েছে বাহা মনিরা। ওরা এসেছে ঝাডখন্ড থেকে--- ছেলে মেয়ে মিলিয়ে 8 জনের দল! জনশূন্য ঠাকুর থানে ফুল ধুপ ধুনা ফলমূলের গন্ধ মিলেমিশে মনটাকে ভরে দিচ্ছে। মাঘের হিমেল বাতাসে ভেসে ভেসে সেই সুবাস চলেছে সুন্দরী পলপলা নদীর ওপর দিয়ে জঙ্গলের গভীরে। বাহার মনও সেই সুবাসের মত আনন্দের আবেশে ভরে আছে---- কারণ এই মেলায় ও ওর মনের মানুষ খুঁজে পেয়েছে---- রানী ঝোরের সা জোয়ান" নবীন"--- মা'স্বর্গ বাউরির দেহুরি বংশের ছেলে। যেন সতেজ শালতরু-- যেমন দীঘল চেহারা তেমনি সুন্দর বাঁশি বাজায়! এই বাঁশিই বাহা ও নবীনকে কাছাকাছি এনেছে। এখান পরবের শিকারি দলের পান্ডা নবীন। জঙ্গল থেকে খরগোশ তিতির ঘুঘু শিকার করেছে। এ জঙ্গলে হুডার বা নেকড়ে ও আছে তবে সংখ্যায় কম। আর আছে মহাকাল--- হাতির দল! সূর্য ডোবার রাক্ষসী বেলায় সুন্দরী পলপলার জল তোলপাড় করে এরা। তারপর ধীরে ধীরে জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের সবজি খেতে হামলা চালায় তছনছ করে দেয় রবি ফসলের সাজানো সম্ভার। শুরু হয় হাতিখেদানো অভিযানের ---এখানেও নবীন নেতৃত্ব দেয়! বাহা মনির কিশোরী মনে গভীর ছাপ ফেলেছে নবীনের কর্মকাণ্ড। নিজের অজান্তেই মন হারিয়েছে কিশোরীটি। এই সেই চিরন্তন লীলা জীবন রঙ্গের। দলের সবার সঙ্গে ফিরে চলেছে নিজের গ্রামের পথে। ওর মন কিন্তু পড়ে আছে স্বর্গ দেহুরির থানে। নবীনের বাঁশির সুর ,সাহস ,নেতৃত্ব দেবার সহজাত ক্ষমতা বাহার মন হরণ করেছে!


 হঠাৎই ওদের রাস্তার বাম পাশের জঙ্গলে আলোডন----- মহাকাল!! ভয়ে আতঙ্কে দিশেহারা বাহা হঠাৎ একটা সবল হাতের হ্যাঁচকা টানে পাশের ডুঙ্গরির ঢালে টেনে নেয় ওকে। পাহাড়ের ঢালে পাথরের খোঁদলে আশ্রয় নেয় দুজনে। নিজের হৃদপিন্ডের শব্দ এখনো বাহার কানে বাজছে। সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরলও। মহাকালের দলের সামনে পড়লে আর বেঁচে ফেরার অবস্থা থাকত না। ওকে মৃত্যুর পথ থেকে জীবনে টেনে এনেছে "নবীন"---- ওর স্বপ্নের রাজকুমার! ও বোঝে মাস্বর্গ বাউরীর ইচ্ছে এটাই। নবীনের হাত ধরে জীবন পথে এগিয়ে যায় বাহা।

🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹

 # জীবন পথের বাঁকে

# কলমে --মনীষা পলমল

 শিক্ষক দিবসের আবহে বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে আমার জীবন পথের বাঁকে বাঁকে দেখা হওয়া সেই সব শিক্ষকদের কথা যাঁরা আমাকে জীবনবোধের শিক্ষায় সমূদ্ধ করেছেন। এঁদের অনেকেরই তথাকথিত পুঁথিগত বিদ্যা নেই। অনেকে স্বাক্ষর ই নন। এঁদের কাছ থেকে যে শিক্ষা আমি পেয়েছি তা আমার জীবনের মণি-মুক্তার অলংকার হয়ে রয়েছে।

  প্রথমেই বলি শতদল দিদার কথা। উনি একজন বৈষ্ণব সাধিকা। নিঃস্বার্থ ভালোবাসা জীবন্ত প্রতিমূর্তি। কোন কিছু আশা না করে মানুষকে ভালবাসতে হয় কিভাবে এঁকে দেখে শিখেছি।

 আমার জীবনের আরেক শিক্ষিকা" শশী দিদা"!

 উনি একজন ঝুমুর শিল্পী! দেশের কথায়" নাচনী"।

 মহাভারতের অদ্ভুত সুন্দর ব্যাখ্যা করেছিলেন উনি---- মহাভারত 5 কালো মানুষের কাহিনী-- কৃষ্ণ, ব্যাস, সত্যবতী, দ্রৌপদীও অর্জুন। মহাভারতের নারী চরিত্র দ্রৌপদী কুন্তী সত্যবতী সম্পর্কে ব্যাখ্যা অবাক করে দেয়। উনি বলেছিলেন---" নিজেকে সম্মান করিস ভাই!যে নিজেকে সম্মান করে না সে কাউকেই সম্মান করতে পারেনা।"

 আনন্দ বাউল-- সাতবউনির মেলায় উনার সাথে আলাপ। সুন্দর সহজভাবে মরমিয়া তত্ত্ব বোঝালেন। মনের মানুষকে কেন বাইরে খোঁজো খোঁজো অন্তরে সেখানেই তাঁর অবস্থান। আমি বাকরুদ্ধ! কি সহজ বিশ্বাস! কী সুন্দর ব্যাখ্যা। অন্তরেই তো বিরাজ করেন অন্তর্যামী।

 এমনই আরেক বাউল সাধিকা -" রসকলি"! নামটাই তাঁর রূপের মত মিষ্টি। এই বাউল বলেছিলেন ভালোবাসার কথা। প্রকৃতি জীব সবাইকে ভালবাসলে ভগবানকে ভালোবাসা হয়। সর্ব জীবে তিনি বিরাজ করছেন। তার প্রকাশ আলোকে বায়ুতে সৌরভে জীবকূলে।

 একই কথার প্রতিধ্বনি শুনেছিলাম আমার বান্ধবীর শাশুড়িমা ফুলমণি সরেন এর কাছে। উনিও বলেছিলেন ভালোবাসার কথা।

"" জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর"!

 এবার বলব এক তামিল বৃদ্ধার কথা--- যিনি একা এই পৃথিবীতে কেবলমাত্র যীশুকেভরসা করে কাটিয়ে দিলেন। রেলের কর্মচারী স্বামী ও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল তাঁর। সুদূর তামিলনাড়ু থেকে রুজি-রুটির টান রেল শহরে এসেছিলেন ওনার শ্বশুর। হিজলি স্টেশনের লাগোয়া বস্তিতে থাকতেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে রেল লাইনে কাটা পড়লো ছেলে টি। এই শোকে স্বামী পাগল হয়েগেলেন। তিনিও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। অসহায় বৃদ্ধা অক্ষর পরিচয় হীন। একমাত্র বিশ্বাস" যিশু বাবা"র উপর! শুরু হলো তার বাঁচার লড়াই। কয়েক বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন।কী আত্মসম্মানবোধ। কখনো

 দান নিতেন না। বয়সের ভারে ন্যুব্জ দেহ তবুও কিছু কাজের বিনিময়ে খাদ্য যোগাড় করতেন।

 আমাদের বাড়িতে যখন আসতেন আমার ঠাম্মির সাথে বসে গল্প করতেন। আমাদের বাগানের গাছগুলো তে জল দিতেন। কিছু কাজ না থাকলে আমাকে ধরে বসিয়ে আমার লম্বা চুলে বেনি করে বাগানের ফুলের মালা লাগিয়ে দিতেন। দক্ষিণী মেয়েদের সাজে সাজিয়ে খুব আনন্দ পেতেন। সেই আত্মসম্মানবোধ আমি অনেক তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও দেখিনি। এঁরাই আমার জীবনবোধের শিক্ষক--- নমি নমি চরণে।।

🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷

# মন উদাসীর কথকতা

# কলমে- মনীষা পলমল

17/11/21

 হৈমন্তী বিহানসাঁঝ আমাকে স্মৃতিমেদুরতায় আবিল করে তোলে। ফেলে আসা শৈশব কৈশোরের মিঠেল স্মৃতির টানে ফিরে যাই সেই সোনালি সময়ে-----" কুমু ----" "কুমু"-- দূর থেকে ভেসে আসছে ঠাম্মির মিষ্টি স্বর---" আয় ইতু পুজোতে বসবি আয়। সবাই যে অপেক্ষা করছে তোর জন্য।"

 দশহাতী বৃন্দাবনী শাড়িটাকে কোনরকমে সামলাতে সামলাতে এসে দাঁড়ায় তৃতীয় শ্রেণীতে পড়া দস্যি মেয়ে টা। মাথার লম্বা কোঁকড়া চুল থেকে তখনো টপটপ করে জল ঝরছে। পুজোর জন্য মাথা ভিজিয়ে স্নান করেছে যে।

 তাড়াতাড়ি বড় ঠাম্মি এসে মাথা মুছিয়ে শাড়িটাকে গুছিয়ে পরিয়ে দেয়। এক দঙ্গল কিশোরী মেয়ে বসেছে তুলসী মঞ্চ কে ঘিরে। প্রত্যেকের সামনে ইতুর সরা। শুষনি কলমি মটর কচু গাছগুলো যেন শনশন করে বাড়ছে! যার সরার গাছের বৃদ্ধি বেশি সে আনন্দে ডগোমগো! কুমুর মন তো পড়ে আছে সদর দরজায়--- কখন আসবে সেই মন আকুল করা ডাক--" রাইমনি"---- এসেছে-- এসেছে! বৈষ্ণবী শতদল-- ওর "শতদল দিদা"!

 পুজো শেষে কিশোরীর দল ঘিরে ধরে বৈষ্ণবী কে! দিদার কাছে যে আছে গল্পের ঝুলি! গান আর গল্প এই দুই অস্ত্রে ঘায়েল মেয়ের দল। আঘুন দুপুরের মিষ্টি রোদে; ভিজে চুল এলিয়ে রোদে পিঠ দিয়ে চলেছে তাদের গল্পের আসর! গল্প শেষে শতদল বোষ্টমী চলল নিজের কুঞ্জে--- সাথী হয় দস্যি মেয়ে টা। কাঁসাইচরের মোহময় ডাক যে সে এড়াতে পারে না। দিগন্ত বিস্তৃত শস্য ক্ষেত, নদী ঘাটের একলা আশুদ গাছটা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। কাঁসাই পাড়ের মনসার আটনের ছলন গুলো যেন তাকে গল্প শোনায়। বিষম ঢাকির ধূমুলে, তুমরি বাঁশির সুরে তার ঘর বিবাগী মন ভেসে চলে! নদীতীরের সরষে ক্ষেতের বাসন্তী রং লাগে তার দুই নয়নে! সোনালী ফসলের খামে হৈমন্তী প্রকৃতি তাকে উৎসবের চিঠি পাঠায়। ইতু টুসু নবান্ন মকরের আনন্দের ডাকে মন ভরে ওঠে। তার কানে বেজে ওঠে ভাদু গানের কলি---" উলটপালট ফুলোট বাঁশিতে

    ঢোলে তালে কাঠি পড়ে না--"

 নবান্নের পৌষ লক্ষ্মীর পূজার পরমান্ন নলেন গুড় পিঠে র সুবাসে ম ম করতে থাকে প্রকৃতি।

 কাঁসাইচরের গুড় কারিগরদের অস্থায়ী বাসস্থান যেন হাতছানি দেয় মেয়েটাকে। নলেন গুড়ের সুগন্ধে খেজুর লবাতের মিষ্টতায় সারা পরিবেশ মাখা থাকে। আকাশে বাতাসে উৎসবের আমেজ। মেলা খেলার আনন্দে ভরে উঠে চরাচর। ধান বোঝাই গরুর গাড়ি গুলোর চাকার ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ যেন ওকে আনমনা করে দেয়। কাঁসাই চরের পরিযায়ী পাখি আর গুড় তৈরি করা পরিযায়ী মানুষগুলো দুই ই কুমুর মনের তারে অনুরণন তোলে।

 একটা টুসু গানের কলি ওর মনে বারবার গুনগুন করতে থাকে---" টুসু যাবেন কলকাতা 

খিদা পেলে খাবেন কি?

 আন লো টুসুর নতুন গামছা

 জিলিপি ছাঁদা বাঁধে দি।"

 টুসুর চৌদলের রঙিন কাগজের রঙ যেন অস্তগামী সূর্যের রং এর সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। টুসু বিদায়ের ব্যথার সাথে মকর পরবের আনন্দের অশ্রু মিশে এক আনন্দ বিষাদমাখা ভালোবাসার জন্ম দেয় কুমুর মনে। 

এই ফেলে আসা কিশোরী বেলা আনন্দ বিষাদের মোড়কে ঢেকে ফেলে মননকে। মনের তারে অনুরণন ওঠে----" ভুলি কেমনে

 আজো যে মনে 

বেদনা সনে রহিলো আঁকা-----"!

🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️

 # শিরোনাম- আমার ছুটি 

# কলমে- মনীষা পলমল

15/11/21

 ছুটি এই শব্দটা আমার মনে রামধনুর সাত রং এর ছটা বিছিয়ে দেয়। ছুটি মানেই সাংসারিক দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি। মন বাউল এর ইচ্ছে ডানা মেলা। আমার ছুটির মানে এটাই। তাই যখনই সুযোগটা পাই সঙ্গে সঙ্গে তার সদ্ব্যবহার করি। আমার মন বাউলের পরিক্রমা শুরু হয় চেনা অচেনা পথে। পথে নামলেই তো পথ চেনা হয় এভাবেই ছুটি তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। এমনই এক ছুটির আনন্দ আমাকে প্রকৃতির রহস্যের আরো কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল--- আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি কে এসেছিল আরো অমূল্য রত্ন রাজি! প্রায় চার দশক আগের কথা----- কজন জঙ্গল পাহাড় ভালোবাসা মানুষ বেরিয়ে পড়েছে ছুটির আনন্দে! নাগরিকতার যান্ত্রিকতায় আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা মন গুলো খোলা হাওয়ায় একটু প্রাণ খুলে শ্বাস নিতে চলেছে পুরুলিয়ার পথে! জল জঙ্গল পাহাড়ের সরজমিন পুরুলিয়া তখন ছিল আদিম অনাঘ্রাতা কিশোরীর মত। যোগাযোগ ব্যবস্থা ও তখন ভাল ছিলনা, রাস্তাঘাটও ভালো নয়। আমাদের নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য ছিল না। আদিম পুরুলিয়া কে আমরা আমাদের মতো করে আবিষ্কার করতে চলেছিলাম। অযোধ্যা পাহাড় তলীতে এক মাহাতো জোতদারের অতিথি হয়ে তার বাড়ি কে কেন্দ্র করে চলল আমাদের জঙ্গল ট্রেকিং অভিযান। আদিম অযোধ্যা তখন জঙ্গলের চাদরে ঢাকা। হাতি বাঘ নেকড়ে ভালুকের লীলাভূমি। আর রয়েছে সরল সাদাসিদে আদিবাসী জনগোষ্ঠী। এদের আতিথ্যের আন্তরিকতায় ভেসে গেলাম। এখানেই দেখা হয়েছিল এক অদ্ভুত প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষের সাথে--- রামেশ্বর চালক-- মানুষটির একমাথা কাঁচাপাকা চুল ,মায়াবী চোখে কি যে মায়া মাখানো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। উনি জঙ্গল পাহাড়ে, নদীর তীরে ,টাঁডভূমিতে গাছ লাগিয়ে বেড়ান !এটাই উনার নেশা। বাড়ির সবাই ওকে ক্ষ্যাপা বলে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম একটা সুন্দর মনকে। পরবর্তী প্রজন্মকে একটা সুন্দর সুস্থ প্রকৃতির উপহার দেওয়ার জন্য নিরলস একক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখানে সবাই ওকে "গাছ বুড়া "নামে ডাকে! উনার লাগানো জঙ্গল ঊষর টাঁড চাট্টান কে সবুজের মায়ায় ঢেকেছে। ন্যাড়া পাহাড়ে সবুজ কেশের বাহার হয়েছে। পলাশ শিমুল শালের বনের সাথে পাহাড় ও এখন সবুজের গানের দোহারকি করছে। আমার ছুটির আনন্দ আরো বেড়ে গেল গাছবুডার সাহচর্যে। উনাকে অনুসরণ করে সারা অযোধ্যা পাহাড় ঘুরেছি। কাসাই উৎস ঝাবরনালায় গেছি উনার সাথে।"" গাছকে ভালবাসলে গাছ তার প্রতিদানে ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয় গাছ বেইমানি জানেনা"--- এই শিক্ষা পেয়েছি উনার কাছ থেকে যা আজও আমার কাছে বেদবাক্য হয়ে আছে! ছুটি শব্দটা তাই আমার কাছে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে গেছে! দুয়ারসিনি জঙ্গলের পথে সাতগুরুং এর সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে হারিয়ে গেলাম ছুটির আনন্দে। সাতগুরুং বড় সুন্দরী নদী-- আদিবাসী কন্যার মত তার চলন! ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ পরিবর্তন মনকে আবিল করে দেয়। আর যখন বামনি ফলস এর পাকদন্ডী বেয়ে উতরাই এ নামছি অজানার আনন্দে মন ভরে উঠছে। মাঝে মাঝে মেঘের আঁচলে ঢেকে দিচ্ছে চরাচর। সূর্যের আলো পড়ে রামধনুর সাত রঙে ছটায় সেজে উঠছে সুন্দরী অযোধ্যা। জলকণার রামধনুর মুকুটে সে সুন্দরীর তাজে সেজেছে। আমার ছুটি সার্থকতায় ভরে গেছে। আজও তাই ছুটি মানেই প্রকৃতি সঙ্গ---- তা সে জঙ্গল --পাহাড়-- নদী বা সমুদ্রের যাই হোক না কেন!

🌻🌻🌻🌻🌻🌻🌻🌻🌻🌻🌻🌻🌻🌻🌻🌻🌻

 # "ঘুনসি তে বাঁধা থাকে ভাঙা মনের পুরাণ----- টুসু"

# কলমে- মনীষা পলমল( সুকান্তনগর তালবাগিচা পশ্চিম মেদিনীপুর)

21/12/21


 মিঠেল শীতে টুসুর স্মৃতি 

কুয়াশার ওই মায়াতে,

 জাগিয়ে তোলে মনের কোণে

  পৌষালী এই প্রভাতে!

 অঘ্রাণ সংক্রান্তি কিংবা পয়লা পৌষ টুসু স্থাপনের মঙ্গল ক্ষণ। জঙ্গলমহল---- প্রান্তিক শিখর ভূমের প্রাণের উৎসব--- টুসু পরবের প্রারম্ভ!


 এইদিন কুমারী মেয়েরা নতুন মাটির সরার পিটুলি মাখিয়ে তাতে তুষ দিয়ে পূর্ণ করে। ওই সরাতে হলুদ সিঁদুর চন্দনের ফোঁঁটা সাজিয়ে , তুষের ওপর কাডুলি বাছুরের গোবরের মন্ড, ধান আতপ চাল আকন্দ, বাসক ,কাচফুল গাঁদা ফুলের মালা দিয়ে পাত্রটিকে পিডি বা কুলুঙ্গি র উপর স্থাপন করা হয়। এই সরাটি প্রতিদিন সন্ধ্যার পর টুসু দেবী হিসাবে পূজিতা হন। পৌষালী সাঁঝে দলবদ্ধ কুমারী মেয়েদের গানের সুরে মেতে ওঠে জঙ্গলমহলের আকাশ বাতাস। টুসু দেবীর কাছে তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতা সুরে সুরে নিবেদন করেন। দেবীর ভোগ হিসেবে চিঁডে গুড় বাতাসা মুড়ি ছোলা ইত্যাদি সাধারনত ব্যবহার করা খাদ্য নিবেদন করা হয়। বড় আন্তরিক এই লোক উৎসব। সীমান্ত বাংলার প্রান্তিক কৃষিজীবী সমাজের বড় আপনার জন এই টুসু। ঘরের মেয়ে আর দেবী এখানে একাকার। কৃষি লক্ষ্মী এখানে টুসুর প্রতীক। টুসুর উৎসবের শেষ চার দিন চাঁওড়ি- বাউডী -মকর- আখান নামে পরিচিত!

 চাঁওড়ি দিনে মেয়েরা ঘরদোর গোবর মাটি দিয়ে নিকিয়ে চালের গুঁড়ি তৈরি করেন।

 বাউডী দিনে তৈরি করা হয় পুর পিঠে ,পুলি পিঠে যা গডগড্যা পিঠে নামে পরিচিত। এইদিন জঙ্গলমহলের মানুষেরা "গুঁড়িহাত" রীতি পালন করেন। অর্থাৎ নতুন চালের গুঁড়ো দিয়ে পিঠে তৈরি করে। বাউডী দিনে হয়" টুসুর জাগরণ।" মেয়েরা জাগরনের ঘর পরিষ্কার করে ফুলমালা আলো দিয়ে সাজায়! সারারাত ধরে মেয়েরা টুসু গান এ অংশগ্রহণ করে! এদিন কুমারী ছাড়াও গৃহবধূ ও বয়স্করা গানে অংশ নেয়! জাগরনের রাতে টুসুর ভোগ হিসেবে বিভিন্ন মিষ্টান্ন ছোলা ভাজা মটর ভাজা মুড়ি মুড়কি জিলিপি নিবেদন করা হয়।

 পৌষ সংক্রান্তি বা মকর দিনের ভোরলবেলায় মেয়েরা দলবদ্ধভাবে গান গাইতে গাইতে টুসু দেবীকে বাঁশ , কাঠ রঙিন কাগজে সজ্জিত চৌদল বা চতুর্দোলায় বসিয়ে নদী বা পুকুরের ঘাটে নিয়ে যান। সেখানে বিভিন্ন টুসু দলের মধ্যে হয় গানের প্রতিযোগিতা। এরপর টুসু বিসর্জন করে নদীতে বা পুকুরে স্নান করে নতুন কাপড় পরেন।

 ছেলেরা পাটকাঠি খড় দিয়ে তৈরি করেন "মেডা ঘর"! এই ঘরে আগুন দিয়ে পালন করেন টুসু পরবের শেষ রীতির।

 টুসুর চৌদলের রামধনু রঙে শিখর ভূমের কাঁসাই শিলাই কেলেঘাই সুবর্ণরেখার ঘাট গুলি ঝলমল করতে থাকে। টুসু গানের মায়াবী সুর ভেসে বেড়ায় লিলুয়া বাতাসে----

" উপরে পাটানিচে পাটা

 তার ভিতরে দারোগা

 ও দারোগা পথ ছাড়ে দাও

 টুসু যাবেন কলকেতা।

 টুসু যাবেন কলকেতা

 খিদে পেলে খাবেন কি?

 আনগো টুসুর নতুন গামছা

 জিলিপি ছাঁদা বাঁধে দি।"

 মকরের অপরিহার্য অঙ্গ টুসু গান! মানুষের চিরন্তন আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ এই গানে! মানভূমের ভাষা আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গের দিনে মানুষকে সচেতন করার কাজে টুসু গানের এক বিরাট ভূমিকা ছিল! প্রকৃত অর্থেই টুসু মহামিলনের পরব! 

 আখান বা আইখ্যান দিন প্রান্তিক মানুষজনের শিকার যাত্রার দিন।

জঙ্গলমহল জুড়ে সারাবছরই চলে উৎসবের বাতাবরণ। হৃদয়ের টানে সকলে মেতে ওঠে এই উৎসব গুলিতে। পুরুষানুক্রমিক ভাবে এই উৎসব চলে আসছে শিখর ভূমে-- এটাই শাশ্বত লোক সংস্কৃতির পরিচয়!

🌼🌼🌼🌼🌼🌼🌼🌼🌼🌼🌼

# সাতবহনা

# কলমে- মনীষা পলমল

23/1/22


 সুবর্ণরেখার বাঁকে বাঁকে রয়েছে কতনা লোকায়ত দেবদেবীর থান বা আটন। তাঁদের পরান কথা এই বিশাল চর ভূমিকে এক অপার্থিব মায়ায় জড়িয়ে রেখেছে। তেমনই কিছু লোক দেবীর পরান কথা শোনাই আজ।

" সাতবহনা"--- অর্থাৎ সাত বোনের কাহিনী!

 নয়াগ্রাম এর ডাহি গ্রামের" মা সাঁতাই বুড়ি"-- এঁদের অন্যতম।

 ভসরাঘাট থেকে সুবর্ণরেখা নদী পেরিয়ে নয়া গ্রামে প্রবেশমুখে নদীর গর্ভে দেবীর থান। কোন আচ্ছাদিত মন্দির নেই। প্রাচীর ঘেরা বেদির ওপর হাতি ঘোড়ার ছলনে পুজো। মা এখানে গ্রাম চন্ডী হিসেবে পুজো পেয়ে থাকেন। "সাঁতাই বুড়ি" আসলে সাঁতারে বুড়ি" --- যিনি সুবর্ণরেখার করাল গ্রাস থেকে আর্তকে রক্ষা করেন। এই দেবী সম্পর্কে নানা উপকথা শোনা যায় এলাকার মানুষের মুখে। জনশ্রুতি যে মা রোজ রাতে বেড়াতে বের হোন আর মাকে যাতে কেউ দেখতে না পায় তাই এলাকা দিয়ে যাবার আগে গলাখাঁকারি দিতে হয় যাতে মা নিজেকে আড়ালে সরিয়ে নিতে পারেন। কথিত আছে একজন এটা না করায় মায়ের হাতের চড় খেতে হয়েছিল তাকে-- এমনই মানুষের বিশ্বাস! মায়ের নাম করে খরস্রোতা নদী নাকি "ভাসা শিলা" চড়ে পার হয়ে ছিলেন একজন! তিনি মাকে"দামুজুডি" পাঁঠা বলি দিয়ে পুজো দিয়েছিলেন।" দামুজুডি "পাঁঠা বলি অর্থে পাঁচ থেকে সাতটি পাঁঠা। এই দেবীর পুজো হলেন দন্ডছত্রী মাঝি বা নৌকা চালকেরা। এরাই মায়ের দর্শন পান তাই এরাই দেহুরী। জনৈক অভিমুন্য ভূঁইয়া এই পূজার প্রচলন করেন।

 শনি ও মঙ্গল বারে নিত্য পূজার সাথে সাথে মকর সংক্রান্তিতে হয় বাৎসরিক উৎসব। বসে গ্রামীণ মেলা। পুজোর নৈবেদ্য হিসেবে নারকেল ফলমূল পায়েস এমনকি ঝারি ভোগ অর্থাৎ মদ ও উৎসর্গ করা হয়। উৎসর্গ করা হয় "ছলন "অর্থাৎ মাটির হাতি ঘোড়ার মূর্তি! সুতোতে ঢিল বেঁধে ও মানত করে সবাই। আশা পূর্ণ হলে পুজো দিয়ে মানত রক্ষা করে। কেউ ছলনা উৎসর্গ করে কেউ বলি না দিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে পাঁঠা মোরগ বা ডাকুয়া ছেড়ে দেন ,পায়রা উড়িয়ে দেন!

 এলাকার মানুষের বড় আপন এই লোক দেবী!

 সাতবহনার অপর দেবীরা হলেন----

1) নদীর অপর পাড়ে আটাঙ্গা গ্রামের রুকনি বুড়ি

2) ঝাড়েশ্বর পুরের বাসুলি বুড়ি

3) নয়াগ্রামের মহাকুলদের পুকুরে কেতকী বুড়ি

4) কুড়চিবনীর খরকাই বুড়ি

5) জামিরাপালের কুঙারসাই বুড়ি

6) রামেশ্বর নিমাই নগরের দুয়ারসিনি বুড়ি!


 দুয়ারসিনি বুড়ি--- রামেশ্বর মন্দিরের সোপানতলে তেঁতুল বাঁশ চরলা, শ্যাওড়া গাছের বেষ্টনীতে রয়েছেন মা দুয়ারসিনি। ছলন স্তূপের আবেষ্টনী বিরাট উঁচু। মাঝে মায়ের মুন্ড মূর্তি। মুক্তির দুপাশে পাহাড়প্রমাণ ছলনস্তূপ। এখানেও শনির মঙ্গলবারে এমনি পূজা ও মানত রক্ষার পূজা হয়। ছলন বেঁধে মানত করা ও ছলন উৎসর্গ করে মানত রক্ষা--- লৌকিক রীতিতে পূজা হয় অব্রাহ্মণ দেহুরীর দ্বারা। মকর সংক্রান্তিতে হয় বাৎসরিক উৎসব ও মেলা। পাখপাখালির কলকাকলিতে মুখরিত মায়ের আটন। তেঁতুল বাঁশের ঘন বেষ্টনীতে শালিক টিয়া , বেনে বউ এর মজলিস। সুবর্ণরেখার চরভূমি হওয়ায় জলের পাখির মেলা ।জলপিপি পানি কাক বক ও দেখা যায়। পাডের পাকুড়গাছে গাংচিল বসে। বড় অনাবিল শান্তির পরিবেশ। দূর থেকে ভেসে আসে মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি। বাউল বাতাসে সে স্বর হওয়ার ভেসে চলে দেব দেউলের ধ্বজাছুঁয়ে আটনের গাছগাছালির মাথাকে নাড়িয়ে দূরে নদীর চরে বেনা ঘাসের জঙ্গলে। জল জঙ্গল একসাথে কেঁপে ওঠে অপার্থিব মায়ায়। দিনমণি অস্তাচলগামী হন। রাক্ষসী বেলার লালিমা গ্রাস করে সর্ব চরাচর কে। আকাশে ফুটে ওঠে তামসী তপস্বিনীর জপমালার মোতির মত একটি দুটি তারা। আঁধারের মায়াবী ওড়না মুখে টেনে জাদুকরী আবেশে ঢাকা পড়ে নদী চর---- চাঁদকে সাক্ষী রেখে শুরু হয় নিশি জাগর কাব্যের।।

🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂

 # প্রান্তিক বাংলার প্রাণের উৎসব--- টুসু পরব

# কলমে- মনীষা পলমল( সুকান্তনগর তালবাগিচা পশ্চিম মেদিনীপুর)

15/1/22

 জঙ্গলমহলের প্রাণের উৎসব টুসু পরব। এর প্রধান আকর্ষণ হলো গান--- টুসু সঙ্গীত। এই গানগুলির মূল বিষয়বস্তু হল লৌকিকও দেহগত প্রেম। এই গান গায়িকার কল্পনা সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনার কাহিনী ব্যক্ত করে। সাংসারিক ও সামাজিক সুখ দুঃখের ঘটনা এই টুসুগানের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। বাংলা লোকসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ এই টুসু গান। সামাজিক সচেতনতা, পণপ্রথা দূরীকরণ, সাক্ষরতার প্রসার ,বধূ নির্যাতনের বিরুদ্ধতা প্রভৃতি সামাজিক দায়িত্বের কথা বলা ূহয় এই গানগুলিতে।

 গোষ্ঠীতে বিশ্বাসী কুড়মি জনজাতির পার্বন "টুসু" আজ জঙ্গলমহলের প্রাণের উৎসব। এই জনজাতির যাপনও সংস্কৃতি প্রকৃতি কেন্দ্রিক। কুড়মি লোক জীবনের হাসি কান্না সুখ দুঃখের কাহিনী সবথেকে বেশি ধরা পড়ে যে গানে তা হলো টুসু গান। সনাতন ঐতিহ্যের মতোই টুসু গানে ধরা পড়ে বর্তমান প্রেক্ষিত ও।

 টুসু উৎসব কবে থেকে চলে আসছে তা সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলেও সম্রাট অশোকের আমলে একই ধরনের সমান্তরাল উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় ধৌলি ও জৌগাডা শিলালিপিতে।

 সংক্রান্তির আগের দিন হয় পৌষ আগলানো। পৌষ আগলানো মানে ফসল আগলানো। পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন মেয়েরা গোবর দিয়ে পৌষ বুড়ি তৈরি করে। সন্ধ্যেবেলায় দীপ জ্বালিয়ে গান গাইতে গাইতে সারারাত জাগরনে কাটায়। একে টুসু জাগরন বলে। পৌষ আগলানো-- ফসল আগলানো! পুরুষেরা পাহারা দেয় ক্ষেতের ফসল আর মেয়েরা গৃহের রক্ষক! একা রাত জাগা যায় না তাই দলবেঁধে উৎসব! টুসু ঘরের মেয়ে !ফসলরূপী আবাদের দেবী --কৃষি লক্ষ্মী।

 তাই ঘরের শস্যরূপী দেবীর কাছে তাদের যত অভিযোগ আবদার। তার কাছেই সব আনন্দের প্রকাশ। গানগুলিতে তারই প্রকাশ---

" উপরে পাটা নিচে পাটা 

তার ভিতরে দারোগা!

 ও দারোগা পথ ছাড়ে দাও

 টুসু যাবেন কলকেতা।

 টুসু যাবেন কলকেতা 

খিদা পেলে খাবেন কি?

 আন গো টুসুর লতুন গামছা

 জিলিপি ছাঁদা বাঁধে দি।"

 একমাস ব্যাপী এই সামাজিক উৎসবের প্রধান ঋত্বিক কুমারী মেয়েরা! পয়লা পৌষ টুসু স্থাপন হবার দিন থেকেই প্রত্যেকদিন এক একটি বিশেষ ফুলে দেবীকে অর্চনা করা হয়! গাঁদা সরষে বাসক আকুন্দ ইত্যাদি। কালচক্র গড়িয়ে চলে আসে মকর সংক্রান্তি ।এবার যে বিদায় দিতে হবে টুসুকে---

"তিরিশ দিন রাখি মাকে তিরিশটি ফুল দিয়ে গো

আর রাখতে লারব মাকে মকর হইল বাদি গো।"


 বিদায়বেলায় টুসু লক্ষ্মী প্রান্তিক মানুষদের আদরের দুলালী--

" কাঁদছো কেনে সাধের টুসু বড় দাদার হাত ধরে

ই সংসারে বিটিছেল্যা রহে কি বাপের ঘরে?"

 রাত পোহালে আসে মকর! টুসু ভাসান দিয়ে নতুন জামা কাপড় পরে ঘরে ঘরে পিঠে খাবার ধুম পড়ে--" টুসু আমার চিন্তামণি 

মাটির কথা শুনে,

 ঘাম পথে আসে মকর 

আমাদের ফাগুনে।"

 গানে গানে টুসুর বাখান ---একদল অন্য দলকে বিদ্রূপ করে

" আমার টুসু মুড়ি ভাজে চুড়ি ঝলমল করে গো

উয়ার টুসু হ্যাংলা মেয়্যা আঁচলা পাতে মাগে গো।"

 গানে গানে টুসু নিরঞ্জন। রঙ্গিন সুদৃশ্য চৌদলে চাপিয়ে টুসুকে ভাসিয়ে দিয়ে শোকবিহ্বল নারীরা বলে---" আমার বড় মনের বাসনা

 টুসু ধনকে জলে দিব না!"

 এ যেন সেই চিরন্তন কন্যা বিদায়ের দৃশ্য!

 মকরের অপরিহার্য অঙ্গ টুসু গান! মানুষের চিরন্তন আশা-আকাঙ্ক্ষার মানবিক প্রকাশ এই গানগুলিতে। মানভূমের ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনে মানুষকে সচেতন করার কাজে টুসু গানের এক বিশেষ ভূমিকা ছিল। প্রকৃত অর্থেই টুসু মহামিলনের পরব। হৃদয়ের টানে মেতে ওঠা প্রান্তিক মানুষজনের বড় মন ছোঁয়া লোক উৎসব এটি। জঙ্গলমহলের সারা বছর ধরেই উৎসবের বাতাবরণ। মনের টানে সকলে দলবদ্ধভাবে মেতে ওঠে এতে। উৎসব চলে আসছে পুরুষানুক্রমিক ভাবে। এটাই শাশ্বত লোকসংস্কৃতির পরিচয়। উৎসবের আবহে কেউই আর কাজকর্মে যুক্ত হতে চায়না। কাজে ডাকলে এই উত্তরই পাওয়া যায়---- "চাঁওড়ি বাঁউডী মকর আখ্যান ঘেঘ্যান সাঁই সুঁই

 তারপর ডাকবি তুই।।"

 তথ্যসূত্র-লোকভাষ, গুগোল

 গানগুলি সংগৃহীত( বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার বরুণ দে)