Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#নীলকন্ঠ#সিরাজুল_ইসলাম।
##"আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান...!"
নাহ্! আমি বিষ পান করে নীলকন্ঠ হইনি ; কিম্বা হতে চাইও নি। বিষক্রিয়ায় হলাহল, নির্জীব দেহটা তখন ডোম আর মেথরে টানাটানি করবে, সে বড্ড ভয়ানক! তবে আমিও তো পান করেছি গো র…

 


#নীলকন্ঠ

#সিরাজুল_ইসলাম।


##

"আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান...!"


নাহ্! আমি বিষ পান করে নীলকন্ঠ হইনি ; কিম্বা হতে চাইও নি। বিষক্রিয়ায় হলাহল, নির্জীব দেহটা তখন ডোম আর মেথরে টানাটানি করবে, সে বড্ড ভয়ানক! তবে আমিও তো পান করেছি গো রবীদাদু ; তবে সেটা বিষ নয়, বিষের চেয়েও খতরনাক চিজ "শরাব !" তোমরা যার নাম দিয়েছো, "শরাবান তহুরা!"


কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া কবেকার কোন এক বোকা কবি আবেগী উন্মাদনায় বলেছিলো, "প্রিয়ার গালের টোলে শরাব ঢেলে চুমুকে চুমুকে শুষে নেবে ; কিম্বা পান করবে!" আ হা! কোন আবেগী উস্মাদনার পাগল সে! 


"আমি জেনে শুনে শরাব করেছি পান...!" 

আমার তখন যৌবন পেরিয়ে পৌড়ত্ব এসে ভর করেছে দেহমনে। তারুণ্যর উচ্ছ্বলতায় বিভোর হওয়ার দিন পার হয়ে গেছে সেই কবে। কোন এক রুদ্রপ্রলয় বৈশাখের ঝড়ের তান্ডব চালানো দিন শেষে, কালের নিয়ম নিগূঢ়ে দিনগত আয়ুক্ষয়। তাই তো বুড়োভাম হয়ে পান করেছি 

সজ্ঞানে, জেনে বুঝেই। ওই যে ফাঁসির আসামী এজলাসে কাঁঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সখেদে উচ্চারণ করে তার পাপের স্বীকারোক্তি, "আমি যাহা বলিবো,  সত্য বৈ মিথ্যা বলিবো না! " আজ না হয় আমিও সত্যবাদী যুধিষ্ঠির হয়ে আজন্ম পাপের স্বীকারোক্তি করে যাই।


আমার পানপাত্র ধরিয়ে দেয়ার গুরু বকুল। বকুলমামা। নিজের মাতুলগোষ্টির কেউ না ; এমন কি সাত-কুলেরও কেউ না। তবুও মামা। আটপৌরে জীবনে পথ-পরিক্রমায় গাঙপাড়ের নির্জনতায় সাক্ষাৎ পাই মামার। উন্মত্ত বড়গাঙের ঘূর্ণিপাকে ঘুরপাঁক খাওয়া উত্তাল তরঙ্গের মতই গর্জনশীল মামাকে দেখে তার ভেতরের রূপ বোঝার যো নেই, যে কোন অপরিচজনের। 

মামা আমার পান করেন হর-হামেশা। বেদনার নীল বিষে জর্জরিত মামা আমার। বেঘোরে ঘোর লাগা তন্দ্রালু  চোখে কী আবেশে শিশুর সারল্যতা নিয়ে চেয়ে থাকে। আরও দু'পেগ করণসূধা গলায় ঢেলে দিয়ে ততোধিক ঘোরলাগা দু'চোখ তার। দু'হাতের তালুতে বিশেষ মুদ্রায় শব্দ তুলে গাইতে থাকে বেসুরো গলায়, "যব সাম ঢলে তো চ্যালে আ না / মাগার আ না তো ফির না যা না / যব চাঁন্দ খিলে তো তুম্ চ্যালে আ যা না...!"

মামার দু'চোখ বেয়ে তখন গঙ্গা-যমুনার ধারা বইতে থাকে। আহা!  কেন যে মামা আমার প্রেমে পড়েছিলো!

"ডুবিয়া মরিলাম, মরিয়া ডুবিলাম / তোমারই প্রেমে পড়িয়া / ইন্দুবালা গো! তুমি কোন আকাশে থাকো...!"


"আমার জনম গেলো ভুলে ভুলে কইরা পিরিতি / ভুলের হাটে মন হারাইলাম না জেনে ক্ষতি...!" 

আমরা সেই সে জাতির বংশধর, একদিন যাঁরা নির্মোহে চাঁদকে ভালোবেসেছিলো! তাই তো আমার বকুল মামাও বংশপরম্পরায় ভালোবাসার মানুষ। প্রেমের মজনু। ভালোবেসেছিলো তার কৈশোরকালে। সদ্য-বিকশিত ফুলকলিটাকে বড্ড আপন করে ; সযতনে ফুল বানিয়ে ফোঁটাতে চেয়েছিলো মামা, তার অস্ফুট হৃদয়াবেগে অকুন্ঠচিত্তে। অপরপ্রান্তের গ্রীনসিগন্যাল পেয়েই মামা হয়েছিলো বাঁধনহারা। প্রেমের গাড়ীটা হাঁকিয়েছিলো চিলমারীর বন্দরে। ছিলো না রোড এ্যাকসিডেন্টের ঝক্কিঝামেলা।


সদ্য যৈবতীকন্যা মামী আমার। পরতেপরতে যার দেহ-সৌষ্টবে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা অখন্ড অবসরে বসে দরাজহাতে সাজিয়ে দিয়েছেন নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত। খাঁজকাটা চড়াই-উৎরাই, খানাখন্দ। আহা! সে নদীর ঝর্ণাধারার দু'কূল ছাপানো যৌবনময়ী জলজবাঁক। বাঁকেবাঁকে তার থরেবিথরে মেঠো ভাঁটফুল, নিম-নিশিন্দা, হাঁতিশূঁঢ়! কমনীয়তায় ভরা বাঁকাচোখে আঁড়চেয়ে চেয়ে থাকে যেন কোন বিষধর কালনাগিনীর চাহনীতে। মামা আমার সে বিষ পান করে নীলকন্ঠ; নীলাঞ্জন। 


##

উদাসী বসন্তদিন। সমুখে বইছে ভরা যৌবনা প্রমত্তা পদ্মা। বড়গাঙের গাঙপাড়ে ভাঙ্গনের দায় বাঁচিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে থাকা বিলুপ্তপ্রায় বিশালাকৃতির গ্রামের কয়েক সারি পাড়া গাঁ। সে গাঁয়ের একটা নির্জন ঘরের ছাউনীতে বসে আছি মামাসহ আমরা ক'জন। সেই দুপুর থেকে চলছে জমিয়ে জম্পেশ আড্ডা। সুরারসের মৌতাতে রঙিন হয়ে আছে সবক'টা প্রাণ।

দুঃখাবেগী মামা তারিয়ে তারিয়ে পান করছে করণসূধা। তার হাতের চেটোয় চেপে রাখা পানপাত্রটা থেকে। আকন্ঠ গিলে গিলে মামা এখন ভোম-ভোলেনাথ। ঠিক যেন বাবা ভোম-ভৈরব। তিনি তার বুকের কাফন সরিয়ে, কফিন খুলে তুলে আনছে হরপ্পা, মহেন-জো-দাঁড়োর সিন্ধুসভ্যতার মতন তাঁর আশৈশব স্মৃতির পুরোনো কোঠাবাড়ী। যেখানে দুরন্ত দুই দুষ্টু কিশোর কিশোরী অনাবিল কলোহাসিতে উন্মত্ত, উদ্যম উচ্ছ্বল। প্রমত্তা বড়গাঙের দুরন্তঃ ঘূর্ণীপাঁকের জলের মত ছলাৎছল উচ্ছ্বলতায় মুখর। সারাটাদিন তখন সেই কৈশোর-যৌবন। না মানে শাসন ; না মানে বারণ।


আমরা লো-ভলিউমে বাজাচ্ছি সিডি-প্লেয়ার। সুর ভেসে আসছে, "তুই ফেলে এসেছিস কারে মন ; মন রে আমার!" অথবা পঙ্কজ উদাসের, " চুপকে চুপকে রাত দিন / আসু ও মে ব্যহে গ্যয়া! "

খাড়ি জল যেন দরদর করে নেমে আসছে বকুল মামার দু'চোখ বেয়ে। মামার চোখের সে জলে আমরাও প্লাবিত হই। আপ্লুত হই। আবেশীত হই। ধীরলয়ে মামা সুরভাঁজে, "ভালোবাসি ভালোবাসি! এর চেয়ে বেশী আর ভালোবাসা যায় না / ও আমার মন পাখি ময়না! "

কি কষ্টের সোনারেণূ অব্যক্তবেদনার বালুচরে থমকে আছে মামার হৃদ-জমিনে ; কেউ খোঁজেনি বাইবের জগতের মানুষেরা। শুধু সূঁড়িখানার আড্ডাতে এলেই মামা আমার উত্তাল উন্মাতাল। তখন ঘেরাটোপের।বলয়ে উগরে দেয় তার অব্যক্তবেদনার অব্যক্তব্যথা যন্ত্রনা। "রঙিলা রে... তেরে রং মে রাঙা দিয়া...!"


বড়লোকের ছেলের অপরূপ গৈরবর্ণ রূপের প্রেমে মজেছিলো ততোধিক রূপবতী মামী; মামার প্রেমিকা। তাদের সেইসব দিনরাত্রির জীবনে নির্ঘুম রাত জেগে দিস্তা দিস্তা কাগজে লিখতো দু'জনে মনের ভাবনাচিন্তা সুখস্বর্গের ইতিকথা।

মানুষ ভাবে এক বিধাতা গড়ে এক।

মামাদের জীবনতরী নদীচরায় ডেবে গেছে, স্বপ্ন সফল হয়নি তাদের। তাই মামার জীবনটা এখন, "ভাটাক্তা হুয়া আত্মা কি তরাহ্। প্রেত্মারা, প্রেত-যোনিরা হিহি হাসে। 


##

ওগো মেয়ে! বসন্তের এই মাতাল হাওয়ায় তুমি কি আমায় ভালোবাসবে?

ভরা পূর্ণিমা চাঁদের আলোয় তুমি কি গুনগুন করে স্বলাজে বলবে, "ফাগুনের পূর্ণিমা রাতে / চল পলায়ে যাই! "

আহা! একজনমে মেটে না সাধ, ভালোবাসিয়া!


তুমি যে আমার কবিতা...

না গো!  শেষের কবিতা নও ; স্বর্ণাভ দ্যুতিময় ভরা প্রথম কবিতা। আমার বাঁশী রাগিনী ; চিরদিন তোমারে চিনি!  

            

##

কলিজাকে বললাম,

চলো কলিজা বিয়ে করে ফেলি!

=না গো, এখন আমার সময় নেই!

 মাড়াই করা ধান শুকোতে হবে। 

সিদ্ধ করে আবারও শুকোতে হবে। 

সেই শুকোনো ধান ঢেঁকিশালে  ভানতে হবে।

কিছুটা তার চালের গুড়ো বানাতে হবে।

শীতার্তের পুলিপিঠা বানাতে হবে। কতশত কাজ।

না গো, আমার সময় নেই মোটেই! সত্যিই বলছি। "

শুনে আমার হৃদয়গহীনে আড়ামোড়া ভাঙে কষ্টরেণূ।


তারপর,

কলিজা উনুনে আঁচ ধরায়।

বুঁনকা বুঁনকা ধোঁয়াওঠে। 

আর কষ্টের দলা পাঁকায় আমার বুকের ভেতর।


আমি অপেক্ষায় থাকি-

শীতের পরিযায়ী পাখিরা আসে, সুদূর সাইবেরীয়া থেকে। সংসার গড়ে, গন্ডা গন্ডা আন্ডাবাচ্চা নিয়ে ফিরে যায় ওরা এক সময়।

তবু আমার অপেক্ষার শেষ হয় না।


প্রতিক্ষা করতে

প্রতিক্ষা করতে

করতে

করতে

করতে

করতে

আমি এখন বয়সী তালগাছ হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি তেপান্তরের ফাঁকা মাঠে।

তবুও সময় হয় না কলিজার।

ধৈর্যবান বয়সী বটের ছায়ায় কত পথিকজন ফেরে ; হয়তো কোন এক শীতের কুয়াশামাখা ভোরে শিশিরভেজা আলপথ মাড়িয়ে মাড়িয়ে মাড়িয়ে কলিজা আসবে, আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকি।


সুরমা নদীরপাড়ে কোন এক বাঁশরীয়ার বাঁশীর সুরে মজেছে মন কলিজার। কূহক হাতছানীতে সে তাই ছুটে গেছে অরণ্যউদ্যানে। খুঁজে পেয়েছে বুঝিবা ক্লান্তিময় জীবনের সুখময়তা।


আমার কলিজা গো!

আমার অপেক্ষার আর শেষ হয় না।


যে তরী তোমার ভাসিয়েছো উজানের পথে,

সে তো আর ফিরবে না ভাটিজলের মিথ্যেমায়ায়।


আহা রে কলিজা আমার!

"এক জনমে মিটলো না সাধ তোরে ভালোবাসিয়া...!"


#নীলকন্ঠ

©সিরাজুল ইসলাম।


রাতঃ ১০:৪৫ মিঃ

২৪ মার্চ ২০২২ খ্রিঃ।