Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

প্রথম-খেয়া-সেরা-সাহিত্য -সম্মাননা

শিরোনাম: #অন্তর_মম_বিকশিত_করকলমে: #অমৃতা_ব্যানার্জী
অফিস-স্কুলের ভিড়ের সময় পেরিয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন কয়েকজন রাস্তায় চলাচল করছে। ফুটপাথ ধরে ধীর লয়ে চলেছেন সনাতন। তাঁর হাতে ধরা একটি মাঝারি আকারের বাজারের থলি। থলির ভিতর লাউ, কুমড়…

 


শিরোনাম: #অন্তর_মম_বিকশিত_কর

কলমে: #অমৃতা_ব্যানার্জী


অফিস-স্কুলের ভিড়ের সময় পেরিয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন কয়েকজন রাস্তায় চলাচল করছে। ফুটপাথ ধরে ধীর লয়ে চলেছেন সনাতন। তাঁর হাতে ধরা একটি মাঝারি আকারের বাজারের থলি। থলির ভিতর লাউ, কুমড়ো, আলু, কাঁচা লঙ্কা এবং একটি প্লাস্টিকে বাঁধা ঘাঁটা পুঁটি মাছ। সনাতনের পরনে লাল ছোপ ধরা সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, গালে সাদা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ধূসর চুলগুলো বড়ই রুক্ষ। সনাতনের বয়স বাষট্টি। সুগার, প্রেসার, কোলেস্টেরল, বাতের ব্যথা - কিছুই এখনও তাঁর শরীরে থাবা বসায়নি। তবুও যেন মানুষটির সর্বাঙ্গ জুড়ে ক্ষয়ের ছাপ। জীবনের বোঝা বইতে বইতে বড় ক্লান্ত তিনি। মনে মনে সনাতন বলেন 'শালা দিনগত পাপক্ষয়। কোন জন্মের পাপের ফল বইছি কে জানে!' কিন্তু মুখে কিছু বলার সাহস হয় না। স্ত্রীর মুখকে বড় ভয় পান তিনি।


আজও তাঁর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। বাজারের রূপ দেখে স্ত্রী অবধারিত যুদ্ধং দেহী মূর্তি ধারণ করবেন। স্ত্রীর দিকটাও বোঝেন সনাতন। সেই মানুষটির জীবনও তো সংসারের পাঁকে আবদ্ধ রয়ে গেছে। তাই কথায় কথায় ফেটে পড়ে হালকা হওয়ার চেষ্টা করেন। সনাতন জানেন, তিনি এ'জীবনে কিছুই করে উঠতে পারেননি। পরিবারের মাথার উপর নিজস্ব ছাদটুকুও দিতে পারেননি। ভাড়া বাড়িতেই কেটে গেল গোটা জীবন। তবুও আজকাল স্ত্রীর কথা শুনলে সনাতনের নিজেকে বড় ব্যর্থ মনে হয়। কঠোর বাস্তব যে চিরকালই সংসারের অপ্রিয়।


বামদিকে বাঁক নিতেই দোতলা বাড়িটি দেখতে পেলেন সনাতন। বড় লোহার গেটের পিছন দিয়ে সিমেন্টের মসৃণ পথ বাড়িতে প্রবেশ করার সিঁড়ি পর্যন্ত চলে গিয়েছে। পথটি দেখামাত্র সনাতনের মন বাড়িটির ভিতরে যাওয়ার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠল। এই বাড়িটি সেই যৌবনকাল থেকে সনাতনের অবলম্বন। কত আপদে-বিপদে এই বাড়ির মানুষজনকে নিজের পাশে পেয়েছেন তিনি। সনাতনের মনে হয়, এই বাড়িটি ছিল বলে হয়তো আজও তাঁর জীবনতরী ডুবে যায়নি।


শান বাঁধানো পথ পেরিয়ে 'কই গো দীপা মা? কেমন আছো দিদিভাই?' বলতে বলতে মূল বাড়িতে প্রবেশ করলেন সনাতন।


রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করছিল দীপা। কাজের মেয়েটি ডাইনিং রুম ঝাঁট দিচ্ছে। সনাতনের ডাক শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল দীপা। কাজের মেয়েটি বলল 'যাও দিদি, বুড়ো হাজির।'


'এইরকম ভাবে কথা বলতে বহুবার মানা করেছি। চুপচাপ নিজের কাজ কর।' কড়া ভাষায় কথাগুলো বলে হাসিমুখে বারান্দায় বেরিয়ে এল দীপা।


দীপার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। তার শরীর সযত্নে লালিত, ব্যবহার মার্জিত। দীপার মধ্যে তার মায়ের ছায়া দেখতে পান সনাতন। সেই একই হাসি, শরীর জুড়ে আভিজাত্যের আভা, মনে মমতার স্রোত। 


বারান্দার চেয়ারে বসে আছেন সনাতন।


---- 'কেমন আছো সনাতন কাকু? বাইরে বসে আছো কেন? ভেতরে এসো।'


---- 'থাক মা, আমি এইখানেই বেশ আছি। তা বল, তোমরা কেমন বেড়ালে?'


---- 'খুব ভালো বেড়িয়েছি কাকু।'


---- 'বাহ খুব ভালো। তা জামাই, নাতনি ভালো আছে তো? তারা কোথায়?'


---- 'সবাই ভালো আছে। এখন তো ওরা যে যার অফিসে আর স্কুলে।'


---- 'বেশ বেশ। জামাই আমাদের কত ব্যস্ত মানুষ।'


---- 'তুমি একটু বস কাকু। আমি চা করে আনি।'


---- 'এখন আবার চা…. আচ্ছা, খাই এক কাপ।'


শান বাঁধানো পথের দু'ধারে কেয়ারি করা ফুলের বাগান। সবুজ পাতার উপর হেমন্তের মিঠে রোদের আদুরে প্রলেপ। বাগানের শোভার দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে সনাতনের মনে হয়, এই বাড়িটার আনাচে-কানাচে যত্ন, ভালোবাসার পরশ।


দীপার বাবা ছিলেন এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্টের অফিসার। চাকরি জীবনের শুরুতে সনাতন ছিলেন তাঁর অফিসের গাড়ির ড্রাইভার। দু'বেলা বড় সাহেবকে অফিসে দেওয়া-নেওয়া করতেন তিনি। অদ্ভুত ব্যক্তিত্বের মানুষ বড় সাহেব। তাঁর ব্যবহারে আদেশ এবং স্নেহ - দুই'ই প্রকাশ পেত। বড় সাহেবের স্ত্রী অর্থাৎ সনাতনের বড়মা তো সাক্ষাৎ দেবী। সনাতন যখন প্রথমদিকে গাড়ি নিয়ে এই বাড়িতে আসতেন তখন বড়মা বাগানের ফল, সবজি তাঁর সঙ্গে দিয়ে দিতেন। সেই খাবারের ভরসাতেই সনাতনের কত রাত কেটেছে। বাড়ির উৎসব অনুষ্ঠানে এই বাড়িতে আমন্ত্রণ পেতেন তিনি। বড় সাহেব কিংবা তাঁর পরিবার দু-একবারের বেশি সনাতনের বাড়িতে যাননি। তবুও সনাতন জানতেন, এই বাড়ি তাঁর আশ্রয়, ভরসার অপর নাম। বিপদে ছুটে এলে কোন না কোন সুরাহা অবশ্যই মিলবে।


বড় সাহেবের একমাত্র মেয়ে দীপাকে বড় হতে দেখেছেন সনাতন। বাবা-মা বড্ড আদরে মানুষ করেছেন মেয়েকে। দীপার যত্ন দেখে মাঝেমধ্যে আফশোস হত সনাতনের। তাঁর নিজেরও তিনটি মেয়ে। কিন্তু কাউকেই দু'বেলা দু'মুঠো ভাত আর মোটা কাপড়ের অতিরিক্ত কিছুই দিতে পারেননি। পনেরো-ষোলো বছর বয়স হতেই তিনজনের গোত্রান্তর করে দিয়েছিলেন। সেই সময়ও অবশ্য পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বড়মা। কখনো সোনার কানের দুল, তো কখনো নগদ টাকা দিয়ে উতরে দিয়েছিলেন কন্যাদায়গ্রস্ত বাবাকে।


দশ বছর হল বড় সাহেব রিটায়ার করেছেন। তাঁদের বহুদিনের শখ পূর্ণ করার জন্য বড়মার সঙ্গে তিনি এখন উত্তরবঙ্গ নিবাসী। বর্তমানে এই বাড়িতে দীপা তার স্বামী এবং মেয়ের সঙ্গে থাকে। দীপার স্বামী রেলের অফিসার। রাশভারী মানুষটি বাইরের লোকের সঙ্গে খুব বেশি কথা বলেন না। তবে তিনিও পরোপকারী মানুষ। দীপা অবসর সময়ে এলাকার কিছু মহিলাদের নিয়ে একটি মহিলা সমিতি চালায়। রাজনীতির সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। অঞ্চলের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে তারা। সনাতনের মতো মানুষদের ব্যাংকের লোনের আর্জি অনুমোদন করানোর জন্য কিংবা রাস্তায় স্ট্রিট লাইট বসানোর দাবিতে বহুবার হত্যে দিতে দেখা গেছে দীপাকে।


'এই নাও কাকু, চা।' দীপার ডাক শুনে পিছন ফিরে তাকান সনাতন। এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা তাঁর হাতে ধরিয়ে দীপা ভিতরে চলে যায়। কাপে চুমুক দেন সনাতন। মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। এই বাড়িতে আসার এটিও একটি কারণ। বড় ভালো চা খায় এরা। বাড়িতে ট্যালট্যালে দুধের মধ্যে ফোটানো গুঁড়ো চা খেতে খেতে জিভে চড়া পড়ে গেলে এই বাড়িতে এসে পাতা-চায়ের সুঘ্রাণ মন ভরে উপভোগ করেন সনাতন।


'কাকু গাছ থেকে নারকেল পাড়িয়েছিলাম। দু'টো নারকেল নিয়ে যাও।' সনাতনের হাতে একটি ব্যাগ ধরিয়ে দেয় দীপা। সনাতন ব্যাগ ধরে দেখেন ভিতরে দু'টো নারকেল আর একটি ছোট প্যাকেট রাখা। প্যাকেটের ভিতর একটি নতুন উলের টুপি। 


---- 'এ'সব কী মা?'


---- 'মানালিতে খুব ভালো শীতের পোশাক পাওয়া যায় কাকু। শীতকালে পরলে আরাম পাবে।'


চা খেয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়ার আশায় এসেছিলেন সনাতন। এতোটা অপ্রত্যাশিত। এইবার তাঁর অস্বস্তি বোধ হতে লাগল।


---- 'আমায় তুমি লজ্জায় ফেলে দিলে মা।'


---- 'তোমার বাজার কিন্তু পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। এইবার কাকিমা আঁশবটি নিয়ে তেড়ে আসবে।'


দীপাদের বাড়ির বিপরীতে বড় মাঠ। মাঠ পেরিয়ে গলির ভিতর নোনাধরা দোতলা বাড়িটার একতলায় বহুবছর ধরে ভাড়া থাকেন সনাতন। বর্তমানে বাড়ির সদস্য সংখ্যা পাঁচ - সনাতন, তাঁর স্ত্রী, সনাতনের বড় মেয়ে এবং তার এক মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়েকে অল্প বয়সে পরের বাড়ি পাঠিয়ে দায়মুক্ত হতে চাইলেও কোনদিনই সেই ভার থেকে মুক্ত হতে পারেননি সনাতন। জামাইয়ের চরিত্র ভালো ছিল না। বিয়ের কয়েক বছর পর ছেলেমেয়েকে নিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে সনাতনের বড় মেয়ে। বাবাকে সাহায্য করার জন্য সে একটি দর্জির দোকানে ব্লাউজ, সালোয়ার কামিজ সেলাইয়ের কাজ করে। তবে তার ছেলে, মেয়ে দুটি বড় বাধ্য এবং পড়াশোনায় মনযোগী।


সনাতন বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে শুনতে পেলেন স্ত্রীর গর্জন। 'বলি জমিদার মানুষ হয়েছেন তিনি। ভাত, ডাল রেঁধে বসে আছি। বেলা বারোটা বাজতে চলল। এখনও বাজার এল না। ভরদুপুরে মাছ কুটতে হবে। আমার যে কেন মরণ হয় না!' বাজারের দশা দেখে হুঙ্কার বেড়ে গেলেও নারকেল আর উলের টুপি দেখে সনাতনের স্ত্রীর মুখে হাসি ফুটল। 'আহা দীপা মেয়েটা বড় ভালো। নাতিটা নারকেল নাড়ু খেতে ভালোবাসে। ওগো ওপর থেকে নারকেল কুরুনিটা পেড়ে দিও। রাতে নারকেল কুরিয়ে রাখব।'

**************************************************

সময় রাত এগারোটা। ঘুমিয়ে পড়েছিল দীপার পরিবার। হঠাৎ আওয়াজে চমকে ওঠে সকলে। বাইরে দাঁড়িয়ে কেউ বা কারা যেন ডাকছে। কাজের মেয়েটি এসে বলে 'ওই সনাতন কাকা এসেছে গো দিদি। ওর বউয়ের কীসব হয়েছে। তোমাদের ডাকছে।'


দীপা ও তার স্বামী নিচে এসে দেখে সনাতন দাঁড়িয়ে আছেন, সঙ্গে এক কিশোরী। এই মেয়েটি সনাতনের নাতনি। আগে দু-চারবার দাদুর সঙ্গে এসেছে। সনাতনের চেহারা বিধ্বস্ত।


---- 'কী হয়েছে কাকু? এতো রাতে….!'


---- 'তোমার কাকিমার হাত কেটে একাকার অবস্থা। নাতির জন্য নারকেল কুরোচ্ছিলেন। হঠাৎ অসাবধানতাবশত হাত ফালা ফালা হয়ে গেছে। রক্তগঙ্গা বইছে। শিরা কেটেছে কিনা বুঝতে পারছি না। এখন তো কোন ডাক্তার পাওয়া যাবে না। হাসপাতালে নিয়ে যাব যে রিকশা কই! বাঁচাও মা।'


---- 'ঠিক আছে কাকু। তুমি বাড়িতে যাও। আমি গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।'


দীপার কথা শোনার পরও দাঁড়িয়ে থাকেন সনাতন। দীপা সরল চাহনির মেয়েটির কাছে গিয়ে বলে 'তুমিই তো মাধবী? দাদুকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। আমি আসছি।'


দীপাদের নিজস্ব গাড়ি আছে। ড্রাইভার ছেলেটি পাড়াতেই থাকে। ফোন করে তাকে ডেকে নিলেন দীপার স্বামী। নিজের ঘরে এসে তৈরি হচ্ছিল দীপা। তার দশ বছরের মেয়ে পিঙ্কি মায়ের খুব ন্যাওটা। রাতে মা ছাড়া ঘুম আসে না তার। একরাশ বিরক্তি নিয়ে পিঙ্কি বলল 'তুমি এতো রাতে যাচ্ছ কেন? ওই দাদুটাকে আমার একদম ভালো লাগে না। সবসময় চলে আসে। কান্ট দে হেল্প দেমসেলভস?'


মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দীপা বলে 'ছিঃ পিঙ্কি! এইভাবে কখনো বলতে হয়? বিপদ কার জীবনে কখন আসবে, তা কে জানে? তুমি ঘুমিয়ে পড়। বাবা আর মালতী মাসি আছে তো। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসব।'


সনাতনের স্ত্রীর হাতের শিরা কাটেনি। তবে আঘাত গুরুতর। চারটে স্টিচ পড়েছে। ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ কিনে সনাতনদের বাড়িতে নামিয়ে দেয় দীপা। দু'হাত তুলে তাকে আশীর্বাদ করেন সনাতন ও তাঁর স্ত্রী - 'বেঁচে থাক মা। আজ তুমি ছিলে বলে কোন সমস্যাই হল না। কীভাবে যে তোমার ঋণ শোধ করব?'


---- 'ঋণের কথা বলছ কেন তোমরা? বিপদে তো মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়ায়। সাবধানে থেকো।'

**************************************************

বাইরের ঘরে বসে মহিলা সমিতির দু'জন সদস্যর সঙ্গে কথা বলছে দীপা। দরজায় টোকার শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকায় সে। পর্দার ফাঁক দিয়ে সনাতনকে দেখা যাচ্ছে।


---- 'দীপা মা একটু কথা ছিল।'


---- 'তুমি বস কাকু। আমি হাতের কাজটুকু সেরেনি।'


দীপার মুখোমুখি দুটি চেয়ারে বসে আছেন সনাতন ও এক কিশোর। কিশোরের চেহারায় এখনও শৈশবের কোমলতা, চোখে ভয়। ছেলেটির নাম রাজু। সনাতনের নাতি।


---- 'কাকিমা এখন কেমন আছেন, কাকু?'


---- 'ভালো মা, আগের থেকে অনেক ভালো। তুমি সেদিন যা করলে….'


---- 'বল কাকু।'


---- 'আজ আবার একটা উপকারের আশায় তোমার কাছে এলাম। জানি খুব বিরক্ত করি তোমাদের।'


---- 'না, না, ঠিক আছে।'


---- 'এই যে আমার নাতি, এই বছর মাধ্যমিক পাশ করে ইলেভেন পড়ছে। রেলের ওয়ার্কশপে অ্যাপ্রেন্টিস নেওয়ার ফর্ম বেরিয়েছে। মাধ্যমিকে ভালো ফল করা ছেলেমেয়েদের নেওয়া হয়। আমার নাতি মাধ্যমিকে পঁচাত্তর শতাংশ নম্বর পেয়েছিল। কিন্তু ওর থেকে বেশি নম্বর পাওয়া লোকও তো আছে। যদি আটকে যায়?'


---- 'কিন্তু অ্যাপ্রেন্টিসে ঢুকে গেলে তো ওর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। পরে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে না পারলে প্রোমোশনও হবে না।'


---- 'সে'সব এখন ভাবছি না মা। বেতন না বাড়লেও আজীবনের জন্য পাকা সরকারি চাকরি তো জুটবে। শুনেছি রেলের সাহেবরা চাইলে একটু চেষ্টা করে নিজেদের লোককে অ্যাপ্রেন্টিসে ঢুকিয়ে দিতে পারে। জামাই তো বড় অফিসার। তাই ওকে যদি বলে দেখ। মা আমাদের অবস্থা তো জানই। একটা সরকারি চাকরি জুটে গেলে নিশ্চিন্ত হই।'


হঠাৎ দীপার মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। সে ধীরে বলে 'তোমরা কয়েকদিন পরে এস। দেখি কী করা যায়।'


সনাতনরা বেরিয়ে গেলে পিঙ্কি মায়ের কাছে এসে বলে 'ওরা কি আবার হেল্প চাইতে এসেছিল? কান্ট দে হেল্প দেমসেলভস?'


পিঙ্কির কথার উত্তর দেয় না দীপা। কিন্তু এই প্রথম তার মনেও একই প্রশ্ন জন্ম নেয়। এতদিন টুকটাক খাবার, ডাক্তার দেখানো কিংবা কিছু অর্থের মধ্যে বিষয়টা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এইবার তো চাহিদা সীমা অতিক্রম করছে।


অতিবাহিত হয়েছে চার দিন। আবার মুখোমুখি সনাতন ও দীপা। 


---- 'কাকু কিছু মনে কর না। এইবার সাহায্য করতে পারলাম না। তোমাদের জামাই সুপারিশ বিষয়টা একদম পছন্দ করে না।'


---- 'একটিবার যদি….'


---- 'ক্ষমা কর কাকু। তোমাদের জামাই চিরদিন সুপারিশ থেকে দূরে থেকেছে। এখন ওর আদর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে আমি ওর সম্মানহানি করতে পারব না।'


দ্রুতগতিতে চলতে শুরু করে সনাতনের শ্বাস। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন 'ঠিকই তো, জামাই কত মানী মানুষ। আমাদের জন্য সে কেন ছোট হবে! ভালো থেকো তোমরা।'

**************************************************

তক্তপোশের উপর বসে আছেন সনাতন। তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ। হঠাৎ যেন তাঁর বয়স কয়েক বছর বেড়ে গেছে। তিন মাস হল সনাতন আর দীপার কাছে যাননি। রাজুর চাকরির আবেদন নামঞ্জুর করার পরে তিনি বুঝেছিলেন পুরোনো সম্পর্কের সুতোয় টান পড়েছে।  


নতুন চিন্তা গ্রাস করেছে সনাতনকে। নাতনিটার আঠারো পেরিয়ে গেছে। অনেকদিন ধরেই তার বিয়ের চেষ্টা শুরু করেছিলেন সনাতন। একটা ভালো সম্বন্ধও এসেছে। পাত্র বি.এ পাশ। বর্ধিষ্ণু কৃষক পরিবারের সন্তান। তাদেরও মাধবীকে পছন্দ হয়েছে।‌ পাকা কথা হয়ে গেছে। পাত্রপক্ষর তাড়া থাকায় আগামী মাসে বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে। সব যোগাড়যন্ত্র প্রায় শেষের মুখে। কিন্তু হঠাৎ পাত্রপক্ষ এক নতুন দাবি করেছে। মাধবীর বিয়ের দু'মাস পরে পাত্রর বোনের বিয়ে। তারা চায় সনাতন যৌতুক হিসেবে মাধবীর হবু ননদের বিয়ের হার দিক। আকাশ ভেঙে পড়েছে সনাতনের উপর। নিজের কিঞ্চিৎ সঞ্চিত পুঁজি ভেঙে এবং বিভিন্ন দিক থেকে ধার করে তিনি নাতনির বিয়ের আয়োজন করছেন। গলা পর্যন্ত প্রায় দেনায় ডুবে গেছেন। এখন আবার সোনার হার! পাত্রপক্ষ যে ধরণের হার বলেছে, তার দাম লাখখানেক। এতো টাকা কোথায় পাবেন তিনি?


পুরোনো অভ্যাসের দরুণ বিপদের দিনে বারবার দীপার কথাই মনে পড়ে সনাতনের। কিন্তু তার কাছে যেতে আজকাল দ্বিধা হয়। একটিবার মাত্র মেয়েটি তাঁর কথার মান রাখেনি। সেইজন্য তাদের এতোদিনের অবদান ভুলে গেলেন সনাতন! নিজের উপর রাগ হয় তাঁর।


'দাদু, তোমাকে কিছু কথা বলার আছে।' রাজুর ডাক শুনে ঘুরে তাকান সনাতন।


---- 'দাদু আমি জানি এই কয়েক মাস তুমি দীপা মাসির সঙ্গে যোগাযোগ রাখনি। এমনকি দিদির বিয়ের নেমতন্ন করতেও যাওনি তুমি। শুনেছি তুমি দিদিমাকে বল, ওঁদের বাড়ি যেতে তোমার দ্বিধা হয়। তাই তোমাকে কথাগুলো বলতে এলাম। দীপা মাসি সুপারিশের বিরুদ্ধে। তবে তিনি তোমার মান রক্ষার জন্য আমার চাকরির কথা মেসোকে একবার হলেও বলতেন কিনা আমি জানি না। কিন্তু আমি তাঁকে সেই সুযোগ দিইনি। সন্ধেবেলা আমি দীপা মাসিকে জানিয়ে দিয়ে আসি, তিনি যেন আমার চাকরির জন্য চেষ্টা না করেন। আমি কারোর দয়ায় চাকরি করতে চাই না দাদু। তাছাড়া এখনই অ্যাপ্রেন্টিসে ঢুকে গেলে আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। আমি পড়তে চাই দাদু। আমার পড়ার খরচ নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। কয়েকটা টিউশন ধরেছি। তাতেই কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।'


---- 'এতদিন কথাগুলো বলিসনি কেন রে?'


বিছানা ছেড়ে গায়ে পাঞ্জাবি গলিয়ে সনাতন স্বগতোক্তি করেন 'আজই যাব দীপা মায়ের কাছে। সে আমার বড়মার মেয়ে। নিশ্চয়ই এই বিপদ থেকে আমাদের উদ্ধার করবে।'


মাঠ ধরে হাঁটছেন সনাতন ও মাধবী। সনাতনের প্রেসার কয়েকদিন আগে ফল করায় বাড়ির লোক তাঁকে একা ছাড়তে সাহস করে না। সনাতন ভাবেন 'দীপা বলেছিল, সে সুপারিশ পছন্দ করে না। আমি তো এইবার সুপারিশ চাইছি না।'


দীপার কাছে সব কথা খুলে বলেন সনাতন। সব শুনে দীপা বলে 'আমি তোমাকে সাহায্য করতে অপারগ কাকু। বাবা বিনা পণে আমার বিয়ে দিয়েছিলেন। আমিও পণপ্রথা বিরোধী।'


---- 'তোমাদের কথা আলাদা মা। তোমরা বড়লোক। সময় নিয়ে দশটা পাত্র বাতিল করার ক্ষমতা আছে তোমাদের। কিন্তু আমাদের সে সুযোগ কোথায়? আমাদের মতো ঘরে মেয়েদের বেশিদিন বসিয়ে রাখা যায় না।'


---- 'সুযোগ করে নিতে হয় কাকু।'


সনাতন হাত জোড় করে বলেন 'আমার অবস্থা তো তুমি সব জান। শেষ মুহূর্তে বিয়ে ভেঙে গেলে আর সমাজে মুখ দেখাতে পারব না। পরিবার নিয়ে আত্মহত্যা করতে হবে।'


মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মাধবীর দিকে তাকিয়ে দীপা বলে 'শুনেছি তুমি কলেজে পড়। লেখাপড়া জানা মেয়ে হয়ে চোখের সামনে নিজের দাদুকে এইভাবে অন্যের পায়ে পড়তে দেখছ! লজ্জা করে না তোমার? তোমার জন্য বৃদ্ধ দাদু নিজেকে অপমানিত করছেন! তুমি মুখ বুজে সহ্য করছ? মনে রেখ মাধবী, যে নিজের জন্য লড়াই করে না, তার পাশে স্বয়ং ঈশ্বরও থাকেন না। তুমি আজীবন অন্যের করুণার পাত্রী হয়ে যদি থাকতে চাও, তাহলে আমার বাড়িতে আর এস না।'


ধীরে স্বরে মাধবী বলে 'ক্ষমা করবেন। আমরা আর কোনদিন আপনাকে বিরক্ত করব না।'


দীপার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান সনাতন ও মাধবী। বড় দরজার কাছে দাঁড়ায় দীপা। মাঠের মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলেছেন সনাতন। মাধবী তাঁর কাঁধ দুটো ধরে আছে। অজান্তেই দীপার চোখের কোণা জ্বালা করে ওঠে।

**************************************************

দীপার বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মাধবী। হঠাৎ সামনের দিকে তাকিয়ে সে বলে 'দীপা মাসি তো!'


একটু এগিয়ে মাধবী ডাকে 'দীপা মাসি?'


ডাক শুনে পিছন ফিরে তাকায় দীপা। দশ বছরে তার চেহারায় খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। শুধু চোখের ওপর চশমা চড়েছে।


---- 'আমাকে চিনতে পারছেন?'


একটু ভেবে দীপা বলে 'মাধবী? সনাতন কাকুর নাতনি।'


---- 'একদম ঠিক ধরেছেন।'


---- 'কত বদলে গেছ তুমি, মাধবী! কেমন আছো?


---- 'আমি ভালো আছি। আপনারা ভালো তো? আপনারা তো মেসোর ট্রান্সফারের পর এই জায়গা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।'


---- 'হ্যাঁ, আমরা তো এখন নাগপুরে থাকি। মেয়ে নাগপুরের কলেজে পড়ে। বাবা-মাও এখন আমাদের সঙ্গে থাকেন। বাড়িটা তো কত বছর বন্ধ পড়েছিল। তাই প্রোমোটারকে দিয়ে দিলাম। প্রোমোটারের সঙ্গে কিছু কাজ ছিল বলেই এতো বছর পরে আবার আসা হল। 

                সনাতন কাকু কেমন আছে? পরিবারের অন্যরা ভালো আছে তো?' 


---- 'দাদু তো আজকাল আর বেশি হাঁটাচলা করতে পারেন না। দিদিমা আর মা ভালো আছে। ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে রাজস্থানের একটা কলেজে লেকচারারের চাকরি পেয়েছে।'


---- 'দারুণ খবর শোনালে। আর তুমি কেমন আছো মাধবী?'


লাজুক হেসে মাধবী বলে 'আমি ভালো আছি মাসি। বি.এ পাশ করার পর প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পেয়েছি। গতবছর আমার বিয়ে হয়েছে। আমার স্বামী ব্যাংকে চাকরি করেন। মাসি, উনি খুব ভালো মানুষ।'


---- 'আমি ভীষণ খুশি হলাম মাধবী।'


---- 'মাসি, আপনাকে কিছু কথা বলার আছে। বহুদিন ভেবেছি বলব। কিন্তু যোগাযোগ না থাকায় বলা হয়নি।'


---- 'কী কথা?'


---- 'দশ বছর আগে আপনার বলা কথা এবং আচরণ আমার জীবন বদলে দিয়েছিল। বারবার নিজেকে ধিক্কার জানিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, নিজের সুখের জন্য আমি পরিবারকে জলাঞ্জলি দিচ্ছি। সম্মান বিকিয়ে যাচ্ছি এমন ঘরে যারা হয়তো ভবিষ্যতে অর্থের মূল্যে আমাকেও বিক্রি করে দেবে। তাই বাড়ি ফিরে বিয়ে ভাঙার কথা বলি। দিদিমা, মা প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু ভাই শক্ত হয়ে আমার পাশে দাঁড়ায়। বিয়েটা ভেঙে যায়। তারপর তিলেতিলে গড়েছি নিজেকে। আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ দীপা মাসি।'


মাধবীর হাত ধরে দীপা বলে 'আমি ঠিক এমনটাই চেয়েছিলাম মাধবী। কোন মানুষ অন্য কারোর আজীবনের অবলম্বন হতে পারে না। ন'বছর আগে আমরা এই শহর ছেড়েছি। তোমরা যদি আমার ওপর ভরসা করে থাকতে তাহলে তালাবন্ধ বাড়ি দেখে কেবল হতাশা জন্ম নিত। ঈশ্বরের আশীর্বাদ সঙ্গে নিয়ে নিজের উপর ভরসা করে চলার নামই জীবন। আমি তোমার জন্য গর্বিত মাধবী। আজীবন মাথা উঁচু করে থেকো।'


বাড়ির সামনে বুলডোজার এসে গেছে। আজ বাড়িটা ভাঙা হবে। প্রোমোটারের সঙ্গে কথা বলার জন্য এগিয়ে যায় দীপা। মাধবীর মোবাইল বেজে ওঠে। তার স্বামী ফোন করেছে।


---- 'মাধবী এইমাত্র প্রোমোটারের সঙ্গে কথা হল। আগামী মাসে উনি আমাদের ফ্ল্যাট হ্যান্ডওভার করবেন। জাস্ট ইমাজিন মাধবী, আমাদের নিজের ফ্ল্যাট!'


ফোন রেখে মাধবী ভাবে, দীপা মাসিকে তো বলাই হল না, তারা দু'জনে বিয়ের আগেই লোন নিয়ে ফ্ল্যাট বুক করেছিল। এইবার নিজের ছাদের তলায় প্রাণভরে শ্বাস নেবে তারা।'


পিছন ফেরে মাধবী। বুলডোজার সশব্দে বাড়ির বুকে প্রথম ধাক্কা দেয়। ধুলো উড়িয়ে দ্রুতগতিতে বেরিয়ে যায় দীপার গাড়ি।