Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

গল্প - শিলুর গঙ্গা যাত্রাকলমে -- মহুয়া মিত্র
মনমরা হয়ে খিড়কি পুকুরের ঘাটে বসে ছিল শিলু। দশ বছরের শৈলজা মাস দুই তিন আগেও বাপের বাড়ির শৈল ছিল, গত মাঘে মাধবপুরের জমিদার শ্রীশচন্দ্র তালুকদারের বড়ো মেয়ে শৈলজা এই রতনডাঙার জমিদার উ…

 


গল্প - শিলুর গঙ্গা যাত্রা

কলমে -- মহুয়া মিত্র


মনমরা হয়ে খিড়কি পুকুরের ঘাটে বসে ছিল শিলু। দশ বছরের শৈলজা মাস দুই তিন আগেও বাপের বাড়ির শৈল ছিল, গত মাঘে মাধবপুরের জমিদার শ্রীশচন্দ্র তালুকদারের বড়ো মেয়ে শৈলজা এই রতনডাঙার জমিদার উদয় ঘোষের বাড়ির মেজ বৌ হয়ে এসে হয়ে গেল শিলু। তবে এটা ওর মন খারাপের কারণ নয়।


যদিও মাধবপুর আর রতনডাঙার দূরত্ব পালকিতে ব্রাহ্মমূহুর্ত থেকে সন্ধ্যায় শাঁখ বাজা অবধি ( বিয়ের পর দিন শিলু এভাবেই শ্বশুরবাড়ি এসে ছিল বলে এটাই ওর হিসাব ) আর এই মাস তিনেকের মধ্যে ও একবারও বাপের ঘরে যায় নি, তবুও ও ভালোই ছিল। শুধু শিবরাত্রির আগে তালুকদার মশাই মেয়ের শ্বশুরবাড়ি শিবরাত্রির তত্ত্ব নিয়ে এসে যখন জানালেন যে তার স্ত্রী চার কন্যার পর একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেছে সাত দিন আগে, তখন সাময়িক শিলুর মনটা বেশ খারাপ হয়ে যায় মা আর ভাইয়ের জন্য, কিন্তু সেটাও কেটে গেল যখন সেদিন বিকেলে ঘোষেদের গোয়ালে চন্দ্রা গাই এক সাদা বাছুর জন্ম দিল, তাকে পেয়ে।


তাছাড়া দুই বাড়িতে তফাৎ নেই বললেই চলে। দুটোই বিরাট বড় বাড়ি, প্রচুর লোকজন। বাড়ির লোকজন, আত্মীয় স্বজন, আশ্রিত, কাজের লোক, মুনিষ, যোগাড়ে আর তারপর তো এসো জন, বসো জন আছেই। সে এক এলাহী কান্ড। আর এই বাড়ির মা মানে শাশুড়ি মাও একেবারে ঐ বাড়ির মায়ের মতো। ওকে আর ওর বড়ো জা কুসুমকে একেবারে চোখে হারায়। নিজের মেয়েদের বকাঝকা করলেও ওদের নৈব নৈব চ। মাধবপুরে থাকাকালীন ওকে তাও কাজ করতে হতো। মায়ের হাতে হাতে এটা ওটা করতো। ঠাকুমা জেঠিমার সঙ্গে রান্না শিখতো। কাজ থেকে ফিরলে জল গামছা এগিয়ে দিতো বাবাকে। বোনগুলোকে নাওয়াতো, খাওয়াতো। কিন্তু এখানে সেসব কিছুই নেই।


শাশুড়ি ভুলেও ওকে রাঁধতে দেয় না। রাতে নিজের পাশে শুইয়ে বলে, --" রান্না কি পালিয়ে যাচ্ছে, করবি আগে বড়ো হ।" বলে ওকে রূপকথার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ায়। কুসুম দিদিও খুব ভালো, ওর সঙ্গে খেলে না ঠিকই তবে বিকেল বেলা ওকে পরিছন্ন করে কাপড় বদলিয়ে কত রকমের চুল বেঁধে দেয় ওকে আর তখন কত গল্প করে দুই জন। শাশুড়ি মা নিজের হাতে ওর প্রিয় পদ রেঁধে ওকে কোলে বসিয়ে খাওয়ায়। ও শুধু সারা দিন গোটা বাড়িময় ঘুরে বেড়ায়। আর যার সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে সে তো এখানে থাকেই না, কলকাতায় থেকে কলেজে পড়ে। সেই শনিবার সাঁঝবেলায় আসে আর সোমবার কাকভোরে চলে যায়। তবে তাতে শিলুর কিছু যায় আসে না। অবশ্য যে দিনগুলো থাকে, সেই দিনগুলো তার খাওয়ার সময় শাশুড়ি ওকে দায়িত্ব দিয়েছে বাতাস করার। সেই সময় সে কত গল্প করে, কলকাতার গল্প, তার কলেজের গল্প। ওখানে না কি মেয়েরাও সব ছেলেদের সঙ্গে বসে পড়াশোনা করে। এক গলা ঘোমটার আড়ালে মন্ত্র মুগ্ধের মত সব শোনে শিলু। ভাবে, সেও যদি পড়তে পারতো! তাই তো আজকাল নিঝুম দুপুরে, শাশুড়ি ভাত ঘুমে ডুবে গেলে, পিছনে আমড়া তলায় চলে যায় ওর ইস্কুল পড়ুয়া দেওরের সঙ্গে। দেওরকে আম মাখা বা তেঁতুল মাখা ঘুষ দিয়ে অক্ষর চেনার চেষ্টা করে। 


এত কিছুর পরেও মন ঠিক নেই। আজ চৈত্র সংক্রান্তি, কাল পয়লা বৈশাখ। অন্য বারের থেকে এবার ওর পয়লা বৈশাখের প্রাপ্তিও হয়েছে বেশি। বাপের বাড়ির তত্ত্বে ওর জন্য এসেছে বালুচরী আর দুই জোড়া নক্সী বালা। শ্বশুর মশাই দিয়েছেন রাজশাহীর তাঁত, শাশুড়ি দুই বৌমার জন্য গড়িয়ে দিয়েছে সোনার টায়রা টিকলী। বড়ো জায়ের বাপের বাড়ি থেকে পেয়েছে হাজার বুটি। আবার সেও গতকাল বাড়ি ফিরেছে, কলকাতা থেকে নতুন বৌয়ের জন্য নিয়ে এসেছে কত সব রূপটানের সামগ্ৰী। তবু মন অস্থির।


ঘোষেরা চৈত্র পড়তে না পড়তেই গুষ্টির যত বৌ তাদের বাপের বাড়ি আর যত মেয়ে তাদের শ্বশুরবাড়ি পয়লা বৈশাখের তত্ত্ব পাঠানো শুরু করে। শাড়ি বৌ যখন তখন শাড়ির বোঁচকা নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির হতো। শাশুড়ির সঙ্গে শিলু নিজেও তত্ত্বের শাড়ি বাছাই করেছে। গোটা মাস জুড়ে চলেছে নতুন বছরের জন্য বাড়ি সাফাই। শাশুড়ি, জা ঘরকন্নার কাজে ব্যস্ত থাকলে সেসব খুশি মনে সামলেছে শিলু। নববর্ষের দিন এই বাড়িতে বিশাল করে লক্ষ্মী নারায়ণ পূজো হয়। সেই পূজোর জন্য সারা সপ্তাহ ধরে এত এত নাড়ু মোয়া সন্দেশ তৈরি হয়েছে। পাড়ার বামুন বৌদের এই কাজে তদারকি করেছে শিলু। আজ চৈত্র সংক্রান্তির দিন নিরামিষ আহার হবে। সন্ধ্যা বেলা ও নেয়ে ধুয়ে নতুন শাড়ি পরে রান্না ঘরে যাবে শাশুড়ির তত্ত্বাবধানে পায়েস রান্না করতে। রাতে সকলের পাতে পরবে বাড়ির নতুন বৌয়ের হাতের তৈরি পায়েস। দুপুরে আলতা বৌ এসে পা ঘষে নক্সা কেটে আলতা পরিয়ে গেছে। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত গোটা জমিদার বাড়ি, তাও কোথাও একটা বিষাদ খেলছে শিলুর মনে।


চৈত্রের তপ্ত দুপুর বিকেলে গড়াচ্ছে। রোদে পোড়া পৃথিবীর জ্বালা জুড়াতে হালকা বাতাস বইছে। হাওয়ায় পুকুরের জলে দোলা লেগেছে। ঘাটের শেষ সিঁড়িতে বসে জলে পা ডুবিয়ে একমনে জলের দিকে তাকিয়ে ছিল শিলু। এমন সময় বিভা আর কুসুম ঘাটে এলো। বিভা শিলুদের দূর সম্পর্কের খুড়শাশুড়ি হলেও বয়সে কুসুমের মতোই। দুজনেই সদ্য যুবতী। উভয়ের শরীরেই লেগেছে নতুন প্রাণের স্পন্দন। ওরা খুব সাবধানে ঘাটে নেমে শিলুর পাশে বসলো। কুসুম শিলুকে ধাক্কা দিয়ে বলল, --" কি রে মেজোবৌ, মুখখানা অমন করে আছিস কেন রে, ঠাকুরপো কিছু বলেছে বুঝি!"


পাশ থেকে রঙ্গ ভরা গলায় বিভা বলল, --" তুইও যেমন বড়ো বৌ! বলি আমার ভাসুরপো অত সাজের জিনিস এনে দিলো, ওগুলো দিয়ে সেজে আমাদের মেজোবৌ কখন সোয়ামীর সন্দর্শনে যাবে এই ভেবে আকুল।" বলে দুজনেই হেসে গড়িয়ে পড়লো।


রাগী মুখে দুজনের দিকে চেয়ে বলে উঠলো শিলু, --" তোমাদের খালি বাজে কথা। আমি ওনার কাছে যাবো না, কোত্থাও যাব না, মায়ের কাছেই থাকবো।"


বলে উঠতে গেলে কুসুম ওকে জোর করে বসিয়ে আদর করে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, --" আহা, রাগ করে না বোন। বোস, কি হয়েছে খুলে বল দেখি। শরীর খারাপ? না মন?"


পাশ থেকে বললো বিভা, --" মনের আর দোষ কি বড়ো বৌ, হতেই পারে। ছোট মেয়ে, প্রথমবার পয়লা বৈশাখে বাপের ঘরে নেই। এখন তো আর তুই বাপের বাড়ি যাবিও না মেজোবৌ। যেতে যেতে সেই আশ্বিন, তোর ভাইয়ের মুখে ভাতের সময়।"


বিভার স্বভাবই বেশি কথা বলা। তাই ওকে গুরুত্ব না দিয়ে কুসুম ফের বলল, --" তাই কি মেজো?"


এবার শিলু বলল, --" আসলে দিদি আমার খুব গঙ্গা যাত্রা করতে ইচ্ছে করছে।"


বিভা আর কুসুম মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। শেষে বিভা বলল, --" ও আবার কি অলক্ষ্যুণে কথা মেজো বৌ! তুই খামোখা গঙ্গা যাত্রা করবি কেন?"


এবার খিলখিল করে হেসে উঠলো শিলু, --" আরে খুড়ি, এ গঙ্গা যাত্রা সে গঙ্গা যাত্রা নয় গো। আসলে আমাদের মাধবপুরে নিয়ম ছিল পয়লা বৈশাখের দিন জমিদার বাড়ির সব মেয়ে বৌরা দল বেঁধে গঙ্গা স্নানে যাবে, কোনো পুরুষ যাবে না। কাজের মেয়েরাও যেত। পায়ে হেঁটে, পালকিতে নয়। গ্ৰামের পাশেই ছিল গঙ্গা। কি যে মজা কি আর বলবো। তারপর অনেক সময় ধরে নেয়ে, ধুয়ে, সাঁতার কেটে, গল্প গাছা করে তবে ডাঙায় উঠতাম। তারপর চলতো সেই গঙ্গা পাড়ে গাছের নিচে বসে দুপুরের খাবার। বেধবারা একধারে, সধবারা একদিকে। কত মাছ, কত ব্যঞ্জন। তারপর আরও একপ্রস্থ গল্প সেরে বিকেলে ঘরে ফেরা। সেই আনন্দ এবার থেকে একদম বন্ধ।" শিলুর চোখ ছলছল করে ওঠে।


হঠাৎ কার গলার আওয়াজ আসে, --" ওঃ এই ব্যাপার।" তিনজন পিছন ফিরে দেখে শিলুর শাশুড়ি কদমবতী দাঁড়িয়ে। কদম ঘাটে নেমে শিলুর পাশে বসলো, বললো, --" এতটুকু কথা আমাকে বলতে পারিস নি বৌ? ওরে আমি যে তোর মা, সব বলবি। আমি পূরণ করব তোর ইচ্ছাটা। তবে এখানে তো গঙ্গা বা অন্য কোন নদী নেই, তাই তোর বাপের বাড়ির নিয়ম মত আমরা মজা করব এখানে, পুকুর পাড়ে। সবাই একসাথে নাবো, ধোবো, খাবো আর খুব মজা করবো। দাঁড়া, তোর শ্বশুরকে সন্ধ্যা বেলা জলখাবার খেতে দিয়ে সব আয়োজন সম্পন্ন করতে বলছি। হাজার হোক আমাদের নতুন বৌয়ের আবদার, রাখতেই হবে।"


--" কিন্তু মা, বাবামশাই কি রাজি হবেন?" কুসুম বলল।


লজ্জা লজ্জা মুখে কদম বলল, --" তোদের শ্বশুর আজ অবধি আমার কোনো কথা ফেলেন নি, এটাও ফেলবেন না।"


--" আমরা সত্যি এমন করব মা?" শিলু বলল।


--" করব রে বাবা করব। এখন চল্, নাইবি যা। দেরি হলে তোদের শ্বশুর আবার বেরিয়ে যাবেন।" বলে কদম জলে নামলো।


শিলুও খুব খুশী। এক না হোক, কিছুটা হলেও তো পুরনো দিনের মতো আনন্দ করতে পারবে, এই বা কম কিসে!