Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

সৃষ্টি সাহিত্য যাপনকোনো ইভেন্টে বা প্রতিযোগিতা নয় শুধু মাত্র পড়ার জন্য আপনাদের দরবারে নিয়ে হাজির হলাম আমার এই গল্পের নৈবেদ্য। ভালো লাগুক বা মন্দ, আপনাদের মূল্যবান মতামত জানার প্রতীক্ষা থাকল।
শিরোনামঃ- প্রবাসী প্রেমকলমেঃ- রজত সর…

 


সৃষ্টি সাহিত্য যাপন

কোনো ইভেন্টে বা প্রতিযোগিতা নয় শুধু মাত্র পড়ার জন্য আপনাদের দরবারে নিয়ে হাজির হলাম আমার এই গল্পের নৈবেদ্য। ভালো লাগুক বা মন্দ, আপনাদের মূল্যবান মতামত জানার প্রতীক্ষা থাকল।


শিরোনামঃ- প্রবাসী প্রেম

কলমেঃ- রজত সরকার

তারিখ ২২/১২/২০২২


বড়ো রাস্তা থেকে নেমে ক্যানেলের পাড় ধরে লাল ধুলোর ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে চলেছে সাদা SUV গাড়িটা। রাস্তার দুধারে তাল আর সোনাঝুড়ি গাছের সারি, ডান দিকে স্বচ্ছ জলের ধারা বয়ে চলেছে ক্যানেল দিয়ে, বাঁদিকে আর ক্যানেলের ওপাড়ে সরষে আর আলুর চাষ। ক্যানেলের পাড় থেকে বাঁদিকে নেমে সরষে খেতের মাঝখানের রাস্তায় কিছুটা যাওয়ার পর শুরু হল ঢালাইয়ের রাস্তা যার ডানদিকে চাষ জমি শেষ হয়ে বেশ খানিকটা ঘাসে ঢাকা পতিত জমি আর ছোট একটা শালবন আর বাঁদিকে কয়েকটা পুকুর আর মঝে মাঝে কিছু কুঁড়ে ঘর খরের ছাউনি দেওয়া। দিগন্ত রেখায় গাছগাছালির মাথায় লাল সূর্য পাটে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে, জমির ওপরে জমাট বেঁধে আছে উনুনের সাদা ধোঁয়া, শেষ ডিসেম্বরের তীব্র শীতে গাড়ির জানলা সব বন্ধই আছে। গ্রামের একটা পুরনো শিব মন্দিরের সামনে গাড়িটা দাঁড়াল, টুবাই বাবা মার সাথে এখানেই গাড়ি থেকে নামল। প্রচন্ড বেগে ঠান্ডা হাওয়া বইছে, মন্দিরের পাশের অশথ্ব গাছে ধাক্কা খাওয়া হাওয়ার শব্দ, পাখিদের বাসায় ফেরার কলতান আর ভুটভুট করে চলা পাম্পের শব্দে চারিদিক মুখরিত। টুবাই নীল জিন্সের ওরক সাদা জ্যাকেটের হুড মাথায় দিয়ে গলার কাছে ফিতেটা বেঁধে চারিদিকটা ভালো করে দেখছে। সেই ক্লাস ফোরে পড়তে এই গ্রাম ছেড়েছিল সে। প্রথমে কার্শিয়াং এর বোর্ডিং স্কুল, তারপর ভুবনেশ্বরে চার বছর, ব্যাঙ্গালুরুতে দুবছর, এখন আমেদাবাদে চাকরী সূত্রে বাস। অন্তত পাঁচ বছর পর নিজের গ্রামের বাড়িতে ফেরা, ছুটিতে যতবার বাড়ি এসেছে তা কলকাতার বাড়িতেই, দাদু ঠাকুমা যতদিন বেঁচে ছিলেন কলকাতাতেই বেশি থাকতেন, বছরে বা দুবছরে এক আধ বার এখানে আসা হত। এখানে থাকেন শুধু টুবাইয়ের কাকু কাকীমা আর বছর তিনেক হল জেঠু জেঠিমা জামসেদপুর থেকে এসে এখানে আছেন, জেঠতুতো দাদা বৌদি জামসেদপুরেই থাকেন, আর আছেন টুবাইয়ের বড়ো ঠাকুমা, কাছাকাছি আশি বছর বয়স তো হবেই, আসলে টুবাইয়ের বড় দাদু ও ঠাকুমা নিঃসন্তান, ছোট ভাইয়ের ছেলে ও নাতি নাতনীদের আপন করেই সারাটা জীবন কাটিয়েছেন। বড় দাদু আজ দশ বছর হল মারা গেছেন, ঠাকুমা নাতি নাতনী অন্তপ্রাণ। টুবাইয়ের খুড়তুত দিদির বিয়ে হয়ে গেছে আজ পাঁচ বছর আগে, তখনই ও এসেছিল এবাড়িতে শেষ, তারপর আজ। টুবাইয়ের ভালো নাম তমোঘ্ন, আর এই শিব মন্দির হল ওদের পারিবারিক। মন্দিরের দাওয়া থেকে টুবাইয়ের মা ওকে ডাকলে সিঁড়ির কাছে স্নিকার খুলে মোজা পড়েই উঠে গেল ওপরে। কাকু কাকীমা আর খুড়তুতো দিদি মন্দিরেই ছিলেন, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মন্দিরে প্রণাম করে এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে। মন্দিরের অনতিদূরেই বেশ বড়ো সাবেকী জমিদার বাড়ি টুবাইদের, প্রথমেই একটা বড়ো গেটের মধ্যে ঢুকে একটা গাড়ী বাড়ান্দার সামনে সিঁড়ি উঠে গেছে উঁচু দাওয়ায়, যার দু দিকে ঘর রয়েছে, ভেতরে বেশ বড়ো বাঁধানো উঠোন, তিন দিকে উঁচু বারান্দা আর দোতলা ঘর পর পর আর সামনে ঠাকুর দালান। উঠোনের চারিদিকে সারি দিয়ে সুপারি গাছ আর ঠাকুর দালানের সিঁড়ির দুপাশে টগর কলকে আর জবার গাছ।

টুবাইকে নিয়ে ওর বাবা মার এখানে আসার দুটো উদ্দেশ্য, এক হল টুবাই নিজের গ্রাম ভালো করে চেনেনা, ওকে গ্রাম, বাড়ি নিজেদের জমি জমা ভালো করে দেখানো আর দুই ওর খুড়তুত ভাই সাগ্নিকের বিয়ের পাকা দেখা। দশ দিনের ছুটি নিয়ে টুবাই বাড়ি এসেছে কিছুদিন বাবা মার সাথে কাটাবে বলে, ফিরে গিয়েই গুরুগ্রামে বদলী, চিঠি এসে গেছে। ঠাকুর দালানের বাঁদিকের ঘরটা হল ওর বড়ো ঠাকুমার। এতো দিন পর টুবাইয়ের সাথে তাঁর দেখা হবে, অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে টুবাই সোজা গেল তাঁর ঘরে। তিনি বিছানায় বসে পান সাজছিলেন, পেছন থেকে তাঁকে জড়িয়ে ধরল টুবাই। নাতিকে আঁকড়ে ধরে অনেক আদর করলেন বড়ো ঠাকুমা, ঠাকুমার গায়ে আর উলের চাদরের দোক্তার গন্ধ, যা ছোটবেলা থেকেই টুবাইয়ের বড় প্রিয়, হীরু ডাকাতের গল্প, ভৈরব কাপালিকের গল্প, হাসি ডাঙ্গালের মাম্দো ভুত আর শাঁকচূন্নির কবলে পড়ে বড়ো দাদু কেমন নাজেহাল হয়েছিলেন তার গল্প শুনতে টুবাইদের সব ভাই বোনের ভীষন ভালো লাগত। শীতের দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর ঠাকুমার লেপের তলায় শুয়ে এক মনে সেইসব গল্প শুনতো সবাই। আজ দাদা দিদিরাও তার মতোই বড়ো হয়ে গেছে বোন দিদিদের বিয়ে হয়ে গেছে, তবুও ঠাকুমার কাছে এসে টুবাই যেন তার শৈশব ফিরে পেল, বিকেল হলেই বাড়ির বাঁধানো চাতালে চলত ওদের ফুটবল খেলা, গ্রামের আরো দু একটা ছেলে আসত সেখানে। ঠাকুমার তৈরি গুড় আম আর কুলের আচার খেতে খুব ভালোবাসতো টুবাই, আর ভালোবাসত ঠাকুমার রান্না করা আলু বড়ি পোস্ত, আমড়ার চাটনী খেতে। সেসব আজ অতীত।

ঠাকুমার ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা তিন তলার ছাদে উঠে ওর প্রিয় কোনটায় গিয়ে দাঁড়াল, যেখান থেকে ক্যানেল পাড়ের রাস্তা, দূরের বড়ো রাস্তা সব কিছু দেখা যায়, শীতের দুপুরে এই ছাদেই ওদের ক্রিকেট খেলা চলত, অনেকটাই বড়ো কড়ি বর্গার ওপর পেটানো ছাদ, রেলিংএর গায়ে শ্যাওলা জমেছিল, এখন শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে গেছে, আঙুল দিয়ে এক জায়গায় শুকনো শ্যাওলা ছাড়াতে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল ওদের ছোট বেলার কয়লা দিয়ে আঁকা তিনটে স্টাম্পের আবছা হয়ে যাওয়া ছবি। পুরো বাড়িটাই আগের মতোই আছে, এখন শুধু প্রত্যেকটা ঘরের সাথে বাইরের দিকের বারান্দায় একটা করে অ্যাটাচড বাথরুম হয়েছে আধুনিক সুবিধা যুক্ত, আগে যা ছিল বাড়ির পেছনে ইঁদারার পাশে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে সূর্য ডোবার ছবি তুলতে তুলতে পেছন ফিরে দেখল ওর দিদিদের গাড়িটা বাড়ির প্রায় কাছে এসে পড়েছে, দিদিরা থাকে আসানসোলের কাছে বার্ণপুর শহরে। নিচে নেমে গেটের কাছে আসতে আসতে জামাইবাবু গাড়ি থেকে নেমে টুবাইকে জড়িয়ে ধরে বলল,

- কি ভাই! সাগ্নিকের পাকা দেখাটাতো হচ্ছে, এবার তোমারটা কবে যাবো বলতো!

- কেন! আমার সুখটা কি সহ্য হচ্ছে না? বেশ তো আছি!

- এ সুখ কি আর সুখরে ভাই! মনের ঘুলঘুলিতে সাধের বুলবুলি উঁকি না মারলে আর কিসের সুখ! নরম কোলে মাথা রেখে তার বুকের স্পন্দন শুনতে শুনতে ভালোবাসার স্বপ্নে হারিয়ে যেতে কিসের মানা ভাই?

- তার জন্য বিয়ে কি করতেই হবে?

- তাই নাকি! সে ব্যবস্থা হয়েছে নাকি?

- তেমন ভাগ্য আর কোথায়!

- আচ্ছা! ঠিক আছে, আমরাই দেখছি কি করতে পারি।

- ছাড়ো ছাড়ো, আমাদের নৈঋত্য বাবু কোথায়?

- ঐতো দেখ মার সাথে সিটের পেছনে কি সব খোঁজাখুজি করছে।

টুবাই গাড়ির গেটটা খুলে বলল,

- কি রে দিদি! গাড়ি থেকে নামতে ইচ্ছে করছে না? দিদি জাহ্নবী খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল,

- দাঁড়া ওর মহামূল্যবান ক্রিকেট ব্যাট খুঁজে পাচ্ছে না! ভাই তুই কি রোগা হয়ে গেছিস রে! শরীর ঠিক আছে তো?

- কি করব বল, আমি তো তোর মতো খাই আর ঘুমোই না যে বেলুনের মতো ফুলব, তুই যেমন ফুলছিস দিন দিন।

- একটা চড় মারব, আমি খাই আর ঘুমোই না? মেয়ে হয়ে জন্মালে বুঝতিস। এই, আমি খুব মোটা হয়ে গেছি নারে?

- না না, ঐ একটু আরকি! গাড়ি থেকে নামবি? কই নিমো বাবু? চলে এসো আমরা দু জন মিলে ডিকি খুলে ব্যাট বের করব।

নৈঋত্যর ডাক নাম নিমো, মামার ডাকে তাড়াতাড়ি সামনে এসে মামাকে জড়িয়ে ধরল সাত বছরেরে মিষ্টি ভাগ্নে নিমো। ততক্ষণে টুবাই আর জাহ্নবীর মা আর কাকীমা খুড়তুতো দিদি সমেত গেটের সামনে এসে পড়েছেন, সকলকে নিয়ে ভেতরে গেলেন। এরই মধ্যে সাগ্নিকও বাড়িতে এসে গেছে, এইবার বাড়ি একেবারে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল, এতো বড়ো উঠোনে নিমোকে ধরে রাখা জাহ্নবীর সাধ্যের বাইরে হয়ে যাচ্ছিল দেখে নিমোর দায়িত্ব নিমোর দিদুনই নিয়ে নিল। ঠাকুর দালানে সন্ধ্যা আরতির পর কাকীমা সকলের জন্য মুড়ি বাদাম ছোলা আর পেঁয়াজ মেখে আনলেন আর সঙ্গে মাছের সিঙ্গাড়া, পাপড়, পেঁয়াজি আর ধনে পাতার বড়া, খেজুর গুড়ের রসগোল্লা আর খেজুর গুড়ের পায়েস। এই কদিন রান্নার জন্য বাড়িতে একজন ঠাকুর রাখা হয়েছে, হাতের রান্নাটি মন্দ নয়! হাড় কাঁপানো শীতে রাতের খাবারে গরম গরম লুচি ফুলকপির ডালনা, বেগুন ভাজা আর কচি পাঠার মাংস, সঙ্গে বাটিতে করে টাটকা খেজুর গুড়, যা টুবাইয়ের খুব পছন্দের।

রাতের খাওয়া দাওয়ার পর জামাই বাবু অনিন্দ্যকে নিয়ে ছাদে গেল। প্রচন্ড ঠান্ডা আজ, রিতি মতো শৈত্য প্রবাহ চলছে, অনিন্দ্য প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা টুবাইকে দিয়ে দুজনে ধরিয়েছে আর জাহ্নবী এসে হাজির। ভাই আর বরের হাতে সিগারেট দেখেই বলল,

- ঠিক ধরেছি, ভাই তোর জামাইবাবু উচ্ছন্নে গেছে যাক তুই অন্তত এগুলো ছাড়!

- ধুর আমি কখনো সখনো খাই, নিমো কি করছে?

- ও মার কাছে ঘুমিয়ে পড়েছে। তোকে একটা কথা বলতে এলাম।

- বল!

- দেখ, সাগ্নিক তোর থেকে দু বছরের ছোট, কাল আমরা চললাম ওর বিয়ের পাকা কথা বলতে, আর তুই বিয়ের কথা বললেই এড়িয়ে যাচ্ছিস। মা খুব রাগ করছে তোর ব্যবহারে, দুঃখও পাচ্ছে, তুই একরম করছিস কেন ভাই! তুই শুধু রাজি হয়ে যা দেখ, আমরা তোর জন্য কতো ভালো মেয়ে দেখব।

- আমি এখন বিয়ে করব না।

- কিন্তু কেন! তোর যদি কাউকে পছন্দ থাকে তো বল, আমি মাকে বলছি।

- তেমন হলে জানাব।

- শোন, আর তিন মাস আমরা অপেক্ষা করব, তার মধ্যে তুই মত দিলে ভাল, নাহলে আমরা যেখানে দেখব তোর বিয়ে সেখানেই হবে এই বলে রাখলাম, আর এই ঠান্ডার মধিযে তোরা যতক্ষণ ইচ্ছে থার আমি বাবা নিচে গেলাম।

পরদিন সকাল থেকেই বাড়িতে তোরজোর শুরু হয়েগেছে, সাগ্নিকের বিয়ের পাকা কথা বলতে যাওয়ার জন্য। টুবাইয়ের বাবা মা, জেঠু, কাকু কাকীমা, খুড়তুতো দিদি আর ওর নিজের দিদি জামাইবাবু যাচ্ছেন, বাড়িতে থাকছে শুধু সাগ্নিক, টুবাই, জেঠিমা আর বড়ো ঠাকুমা। টুবাই বাথরুমে এমন সময় ওর দিদি দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলে গেল, ভাই তোর ফোন আসছে বারবার, বেরিয়ে দেখিস। মটরশুঁটি দিয়ে আলুর দম, লুচি আর খেজুর গুড়ের পায়েস দিয়ে প্রাতরাশ সেরে সকলে দুগ্গা দুগ্গা বলে শুভ কাজে বেরিয়ে পরল। টুবাই ওপরের ঘরে এসে টেবিলে নিজের ফোনটা দেখে খেয়াল পড়ল দিদি বলেছিল কার নাকি ফোন এসেছিল, ফোনের লকটা খুলেই চমকে উঠল, প্রণতির এগারোটা মিসড কল! তাড়াতাড়ি রিং ব্যাক করল, ওপার থেকে উত্তর এল,

- যাক, সময় পেলে তাহলে? চার দিন হল বাড়ি গেছ, একটি বারও মনে পড়লনা আমার কথা?

- সরি সরি সরি, দেখো এসে থেকে একদিনও বাড়িতে থিতু হতে পারিনি, শুধু গাড়িতে গাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখন আমি বাড়ি থেকে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার দূরে দেশের বাড়িতে এসেছি, এখানে ভাইয়ের বিয়ে, সবাই এইমাত্র গেল বিয়ের দিন ঠিক করতে। সবাই মিলে আমাকে ধরেছে ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল, তুই কেন বিয়ে করছিস না। ভীষণ চাপে আছি, কি করব খুঁজে পাচ্ছি না।

- চাপের কি আছে! বিয়ে করে নিলেই পারো!

- খুব না? ইয়ার্কি হচ্ছে? তুমি বললে করে নেবো, তুমি পারমিশন দিচ্ছো?

- তুমি আবার আমার পারমিশনের ধার ধারো নাকি? বাড়ি গিয়েই আমাকে ভুলে যাও!

- আচ্ছা বলো তো তুমি তোমার ভালোবাসাকে কখনো ভুলে থাকতে পারো?

- না পারিনা, কারণ আমি সত্যিকারের ভালোবাসি।

- ও! আমার ভালোবাসা মিথ্যে?

- জানিনা, গত তিন বছরে দেখা হয়েছে পাঁচ বার, যে টুকু যোগাযোগ ফোন আর ভিডিও কলে, তাও যদি নিজে যোগাযোগ না রাখো, ফোন করলে ফোন না ধরো তাহলে কি বলি বলতো?

- প্রণতি প্রণতি আরে এতো অভিমান করো না, দেখো আমি যেখানেই থাকিনা কেন, আমার মনতো তোমার সাথে বাঁধা! শুধু তোমার কাছে আসব বলে গুজরাটের চাকরী ছেড়ে দিল্লী আসছি! এর পর আমাদের রোজ দেখা হবে। এখন খুব সমস্যায় আছি, এই সময়ে তুমি যদি পাশে না থাকো তাহলে আমার কি হবে বলতো!

- আমি তো পাশে থাকতেই চাই, তুমিই তো দূরে দূরে সরে যাও খালি। একদম ভাল্লাগছেনা, একে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা সকাল থেকে বাড়িতে একা আছি, নিজের রান্নাটাও নিজেকে করতে হচ্ছে!

- সেকি! কেন? বাবা মা সবাই কোথায় গেলেন?

- আজ সকালে জরুরী কাজে কলকাতা গেছে, কাল ফিরবে, বিকেলে পিয়া আন্টি এসে আমার সাথে রাতে থাকবে।

- হঠাৎ কি এমন জরুরী কাজ?

- কাল রাতে একটা ফোন এসেছিল, বোধহয় বাবার ব্যবসার কোনো কাজ, মায়েরও সই লাগবে।

প্রায় ঘন্টা খানেক চলল, টুবাই আর প্রণতির ফোনালাপ, স্নান খাওয়া সেরে নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে মনে করছে প্রণতির সাথে আলাপের প্রথম দিনটা। গুজরাটে ও যে কোম্পানীতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজে ঢুকেছে সেখানেই প্রণতি ছিল অ্যাকাউন্টস সেকসনে। ক্যান্টিনে সেদিন টেবিল খালি না থাকায় প্রণতির সাথে টেবিল শেয়ার করেছিল, সেদিনই জানতে পারে ও বাঙালি। প্রণতি মুখার্জী, বাড়ি কলকাতায় হলেও বাবা মা দিল্লীর প্রবাসী, বাবা ওখানে ব্যবসা করেন। এখানে চাকরি পেয়ে এসেছিল আর তিন মাস পর ফিরে যাবে দিল্লী, ওখানকার একটা কোম্পানীতে ইন্টারভিউ দিয়েছে। এর পর প্রায়ই দেখা হত প্রণতি আর টুবাইয়ের, বাঙালী হওয়ার সুবাদে দুজনের ভাব জমে ওঠে, কাজের ফাঁকে দেখা হলেই গল্প হত। এরপর একদিন প্রণতি এখানকার চাকরীটা ছেড়ে দিয়ে দিল্লী চলে গেল, তারপর মাঝে মাঝে কথা হয় টুবাইয়ের সাথে। টুবাইও প্রণতি কে মিস করে আজকাল, পুজোয় বাড়ি আসার সময় দিল্লীতে এক রাত কাটিয়ে তারপর আসত। আর সেই সময়েই দেখা হত ওদের দুজনের। এরকমই এক দিন বিকেলে কি সন্ধ্যার মুখে দুজনে ইন্ডিয়া গেটের কাছে সবুজ ঘাসের গালিচায় বসে বসে গল্প করছে, হঠাৎই প্রণতি ওকে জিজ্ঞাসা করে বসল,

- আচ্ছা একটা কথা কথা বলব?

- হ্যাঁ বলো না!

- তুমি যত বার বাড়ি যাও এখানে থেকে আমার সাথে দেখা কর কেন?

- ভালো লাগে তাই! কেন তোমার কি ইচ্ছে করে না? তেমন হলে আর দেখা করব না।

- না ঠিক তা না, তুমি আসবে বললেই আমিও অফিস থেকে সোজা চলে আসি তোমার সাথে দেখা করতে, কেন?

- তোমার মনে হয় আমার সাথে দেখা করা যায় তাই আসো!

- শুধুই কি তাই? মানে আমি যদি বলি তুমি আমার সাথে আর দেখা করো না, তুমি আসা বন্ধ করে দেবে?

- তুমি বললে তো তা করতেই হবে। আমি তো আর জোর করে তোমার সাথে দেখা করতে পারি না!

- আচ্ছা! তুমি যখন চলে যাও তোমার মন খারাপ করে না?

- উমমম, সেভাবে বুঝিনা, তবে একটা বন্ধুর কাছ থেকে চলে যাওয়ার পর কিছুটা হ্যাংওভার থাকে হয়তো, তোমার?

- ঠিক মন খারাপ কিনা জানিনা, তবে তোমাকে মিস করি মাঝে মাঝে, আর তখনই তোমাকে ফোন করি। আচ্ছা তমোঘ্ন! আমরা কি শুধুই বন্ধু?

- আমিতো তাই মনে করি, তোমার কি আমাকে শত্রু মনে হয় নাকি?

- ধ্যাত! আমি কিন্তু একটু সিরিয়াস কথা বলছি, কেন জানিনা আমার মনে হচ্ছে আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলছি হয়তো।

- Are you serious? প্রণতি একটু লজ্জা মাথানো দৃষ্টিতে বলল,

- তাই তো মনে হচ্ছে।

এই সব ভাবতে ভাবতে টুবাইয়ের চোখে ঘুম এসে গেছে এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল, প্রণতির ফোন,

- কি করছিলে?

- তোমার কথাই ভাবতে ভাবতে একটু ঘুম এসে গেছিল।

- আমিও তো তোমার কথাই ভাবছি, কিন্তু ঘুম আসছে না যে! কি করি বলতো?

- এসো দুজনে মিলে গল্প করি, বলো কি ভাবছিলে?

- ভাবছিলাম কি ভাবে তুমি আমাকে প্রপোজ করেছিলে।

- কি ভাবে?

- মনে আছে সেদিন আমরা ইন্ডিয়া গেটে বসেছিলাম সন্ধ্যা বেলা?

- খুব মনে আছে।

- তারপর তুমি আমাকে বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে হোটেলে ফিরে গেলে, পর দিন ভের পাঁচটা বত্রিশে এয়ারপোর্ট থেকে আমাকে ফোন করে বললে…

- Will you marry me?

- ঠিক তাই। আমি কি উত্তর দেবো ভেবে পাচ্ছিলাম না, আমার দুচোখ ভরে এসেছিল, তুমি বললে….

- কোনো তাড়া নেই, ভেবে উত্তর দিও…

- হ্যাঁ, আর আমি বললাম…

- ভাবার কিছু নেই, আমি প্রস্তুত, আজই মাকে বলব তোমার কথা। তাতে তুমি বললে

- আমার কিছুটা সময় লাগবে প্রণতি, একটা মিনিমাম ফিনান্সিয়াল ব্যালান্স করে বিয়ে করতে চাই। তুমি বললে…

- আমারও কিছুটা ব্যালান্স আছে তমোঘ্ন, দুজন মিলে সংসার ঠিক চালিয়ে নেব। দেখেছো সেদিনের প্রত্যেকটা কথা আমাদের দুজনেরই মনে আছে, তুমি আমার কথাটা বলছ আর আমি তোমারটা।

- হ্যাঁ, ঠিক তাই তমোঘ্ন, তবে এবার আমার মনে হচ্ছে মাকে জানানোর সময় এসে গেছে, অবশ্যই তুমি যদি বলো।

- আমিও তাই ভাবছিলাম প্রণতি, আমি আজই দিদিকে তোমার কথা বলব, আজ সকালে তুমি ষখন ফোন করেছিলে, আমি বাথরুমে ছিলাম, দিদিই কিন্তু বলেছিল আমার ফোন আসছে বার বার, আমি যেন ফোনটা ধরি।

- তোমার ফোন ধরার কথা আর বলোনা, কাল সন্ধ্যাবেলাও ফোন করেছিলাম তুমি ধরার সময় পাওনি।

- এরকম বলোনা প্লীজ! আমি তোমার ফোন কখনো ইগনোর করেছি, বলো? আসলে এখানে এসে থেকে এমন হচ্ছে এবার…

- যে আমাকেই ভুলে যাচ্ছো। যাক, বাবা মা ফিরে এলেই কিন্তু মাকে আমি সব জানাচ্ছি।

- ঠিক আছে, আমিও দিদিকে আজ বলব।

প্রণতি হঠাৎ হেসে উঠল, টুবাই বলল,

- হাসলে কেন! না কিছুনা এমনি।

- এমনি মানে! পাগল নাকি?

- তোমার অনুমতি পেয়ে হয়ে গেছি, রাখি এবার?

- কেন!

- মা ফোন করছে।

- আচ্ছা ঠিক আছে রাখো, সন্ধ্যা বেলায় আমি ফোন করব।

- ধন্যবাদ। রাখলাম।

টুবাই কোল বালিশটা বুকের কাছে টেনে নিয়ে চোখটা বন্ধ করেছে সবে, আর নিমোর গলা শুনতে পেল, বুঝল সবাই সাগ্নিকের বিয়ের দিন ঠিক করে ফিরে এসেছে, দিদির কাছে সব জানতে পারবে ভেবে ও চেখটা বন্ধ করে শুয়ে থাকল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে দরজা খোলার শব্দ শুনে দেখল নিমো ঘরে ঢুকেছে, ও দরজাটা আবার বন্ধ করে মামার খাটে উঠে শুয়ে পড়ল। টুবাই বলল,

- কি খবর নিমো বাবু?

- কিছু না, বাবা মা আর দাদুন গাড়ি করে কোথায় গেল আমি দিদুনের সাথে চলে এলাম।

- কোথায় গেল?

- জানিনা।

- বেশ তুমি আমার সাথে শুয়ে পড়ো।

এটা সেটা বলতে বলতে নিমো মামাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল। টুবাইও এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল আবার, ঘুম ভাঙল দিদির ডাকে, তখন অন্ধকার নেমে গেছে, চোখে মুখে এক রাশ উচ্ছাস নিয়ে টুবাইকে ধাক্কা দিয়ে বলল,

- ভাই এখনো ঘুমোচ্ছিস! শিগগিরি ওঠ! নিচে বাবা এক্ষুনি তোকে বৈঠক খানায় ডাকছে।

- যাচ্ছি যাচ্ছি, আগে কি খবর হল বল!

- ১৭ই জানুয়ারী বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে, তুই আগে শুনে আয় তারপর সব বলছি, আর শোন, এই ট্রাউজার পরে যাসনা, গেস্ট এসেছে একটু ভালো জামা কাপড় পরে আয়, আমি চললাম।

টুবাই বাথরুমে ঢুকে গেল, জাহ্নবী নিমোকে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। টুবাই একটা জিন্স আর জ্যাকেট পড়ে এক তলার বৈঠক খানায় এসে সব দেখে প্রায় ভিমড়ি খেয়ে গেল। দেখল ঘরে বড়ো ঠাকুমা সমেত সবাই উপস্থিত, আর সামনে বসে রয়েছেন প্রণতির বাবা মা। প্রণতির কাছে ওনাদের ছবি দেখেছে, প্রণতির প্রোফাইল পিকচারেও ওর বাবা মার ছবি, তাই চিনতে অসুবিধা হল না। কিন্তু কোনো অঙ্ক মিলছেনা টুবাইয়ের, যে কথা আজ রাত্রে ও দিদিকে সাহস করে বলবে ভেবেছিল সেকথা বড়ির সকলে জেনে গেল, এমনকি প্রণতির বাবা মাও! দু ঘন্টা আগেও প্রণতির সাথে কথা হল সেও তো কিচ্ছুটি বলল না! টুবাইকে বসতে বলে ওর বাবা বললেন,

- অখিলেশ বাবু, এই আমার ছেলে তমোঘ্ন, গুজরাটে একটা কোম্পানীতে ইঞ্জিনিয়ার, দিল্লীতে বদলী হয়ে আসছে, কেন আসছে, আমার মেয়ে না বললে আমি জানতেও পারতাম না, আর সেই কারণে আপনাদের এভাবে তড়িঘড়ি আসতে বলা, বড্ড কষ্ট দিলাম আপনাদের কিছু মনে করবেন না, আমরা যেতেই পারতাম, তবে আপনার মেয়েকে কোথায় বিয়ে দিতে চলেছেন সেটা আপনাদেরও জানা দরকার।

- না না, একি বলছেন, মেয়ে যে অন্তত একটা বাঙালী ছেলেকে পছন্দ করেছে এটাই আমাদের কাছে বড়ো পাওনা, প্রণতি এ বিষয়ে ওর মাকে বা আমাকে কিছুই বলেনি কোনো দিন, কাল রাত্রে আপনি ফোন না করলে আমি জানতেও পারতাম না। মেয়েকে অনেক দিন ধরে বিয়ের কথা বলছি, ও শুধু বলছে আমাকে একটু সময় দাও। মেয়েও জানেনা আমরা এখানে এসেছি, আপনার কাছে শোনার পর ওর কাছে তমোঘ্নর ছবি দেখলাম। ওকে শুধু বলেছি, ছেলেটিকে বাড়িতে আসতে বলো, কাল আমরা জরুরী কাজে কলকাতা যাচ্ছি, এসেই ছেলেকে দেখতে চাই। আর আমরা যতক্ষণ না ফিরে আসছি, আমরা যে সব জানি একথা তুমি ওকে বলবে না।

অখিলেশ বাবুর কথায় সবাই জোর হেসে উঠল, টুবাইয়ের জেঠু বললেন,

- এটা বেশ ভালো করেছেন, ওরা আমাদের ফাঁকি দিল এতো দিন ধরে, আর আমরা এমনি এমনি ছেড়ে দেবো?

ওর জামাইবাবু বললেন,

- বেশ তো ডুবে ডুবে জল খেয়েছ ভায়া, আর বাড়ি শুদ্ধু সবাইকে ঘোল খাইয়েছো। তোমার মা তো ভাব ছিলেন, তুমি বোধ হয় সন্ন্যাস নিয়ে হিমালয়ে যাবে। একটু অসাবধানতার জন্য হাটে হাঁড়িটা ভেঙে গেল। রাতে খাওয়া দাওয়া করে ফোনটা ঘরে রেখে ছাদে না উঠলে কেউ জানতেই পারতাম না। ভাগ্যিস ফোনটা তোমার দিদি ধরে ফেলেছিল! সব জেনে দিদিই প্রণতির থেকে ওর বাবার ফোন নম্বরটা নিয়ে বাবাকে দিয়েছিল আর ওকে দিব্যি দিয়েছিল, প্রণতি যেন এসব তোমাকে না বলে। তারপর তোমার বাবা ওনার সাথে কথা বলার পর অনলাইনে টিকিট কেটে কালই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম আমি তোমার শ্বশুর মশাইকে।

টুবাই রাগে কটমট করে দিদির দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলতে পারল না। ওর দিদি এক কোনে বসে মুচকি মুচকি হাসছে। অখিলেশ বাবু বললেন, দাঁড়ান মেয়েকে একটু সারপ্রাইজ দিই, ও খুব ফাঁকি দিয়েছে আমাদের। এই বলে ফোনে মেয়েকে একটা ভিডিও কল করলেন স্পীকার অন রেখে। ওদিক থেকে প্রণতি ফোনটা ধরে বলল,

- হ্যাঁ বাবা বলো।

- হ্যাঁরে সব ঠিক আছে তো মা? কোনো অসুবিধা হয়নি তো?

- না না, আমি ঠিক আছি, আন্টিও এসে গেছেন, অফিস থেকে ফিরে দুজনে ড্রয়িং রুমে টিভি দেখছিলাম, ফোনটা পেয়ে এখানে এলাম।

- আচ্ছা বেশ, এবার যেটা বলছি ঠান্ডা মাথায় মন দিয়ে শোনো। আমরা এখানে তোমার সম্বন্ধ দেখে তোমার ভালো জায়গায় বিয়ে ঠিক করেছি, তোমার ঐ ছেলেকে আর কিছু বলার দরকার নেই, ওর সাথে তুমি কোনো যোগাযোগ রাখবে না।

ফোনের ওপাশ থেকে আর কোনো শব্দ নেই, গম্ভীর মুখে চুপ করে দাঁড়িয়ে প্রণতি, অখিলেশ বাবুর পাশ থেকে ওনার স্ত্রী বললেন, এই কি যাতা বলছ! মেয়েটা একা আছে বাড়িতে! অখিলেশ বাবু স্ত্রীকে ইশারায় চুপ করিয়ে মেয়েকে বললেন,

- কি হল? চুপ করে আছো যে!

প্রণতি ছলছল চোখে বলল, মা কোথায়?

- মা এখানেই আছে।

- মা কে দাও। অখিলেশ বাবু স্ত্রীর সামনে ফোনটা ধরলে প্রণতি বলল,

- এটা তোমরা কি করলে মা? আমাকে একবারও জিজ্ঞাসাও করলে না! ফোনটা নিজের সামনে এনে অখিলেশ বাবু বললেন,

- তোমাকে কি জিজ্ঞাসা করব? তুমি প্রেম করার সময় আমাদের অনুমতি নিয়েছিলে? তখন বাবা মার মান সম্মানের কথা এক বারও মনে ছিল না?

টুবাই সোফা ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিল, ওর জামাইবাবু ওর হাত ধরে বসিয়ে বলল,

- যাচ্ছো কোথায়! পিকচার আভি বাকি হ্যায়! বসো বসো!

অখিলেশ বাবু বললেন সামনে ছেলের বাবা মা আছেন, ওনারা তোমাকে দেখবেন, তুমিও দেখে নাও সবাইকে। এই বলে টুবাইয়ের বাবার দিকে ফোনটা ফেরালেন, টুবাইয়ের বাবা বললেন, মন খারাপ কোরো না মা, বাবা মা যা করেন সন্তানের ভালোর জন্যই করেন, তাঁরা কখনো সন্তানের অমঙ্গল চান না। প্রণতি কনো কথা না বলে দৃষ্টি নিচের দিকে করে দাড়িয়ে আছে, আর ওর দুচোখ দিয়ে অবিরাম জল ঝরছে। টুবাইয়ের মা ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে বললেন এইতো কতো মিষ্টি দেখতে আমার মাকে! এভাবে কাঁদেনা ছিঃ দেখো আমার ছেলেও দেখতে খুব ভালো, দেখো একবার, তোমার পছন্দ না হয় আমরা এই সম্বন্ধ নিয়ে আর এগবো না, একবার তুমি আমার ছেলেকে দেখো। এই বলে টুবাইয়ের সামনে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললেন একবার তাকাও, দেখো একবার আমার ছেলেকে! প্রণতি চোখ কিছুতেই তোলেনা, শুধু অঝোরে কেঁদে চলেছে, টুবাইয়ের মা বললেন আমি তোমার গুরুজন হই না মা! আমি বলছি একটি বার চোখ তোলো! প্রণতি খুব আস্তে আস্তে ওর চোখ দুটো ওপরে তুলল, বাবার প্রতি অভিমানে, দুঃখে, বেদনায় ওর চোখ লাল হয়ে গেছে, চোখের সামনে টুবাইকে দেখেও যেন বিশ্বাস করতে পাচ্ছেনা, টুবাইয়ের মা বললেন কি হল, দেখ ভালো করে! আমার ছেলেকে পছন্দ হচ্ছে না? জাহ্নবী এসে পেছন থেকে ভাইকে জড়িয়ে ধরেছে, এইবার প্রণতি সামনে টুবাইকে দেখে অবাক হয়ে গেছে! কি করবে বুঝতে পারছেনা, শুধু বড়ো বড়ো চোখ করে টুবাইকে দেখেই চলেছে। মা বললেন, কি হল? পছন্দ হয়নি? তাহলে আমি এই সম্বন্ধ করতে বারণ করে দিচ্ছি মা, তুমি দুঃখ করো না। প্রণতি তাড়াতাড়ি বলল, নানা বারণ করবেন না! বলেই দুহাতে নিজের মুখটা ঢেকে নিল। টুবাইয়ের জামাই বাবু ফোনটা নিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুনের একটা কবিতা উদ্ধৃত করে বলল,

আমরা দুজনে রচনা করেছি

একে অপরের ক্ষতি,

প্রবাসী প্রেমের পাথরে গড়েছি

অন্ধ অমরাবতী।

আর এই কবিতা শুনে এ বাড়ির সবাই উচ্চ স্বরে হেসে উঠলেন।