সৃষ্টি সাহিত্য যাপন শিরোনাম -অসহায়াকলমে-স্বীকৃতি ভট্টাচার্য্য
বাপের বাড়িতে থাকতে আমি বাগান করতাম l সেখানে ফুল ফুটতো, ছিঁড়ে নিয়ে চুলে বেঁধে কত কী যে ভাবতাম সে কেবল আমিই জানি lএখানে বাগান নেই l আছে বিরাট একটা রান্নাঘর আর দুটো বড়ো ব…
সৃষ্টি সাহিত্য যাপন
শিরোনাম -অসহায়া
কলমে-স্বীকৃতি ভট্টাচার্য্য
বাপের বাড়িতে থাকতে আমি বাগান করতাম l সেখানে ফুল ফুটতো, ছিঁড়ে নিয়ে চুলে বেঁধে কত কী যে ভাবতাম সে কেবল আমিই জানি l
এখানে বাগান নেই l আছে বিরাট একটা রান্নাঘর আর দুটো বড়ো বড়ো গভীর গর্তে গড়া উনুন l আর আছে দুবেলা পেট ভরে খেতে চাওয়া বেশ কয়েকজন ক্ষুদার্ত মানুষ l
"দেখিস, ধীরে ধীরে আপন হয়ে যাবে সকলে" এই কথা বলেছিলো মা l আপন হলো সকলেই, কিন্তু আমিই হলাম না কারোর l
এখানে বাগান তৈরী করতে গিয়েছিলাম একদিন সকালে উঠেই l কয়েকটা গাছ লাগিয়ে জল দিয়ে বেড়া দিলাম শক্তপোক্ত l ছাগলে গরুতে নয়, ঘরের মানুষরা এসে তছনছ করে দিয়ে গেলো পরেরদিন l আলপনা দিতাম বাপের বাড়ি l সেই আলপনা আজও আছে l এখানে আর দিতে সাহসে কুলালো না l মনে আলপনা দেওয়া যায় না, দেওয়া গেলে,আমার সমস্ত এই ভাঙা দেওয়াল জুড়ে দিতাম অজস্র আলপনা l
বাপের বাড়িতে একটা বিরাট বিছানা ছিল, যেটা ছিল অপূর্ব সব কল্পনার তুলোর চাদরে ঢাকা l তার উপর বসে শুয়ে ঘুমিয়ে হঠাৎ একদিন শুনতে পেলাম -বিয়ে হবে আমার l
সে'দিন বাগানের সমস্ত গাছে জল দেওয়া বন্ধ করে দিলাম l কিছুদিন যেতেই সব মরে গেলো l তবু মায়া করলাম না l বোললাম, 'আমার ঘর ভাসিয়ে দিলে তোমরা,আজ তোমাদের জমি আমিও কেড়ে নিলাম l'
হাসতে হাসতে স্বপ্নের চৌকাঠ পেরিয়ে নরকের ঘরে এসে পড়লাম l আলপনাহীন ঘরে অতি ছোট্ট একটা নিথর বিছানায় প্রতিদিন আমায় শুইয়ে দেয় ভালুকের মতো এক পুরুষ ভূত l যার হৃদয় বলে কিচ্ছু নেই,আছে কেবল তীব্র কামনা l
সে তার মানসিক সমস্ত ক্ষুধাকে লাঙ্গলের ফলায় বেঁধে অমানবিক পরিশ্রমে আমার সুখানুভবকে অতিক্রম করে নিজের সুখ খুঁজে নিতে চায় আমার শরীরে এসে l
সারাদিনের আমার ক্লান্ত শরীরের উপর উঠে মানুষটি অপূর্ব আনন্দচিত্তে আমায় ছিঁড়ে ছিঁড়ে টুকরো করে দেয় প্রতিটিদিন l
আবার কোনোদিন ভাগ্যের মিথ্যে এক ভোরবেলায় আমায় ডেকে,চোখের দিকে তাকিয়ে বলে "এসো আরেকবার খেলি l"
খেলার কথা মনে পড়তো ভীষণ রকম l
পাঁছিলের উপর উঠে পেয়াড়া গাছের ডাল ভেঙে আবার পাঁচিলের অন্যপ্রান্তে গিয়ে ডাকতাম সীতাকে l সীতা আর আমি খেলতাম l
সীতারও একদিন এইভাবেই স্বপ্নহীন নরকে বুঝি পা এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিলো অসহায় l
আমি একা একা খেলতাম l
এখানে পুকুরের দুটো সিঁড়ি বেয়ে নামলেই জল l সমস্ত এঁটো বাসন নিয়ে মাজতে মাজতে প্রতিদিন ভাবতাম ডুবে মরি l কিন্তু সারাদিন পাড়ার দামাল ছেলেরা সাঁতরে বেড়াতো পুকুরের এপার থেকে ওপার l
বেঁচে ফিরে এলে এইজীবনে আর লজ্জার শেষ থাকবে না জেনেই ডুবতে পারিনি l
এই কদিন মাত্র হলো, একটি ছেলের সাথে চোখে চোখে কথা হয় l খুব ভালো লাগে আমার l
পুকুরে বাসন ধুতে ধুতে দেখি ছেলেটি ঘাটের কাছে এসে, পিঠে পেটে হাতে পায়ে সর্ষের তেল মেখে ঝপাং করে জলে ঝাঁপ মারে l কিছুটা জল এসে আমায় ধুয়ে দিয়ে যায় আমার নারীত্বে l বাসন ধুতে ধুতে দেখি ছেলেটির সাঁতারকাটা l দু'চোখ ভরে দেখি মাছের মতো তীব্র তার গতিবেগ,দেখি জলভরা দুটি চোখ আমারই দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হঠাৎ ডুবে যাচ্ছে কখনো কখনো জলের তলায় l
আমি ভেসে উঠি অন্ধকার থেকে অপূর্ব আলোয় l
মাথা থেকে আমার লজ্জার ঘোমটা খসে পড়ে, মুছে যায় সিঁথির অভিশাপ l শুধু এইটুকুর লোভে পুকুরঘাটটি স্বর্গের এক অমৃতসরোবর হয়ে ওঠে আমার মনে l
সারা শরীর অপূর্ব আনন্দে কেঁপে ওঠে l
ছেলেটির স্নান সারা হলে বাসন নিয়ে আমিও উঠে পড়ি l
পিছন ফিরে দেখতে মন চায় খুব l কিন্তু আজও সেটা পারলাম না l