Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

প্রথম-খেয়া-সেরা-সাহিত্য -সম্মাননা

আর একটাই বাকিনিরঞ্জন ঘোষ
“আমার মনে হচ্ছে, তুই কোথাও একটা ভুল করছিস। তোর কথাটা আমি মানতে পারলাম না।““না রে। একটু চিন্তা করে দ্যাখ, দুটো মার্ডারই হয়েছে একই থানার এলাকায়। দুটো মার্ডারের ঘটনাস্থলের  দুরত্ব বেশি নয়, এ পাড়া ও পাড়া। এক…

 


আর একটাই বাকি

নিরঞ্জন ঘোষ


“আমার মনে হচ্ছে, তুই কোথাও একটা ভুল করছিস। তোর কথাটা আমি মানতে পারলাম না।“

“না রে। একটু চিন্তা করে দ্যাখ, দুটো মার্ডারই হয়েছে একই থানার এলাকায়। দুটো মার্ডারের ঘটনাস্থলের  দুরত্ব বেশি নয়, এ পাড়া ও পাড়া। একই ধরণের ওয়েপন দিয়ে মার্ডার করা হয়েছে দুজনকেই। দশ দিনের তফাতে। আমার মনে হচ্ছে এটা কোন সিরিয়াল কিলারের কাজ। দেখা যাক আর কোন মার্ডার হয় কিনা, অবশ্য আমি চাই না হোক। তবে, আমি সিওর এটা সম্পত্তিগত বা ব্যবসা সংক্রান্ত দ্বন্ধের কারণে খুন নয়। কোন পাগলের দ্বারা এই খুন হয়েছে। আমি দুটো বাড়িতেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। দুই বাড়ির প্রত্যেকটি লোকই হতবাক হয়ে রয়েছে খুনের ব্যাপারে। যারা খুন হয়েছে তারা কেউ সম্পত্তি বা ব্যবসা দেখাশোনা করত না।“

“কিন্তু তুই অন্য দিকটা দেখছিস না। দুটো ফ্যামিলির মধ্যে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। দু পুরুষ আগে একান্নবর্তী ফ্যামিলি আলাদা হয়ে যায়। যে দুজন খুন হয়েছে, তারা রক্তের সম্পর্কে জাঠতুতো খুড়তুতো ভাই হয়। সেক্ষেত্রে কি করে বলি যে এর মধ্যে পরিবারগত দ্বন্ধ নেই?”

“হ্যাঁ, সেটা অবশ্য বলা যায়। তবুও আমার মন বলছে এই দুটো খুনের মধ্যে কোন পরিবারগত বিবাদ নেই, অন্য কিছু।“


কথা হচ্ছিল দুই সেকেন্ড অফিসারের মধ্যে। দুই জনের বন্ধুত্ব ট্রেনিং পিরিয়ড থেকে। তুষার লালবাজারে পোস্টিং, কোন একটা তদন্তের কারণে মিহিরের এখানে এসেছিল। চা খেতে খেতে কথার মাঝে সদ্য ঘটে যাওয়া দু দুটো খুনের ঘটনা এসে পড়ে। দুটো খুনই হয়েছিল মিহিরের থানা এলাকায়। একটার কেস বুঝে উঠতে না উঠতেই আর একটা খুন। আর এখন এই ধরণের ঘটনার গন্ধ পেলেই হয়, ক্যামেরা ম্যান, রিপোর্টার, টিভি, খবরের কাগজওয়ালা সবাই কাঁঠালের মাছির মতো ভনভনিয়ে ছেঁকে ধরে। এই ধরনের খুনের কারণ, ব্যাখ্যা সব জানতে চায়। ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। 

কেস দুটোই জটিল আকার ধরেছে শুধুমাত্র খুনের জন্য ব্যবহৃত হাতিয়ার কে নিয়ে। ছুরি নয়, পিস্তল নয়, অদ্ভুত হাতিয়ার, দুটোতেই একই ধরণের হাতিয়ার। একটা চট বা প্লাস্টিকের বস্তা সেলাই করা গুন ছুঁচ। সামান্য মোটা। ঘাড়ের পেছন দিকে মাথার সামান্য নিচে, যেটাকে সারভাইক্যাল স্পাইন বলা হয়, প্রায় তিন ইঞ্চি বিঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছুঁচের হাতল ছাড়া অতখানি ছুঁচ ঘাড়ের পিছনে বিঁধিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। মিহিরের ধারণায় আলগা ফাঁপা হাতল ব্যবহার করা হয়েছে দুটো ক্ষেত্রেই। ছুঁচ সজোরে ঘাড়ে ঢুকিয়ে দিয়েই হাতল টেনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ছুঁচ থেকে কোন ছাপ বা কোন কিছু তথ্য পাওয়া যায়নি। দুটো পরিবারের দুজোড়া বৃদ্ধ বৃদ্ধা ছাড়া প্রায় সবাইকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কারও থেকে কোন ক্লু পাওয়া যায়নি। লালবাজার থেকে কেসটার প্রোগ্রেস জানতে চেয়েছে, একটু কড়া ভাবেই। অবশ্য লালবাজারকে দোয দিয়ে কি হবে, যে ভাবে খবরের কাগজ আর টিভি চ্যাঁচাচ্ছে ঘটনাটা নিয়ে, অফিসাররা তো কড়া মেজাজ নিয়ে কথা বলবেই। তাদেরও তো জবাবিহি করতে হয়। এদিকে মিহির এক পাও এ ব্যাপারে এগোতে পারেনি।

চা খেতে খেতে তুষার কে দুঃখের কথাগুলো বলছিল মিহির। 


“তুই কি করে সিওর হচ্ছিস যে দুই ফ্যামিলির মধ্যে শত্রুতা নেই”, তুষার জিজ্ঞাসা করল।

“দ্যাখ, দুই পরিবারই ব্যবসা করে, কিন্তু দুটো ব্যবসাই আলাদা আলাদা ধরণের ব্যবসা। এক পরিবারের ব্যবসা চায়ের ডিলারশিপ। রিটেল বিক্রিও করে। কোলকাতায় বিভিন্ন জায়গায় পাঁচখানা দোকান আছে। আর এক ফ্যামিলি লোহালক্কড়ের বিজনেস করে। এদের অবশ্য প্রথমজনদের মতো বড়ো বিজনেস নয়। এদের একটাই দোকান আছে। তবে বেশ বড় গোছের। এরাও পাইকিরি আর খুচরো দুটোই বিক্রী করে। আমি কেসদুটোয় সামান্যও এগোতে পারিনি। শুধু খুনের অস্ত্র দেখে মনে হচ্ছে এটা সিরিয়াল কিলিং হতে পারে।“

“এদের কল লিস্ট চেক করেছিস সেখান থেকেও তো কোন ক্লু পাওয়া যেতে পারে?”

“দেখেছি। গত একমাসের কল লিস্ট চেক করেছি। লিস্ট দেখে আমার কিছু সন্দেহ হয়নি। দু জনেরই বয়েস পঁচিশ ছাব্বিশের মধ্যে। কল করেছে বন্ধু বান্ধবেরাই। সবাইয়ের নাম রয়েছে ফোনের মধ্যে। আমি এখানে কিছু পাইনি।“

“ফোন দুটো কোথায়?”

“আমার কাছে, থানায়। দুটো ডেড বডিরই পকেটে ফোন ছিল, তাই থানায় রাখা হয়েছে।“

“আমাকে এক দিনের জন্য দে তো ফোন দুটো, আমিও একটু খুঁজে দেখি। যদি অমূল্য রতন কিছু পাই।“

“সে তুই নিয়ে যা। দ্যাখ যদি কিছু উদ্ধার করতে পারিস।“


রাতেই মিহিরের কাছে ফোন এল, তুষার করেছে।

“বস, তুই তো ফোন দুটো ভালভাবে চেক করেছিস বললি, কিন্তু একটা জিনিষ লক্ষ্য করিসনি। একটা নম্বর দুটো ফোনেই সেভ করা ছিল। আলাদা আলাদা নামে সেভ করা ছিল বলে তুই হয়তো বুঝতে পারিসনি। একটাতে গোল্ডি নামে আর একটাতে সোনালী নামে। নাম দুটো প্রায় সমার্থক বলে আমার সন্দেহ হওয়াতে চেক করলাম। ঐ ফোন নম্বরে এই মাসে প্রায় রোজই কথা হয়েছে। দু জনের সঙ্গেই। ফোনের অধিকারিণী নিঃসন্দেহে মহিলা।“

“বলিস কি রে! তাহলে তো একটু জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয়। কালকেই ধরতে হবে। তিনি আবার কোন থানা এলাকায় থাকেন কে জানে। অবশ্য যেখানেই থাকুক অসুবিধে হবে না।“


না ধরা গেল না। সকাল ন টা নাগাদ মিহির ফোন করে ফোন সুইচ অফ পেল।  ঘন্টা দুয়েক পরেই সকাল ১১টার সময় লালবাজার থেকে ফোন এল। ডেপুটি এক্ষুণি দেখা করতে চাইছেন।


“আপনার খুব সম্ভব জানা নেই, গতকাল রাতে দশটার সময় ভবানীপুরে এক ফ্ল্যাটের লিফটের মধ্যে এক মহিলা খুন হয়েছেন। স্বর্ণালী বোস।“ ডেপুটি জানালেন, “মার্ডার ওয়েপন সেম, যে ধরণের ওয়েপন দিয়ে আপনার এলাকায় দুজন মার্ডার হয়েছে। আমি এই কেস তিনটের তদন্তের ভার একজন স্পেশাল অফিসারকে দিচ্ছি। আপনি আপনার ফাইল তাকে বুঝিয়ে দেবেন। সে আপনার সঙ্গে বেলা দুটো নাগাদ দেখা করে নেবে।“ 

মিহির সেলাম ঠুকে থানায় ফিরে এল।


দুটো নয়, বিকেল তিনটের সময় তুষারের পরিচিত মুখটা মিহিরের সামনে দেখা দিল।

“কি রে, কি ব্যাপার?”

“কেন জানিস না তুই, ডেপুটি তোকে কিছু বলেনি?”

“ও হরি। তোকে এই কাজের ভার দিয়েছে। ভালোই হলো, ঝামেলা থেকে মুক্তি পেলাম।“

“আজ্ঞে না বস। দরকার পড়লে তোকে হেল্প করতে হবে। তাড়াতাড়ি এককাপ চা খাওয়া, তারপর কাজের কথা বলব। তার আগে একটা কথা জেনে নে, তোর গোল্ডি, সোনালী আর স্বর্ণালী বোস একই মহিলা। সেম ফোন নম্বর। বয়েস বাইশ তেইশের কাছাকাছি।“

“খুন হয়ে গেল!”

“আজ্ঞে। খুন হয়ে গেছে। তুই আর জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ পেলি না। এখন ভবানীপুর থানা যেতে হবে। দেখি কতদূর কি হয়েছে।“


রাত ৯ টার সময় তুষারের ফোন এল।

“কি রে, কি খবর?” মিহিরের জিজ্ঞাসা।

“জটিল ব্যাপার।”

“কেন, জটিল কেন?”

“আর একটা খুন হবে বস। কিন্তু তুই, আমি, ভবানীপুর থানা কেউ সেই খুনটাকে রুখতে পারব না, যদি না খুনী এর মধ্যে ধরা পড়ে।“ 

“খুন হবে মানে? কে বলল?”

“কে আবার বলবে, স্বয়ং খুনি জানিয়েছে।“

“হেঁয়ালী রাখ। খুলে বল।“

“খুলে বলার কিছু নেই। গোলডি ওরফে সোনালী ওরফে স্বর্ণালীর ব্লাউজে একটা কাগজ পাওয়া গেছে। তাতে লেখা ‘আর একটাই বাকি’। অতএব। মজার কথা কি জানিস, আজকাল সবাই মানে একশা পারসেন্ট লোক বল পেন ব্যবহার করে। খুনি মহাশয় কিন্তু ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করেছেন, ব্লু ব্ল্যাক কালি।“  

“বাঃ, একটা ক্লু তাহলে পাওয়া গেল অন্ততঃ। আর কিছু প্রোগ্রেস?”

“তুই কি সারা কোলকাতা শহরের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করবি, কে ফাউন্টেন পেন আর ব্লু ব্ল্যাক কালি ব্যবহার করে? এদিকে, প্রোগ্রেস বলতে এদিক ওদিক ফ্ল্যাটে খোঁজ নিয়ে জানা গেল মহিলা কোন প্রাইভেট কোম্পানীতে কাজ করতেন। কেউ তার আত্মীয় স্বজনের খোঁজ দিতে পারল না। ফোনেতেও কোন আত্মীয় স্বজনের নম্বর পাওয়া যায়নি। বেশি নম্বরও সেভ ছিল না ফোনেতে, অল্প কিছু। তোর এলাকার দুই ভিকটিমের নম্বরও ছিল। যে কটা নম্বর পাওয়া গেছে তাদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। কেউ অফিস কলিগ, কেউ বা শুধুই বন্ধু। দুটো ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা জানিয়েছে মহিলার ফ্ল্যাটে সন্ধ্যের দিকে লোকের যাতায়াত ছিল। পাশের বাসিন্দাদের সঙ্গে হাই হ্যালো ছাড়া বিশেষ কথাবার্তা ছিল না। কেউ খুলে কিছু না বললেও, আভাষে ইঙ্গিতে জানিয়েছে মহিলার দেহ বিক্রীর ব্যবসা ছিল।“

“সে তো বুঝলাম, কিন্তু খুনীকে ধরা যাবে কি করে।“ 

“সে যদি নিজে থেকে ধরা দেয় তবেই ধরা যাবে। এছাড়া আর কোনমতে সম্ভব নয়।“ তুষার ফোনের ওপার থেকে ক্লান্ত হাসল।

“একটা কাজ করা যাক, তুই সোনালীর ফোনে যে কটা লোকের নম্বর আছে, সবাই কে নজরে রাখ।“

“খেপেছিস নাকি? পঁচিশ তিরিশটা লোকের উপর নজর রাখা সম্ভব ?”

“দ্যাখ আমাদের সামনে আর অন্য কোন রাস্তা নেই। কিছু না করার থেকে এটাই করা যাক। তুই ফোনের লিস্ট দেখে একটা সম্ভাব্য ভিকটিমের লিস্ট তৈরী করে ফেল, বাছাই করে। তোর বুদ্ধি মতো সেই লিস্ট দেখে কিছু লোক বেছে নিয়ে লোকগুলোর সঙ্গে কথা বল। আজ থেকেই শুরু কর। হয়তো আমরা বুঝতে পারব, খুনীর চতুর্থ ভিকটিম কে।“

“ঠিক আছে, সেই চেষ্টাই করছি।“


সকাল ১১টায় ফোনটা রিসিভ করল মিহির। একটা রিল্যাক্স মুডে চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, বল, কি খবর?”

“মনে হয় চিহ্নিত করতে পেরেছি। নাম রমেশ মাইতি। লোকটা মানিকতলায় থাকে। রিস্ক নিইনি। সাত জনকে বেছে নিয়েছিলাম ফোন নম্বরের লিস্ট থেকে। আজ সকাল ১০ টার সময় সবাইকে দেখা করতে বলেছিলাম, পুলিশি ভয় দেখিয়ে। ছ জন কে মনে হলো না এরা সোনালীর সঙ্গে কোন ভাবে জড়িয়ে আছে। সবাই অফিস কলিগ। একজন শুধু বলল, সে সোনালীর বন্ধু আর বিজনেস করে। একটু বেশি বয়েস, প্রায় পঁয়ত্রিশ।  আমার সঙ্গে কথা বলার সময় ঠিক ঠাক কথা বলতে পারছিল না। আমার সন্দেহ হয়েছে।“

“তুই ওকে বলিসনি তো ওর বিপদের কথা?”

“পাগল নাকি, ওকে শ্যাডো করতে হবে, সন্ধ্যেবেলা থেকে। ওকে একবার তোর থানায় আসতে বলেছি বিকাল বেলায়, এখানে আরও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে বলে। সন্ধ্যে ৬ টা পর্যন্ত ওকে আটকে রাখব। ও তোর থানা থেকে বেরোলেই, তুই শ্যাডো শুরু করবি। খানিকটা পরেই আমি তোকে জয়েন করব। এখন রাখ।“


ফলো করাটা খুব একটা সহজ হলো না। দুই বন্ধু অনেক ঘুরে ঘুরে মানিকতলায় রমেশের বাড়ির কাছাকাছি একটা চায়ের দোকানে দাঁড়াল। মিহির দোকানের মালিককে পরিচয় জানাল। সে সন্ত্রস্ত মুখে দুই বন্ধুকে বসতে বলল।

“দ্যাখ, আমরা রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত দেখব।“ তুষার বলল, “যদি এর মধ্যে যদি কিছু না হয়, তাহলে কাল দেখা যাবে।“

“কিন্তু আমরা কতদিন এই বুনোহাঁসের পেছনে দৌড়ব?  অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ে যাওয়া।“

“আমাদের তো আর কিছুই করার নেই। দেখা যাক কতদূর কি হয়।“


“তুষার লোকটাকে একটু ভালো করে দ্যাখ, ঐ যে গলির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।“

“দেখেছি। কিন্তু লোকটা একটু বয়স্ক মনে হচ্ছে।“ 

“হোকগে বয়স্ক, ঠিক আটটা বাজে। চল ফলো করি।“

"আর একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছিস, লোকটার জামার বুকপকেটে কালির দাগ। আজকাল যেটা দেখা যায় না।"

"তাহলে এই খুনি হতে পারে।"

“কিন্তু খুব একটা কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। আমরা দূর থেকে লক্ষ্য রাখব।“

“কিন্তু তার আগে যদি কিছু হয়ে যায়, আমরা লোকটাকে বাঁচাতে পারব না।“

“কিন্তু তার আগে আমরা যদি লোকটাকে ধরি তাহলে ব্যাপারটাই যে কেঁচে যাবে। এই লোকটাই যদি খুনি হয়, আমাদের একে এ্যাটাক করার সুযোগ দিতেই হবে, তা নাহলে আমরা খুনিকে ধরতে পারব না। সারা জীবনের মতো আমরা খুনিকে হারিয়ে ফেলব।“


দুই বন্ধু চরম উত্তেজনায়। রমেশ মাইতি বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। বয়স্ক লোকটা অনেকটা রমেশের কাছাকাছি। দুই বন্ধু কাঁধে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে এগুচ্ছে ওদের থেকে বেশ কয়েক গজ পেছনে। বয়স্ক লোকটাকে কি জানি কি বলল রমেশ মাইতি। দুজনেই দূর থেকে দেখতে পেল, বয়স্ক লোকটা হঠাৎ হাত তুলল।

“কুইক, দৌড়ো।“

নাঃ, বাঁচানো গেলনা রমেশ মাইতি কে। রাস্তায় পড়ে ছটফট করছে। মিহিরের শক্ত হাতে বয়স্ক লোকটার হাত। সে ছাড়ানোর সামান্যতম চেষ্টাও করছে না। ইতিমধ্যে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে গেছে।


লালবাজারে একটা ঘরে তুষার, মিহির, আরও কয়েকজন অন ডিউটি অফিসার বসেছিলেন। সামনে মাথা নিচু করে বসে থাকা একটা কাঁচা পাকা চুলের মাথা।

আস্তে আস্তে মাথা তুলল লোকটি। তুষারের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনারা কষ্ট না করলেও আমি ধরা দিতাম স্যার, আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে। দু বছরের নরক যন্ত্রনা সহ্য করেছি। আর আমার বাঁচতে ইচ্ছে নেই।“

“বলুন, আপনার যা বলবার বলুন।“ মিহির বলল, “আপনার সমস্ত বক্তব্য আমরা লিখে নেব। আপনার বিচারের সময় প্রয়োজন পড়বে।“

"বিচার!" ক্লান্ত হাসল লোকটি। “আমি নীলরতন সমাদ্দার। একটা নামী স্কুলের ইংরাজীর শিক্ষক, অবিবাহিত। আমার কোন আত্মীয় স্বজন জীবিত নেই।

আমার দাদার একমাত্র সন্তান মৌসুমীকে নিজের মেয়ের মতো মানুয করে তুলতে চেয়েছিলাম। ওর বাবা মা একটা এ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। তখন ওর পাঁচ বছর বয়েস। তারপর থেকে আমিই একাধারে ওর বাবা আর মা হয়ে গিয়েছিলাম।

অনেক ভালো রেজাল্ট করেছিল হায়ার সেকেন্ডারীতে। ওর যে সাবজেক্টে পড়ার ইচ্ছা ছিল সেটা আমাদের মফঃস্বলে পড়ার সুযোগ ছিল না বলে বাধ্য হয়ে কোলকাতায় একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলাম। একটা বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে ওকে রেখেছিলাম। আর সেইখানেই ঘটনার সূত্রপাত।

ও কোলকাতায় আসার তিন মাস বাদে ওর একজন সাথী পেয়িং গেস্ট সেখানে আসে। স্বর্ণালী বোস। সে পড়াশোনা করত না। কোন একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে কাজ করত। সে আসলে কুনকির কাজ করত। অল্প বয়সী মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তাদের সর্বনাশ ঘটাত। এই কাজে তার দোসর ছিল তিনজন। তাদের আমি পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছি, যাতে ওরা আর কোন মেয়ের সর্বনাশ না করতে পারে। 

স্বর্ণালী কিছু দিন পর ঐ বাড়ি থেকে চলে যায়।  আমার ভাইঝিকে বলে সে ভবানীপুরে এ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছে। তার কিছুদিন পর সে আমার ভাইঝিকে নেমন্তন্য করে। যেদিন আমার ভাইঝিকে নেমন্তন্য করে সেদিন ঐ তিনটে শয়তান কে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল। সে কোন কিছু খাইয়ে আমার ভাইঝিকে অজ্ঞান করে দেয়। আর তারপর ঐ তিনজন নরপশু আমার ভাইঝিকে ধর্ষণ করে আর তার ভিডিও তুলে রাখে। পরে ঐ ভিডিও আমার ভাইঝিকে দেখিয়ে বলে তাদের সঙ্গে কোন হোটেলে যেতে, কোন লোককে সঙ্গ দিতে। না গেলে তারা এই ভিডিও সবাইকে জানিয়ে দেবে।

কিন্তু ওদের এই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। আমার ভাইঝি কোনক্রমে ওদের কবল থেকে পালিয়ে আসে। বিনা দ্বিধায় আমাকে সে সব কিছু জানায়। ওদের ছবি আমাকে দিয়ে দেয়। তারপর সুযোগ বুঝে আত্মহত্যা করে। আমি প্রথমে দিশাহারা হয়ে পড়ি। কি করব বুঝে উঠতে পারিনি। তারপর ধরা পড়ল, আমার লাংস ক্যানসার। তখনই আমি ঠিক করে নিলাম, মরার আগে আমি প্রতিশোধ নেব। 

কোলকাতায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলাম। আর ওদের উপর লক্ষ্য রাখতে শুরু করলাম।

আমি ছুরি চালাতে পারি না। জীবনে পিস্তল দেখিনি কোনদিন। কি করব?

একটু চিন্তা করে আমি মারার অস্ত্র পেয়ে গেলাম। চাকরি পাবার আগে আমি পয়সার জন্য ফুটবল সেলাই করতাম। মোটা গুণছুঁচ সেলাইয়ের কাজে ব্যবহার করতাম। সে গুলো রাখতাম ছোট ছোট বাঁশের নলিতে। ঐটাই আমার অস্ত্র হয়ে উঠল।

সুযোগ খুঁজে কাজে লাগালাম।

এই লোকটাকে একটা মেয়ের ঠোট দিয়ে দেখা করতে বলেছিলাম। আজ টোপটা কাজে লাগল।

আমার আর কিছু বলার নেই। আমার জীবনও শেষ হয়ে এসেছে। হয়ত বিচার শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি বাঁচব না। আমি য়া করেছি তার জন্য আমি বিন্দুমাত্রও লজ্জিত নই।“

===============================