Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন    #গল্প   #সূর্যাস্তের আগে   #অমিতাভ_রায়
                         -
    ভোরে সূর্যটা উঁকি মারার আগেই বেরিয়ে পড়ে দেবু অর্থাৎ দেবব্রত। এটা ওর রোজকার অভ্যাস। জীবনের বাষট্টিটা বছর পেরিয়ে গিয়েছে। অবসর নিয়েছে। তবুও …

 


#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন 

   #গল্প

   #সূর্যাস্তের আগে

   #অমিতাভ_রায়


                         -


    ভোরে সূর্যটা উঁকি মারার আগেই বেরিয়ে পড়ে দেবু অর্থাৎ দেবব্রত। এটা ওর রোজকার অভ্যাস। জীবনের বাষট্টিটা বছর পেরিয়ে গিয়েছে। অবসর নিয়েছে। তবুও এই অভ্যাস বদলায় নি। এখন অঢেল সময়। আগে ভাবতো রিটায়ার করে শুধু ঘুরে বেড়াবে আর বই পড়বে। এখন বুঝেছে ওটা কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে। নিজে বিয়ে করেনি। কিন্তু, ভাইপো- ভাইঝিদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে সবসময়। আজও যথারীতি ভোরবেলায় বেরিয়েছিল ও। কিছুটা হাঁটতেই সামনে দেখে এক মহিলা ওর কিছুটা আগে হাঁটছে। পেরিয়ে যাওয়ার সময় একবার মহিলার দিকে তাকিয়ে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যায় ও। তারপর সবিস্ময়ে  চেঁচিয়ে ওঠে, "মৃণ্ময়ী -মিনু তুমি!" মিনু ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। বলে,"কমবয়সে সবাই কীরকম ভোরে হাঁটতাম- তাই না দেবুদা?" দেবু মাথা নেড়ে সায় দেয়। ওরা অনেকেই হাঁটতো। ধীরে ধীরে মেয়েগুলোর বিয়ে হয়ে গেল। ছেলেগুলো চাকরি বাকরির চাপে হাঁটা বন্ধ করে দিল। একমাত্র পরেশ হাঁটতো দেবুর সঙ্গে নিয়ম করে। ওরও হঠাৎ একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেল। পরেশের কথা ভেবে মন বিষণ্ণ হয়ে গেল দেবুর। "তুমি বিয়ে করো নি- তাই না?" দেবু মাথা নাড়ে। তারপর বলে, "জীবনে একজনকেই ভালবেসেছিলাম। আর কাউকে ভালবাসতে পারলাম না।" মিনু নীরব হয়ে যায়। ওর কিছু বলার নেই। বাড়ির চাপে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। নইলে কী করতো ও? দেবুদাও তো সাহস করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে বলেনি। ধীরে ধীরে সূর্য উঠছে। চারদিকে নরম রোদের আলো। "তুই এখানে এলি কবে?" দেবু আবার পুরনো দিনের মতোই ওকে তুই তুই করে কথা বলছে। প্রথমটায় বোধহয় অস্বস্তি হচ্ছিল। মুচকি হাসে মিনু। তারপর বলে, "চিরকালের জন্য চলে এসেছি।" "মানে?" বিস্মিত দেবুর মুখের দিকে তাকিয়ে মিনু বলে,"অনেক সহ্য করেছি। আর নয়।" দেবু নীরব হয়ে যায়। মিনুর বিবাহিত জীবনে সমস্যা রয়েছে তা ও জানতো না। মিনু বিড়বিড় করে,"লোকটা আমায় কোনদিন ভালবাসেনি। চরিত্রহীন। মেয়ে থাকে নিউইয়র্কে। আমার গায়ে ওর বাবাকে অনেকবার হাত তুলতে ও দেখেছে ছোটবেলায়। তারপর ওকে হস্টেলে দেওয়া হল। এখন চাকরি করে। সেদিন ভিডিও কলে আমার চেহারার অবস্থা দেখে বলল, 'মা- তুমি এখনও একসঙ্গে আছো কী করে!' সেদিন ও আমার উপরে যথেষ্ট অত্যাচার করেছিল। আমিও ভেবে দেখলাম।বাপের বাড়িটা ফাঁকাই পড়ে আছে। বিক্রির কথা ভাবছিল ও। আমি চলেই এলাম। আমিও অনলাইনে একটা ছোটখাটো কাজ করি। চলে যায়।" মিনুর মা এই কিছুদিন আগে মারা গেলেন। ওর বাবার বেলা শ্মশানে গেলেও মায়ের বেলা আর যায় নি দেবু। অফিসে সেদিন ওর শেষ কাজের দিন ছিল। খুব ঝড়বৃষ্টিও হয়েছিল সেদিন। যেতে পারে নি। গেলে সেদিনই মিনুর সঙ্গে দেখা হতো। সে কথা ভেবে আর লাভ কী? মিনু হাঁপিয়ে গিয়েছে দেখে দেবু বলে,"চ, ঐ চায়ের দোকানে বসি। চা খাবো।" চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে মিনু বলে, "তুমি আমার খবর না রাখলে কী হবে- আমি তোমার সব খবর রাখি কিন্তু।" একটু অপ্রস্তুত হয়ে দেবু বলে, "আমার আবার খবর!" মিনু হাসে। বলে, "শুনলাম তুমি এখন ভাইপো- ভাইঝি অন্ত প্রাণ। ওরাও তোমায় খুব ভালবাসে।" দেবু হাসে। এবার রোদ চড়া হচ্ছে। উঠে পড়ে দুজনেই।  

 

   রাতে ভালভাবে ঘুম হল না দেবুর। পুরনো দিনের সব কথা এলোমেলোভাবে মনে পড়তে লাগল। ভোরের ঠিক আগে ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন ঘুম ভাঙল, তখন সূর্যের আলো ঘরে ঢুকে পড়েছে। তড়িঘড়ি উঠে, পোশাক বদলে বাইরে বেরিয়ে হতাশ হল দেবু। আজ বেরিয়ে লাভ নেই। এর আগে একবার টাইফয়েড হয়েছিল। তখন বেশ কয়েকদিন ভোরে হাঁটতে পারে নি ও। আর আজও পারলো না। মিনুর মুখটা মনে পড়ে গেল। আজ দেখা করার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু, কিছু করার নেই। রাতেই প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। আজ ভোরেও তা থামল না। সুতরাং বেরিয়ে লাভ হবে না। পরের দিন ভোরে উঠল দেবু। রাস্তা ভেজা। রাতে নিশ্চয়ই আবার বৃষ্টি হয়েছে। ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে দেবু। চারদিকে তাকিয়েও মিনুকে দেখতে পেল না ও। পরের দিন ভোরবেলাতেও দেখা হল না। কিন্তু, সেদিনই ভোলার ওষুধের দোকানে ওষুধ কিনতে গিয়ে শুনল মিনু খুব অসুস্থ। নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছে। মন খারাপ হয়ে গেল দেবুর। 


  নার্সিংহোমের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ইতস্তত করছিল দেবু। বিকেলের আলোটা ম্লান হয়ে আসছে। একটু পরেই অন্ধকার নামবে। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে যাবে। মন স্থির করে রিসেপশনের সামনে দাঁড়িয়ে মিনুর নাম বলতেই রিসেপশনিস্ট ওর হাতে কার্ড দিয়ে তিনতলায় উঠে যেতে বলল। রুমে ঢুকে দেখল মিনু আধশোয়া হয়ে মোবাইল ফোনে কিছু একটা করছে। ওকে দেখে হাসি ফুটে উঠল মিনুর মুখে। পাশের চেয়ারে বসতে বলল। মিনু বোধহয় ধাক্কাটা সামলে নিয়েছে। হঠাৎই কীরকম আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল দেবু। মিনুর হাতটা চেপে ধরে বলল,"তোকে দেখে আবার আগের মতো লাগছে রে।" মিনুর চোখের কোণে জল। ধরা গলায় বলে, "বুড়ো হয়ে তোমার সাহস বেড়েছে দেখছি!" দেবু বলে,"আমি কী সাহসী! তুইই তো বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিস।" মিনু দেবুর হাতটা ধরে থাকে। তারপর বলে, "আমি খুব একা গো দেবুদা। মেয়ে তো অনেক দূরে। তুমি তো ভাইপো- ভাইঝিদের নিয়ে বেশ আছো। এতক্ষণ মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম। এখনও ও রয়েছে।" দেবুর দিকে ফোনটা বাড়িয়ে বলে,"মেয়ে, তোমার সঙ্গে কথা বলবে।"  স্ক্রিনের মিষ্টি মেয়েটা হাত নাড়ে। বলে,"আমি তোমার কথা অনেক শুনেছি আঙ্কেল। তুমি একটু মাকে দেখো। আর ছোটো হয়ে একটা কথা বলবো?" দেবু মাথা নাড়ে। "তুমিই নাকি 'লাভ ইন দা টাইম অফ কলেরা' মাকে পড়িয়েছিলে। বলেছিলে, বয়স তো একটা সংখ্যামাত্র, আসল কথা মন- তাই না? তোমরা দুজনেই তো একা। একটু বেশী সময় মার কাছে থাকতে পারো না। মা তো আর খুব বেশীদিন..." মেয়েটা কান্নায় ভেঙে পড়েছে। দেবু চমকে যায়। আর খুব বেশীদিন মানে কী? তাহলে কী ডাক্তার বলে দিয়েছে? ও জোরে মিনুর হাত চেপে ধরে। "আমি তোকে যেতে দেব না মিনু।" চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। মিনু ফিসফিস করে বলে,"এই কথা তুমি শেষ পর্যন্ত বলতে পারলে দেবুদা!" মিনুর চোখে জল। কিন্তু, মুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তির হাসি। বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি নেমেছে।